ফরাসি বিপ্লবের গল্পকথা - পঞ্চম পর্ব

আমাদের ফরাসি বিপ্লবের গল্পকথার এটিই শেষ পর্ব। গত পর্বেই আমরা দেখেছিলাম, ষোড়শ লুই কে গিলোটিনে হত্যা করা হয়েছিলো। রাজার মৃত্যুর পর ফ্রান্সের ভিতরে এবং বাইরে এক বিরাট বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতা দেখা যায়। এই কঠিন এবং নিদারুন দিনগুলি থেকে কিভাবে ফ্রান্স বেরিয়ে এলো, এবং বিপ্লবকে রক্ষা করলো, এটাই আজকে আমাদের গল্পের মূল বিষয়বস্তু।

তাহলে চলো, গল্পের শেষ অংশটুকু শুনে নেওয়া যাক....


ফরাসি বিপ্লবের গল্পকথা - পঞ্চম পর্ব
ফরাসি বিপ্লবের গল্পকথা 


১৭৯৩ খ্রিঃ ২১ জানুয়ারি, ষোড়শ লুইকে গিলোটিনে হত্যা করবার পর জেকোবিন দলের কেউ কেউ ভারি আমোদ করে বলেছিলো, যাক বাবা, আপদটা মরেছে। এবার একটু নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো। 

জিরোন্ডিষ্টরা অবশ্য প্রথম থেকেই রাজার মৃত্যুদন্ডের পক্ষপাতী ছিলো না। গিলোটিনে রাজার ধর থেকে মুন্ডুটা আলাদা হয়ে যাওয়ার পর এদের কারো কারো মনে হয়েছিলো, কাজটা মনে হয় ভালো হলো না। এর ফল ফ্রান্সকে ভুগতে হবে। 

জিরোন্ডিষ্টদের আশঙ্কার যথেষ্ট কারনও ছিলো। দেশে রাজতন্ত্রের সমর্থকদের সংখ্যা তখনও যথেষ্টই ছিলো। তারা যে সহজে এই ঘটনাটা মেনে নেবে না, এই বিষয়ে জিরোন্ডিষ্টরা একরকমের নিশ্চিত ছিলেন। এর থেকেও বড়ো কথা, সারা ইওরোপ জুড়ে রাজার আত্মীয় স্বজন ছড়িয়ে আছে। তারাও এত সহজে রাজার মৃত্যুদন্ডের ব্যাপারটাকে হজম করে নেবে না। 

ষোড়শ লুইয়ের মৃত্যুদন্ডের পর অগ্নিগর্ভ ফ্রান্স 

দু একদিনের মধ্যেই দেখা গেলো, জিরোন্ডিষ্টরা যেরকম ভয়ের আশঙ্কা করেছিলেন, পরিস্থিতি তার থেকে আরো অনেক বেশি খারাপ হয়ে গেলো। ফ্রান্সের ৮৩ টা রাজ্যের মধ্যে ৬০ টাতেই রাজতন্ত্রের সমর্থকরা ভয়ঙ্কর বিদ্রোহ আর দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু করে দিলো। 

এদিকে এই সময়টাতেই আবার গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো দেশে মূল্যবৃদ্ধি এবং খাবারের দাম মারাত্মক ভাবে বাড়তে আরম্ভ করেছিলো। খাদ্যসংকটে অনেকেই খাবার মজুত করে রেখে দিতে চাইলো, এবং এটা থেকে কিছু দিনের মধ্যেই ফ্রান্স মজুতদার, কালোবাজারি আর ফাটকাবাজির স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়ে গেলো। 

খাদ্য সংকটের আতঙ্কে লোকেরা খাদ্য পন্যের চলাচলে বাধা দিতে থাকলো। সকলেই চাইলো, তাদের এলাকার খাদ্য ভান্ডার গুলি যেন গাড়ি করে অন্য কোথাও না নিয়ে যাওয়া হয়। এতে পরিস্থিতি আরোও ঘোরালো এবং খারাপ  হয়ে গেলো। 

ইতিমধ্যেই গ্রাম থেকে দলে দলে ক্ষুধার্ত লোকজন প্যারিসে ভীড় বাড়াতে আরম্ভ করলো। ওখানেও যখন কোন খাবার পাওয়া গেলো না তখন তারাও দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু করে দিলো। 

এই সুযোগে বাইরের দেশগুলো থেকে কয়েকশো গোয়েন্দা ফ্রান্সে ঢুকে পড়লো। খালিপেটে থাকা আর রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে থাকা কিছু লোককে ঘুষ দিয়ে তারা ফ্রান্সের "হাড়ির খবর" নিয়ে নিতে চাইলো। সেই সব খবর থেকে ইওরোপের দেশগুলো সিদ্ধান্ত নিলো, এবার ফ্রান্সকে একটা উচিত শিক্ষা দিতেই হবে, এবং শিক্ষা দেওয়ার জন্য এরথেকে ভালো সময় আর হতে পারে না। 

ফ্রান্স বিরোধী প্রথম শক্তিজোট

১৭৯৩ খ্রিঃ ইংল্যান্ড, অষ্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, স্পেন, পর্তুগাল, সার্ডিনিয়া, নেপলসের মতো দেশগুলো ফ্রান্স বিরোধী শক্তি জোটে ঐক্যবদ্ধ হয়। এরা সম্মিলিত ভাবে ঠিক করলো, ফ্রান্স আক্রমন করে পুরো দেশটাকেই দখল করে নিতে হবে। নাহলে ফ্রান্সের দেখাদেখি আমাদের দেশের লোকগুলোও বিপ্লব শুরু করে দেবে এবং লুইয়ের মতো মুন্ডু কাটতে আরম্ভ করবে। সুতরাং ফ্রান্সকে শুধু শিক্ষা দেবার জন্যই নয়, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করবার জন্যও আক্রমণ করতে হবে। 

সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটাকে ফলপ্রসূ করতে ইওরোপীয় দেশগুলো দেরি করলো না। ওরা ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে দিলো এবং একটু একটু করে প্যারিসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। 

ন্যাশনাল কনভেনশন আর সাপ নেউলের লড়াই 

এদিকে ন্যাশনাল কনভেনশনে দেশের এই পরিস্থিতি দেখে প্রধান দুই দল জিরোন্ডিষ্টজেকোবিনরা খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। আইনসভার এই দুই দলের মধ্যে মোটেই বনিবনা ছিলো না। জিরোন্ডিষ্টদের অনেকে রাজার মৃত্যুদন্ডের বিরোধী ছিলো বলে জেকোবিনরা ওদের একদমই পছন্দ করতো না। অন্যদিকে আবার সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ডের মতো কিছু উগ্র ঘটনার জন্য জিরোন্ডিষ্টরা জেকোবিনদের দায়ি করতো এবং মাঝে মধ্যেই এটা নিয়ে আইনসভায় ওদেরকে চুলকে দিতো। 

আইনসভায় অবশ্য জিরোন্ডিষ্টরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো। এই সময়ে সরকারটা তারাই চালাচ্ছিলো। ন্যাশনাল কনভেনশন গঠিত হওয়ার পর ঠিক করা হয়েছিলো, খুব শীঘ্রই দেশের জন্য আরেকটি নতুন সংবিধান লেখা হবে। আইনসভাতে জিরোন্ডিষ্টরা প্রথমদিকে এই সংবিধান লেখার চেষ্টাও চালিয়েছিলো। কিন্তু জেকোবিনরা বেশ কয়েকটা বাগড়া দেওয়ার পরই ওরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। 

এই সময় জেকোবিনরা সংবিধান লেখার কাজে এগিয়ে এসেছিলো, এবং অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই খস খস করে তারা একটা সংবিধান লিখেও ফেললো। কিন্তু সেই সময় ফ্রান্সের পরিস্থিতি দিনের পর দিন যাচ্ছেতাই হয়ে পড়েছিলো। এই পরিস্থিতিতে দুই দলই সিদ্ধান্ত নিলো, সংবিধান কার্যকর করার উপযুক্ত সময় এখন নয়। আপাতত, কঠোর ভাবে দেশের অরাজক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে এবং বৈদেশিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে হবে। 

এই সময় আইনসভা এবং সরকারের রাশ দুটোই ছিলো জিরোন্ডিষ্টদের হাতে। তারা সেভাবে কিছুতেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারছিলো না। এর ওপর একের পর এক যুদ্ধে যখন ফ্রান্স হেরে যেতে থাকলো, তখন তাদের জনপ্রিয়তা একদম তলানিতে পড়ে গেলো। 

 জেকোবিনদের ক্ষমতা দখল

জেকোবিন দলের প্রধান নেতা রোবসপিয়ার এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে চাইলেন। ইতিমধ্যে প্যারিসে খাবারের সন্ধানে বহু সাঁকুলেৎ আর গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা জড়ো হয়েছিলেন। এদের ওপর জেকোবিনদের খুব ভালো প্রভাব ছিলো। এই সময়টাতে জেকোবিন দলের নেতারা জিরোন্ডিষ্টদের বিরুদ্ধে লোকজনকে খেপাতে আরম্ভ করে। এর দু এক দিনের মধ্যেই উত্তেজিত জনতা আইনসভা ঘেরাও করে জিরোন্ডিষ্টদের গ্রেপ্তারের দাবি জানাতে থাকে। 

এই সুযোগে রোবসপিয়ার ২৯ জন জিরোন্ডিষ্ট সদস্য এবং ২ জন মন্ত্রীকে পদচ্যুত করে আইনসভা থেকে বহিষ্কার করে দিলেন। এই ঘটনার ফলে আইনসভায় জেকোবিনরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেলো এবং সরকার গঠনের রাশ তাদের হাতে চলে গেলো। 

সন্ত্রাসের শাসন

এর কদিন পরেই রোবসপিয়ারের নেতৃত্বে ফ্রান্সে এক কঠোর, কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলো। ১৭৯৩ খ্রিঃ ২ রা জুন থেকে ১৭৯৪ খ্রিঃ ২৭ জুলাই পর্যন্ত এই শাসনব্যবস্থাকে চালানো হয়েছিলো। ফ্রান্সের লোকেদের কেউ কেউ আজও এটাকে ফ্রান্সের ইতিহাসের একটা কালো অধ্যায় বলে উল্লেখ করে থাকেন। কত লোককে যে এই সময়টাতে মেরে ফেলা হয়েছিলো, তার সঠিক কোন হিসাব আজও পাওয়া যায় নি। 

রোবসপিয়ারের হাত ধরে ফ্রান্সে যে নতুন শাসন ব্যবস্থার জন্ম হলো, তাকে আজও লোকজন সন্ত্রাসের শাসনব্যবস্থা বলেই ডাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। রোবসপিয়ারও মনে মনে এমন একটা শাসনব্যবস্থা চেয়েছিলেন, যেখানে লোকেরা ভয়ে শুটিয়ে থাকবে। ভিতু লোকেরা একদমই দাপাদাপি বা বেয়াদপি, কোনটাই করে না। তাদের কাছ থেকে সহজেই আনুগত্য আদায় করা যায়, এবং আরোও অনেক রকমের সুবিধা আছে ভেবেই ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসন কায়েম করা হয়েছিলো। এটি ছাড়া বিকল্প কোন পথের সন্ধান তখনকার নেতারা পান নি। 

সন্ত্রাসের সংগঠন এবং উপকরন

সন্ত্রাসের শাসনকে চালাবার জন্য ঠিক করা হলো, আইনসভার সদস্যদের নিয়ে বেশ ক টি কমিটি গঠন করা হবে, এবং ঐ কমিটি গুলির হাতেই সন্ত্রাসের শাসনের দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হবে। জন নিরাপত্তা সমিতি নামে একটা কমিটি তৈরি করা হলো। এর হাতে নীতি নির্ধারণের মূল দায়িত্ব দেওয়া হলো। এর সাথেই একটা আইন তৈরি করে জানিয়ে দেওয়া হলো, দেশের সব কর্মচারী এবং রাজ্যের শাসকদের এর আদেশ মেনে চলতে হবে। যারা এটি মানবেন না, অথবা বিরোধীতা করবেন, তাদের গিলোটিনে মেরে ফেলা হবে। 

 জন নিরাপত্তা সমিতি ছাড়াও, সাধারণ নিরাপত্তা সমিতি নামে আরও একটা কমিটি গড়ে তোলা হলো। ঠিক করা হলো, এই কমিটির লোকজন দেশের পুলিশ আর আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দিকটা দেখবেন। 

এই সময়টাতে যে সমস্ত লোকেরা খুব দাপাদাপি আর বেয়াদপি করছিলো, তাদের ঠান্ডা করবার জন্য "সন্দেহের আইন" তৈরি করা হলো। এই আইনটির সাহায্যে যে কাউকে সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার করা যেতো। 

সন্দেহের আইনে যাদের ধরে নিয়ে আসা হতো, তাদের বিচার করবার জন্য এই সময় বিপ্লবী বিচারালয় নামে একটা বিশেষ আদালতও তৈরি করা হয়। এই আদালতের অবশ্য একটাই কাজ ছিলো, ধরে নিয়ে আসা লোকগুলো কে দেশদ্রোহী, বিপ্লবের শত্রু বলে দেগে দিয়ে গিলোটিনের জল্লাদদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া।

 সন্ত্রাসের শাসনকালে সন্দেহের আইন, বিপ্লবী বিচারালয়, এবং গিলোটিন এই তিনটাকে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করে কয়েক হাজার মানুষকে মেরে ফেলা হয়। কিছু মানুষকে অবশ্য লয়ার নদীর জলে মেরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো অথবা জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিলো। 

যারাই সরকারের বিরোধীতা করতো, এই সময় তাদের সবাইকেই একরকম পাইকারি ভাবে মেরে ফেলা হয়। এই তালিকায় রাজতন্ত্রী থেকে সাধারন মানুষ, জিরোন্ডিষ্ট দল থেকে জেকোবিন দল সবাই ছিলেন। রানি মেরী এ্যান্টোয়ানেটকেও এই সময় দেশদ্রোহীর অপরাধে গিলোটিনে হত্যা করা হয়। কেউ একজন একটা পরিসংখ্যান দিয়ে বলেছিলেন, এই সময়টাতে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৯৪ জনকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হতো। 

এত বেশি পরিমানে মারামারি এবং কাটাকাটির ফলে দেশে যতটুকু অরাজকতা ছিলো, সব বন্ধ হয়ে গেলো। হাড়হিম করা শশ্মানের স্তব্ধতা আর মুন্ডুচ্ছেদের ভয়াল আর্ত চিৎকার ছাড়া এইসময় আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না। 

সন্ত্রাসের নায়কদের উল্লেখযোগ্য সংস্কার 

সন্ত্রাসের শাসনের নায়কেরা শুধু যে হত্যাকাণ্ডই চালিয়েছিলেন এমনটা নয়। একটা আইন নিয়ে এসে এইসময় দেশের সব অবিবাহিত যুবকদের সেনাবাহিনীতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, যাতে বিদেশী শত্রু রাষ্ট্র গুলোর সঙ্গে যুদ্ধে পেরে ওঠা যায়। এর ফল হাতে নাতে পাওয়া গিয়েছিলো। অল্প সময়ের মধ্যেই ফ্রান্স বিভিন্ন রনাঙ্গনে জয়ী হতে থাকলো। 

এদিকে দেশের ভিতরের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ করবার জন্য জিনিস পত্রের দাম বেঁধে দেওয়া হলো। শ্রমিকদের মজুরি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলো। অভিজাতদের জমি গুলোকে কৃষকদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হলো, সবার জন্য প্রাইমারি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হলো, এবং এইভাবেই রোবসপিয়ারের নেতৃত্বে জেকোবিন দল বিপ্লবের সুফল গুলি তাদের প্রধান সমর্থক নীচু মানুষ গুলোর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলো। 

বিপ্লব যখন তার সন্তানদের খেয়ে ফেলছিলো

সন্ত্রাসের শাসনকালের প্রথমদিকটাতে যে কর্মক্ষমতা দেখা গিয়েছিলো, শেষের দিকটাতে ওটা একদমই দেখা যায় নি। প্রয়োজন ছাড়া কেউ যখন একটা প্রকান্ড গাছের গুড়িকে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যায়, সন্ত্রাসের শাসনকালের শেষের দিকটাকে সেই ভাবেই টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন রোবসপিয়ার। এটা নিয়ে দাঁতো, হিবার্টের মতো সন্ত্রাসের শাসনের নেতারা প্রশ্ন করলে, রোবসপিয়ার তাদেরও গিলোটিনে হত্যা করেন। 

এইসব ঘটনাগুলো দেখে লোকজন বলতে আরম্ভ করেছিলেন, বিপ্লব তার সন্তানদেরই খেয়ে ফেলছে। কারো করো মনে এই সময় বিপ্লব, হত্যা আর রক্তপাত নিয়ে নানা প্রশ্ন আর সন্দেহ দেখা দিতে আরম্ভ করেছিলো। 

মানুষ মারতে মারতে মানুষ অনেকসময় নরপিশাচে পরিনত হয়ে যায়। সে এক রকমের অমানুষিক রুগীতে পরিনত হয়। রাজতন্ত্রী এবং সব বিরোধী কন্ঠস্বর কে মেরে ফেলবার পর রোবসপিয়ার যখন নিজের দলের, নিজের লোকেদেরই গলা কাটতে উদ্যোত হয়েছিলো, তখন অনেক সুস্থ, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের এটাই মনে হয়েছিলো। 

থার্মিদরিয় প্রতিক্রিয়া : স্বেতসন্ত্রাস

সন্ত্রাসের শাসনকালের শেষের দিকটাতে সন্ত্রাস নিয়ে রোবসপিয়ারের বাড়াবাড়ি ন্যাশনাল কনভেনশনের সদস্যরা আর মেনে নিতে পারলেন না। ১৭৯৪ খ্রিঃ ২৬ জুলাই, রোবসপিয়ার সহ অন্যান্য নেতাদের গ্রেপ্তার করা হলো। তারপর কাল বিলম্ব না করে পরের দিনই সবাইকে গিলোটিনে মেরা ফেলা হলো। প্রজাতন্ত্রিক বর্ষপঞ্জী ১০ তরমিদর এই ঘটনা ঘটেছিলো। 

জেকোবিনদের পর পুনরায় জিরোন্ডিষ্টরা শাসন ক্ষমতার রাশ নিজেদের হাতে নিয়ে নিলো। তারপরেই জেকোবিনদের তৈরি করা ভালো মন্দ সব আইন এবং সংস্কার গুলোকে একরকম ছেটে ফেলে যে কয়জন জেকোবিন সমর্থক তখনও সক্রিয় ছিলেন তাদের পরের পর হত্যা করা হতে থাকে। রোবসপিয়ারের লালা সন্ত্রাসের কলঙ্কমোচনের জন্য এই নারকীয় অধ্যায়টির নাম দেওয়া হলো "স্বেত সন্ত্রাস" । এবং 
এইভাবে হত্যার মধ্য দিয়েই "হত্যার শাসনের" অবসান ঘটানো হলো। 

ডাইরেক্টরির শাসনব্যবস্থা

সন্ত্রাসের শাসনকাল শেষ হবার পর ন্যাশনাল কনভেনশন খুব শীঘ্রই আর একটি নতুন সংবিধান তৈরি করে ফেললো। এই নতুন সংবিধান অনুযায়ী আইনসভার পাঁচজন ডায়রেক্টরির হাতে শাসন ক্ষমতার ভার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। ১৭৯৫ থেকে ১৭৯৯ পর্যন্ত এই ডায়রেক্টররাই ফ্রান্স শাসন করেছিলেন বলে এই সময়কালের শাসন ব্যবস্থা ডায়রেক্টরির শাসন নামে পরিচিত হয়েছিলো। 

বুঁরবো রাজা অথবা রোবসপিয়ারের মতো স্বৈরাচারী শাসকের মুখ যাতে ফ্রান্সের লোকেদের ফের দেখতে না হয়, সেইজন্য ডায়রেক্টরির শাসনের সংবিধানটিতে এমন ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো, যাতে কোন ডায়রেক্টরিই দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে যেতে না পারেন। এইজন্য ঠিক করা হয়েছিলো প্রত্যেক বছর একজন করে ডায়রেক্টর অবসর নেবেন এবং নতুন একজন কাজে জয়েন করবেন। 

প্রত্যেক ডায়রেক্টর মন্ত্রী নিয়োগ করে কাজকর্ম চালাবেন। ঐ মন্ত্রীরা অবশ্য তার কাজের জন্য ডায়রেক্টরের কাছেই দায়বদ্ধতা থাকবেন।

ডাইরেক্টরির শাসনের অপদার্থতা

১৭৯৫ সালের সংবিধানটিতে যে ব্যবস্থা করা হয়েছিলো, তাতে আর যাইহোক, স্থিতিশীলতার সঙ্গে কখনই সরকার চালানো যেতো না। বাস্তবে সেটিই ঘটেছিলো। ৫ বছরের ডায়রেক্টরির শাসনে দলাদলি, এক ডায়রেক্টরের সঙ্গে অন্যদের মতভেদ এসব ছাড়া নতুন কিছুই আর দেখা যায় নি। 

এই সময় মুদ্রাস্ফীতি, অরাজকতা, দুর্নীতি, দাঙ্গা হাঙ্গামা, অপশাসনের যতরকমের কুফল আছে সব কটিই দেখে নেওয়ার দুর্ভাগ্য ফ্রান্সের লোকেদের হয়েছিলো। এইসব দেখে অনেকেই ভারি হতাশ হয়ে আক্ষেপের সুরে বলতেন, এত বিপ্লব, রক্তপাত করে কি লাভ হলো? আমরা তো কিছুই পেলাম না। কেউ কেউ দেশের এই দুরবস্থার মধ্যেও স্বপ্ন দেখতেন, এমন একদিন নিশ্চয়ই আসবে, একজন অলৌকিক ক্ষমতাশালী নেতা এসে আমাদের সব দুঃখ কষ্ট দূর করে দেবে। অনাহারে, অর্ধাহারে থাকা সেই মানুষ গুলির স্বপ্ন কিন্তু মিথ্যা হয়ে যায় নি। 

ডাইরেক্টরির নায়কেরা দেশের বর্তমান অবস্থা থেকে মানুষের মন ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য উগ্র পররাষ্ট্র নীতি এবং যুদ্ধনীতির আশ্রয় নিলেন। পাঁক থেকে যেমন পদ্ম ফুটে ওঠে, শুয়োপোকার গুটি থেকে যেমন প্রজাপতি বেরিয়ে আসে, ঠিক তেমনি ভাবে ডায়রেক্টরিদের রনাঙ্গন থেকে ফ্রান্সের লোকেরা তাদের বহু প্রতিক্ষীত স্বপ্নের নায়ককে উঠে আসতে দেখেছিলেন। সে গল্প অবশ্য অন্য। নেপোলিয়ন দ্য গ্রেটের গল্প...। 


সমাপ্ত 





 
 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post