ইতিহাসের উপাদান :হাতিয়ার

ইতিহাসের উপাদান : হাতিয়ার
ইতিহাসের উপাদান : হাতিয়ার 


(ক.) ইতিহাসের উপাদান - "হাতিয়ার" সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও পরিচয় :- 

(১.) প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হলো আদিম মানুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন "হাতিয়ার"। 

(২.) প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষের চিন্তা ভাবনার অগ্রগতি ও জীবন চর্চার পরিবর্তনের কথা হাতিয়ার গুলির বিবর্তন থেকে ধারনা লাভ করা যায়। 

(৩.) সময় ও যুগের হাত ধরে মানুষের হাতিয়ার তৈরি ও ব্যবহারের কৌশলে নানা বদল ঘটে । যেমন - 

  • প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ পাথরের বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করতো। 
  • প্রায় ঐতিহাসিক যুগে পাথরের পাশাপাশি ধাতু বিশেষত তামা ও ব্রোঞ্জের বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করতো এবং 
  • ঐতিহাসিক যুগে লোহার তৈরি বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করতো।

(৩.) প্রাগৈতিহাসিক যুগের হাতিয়ার গুলি বেশিরভাগই পাওয়া গেছে প্রাচীন গুহার মধ্যে বা নদী তীরবর্তী এলাকায়

(খ.) হাতিয়ারের প্রাচীনত্ব নিরূপন পদ্ধতি : - 

(১.) প্রাগৈতিহাসিক ও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের পাথরের তৈরি হাতিয়ার গুলির প্রাচীনত্ব নিরুপনের জন্য "পটাশিয়াম আর্গন পদ্ধতি" ব্যবহার করা হয়। 

(২.) এই পদ্ধতিতে একটি পাথরের মধ্যে থাকা পটাশিয়াম ও আর্গনের অনুপাতের উপর ভিত্তি করে পাথরের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়। 

(গ.) প্রাচীন প্রস্তর যুগের হাতিয়ার :-

(১.) প্রাচীন প্রস্তর যুগে আদিম মানুষের হাতিয়ার গুলি ছিলো পাথরের তৈরি। বড়ো একখন্ড পাথরকে তারা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতো। পাথরের অস্ত্র গুলি ছিলো - অমসৃন ও ভারী

(২.) কোয়ার্টজাইট (Quartizite), ব্যাসাল্ট ও গ্রানাইট জাতীয় শক্ত পাথর দিয়ে এই সময়ের অস্ত্র গুলি তৈরি করা হতো। তবে এই যুগের শেষ দিকে অস্ত্র তৈরি করার ক্ষেত্রে মসৃন পাথরের ব্যবহার শুরু হয়। 

(৩.) প্রাচীন প্রস্তর যুগের প্রথম পর্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র ছিলো - "হাত কুঠার"।

(৪.) "হাত কুঠার" ছিলো মানুষের তৈরি প্রথম প্রকৃত হাতিয়ার।

 (৫.) আফ্রিকার ওল্ডুয়ান সংস্কৃতিকালের মানুষেরা প্রথম হাতকুঠার বানাতে শিখেছিলো।

(৬.) হাতকুঠার দু দিকেই ধরা যেতো। সাধারনত কোন কিছু কাটার ক্ষেত্রে হাতকুঠারের ব্যবহার করা হতো।

(৭.) হাত কুঠার ছাড়া প্রাচীন প্রস্তর যুগের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র গুলি ছিল - 

  • বাটালি, 
  • কাটারি, 
  • শাবল, 
  • ধারালো ছুরি, 
  • ঘষবার যন্ত্র, 
  • বর্শা, 
  • তিরের ফলা, 
  • পাথর ফুটো করার যন্ত্র, এবং 
  • হারপুন

(ঘ.) প্রাচীন প্রস্তর যুগে হাতিয়ারের আবিষ্কার ও বিবর্তন :- 


প্রাচীন প্রস্তর যুগের বিভিন্ন পর্বের হাতিয়ার
প্রাচীন প্রস্তর যুগের বিভিন্ন পর্বের হাতিয়ার 

নিন্ম বা আদি প্রাচীন প্রস্তর যুগ :- 

  • চপার - চপার সাধারনত গোল পাথর ছিলো, যার একদিকটা অমসৃন ছিলো। গর্ত খোঁড়ার কাজে বা পশুর চামড়া ছাড়াতে এই অস্ত্রের ব্যবহার করা হতো। 
  • হাতকুঠার - হাত কুঠার ছিলো একদিক ছুঁচালো ও অন্যদিকে ভোঁতা পাথরের অস্ত্র। মাংস কাটার ক্ষেত্রে এর ব্যবহার করা হতো। 
মধ্য প্রাচীন প্রস্তর যুগ :- 
  • ছুরি :- সূক্ষ্ম ও ধারালো পাথরের ছুরি সাধারনত শিকারের কাজে ব্যবহার করা হতো। 
  • রেদাঁ :- শিকার করা পশুর লোম তুলতে এবং ছুরিকে ধারালো করতে এর ব্যবহার করা হতো। 
উচ্চ প্রাচীন প্রস্তর যুগ :- 
  • হারপুন - মাছ শিকার করার জন্য হাড় দিয়ে এটি তৈরি করা হতো। এর মুখটি ছুঁচালো ছিলো।
  • সূচ :- চামড়া সেলাই করার জন্য ব্যবহার করা হতো। 
  • ছিদ্রক :- চামড়া ছিদ্র করার জন্য ব্যবহার করা হতো। 
  • জ্যাভলিন বা বল্লম :- ছুড়ে শিকার করার জন্য ব্যবহার করা হতো। 

(ঙ.) মধ্য প্রস্তর যুগের হাতিয়ার :- 

(১.) মধ্য প্রস্তর যুগের হাতিয়ার গুলি ছিলো ক্ষুদ্র ও মসৃনহাতিয়ার গুলির দৈর্ঘ্য ছিলো ১ থেকে ৩ সেন্টিমিটার। সেইজন্য মধ্য প্রস্তর যুগকে "মাইক্রোলিথিক" বা "ক্ষুদ্র প্রস্তর যুগ" বলা হয়।

(২.) মধ্য প্রস্তর যুগে মানুষের জীবিকা ছিলো শিকার করা, মাছ ধরা, খাদ্য সংগ্রহ করা এবং এ যুগের শেষের দিকে কৃষি ও পশুপালন করা। এই জীবিকা বা প্রয়োজনীয়তার দিকে তাকিয়ে এই সময়ের অস্ত্র গুলি তৈরি করা হতো। 

(৩.) মধ্য প্রস্তর যুগে হাত কুঠার ও কোপানির অস্ত্র গুলির ব্যবহার কমে যায়। এর বদলে তীক্ষ্ণ শলা ও ব্লেড বা কাটারি জাতীয় অস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যায়। 

(৪.) এই সময়ের অস্ত্র গুলি কোয়ার্টজ, ট্যালসেদনি, চার্ট পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছিলো। এগুলি ছাড়া অ্যাগেট, কর্নেলিয়ান ও গার্নেট পাথরের ব্যবহারও দেখা যায়। 

(৫.) এই সময়ের উল্লেখযোগ্য অস্ত্র গুলি হলো - 
  • বাটালি, 
  • চাঁচনি, 
  • ব্লেড, 
  • তুরপুন
  • পাথরের জাঁতা, 
  • হামানদিস্তা, 
  • ক্ষুদ্র ছেদক, 
  • হারপুন
  • তির ধনুক
  • ম্যাটক কোদাল। 
(৬.) মধ্য প্রস্তর যুগে মাটি খুঁড়ে খাবার যোগ্য মূল বের করার জন্য হরিনের শিং এর গোড়ার খুলি কেটে তারা "ম্যাটক কোদাল" বানাতো। এছাড়া ইওরোপের সর্বত্র এই সময় প্রচুর "হারপুনের" ব্যবহার করা হয়। হারপুন হাড় দিয়ে বানানো মাছ ধরার হাতিয়ার ছিলো। এযুগে তির ধনুক ব্যবহারের কথা অবশ্য গুহাচিত্র থেকে জানা গেছে। 

(চ.) প্রাচীন প্রস্তর যুগের সঙ্গে মধ্য প্রস্তর যুগের হাতিয়ারের পার্থক্য :- 

  1. প্রাচীন প্রস্তর যুগ থেকে মধ্য প্রস্তর যুগে অস্ত্রের সংখ্যা ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছিলো। 
  2. প্রাচীন প্রস্তর যুগের অস্ত্র গুলি ছিলো ভারী, ভোঁতা ও অমসৃন। কিন্তু মধ্য প্রস্তর যুগের অস্ত্র গুলি ছিলো অনেক হালকা, ছোটো ও মসৃন। 
  3. প্রাচীন প্রস্তর যুগের অস্ত্র গুলিতে হাতল ছিলো না। কিন্তু মধ্য প্রস্তর যুগের অস্ত্র গুলিতে পৃথক হাতল লাগানোর বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। 
  4. এছাড়া, মধ্য প্রস্তর যুগের অস্ত্র নির্মানে হাড়ের ব্যবহার দেখা যায়, যা প্রাচীন প্রস্তর যুগের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় নি। 

(ছ.) নব্য প্রস্তর যুগের হাতিয়ার :- 

(১.) নব্য প্রস্তর যুগের হাতিয়ার গুলি বেশিরভাগই তৈরি হতো বেলেপাথর বা কোয়ার্টজ পাথর থেকে। 

(২.) এই সময়ের হাতিয়ার গুলি মধ্য প্রস্তর যুগ থেকেও ছিলো অনেক উন্নত, হালকা, তীক্ষ্ণ, ধারালো ও মসৃন। 

(৩.) এই সময়ের উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার গুলি ছিলো - 
  • কাস্তে, 
  • হামানদিস্তা, 
  • জাঁতা, 
  • শিলনোড়া, 
  • বাটালি, 
  • হাতুড়ি, 
  • তির ধনুক, 
  • হারপুন
  • গাঁইতি, 
  • হাড়ের সূচ
(৪.) নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ কৃষিকাজ করায় পশুর শিং থেকে তৈরি কাস্তে, হামান দিস্তা ইত্যাদি হাতিয়ারের ব্যবহার বেড়েছিলো। অন্যদিকে শিকারের প্রবনতা কমায় বেশ কিছু শিকার করা হাতিয়ার তার গুরুত্ব হারাতে শুরু করেছিলো। 

(জ.) তাম্র প্রস্তর যুগের হাতিয়ার :- 

(১.) নব্য প্রস্তর যুগের শেষ দিকে মানুষ তামার তৈরি হাতিয়ার ব্যবহার করে। 

(২.) পরে তামার সঙ্গে টিন মিশিয়ে ব্রোঞ্জ ধাতু দিয়ে অপেক্ষাকৃত শক্ত ও মজবুত অস্ত্র তৈরি করে। 

(৩.) এ যুগের উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার গুলি ছিলো - 
  • হাতুড়ি, 
  • বাটালি, 
  • কাস্তে
  • তুরপুন
  • রেঁদা
  • বর্শা, 
  • লাঙল। 

(ঝ.) লৌহ যুগের হাতিয়ার :- 

(১.) তাম্র প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির পর পৃথিবীতে লৌহ যুগের সংস্কৃতি আসে। 

(২.) পৃথিবীতে তামা ও লোহা দুটো ধাতুই প্রথম ব্যবহার শুরু করেছিলো সুমেরীয় সভ্যতার লোকেরা। 

(৩.) লোহা দিয়ে আরোও উন্নত, ভারী অস্ত্র তৈরি হয়। এছাড়া বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্রও তৈরি হয়। 

(৪.) লোহার অস্ত্র এই সময় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে সুদূরপ্রসারী বিপ্লব নিয়ে আসে। লোহার হাতিয়ারের সাহায্যে বনাঞ্চল সাফ করে যেমন কৃষিক্ষেত্রের প্রসার ঘটে, ঠিক তেমনি লোহার হাতিয়ারে "রাজশক্তি" বলবান হয়ে বড়ো বড়ো সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে। 

(ঞ.) হাতিয়ারকে কেন ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়? 

(১.) প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষ ছিলো যাযাবর। এই সময় মানুষ কোন উৎপাদন করতে পারতো না। প্রকৃতির কোল থেকে পাওয়া পাথরের হাতিয়ার গুলি ছিলো তাদের একমাত্র সম্পদ। এগুলি দিয়ে তারা শিকার করতো, হিংস্র পশুর আক্রমন থেকে আত্মরক্ষা করতো। এমনকি খাদ্য গ্রহণের সময়েও অর্থাৎ মাংস কাটার কাজে এই হাতিয়ার গুলিকে তারা ব্যবহার করতো। মানুষের ব্যবহৃত দ্রব্যাদিকেই ইতিহাস রচনার আকর বলা হয়। এই দিক থেকে হাতিয়ার গুলিও ছিলো প্রাগৈতিহাসিক কালের ইতিহাস রচনার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ আকর।

(২.) আদিম মানুষের তৈরি হাতিয়ার গুলি এমন এক ঐতিহাসিক উপাদান ছিলো, যা সে সময়ের মানুষের আর্থ - সামাজিক বিবর্তন ও জীবন ধারন পদ্ধতি সম্পর্কে একটা ঐতিহাসিক ধারনা ও পরিচয়ের আভাস দেয়। এত বিস্তৃত ধারনার আভাস আর অন্য কোন উপাদান থেকে পাওয়া যায় না। 

(৩.) মাথায় রাখতে হবে, সব যুগেই চাহিদা ও প্রয়োজনের দিকে তাকিয়েই মানুষ হাতিয়ার তৈরি করে। হাতিয়ারের গঠন বিন্যাস ও তার প্রয়োগের দিকটির মধ্যে সমকালীন সময়ের অদৃশ্য পরিবর্তনের ধারা ও ধারনা গুলি ধরা থাকে

 উদাহরন হিসাবে বলা যায়, মধ্য প্রস্তর যুগে প্রচুর "হারপুন" পাওয়া গেছে। হারপুন অস্ত্রটি মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করা হতো। মধ্য প্রস্তর যুগে বিপুল পরিমান হারপুনের প্রাপ্তি থেকে বুঝে নেওয়া যায়, মধ্য প্রস্তর যুগ থেকেই আদিম মানুষের জীবনে নদী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করেছিলো। 

আবার নব্য প্রস্তর যুগে পশুর শিংয়ের অসংখ্য ধারালো কাস্তে পাওয়া গেছে। এই কাস্তে গুলো ফসল কাটার কাজে ব্যবহার করা হতো। নব্য প্রস্তর যুগে আদিম মানুষ যে উৎপাদন ও কৃষিকাজের জীবনে প্রবেশ করেছিলো, তার সাক্ষ্য দেয় এই সময়ের প্রাপ্ত অস্ত্র বা হাতিয়ার গুলি। এইভাবে হাতিয়ার মানুষের চিন্তা ভাবনার অগ্রগতি ও জীবন চর্চার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের দিক গুলি জানতে সাহায্য করে। 

(৩.) এই পরিবর্তন গুলি ছাড়াও, হাতিয়ারের গঠন বৈচিত্র্য, তার নির্মান কৌশল এবং হাতিয়ার ব্যবহারের ধরন দেখে আদিম মানুষের প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের দিকটিও বোঝা যায়। এইসব কারনের জন্য হাতিয়ারকে প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান বলে মনে করা হয়। 

মক টেস্ট 

মক টেস্ট দেওয়ার জন্য নিন্মলিখিত প্রশ্ন গুলির উত্তর দাও :-


Post a Comment (0)
Previous Post Next Post