প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান : সংক্ষিপ্ত তথ্য
(ক.) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের অর্থ, সংজ্ঞা ও শ্রেনীবিভাগ:-
(১.) যে কোন দেশের প্রাচীন যুগের ইতিহাস রচনার অপরিহার্য উপাদান হলো - প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান।
(২.) মাটি খুঁড়ে প্রাপ্ত প্রত্ন বা প্রাচীন নথিপত্র বা দ্রব্যাদিকেই সাধারনত "প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান" বলা হয়।
(৩.) "প্রত্ন" শব্দটির অর্থ প্রাচীন এবং "তাত্ত্বিক" শব্দটির অর্থ হলো জ্ঞানী। যে সমস্ত পন্ডিত মাটি খুঁড়ে বিভিন্ন প্রাচীন দ্রব্যাদি সম্পর্কে গবেষনা করে আমাদের ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে জানতে সাহায্য করেন তাদেরকেই সাধারনত "প্রত্নতাত্ত্বিক" বলা হয়ে থাকে।
(৪.) ইতিহাস রচনার প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান গুলিকে প্রকৃতি ও চরিত্র অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন -
- জীবাশ্ম,
- মানুষের ব্যবহৃত হাতিয়ার, মৃৎপাত্র ও অন্যান্য দ্রব্যাদি,
- নরকঙ্কাল
- প্রাচীন গুহাচিত্র,
- লিপি,
- মুদ্রা,
- প্রাচীন স্থাপত্য ভাষ্কর্য ও সমাধি।
(খ.) ভারতে প্রত্নতত্ত্বের চর্চা:-
(১.) ১৭৮৪ খ্রিঃ স্যার উইলিয়াম জোন্সের উদ্যোগে প্রাচ্য বদ্যা চর্চার জন্য"এশিয়াটি সোসাইটি" প্রতিষ্ঠা হলে ভারতে প্রত্নতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ উৎসাহ ও উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়।
(২.) ড. বুকানন হ্যামিলটন ভারতে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষনার প্রথম পথপ্রদর্শক ছিলেন। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে তিনি বাংলা, আসাম ও কর্নাটকে প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা চালিয়ে বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন আবিষ্কার করেন।
(৩.) ১৮২৯ - ১৮৪৭ পর্যন্ত ভারতের ঐতিহাসিক স্থাপত্য কীর্তি গুলি নিয়ে সমীক্ষা ও অনুসন্ধান করেন প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ জেমস ফার্গুনসন।
(৪.) ১৮৩৭ খ্রিঃ কলকাতা টাকশালের কর্মী ও এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের সম্পাদক জেমস প্রিন্সেপ সর্বপ্রথম ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা অশোকের লেখ গুলি পাঠোদ্ধার করেন। এর ফলে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
(৫.) পরবর্তীকালে ভারতে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের জন্য "সুনির্দিষ্ট নীতি" ও "প্রতিষ্ঠানের" প্রয়োজনীয়তা থেকেই ১৮৬১ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয় "আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া" বা "ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ"।
(৬.) প্রত্নতত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য আলেকজান্ডার কানিংহামকে" ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের জনক" বলা হয়।
(৭.) ১৮৬১ খ্রিঃ স্যার আলেকজান্ডার কানিংহামের পরামর্শে ভারতের ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং "আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া" বা ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রথম মহানির্দেশক ছিলেন আলেকজান্ডার কানিংহাম। তিনি তক্ষশিলা, ভারহুত, সাঁচী, বুদ্ধগয়াতে খননকার্য করে বহু অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার করেন।
(৮.) বড়োলাট লর্ড কার্জন ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে নতুন করে পুনর্গঠিত করেন। তিনি ১৯০৩ খ্রিঃ ভারতে "কেন্দ্রীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ" প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর প্রথম অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন প্রত্নতত্ত্ববিদ জন মার্শাল।
(৯.) জন মার্শাল মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা, তক্ষশিলা অঞ্চলে খননকার্য পরিচালনা করেন। পরবর্তীকালে প্রত্নতত্ত্ববিদ দয়ারাম সাহনী ১৯২১ খ্রিঃ পাঞ্জাবে মন্টেগোমারি জেলায় হরপ্পা এবং প্রায় একই সময়ে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধু প্রদেশে লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদাড়ো নগরীর আবিষ্কার করেন।
(১০.) ভারতের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক হলেন -
- স্যার অরেল স্টাইন,
- ডঃ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়,
- দয়ারাম সাহানী,
- ননীগোপাল মজুমদার,
- এস আর রাও,
- জন মার্শাল,
- আলেকজান্ডার কানিংহাম
- ডি বি স্পুনার প্রমুখ।
(গ.) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের কাল নির্নয় পদ্ধতি :-
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের কাল নির্নয়ের উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি গুলি হল :-
(১.) রেডিও কার্বন - ১৪ পদ্ধতি :-
এর আবিষ্কর্তা ছিলেন উইলার্ড ফ্রাংক লিবি। যেকোন প্রানীর হাড় বা প্রাচীন কাঠের ওপর কার্বন গ্রহন ও বর্জনের অনুপাত পর্যবেক্ষণ করে এই পদ্ধতিতে প্রত্নবস্তুর সময়কাল ও প্রাচীনত্ব নিরুপন করা হয়।
(২.) ডেনড্রক্রনলজি পদ্ধতি :-
এর আবিষ্কর্তা ছিলেন অ্যান্ড্রু এলিকট ডগলাস। কয়লা বা কাঠের অঙ্গারের প্রাচীনত্ব নিরুপন এই পদ্ধতিতে করা হয়।
(৩.) পটাশিয়াম আর্গন পদ্ধতি :-
এই পদ্ধতিতে পাথরের মধ্যে থাকা পটাশিয়াম ও আর্গনের অনুপাত নির্নয় করে যেকোন প্রাচীন পাথর বা শিলাখন্ডের সময়কাল নির্নয় করা হয়।
(৪.) থার্মোলুমিনিসেন্স পদ্ধতি :-
মাটির তৈরি কোন পাত্র কতদিনের পুরাতন, তা নির্নয়ের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
(৫.) ইউরেনিয়াম থোরিয়াম পদ্ধতি :-
সাড়ে তিন লক্ষ বৎসর বা তার অধিক সময়কালের কোন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের প্রাচীনত্ব নিরুপনের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।
(ঘ.) ইতিহাসের উপাদান হিসাবে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান কতখানি গুরুত্বপূর্ণ?
ইতিহাসের উপাদান হিসাবে প্রত্নতত্ত্ব যে কত মূল্যবান তার বহু প্রমান দেওয়া যায়। যেমন -
(১.) প্রাক্ ঐতিহাসিক যুগে কোন লিখিত উপাদান ছিলো না। তাই এই সময়কালের ইতিবৃত্ত জানার ক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্বই হলো একমাত্র উপায়।
(২.) আমাদের দেশে প্রত্নতত্ত্বের ওপর ভর করেই হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কার হয়েছে। প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার পুরো ইতিহাসটাই রচিত হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ওপর ভর করে।
(৩.) শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের ইতিহাসে কিছুকাল আগে পর্যন্ত যে সমস্ত ঘটনাকে কাহিনী বা কিংবদন্তি বলে মনে করা হতো এখন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কারের ফলে সেগুলি যে সত্য তা প্রমানিত হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে মহাভারতে বর্নীত পান্ডব ও কৌরবদের রাজধানী হস্তিনাপুরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের কথা বলা যায়।
(৪.) ভারতে ব্যকট্রিয় গ্রীক রাজাদের কথা, কলিঙ্গরাজ খারবেলের কথা, মহান শাসক হিসাবে অশোকের ধম্মনীতি ও শাসনতান্ত্রিক আদর্শের কথা, এসবই একমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ভিত্তিতেই জানা গেছে। এগুলি ছাড়াও,
(৫.) পাটলিপুত্রের কুমরাহার গ্রামে প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. বি স্পুনার মৌর্য রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে, ৮৪ স্তম্ভ যুক্ত এক বিশাল দরবার কক্ষ। এছাড়া,
(৬.) তক্ষশিলা, সারনাথ, রাজগীর, পাটলিপুত্র প্রভৃতি স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে প্রাচীন ভারতে নগরায়নের ইতিহাস জানা সম্ভব হয়েছে।
(৭.) ১৯১৭ খ্রিঃ ডি বি স্পুনার নালন্দায় খনন কার্য করে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যের নিদর্শন আবিষ্কার করেন। এই ভাবে প্রত্নতত্ত্ব ইতিহাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। সাহিত্যিক বা লিখিত উপাদানে বর্নীত কোন নগর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজধানী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের চাক্ষুষ ও জীবন্ত প্রমান একমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান থেকেই পাওয়া যায়।
মক টেস্ট
মক টেস্ট দেওয়ার জন্য নিন্মলিখিত প্রশ্ন গুলির উত্তর দাও :-