ইতিহাসের আদি উপাদান ও তার প্রকৃতি

(১.) ইতিহাসের আদি উপাদানের সংজ্ঞা ও শ্রেনী বিভাগ :- 

"ইতিহাসের আদি উপাদান" বলতে "প্রাগৈতিহাসিক যুগ", "প্রায় ঐতিহাসিক যুগ" এবং "ঐতিহাসিক যুগের" ইতিহাস রচনার উপাদানকেই বোঝায়। এই তিনটি যুগকে একত্রে "প্রাচীন যুগ" বলা হয়। এই সমগ্র প্রাচীন যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান গুলোকে ঐতিহাসিকরা দুটি ভাগে ভাগ করেছেন, যথা - 
  • (ক.) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ও 
  • (খ.) সাহিত্যিক উপাদান। 

(ক.) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান :- প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানকে আবার ঐতিহাসিকরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন - লিপি, মুদ্রা, স্থাপত্য ভাষ্কর্য, বিভিন্ন জীবাশ্ম, হাতিয়ার ও মানুষের ব্যবহার্য বিভিন্ন দ্রব্যাদি, মৃৎপাত্র, মৃৎশিল্প ইত্যাদি। 

(খ.) সাহিত্যিক উপাদান :- অন্যদিকে সাহিত্যিক উপাদানকে - দেশীয় সাহিত্য এবং বিদেশীয় সাহিত্য এই দুটি মূল ভাগে ভাগ করা হয়। দেশীয় সাহিত্যকে আবার পুরান, মহাকাব্য, ধর্মীয় সাহিত্য, ইতিহাস, ইত্যাদি নানা উপ বিভাগে বিভক্ত করা হয়। অপরদিকে বিদেশী সাহিত্য বা বৈদেশিক ভ্রমন বৃত্তান্তকে গ্রিক বিবরন, চৈনিক বিবরন, আরবীয় বিবরন ইত্যাদি নানা ভাগে ভাগ করা হয়। 

মাথায় রাখতে হবে, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে একাদশ শ্রেণিতে ইতিহাসের যে নতুন সিলেবাস তৈরি হয়েছে, তাতে ইতিহাসের "Early sources and their Nature" বিষয়টিকে যুক্ত করা হয়েছে। এটির সঠিক বিশ্লেষন এবং উপস্থাপন পূর্বে উল্লেখিত ইতিহাসের উপাদানের শ্রেনী বিন্যাসের মতো হবে না। 
প্রাগৈতিহাসিক, প্রায় ঐতিহাসিক এবং ঐতিহাসিক যুগের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেনি বিন্যাসের নিরিখে ইতিহাস রচনার উপাদান গুলিকে আমাদের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষন ও উপস্থাপন করতে হবে। এই নিরিখে আমরা আমাদের আলোচনাকে এখানে দুটি পার্টে ভাগ করে আলোচনা করবো। যথা - 
  • (১.) প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান ও 
  • (২.) ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান।
ইতিহাসের আদি উপাদান ও তার প্রকৃতি
ইতিহাসের আদি উপাদান ও তার প্রকৃতি 


(২.) প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান :- 

প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার সব উপাদান গুলোই হলো প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। এই সময়কালে কোন লিপির আবিষ্কার হয় নি বা কোন লিপির পাঠোদ্ধারও করা যায় নি। তাইএখানে কোন লিখিত উপাদান নেই। 

প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ধারনা 


মাটি  খুঁড়ে প্রাপ্ত প্রত্ন বা প্রাচীন নথিপত্রকেই সাধারনত "প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান" বলা হয়। "প্রত্ন" শব্দটির অর্থ প্রাচীন এবং "তাত্ত্বিক" শব্দটির অর্থ হলো জ্ঞানী। যে সমস্ত পন্ডিত মাটি খুঁড়ে বিভিন্ন প্রাচীন দ্রব্যাদি সম্পর্কে গবেষনা করে আমাদের ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে জানতে সাহায্য করেন তাদেরকেই সাধারনত "প্রত্নতাত্ত্বিক" বলা হয়ে থাকে। 

ভারতের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক হলেন - স্যার অরেল স্টাইন, ডঃ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দয়ারাম সাহানী, ননীগোপাল মজুমদার, এস আর রাও, জন মার্শাল প্রমুখ। 

ইতিহাসের উপাদান হিসাবে প্রত্নতত্ত্ব যে কত মূল্যবান তার বহু প্রমান ও যুক্তি দেওয়া যায়। যেমন - 

(১.) পৃথিবীর সব দেশেই প্রাক্ ঐতিহাসিক যুগের ইতিবৃত্ত জানার ক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্বই হলো একমাত্র উপায়। 

(২.) আমাদের দেশে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ও সাক্ষ্যের ওপর ভর করেই হরপ্পা সভ্যতার মতো সবথেকে প্রাচীনতম আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। 

(৩.) শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের ইতিহাসে কিছুকাল আগে পর্যন্ত যে সমস্ত ঘটনাকে কাহিনী বা কিংবদন্তি বলে প্রচার করা হতো এখন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কারের ফলে সেগুলি সত্যতা সম্পর্কে জানা হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে মহাভারতে বর্নীত পান্ডব ও কৌরবদের রাজধানী হস্তিনাপুরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের কথা বলা যায়। বাংলায় রঘু ডাকাতের কালি মন্দির এবং রামসেতুর আবিষ্কারের কথাও প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়। 

(৪.) এছাড়া, ভারতে ব্যকট্রিয় গ্রীক রাজাদের কথা, কলিঙ্গরাজ খারবেলের কথা, মহান শাসক হিসাবে অশোকের ধম্মনীতি ও শাসনতান্ত্রিক আদর্শের কথা, সমুদ্রগুপ্তের দিগ্বিজয়ের কথা, এসবই একমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ভিত্তিতেই জানা গেছে। 

বর্তমান কালে Radio - carbon - xiv পরীক্ষা, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানকে ইতিহাস চর্চায় অনেক বেশী উপযোগী ও গ্রহনযোগ্য করে তুলেছে। কারন রেডিও কার্বন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে প্রায় নিখুঁত ভাবে জানা সম্ভব হচ্ছে। 

এইভাবে দেখা যায়, প্রত্নতত্ত্ব ইতিহাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, ইতিহাসের জ্ঞানকে আরোও সমৃদ্ধ করে এবং ঐতিহাসিক সত্যকে প্রকাশ করে। 

(ক.) প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান গুলির শ্রেনি বিভাগ :-

প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান গুলিকে ঐতিহাসিকরা ৫ টি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা -
১. জীবাশ্ম,
২. আদিম মানুষের ব্যবহার্য হাতিয়ার ও অন্যান্য দ্রব্যাদি। 
৩. গুহাচিত্র,
৪. প্রাচীন সমাধি এবং
৫. প্রাচীন নির্মান ও স্থাপত্য ভাষ্কর্যের ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদি।

(খ.) প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের উপাদান গুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় :- 

প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের উপাদান
প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের উপাদান 


জীবাশ্ম :- প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার প্রাথমিক উপাদান হলো জীবাশ্ম। পাললিক শিলার ভাঁজে কোন জীবদেহের প্রস্তরীভূত দেহাবশেষের অংশকেই "জীবাশ্ম" বলা হয়। জীবাশ্ম থেকে প্রাগৈতিহাসিক কালের জীবজন্তু সম্পর্কে যেমন অনেক তথ্য পাওয়া যায়, তেমনি আদিম মানুষের দৈহিক বিবর্তনের ইতিহাসও জানা যায়। 

হাতিয়ার ও অন্যান্য দ্রব্যাদি :- প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ব্যবহৃত আদিম মানুষের বিভিন্ন হাতিয়ার গুলি তাদের জীবন যাত্রার অগ্রগতি ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের দিক গুলি সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। হাতিয়ার ছাড়াও প্রাচীন কালে মানুষের ব্যবহৃত  মাটির পাত্র, মূর্তি, গহনা, শিশুদের জন্য নির্মিত মাটির খেলনা গুলি থেকে সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। 

গুহাচিত্র :- প্রাগৈতিহাসিক কালে আদিম মানুষ যখন যাযাবর ছিলো, তখন কিভাবে তারা শিকার করতো, কোন কোন অস্ত্রের প্রয়োগ করে শিকার করা হতো, সেসময় কোন কোন জীবজন্তুর অস্তিত্ব ছিলো, তাদের আকার আয়তন কেমন ছিলো - ইত্যাদি সম্পর্কে নানা মূল্যবান তথ্য গুহাচিত্র গুলি থেকে জানতে পারা যায়। 

প্রাচীন সমাধি :- মৃত্যুর পর মৃতদেহকে সমাধিস্থ করার প্রথা পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতাতেই দেখা যায়। সমাধির রকমফের ও রীতি নীতি থেকে যে কোন সভ্যতার মানুষদের অতিন্দ্রীয় জগৎ সম্পর্কে ধারনা ও সংস্কারের পরিচয় পাওয়া যায়। অনেক প্রাচীন সভ্যতায় সমাধিকে কেন্দ্র করে বিস্ময়কর সৌধও নির্মান করা হতো। উদাহরন হিসাবে মিশরের পিরামিডের কথা বলা যেতে পারে। এগুলি থেকে ইতিহাসের নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। 

প্রাচীন স্থাপত্য ভাষ্কর্যের ধ্বংসাবশেষ :- প্রাচীন স্থাপত্য ভাষ্কর্যের ধ্বংসাবশেষ থেকে মানুষের শিল্প সংস্কৃতির ইতিহাস সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষের ভিত্তিতেই পুরাতন কোন নগরীর ঐতিহাসিক উপস্থিতির কথা জানা যায়। আমাদের দেশে হরপ্পামেহরগড়ের মতো প্রাচীনতম সভ্যতা গুলি প্রাচীন স্থাপত্যের ওপর ভর করেই আবিষ্কৃত হয়েছে। 

(গ.) প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের উপাদান গুলির প্রকৃতি,বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্বের দিক:- 

প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান গুলির বেশ কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন - 

(১.) এই সময়কালের ইতিহাস রচনার সব উপাদান গুলোই বস্তুগত ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। যেমন - আদিম মানুষের ব্যবহার করা বিভিন্ন দ্রব্যাদি, গুহাচিত্র, সমাধি বা বাড়ি ঘরের ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদি। 

(২.) আমরা আগেই আলোচনা করেছি, প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ লিখতে জানতো না। এই সময় তাই কোন লিখিত উপাদান পাওয়া যায় নি। অন্যদিকে প্রায় ঐতিহাসিক যুগে খুব সামান্য লিখিত উপাদান পাওয়া গেলেও, সেগুলির পাঠোদ্ধার করা যায় নি।

(৩.) প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদানের আরেকটি বিশেষত্বের দিক হলো - এই সময়কালে প্রাপ্ত উপাদানের সংখ্যা খুবই সীমিত। অনেক বস্তুগত উপাদান কালের গ্রাসে নষ্ট হয়ে গেছে বা হারিয়ে গেছে। এমন অনেক উপাদান আছে, যা এখনও অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। ফলতঃ প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগে জীবাশ্ম ও মানুষের ব্যবহার করা হাতিয়ার ছাড়া তেমন কোন ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায় না।

(৪.) প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের প্রত্নতত্ত্বিক উপাদান ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁর প্রাচীনত্ব নিরুপন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আবশ্যিক বিষয়। মাটি খুঁড়ে যা পাওয়া যায়, তার সব কিছুই নির্দিদ্ধায় গ্রহন করা যায় না। উপাদান গ্রহনের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকে তাই যথেষ্ট সতর্কতার অবলম্বন করতে হয়। 

(৫.) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের কাল নির্নয়ের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন - রেডিও কার্বন ডেটিং বা রেডিও কার্বন - ১৪, ডেনড্রোক্রোনোলজি পদ্ধতি,পটাশিয়াম আর্গন পদ্ধতি,থার্মোলুমিনিসেন্স পদ্ধতি, ইউরেনিয়াম থোরিয়াম পদ্ধতি ইত্যাদি। এই সমস্ত পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের প্রাচীনত্ব নিরুপন করা হয় অর্থাৎ পুরাবস্তু ঠিক কতদিনের পুরাতন তা জানার চেষ্টা করা হয় । যদিও এইসব পদ্ধতি দ্বারা প্রত্নবস্তুর একেবারে নিখুঁত কালসীমা জানা সম্ভব না হলেও, অনেকটাই কাছাকাছি সময়কালের প্রমান পাওয়া যাওয়া  যায়। এককথায়, প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের উপাদান গুলির সময়কাল নির্নয় একটি জটিল ও কঠিন কাজ। 

(৬.) প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের প্রত্নতত্ত্বিক উপাদান গুলির আরেকটি বিশেষ দিক হলো, এই সময়কার উপাদান গুলিতে কোন লিখিত ভাষ্য বা কথ্য তথ্য না থাকায়, তা অনেকটাই ভাব ও কাল নিরপেক্ষ। ফলে কাল, যুগ বা সময়কালের পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব থেকে এই পর্যায়ের উপাদান গুলো অনেকটাই মুক্ত। 

*******************************************

(২.) ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান :-

যে সময়ে লিখিত উপাদান পাওয়া গেছে এবং তার পাঠোদ্ধারও করা গেছে, সেই সময়কালের অতীত বৃত্তান্ত ঐতিহাসিক যুগের অন্তর্গত। ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনায় লিখিত উপাদানকে সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান বলে মনে করা হয়। অবশ্য লিখিত উপাদানের বাইরে একাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানও ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। 

মাথায় রাখতে হবে, পৃথিবীর সব দেশেই প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের পর ঐতিহাসিক যুগের আগমন ঘটে। সূচনা লগ্নের ইতিহাসটুকু বাদ দিলে সমগ্র প্রাচীন যুগের ইতিহাসই ঐতিহাসিক পর্বের অন্তর্গত। এই সময়কালের ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ লিখিত ঐতিহাসিক উপাদান গুলো হলো -
১. লিপি,
২. মুদ্রা,
৩. বিভিন্ন সাহিত্যগ্রন্থ,
৪. বিদেশি বিবরন,
৫. সরকারি দলিলপত্র।
 

(ক.) ঐতিহাসিক যুগের উপাদান গুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও ধারনা :- 

ঐতিহাসিক যুগের উপাদান
ঐতিহাসিক যুগের উপাদান 


লিপি :- ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হল লিপি। প্রাচীন মিশরের হায়ারোগ্লিফিক লিপি থেকে সেদেশের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য পাওয়া যায়। তেমনই প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার ইতিহাস রচনায় কিউনিফর্ম লিপি নানা ভাবে সাহায্য করে।

 লিপি থেকে বিভিন্ন রাজার নাম, রাজবংশের পরিচয়, রাজার রাজ্যসীমা, ভাষা ও লিপির বিবর্তন সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। আমাদের দেশ ভারতে অশোকের সময়কাল থেকে বিভিন্ন রাজারা গুহার দেওয়ালে, পাথরের স্তম্ভে বা তাম্র ফলকে অনেক লিপি খোদাই করেছিলেন। এই লিপি গুলি থেকে তাদের রাজত্বকালের অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।

মুদ্রা :- লিপির পরেই ঐতিহাসিক যুগের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিলো মুদ্রা। মুদ্রায় উল্লেখিত সন, তারিখ থেকে যেকোন সময়কালের রাজার রাজত্বকাল সম্পর্কে জানতে পারা যায়। এছাড়া, মুদ্রায় ধাতুর গুনগত মান ও প্রাপ্তির সংখ্যা থেকে যেকোন সময়কালের অর্থনৈতিক উত্থান পতনের দিকটি সম্পর্কে জানা যায়। মুদ্রায় বিভিন্ন ধর্মের দেব দেবীর ছবি থেকে রাজার ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কেও বহু তথ্য পাওয়া যায়। কারিগরি জ্ঞানের দক্ষতার দিকটিও মুদ্রার আকার আয়তন ও নান্দনিক সৌন্দর্যের দিকটি থেকে বুঝে নেওয়া যায়।

ভারতে ৩০ জন ব্যাকট্রীয় গ্রীক রাজার নাম একমাত্র মুদ্রার থেকেই জানা গেছে। এদিক থেকে বিচার করে বলা যায়, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার ভূমিকা ছিলো একমেবাদ্বিতীয়ম্। 

সাহিত্যগ্রন্থ :- প্রাচীন ভারতের মৌলিক কোন ইতিহাস গ্রন্থ পাওয়া যায় নি। তাই এই সময়কালে রচিত বিভিন্ন ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ বিভিন্ন সাহিত্যিক উপাদান গুলি থেকে ইতিহাস রচনার উপাদান সংগ্রহ করা হয়। প্রাচীন ভারতের সাহিত্যিক উপাদান ছিলো বহু ও বৈচিত্র্যময়। যেমন - বেদ, পুরান, মহাকাব্য, জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্য, চরিত সাহিত্য, আঞ্চলিক সাহিত্য, জ্ঞান, বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ। 

সাহিত্যিক উপাদানের তথ্য অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ঐতিহাসিককে ব্যবহার করতে হয়। কারন সাহিত্যের সঙ্গে কল্পনা ও অতিরঞ্জনের একটি যোগ থাকে। সাহিত্য সব সময় নিরপেক্ষও হয় না। তাই অন্যান্য উপাদান বিশেষত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সঙ্গে সাহিত্যিক উপাদানের তথ্য যাচাই করে তবেই ইতিহাস চর্চায় গ্রহন করতে হয়। 

বিদেশী বিবরন :- বিভিন্ন সময়ে ভারতে বা অন্য কোনো দেশে আগত বিদেশী পর্যটকদের বিবরনী গুলিও ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে বিবেচিত হয়। প্রাচীন ভারতে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের কথা তার সঙ্গে আগত একমাত্র গ্রীক ও রোমান পর্যটকদের বিবরনী থেকেই জানা যায়। প্রাচীন ভারতে বহু বৌদ্ধ বিহার ও প্রাচীন নগরের অস্তিত্বের কথা চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙ ও ফা হিয়েনের বিবরনী থেকে জানা যায়। 

দেশে আগত বিদেশীরা সাধারনত দেশীয় ভাষা জানতেন না। তারা যা লিখেছেন, সবই শুনে শুনে। তাদের ব্যাখ্যা ও বর্ননায় অনেক ভুল ও অসঙ্গতি দেখা যায়। তাই ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে বিদেশী বিবরনীকে খুব সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়। 

সরকারি দলিলপত্র :- আধুনিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে সরকারি দলিলপত্র গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়। 

ব্রিটিশ আমলের সরকারি আদেশ, বিজ্ঞপ্তি, সরকারি আধিকারিকদের প্রতিবেদন, গোয়েন্দা ও পুলিশি রিপোর্ট এবং সরকারি চিঠিপত্র গুলি "সরকারি নথিপত্র" নামে পরিচিত। ব্রিটিশ আমলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস রচনায় এই সরকারি নথিপত্র গুলি প্রভূত পরিমানে সাহায্য করে। সরকারি নথিপত্র মহাফেজখানায় সংরক্ষিত থাকে। 

ভারতে মোগল আমল ও ব্রিটিশ আমলের ইতিহাস রচনায় সরকারি দলিলপত্র গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়। 


(৩.) প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদানের সঙ্গে ঐতিহাসিক যুগের উপাদানের পার্থক্য ও তুলনা :-

প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান গুলির সঙ্গে ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান গুলির বেশ কিছু চরিত্রগত পার্থক্য দেখা যায়। যেমন - 

(ক.) লিখিত তথ্য সংক্রান্ত পার্থক্য :- 

প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান গুলোতে কোন লিখিত তথ্য নেই। কিন্তু ঐতিহাসিক যুগের উপাদান গুলিতে সব তথ্যই লিখিত আকারে থাকে।

(খ.) চরিত্রগত পার্থক্য :-

প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান গুলো হলো প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। কিন্তু ঐতিহাসিক যুগের উপাদান গুলো হলো প্রত্নতাত্ত্বিক ও লিখিত

(গ.) সময়কাল নির্নয় সংক্রান্ত পার্থক্য :- 

প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের উপাদান গুলির সঠিক সময়কাল নির্নয় করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি প্রয়োগ করে ঐতিহাসিকরা উপাদান গুলির সঠিক সময়কাল নির্নয় করার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান গুলির কাল নির্নয় পূর্ববর্তী যুগ দুটির ন্যায় দূরুহ ও কঠিন নয়

(ঘ.) উপাদানের প্রাপ্তি সংক্রান্ত পার্থক্য :- 

প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগে ইতিহাস রচনার উপাদান খুব সামান্যই পাওয়া গেছে। কিন্তু তুলনামূলক ভাবে ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া গেছে

(ঙ.) ধারাবাহিক ইতিহাস রচনার প্রশ্নে পার্থক্য :- 

ঐতিহাসিক যুগের উপাদান গুলিতে লিখিত তথ্য বা ভাষ্য থাকায় অতীতের বহু বিশেষ ঘটনার কথা জানতে পারা যায়। লিখিত তথ্য ব্যবহার করে ঐতিহাসিক যুগের ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয়, যা প্রাগৈতিহাসিক বা প্রায় ঐতিহাসিক যুগে কখনোই করা যায় নি।

(চ.) নিরপেক্ষ তথ্য প্রদানের প্রশ্নে পার্থক্য :- 

ঐতিহাসিক যুগের উপাদান গুলি লিখিত আকারে থাকায় এবং বহু পরস্পর বিরোধী উপাদান থাকায় সেগুলি কখনই ভাব ও কাল নিরপেক্ষ নয়। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের উপাদান গুলোতে কোন লিখিত বা কথ্য ভাষ্য নেই। ফলে উপাদান গুলি প্রকৃতিগত দিক থেকে ভাব ও কাল নিরপেক্ষ

(৪.) প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান কেন পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় নি? 

প্রাচীন ভারতে ইতিহাস লিখতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা যে যে সমস্যার সম্মুখীন হন তার মধ্যে প্রধান সমস্যা হলো ঐতিহাসিক উপাদানের স্বপ্লতা

প্রাচীন ভারতে ঐতিহাসিক উপাদান বিশেষ পাওয়া যায় না। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানও পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়েই তাই ঐতিহাসিকদের তথ্য সংগ্রহের জন্য সাহিত্যিক উপাদানের মুখাপেক্ষী হতে হয়। 

প্রাচীন ভারতে হেরোডোটাস বা থুকিডিডিসের মতো কোন ঐতিহাসিকের জন্ম হয় নি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সাহিত্য, ধর্ম ও দর্শন নিয়ে এদেশে ব্যাপক ভাবে চর্চা ও নানা গ্রন্থ রচিত হলেও, কোন মৌলিক ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচিত হয় নি। সমগ্র প্রাচীন যুগ জুড়ে শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ পাওয়া গেছে, তা হলো কলহনের রাজতরঙ্গিনী। 

প্রাচীন ভারতে কোন মৌলিক ইতিহাস গ্রন্থ বা ঐতিহাসিক উপাদান না থাকার পিছুনে অবশ্য ঐতিহাসিকদের পক্ষে অনেক যুক্তি তুলে ধরা হয়। যেমন -

(১.) ভূর্জপত্র, তালপত্র ইত্যাদি নশ্বর বস্তু ছিলো প্রাচীন ভারতে লেখার মুখ্য উপকরন। প্রাচীন অনেক পুঁথি তালপাতায় লেখা হতো। কালের নিয়মে অনেক পুঁথি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভারতে পর্যাপ্ত ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায় না। ভারতের আদ্র ও চরম মনোভাবাপন্ন জলবায়ুর কারনে প্রাচীন ভারতের অনেক গুহাচিত্রের নিদর্শনই অস্পষ্ট ও নষ্ট হয়ে গেছে। 

(২.) ইংরেজ ঐতিহাসিক এ বি কিথের মতে, প্রাচীন ভারতীয়রা ধর্ম ও আধ্যাত্মিক জগৎ নিয়ে এতটাই নিমগ্ন ছিলো যে লৌকিক জগতের সমস্ত ঘটনাকেই তারা মায়া, তুচ্ছ ও নকল বলে মনে করতো। ভারতীয়রা পরলোক ও অদৃষ্টের ওপর বেশি বিশ্বাসী ছিলো। লৌকিক জগৎ সম্পর্কে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিভঙ্গির কারনেই ভারতীয়দের মধ্যে কোন ঐতিহাসিক চেতনার জন্ম হয় নি।

(৩.) অনেকে আবার মনে করেন, প্রাচীন ভারতে বড়ো আকারের কোন বৈদেশিক আক্রমণ ঘটে নি। তাই ভারতীয়দের মধ্যে কোন জাতীয়তাবাদ জাগ্রত হয় নি। জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতীয়রা তাই স্বদেশের ইতিহাস রচনায় অবতীর্ণ হতে পারে নি।

মাথায় রাখতে হবে, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদানের স্বপ্লতা সত্ত্বেও ঐতিহাসিকরা নানা আকর থেকে প্রাচীন যুগের লুপ্ত ইতিহাস পুনরুদ্ধার করেছেন। এইসব আকর গুলির মধ্যে অন্যতম হলো - সাহিত্য ও প্রত্নতত্ত্ব। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান



👉ইতিহাসের উপাদানের বিভিন্ন ভাগ গুলি সম্পর্কে আরোও বিস্তারিত ভাবে জানার জন্য নিন্মলিখিত পেজের লেখা গুলি পড়ে দেখতে পারো। 









Post a Comment (0)
Previous Post Next Post