ফরাসি বিপ্লবের গল্পকথা - তৃতীয় পর্ব

 ফরাসি বিপ্লবের গল্পকথায় আগের পর্বটিতে তোমাদের  অভিজাত বিদ্রোহের গল্প শুনিয়েছিলাম। অভিজাতদের ওপর কর বসানোর প্রতিবাদে ওরা ফ্রান্সে ভয়ঙ্কর বিদ্রোহ আর দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু করে দিয়েছিলো। এই অবস্থায় ভীত ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তারপর ফ্রান্সের পরিস্থিতি কোন দিকে গেলো,  সেই  বাদবাকি গল্পটাই আজকে বলবো।

তাহলে চলো... ফরাসি বিপ্লবের বাকি গল্পটা শোনা যাক... 


ফরাসি বিপ্লবের গল্পকথা - তৃতীয় পর্ব
ফরাসি বিপ্লবের গল্পকথা 



অভিজাতদের বিদ্রোহের চাপে শেষপর্যন্ত ষোড়শ লুই ঘোষনা করেছিলেন মে মাসের প্রথম দিনটিতে (১৭৮৯,১ মে) স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকা হবে। ইতিমধ্যে দেশের লোকেরা স্টেটস জেনারেলের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো। অভিজাত বিদ্রোহের পর ফ্রান্সে নতুন প্রজন্মের অনেকেই প্রথম বারের মতো স্টেটস জেনারেলের নাম শুনেছিলো। এদের অনেকেরই তাই স্টেটস জেনারেলের ব্যাপারটা নিয়ে ভারি কৌতুহলের জন্ম হলো। 

ওদিকে ফরাসি সরকারে তখন বিরাট সাজো সাজো রব। দীর্ঘ প্রায় ১৭৯ বছর পর স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন বসতে চলেছে। ১৬১০ খ্রিঃ শেষ বারের মতো স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন বসেছিলো। সুতরাং এই সভার নিয়ম কানুন রীতি নীতি গুলো সেভাবে আর কারো মনে ছিলো না। তাই সেগুলোকে নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার অনুশীলন চলতে থাকলো। 

এদিকে তৃতীয় সম্প্রদায়ের লোকেরাও মনে মনে তৈরি হচ্ছিলো। অভিজাতদের সঙ্গে রাজার লড়াইটা খুব কাছ থেকেই তারা দেখেছে। স্টেটস জেনারেল কি জন্য ডাকা হয়েছে, আর সেখানে কি হতে চলেছে সেটা তারা আগে ভাগেই আন্দাজ করতে পারলো। সেইমতো তারাও সবদিক থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখলো। 

স্টেটস জেনারেলের সভা আহ্বান 

মে মাসের ৫ তারিখটিতে (১৭৮৯,৫ মে) বিরাট শোভাযাত্রা করে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন বসলো। প্রথমে রাজা ছোটখাটো একটা বক্তিতা দিলেন। তারপরে অর্থমন্ত্রী নেকার একটা দীর্ঘ বিরক্তিকর বক্তিতায় অর্থনীতি নিয়ে একথা সেকথা বলে, শেষটায় সকলকে করের স্বপক্ষে সম্প্রদায়গত ভাবে একটি করে ভোট দিতে বললেন। আর এরপরেই যা ঘটলো, সেটা ফ্রান্সের ইতিহাসে ইতিহাস হয়ে থেকে গেলো। 

স্টেটস জেনারেলের সভা নিয়ে তৃতীয় সম্প্রদায়ের লোকজন এমনিতেই ভারি অসন্তুষ্ট ছিলেন। প্রথম থেকেই এর নিয়ম কানুন গুলো নিয়ে রাজা বড়ো বেশি বাড়াবাড়ি করছিলেন। এই সময় স্টেটস জেনারেলের বেশ কিছু নিয়ম তৃতীয় সম্প্রদায়ের লোকেদের পক্ষে একদমই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলো না। 

স্টেটস জেনারেলে অভিজাতদের ময়ূরের পেখম লাগানো জমকালো পোশাক পরে আসার অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো। আর অন্যদিকে তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের ম্যাড়ম্যাড়ে কালো রঙের বিদঘুটে পোশাক পরে আসতে বলা হলো। এখানেই শেষ নয়, যাজক ও অভিজাতরা সভাকক্ষে আসন গ্রহণ করবার পরেই তৃতীয় সম্প্রদায়কে সভাকক্ষে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। এইসব মধ্যযুগীয় নিয়ম কানুন গুলো আর যাই হোক, নব্য শিক্ষিত তৃতীয় সম্প্রদায়ের পক্ষে একদমই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলো না। এজন্য তারা যথেষ্ট অপমানিত বোধ করতে থাকেন। 

স্টেটস জেনারেলের সভা শুরু হওয়ার পর থেকেই তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের এই বিষয় গুলো নিয়ে যথেষ্ট মাথা গরম ছিলো। তারা একরকম ঠিক করেই এসেছিলেন, তাদের ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায় আর বৈষম্যের দিক গুলোকে তারা আর কোন মতেই মানবেন না।

স্টেটস জেনারেলের বক্তিতা পর্ব শেষ হবার পর অর্থমন্ত্রী নেকার করের স্বপক্ষে ভোট দেওয়ার প্রস্তাব রাখলেন, এবং তিনটি শ্রেনীকে যে যার কক্ষে চলে যেতে বললেন। নেকারের এই কথাখানা শুনেই তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যরা ভয়ানক চেঁচামেচি জুড়ে দিলো। 

একত্র অধিবেশন এবং মাথাপিছু ভোটের দাবি 

তারা চিৎকার করে বলতে লাগলেন, আগে যৌথ অধিবেশন আর মাথা পিছু ভোটের দাবি রাজাকে মানতে হবে, তারপরেই ভোট দেওয়ার কথা ভাবা যাবে। 

তৃতীয় সম্প্রদায়ের এমন কান্ডকারখানা দেখে অভিজাতদের কেউ কেউ বেজায় চটে গেলেন। তাদের সব পরিকল্পনায় তৃতীয় সম্প্রদায় যে এইভাবে জল ঢেলে দেবে, সেটা তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি। এদেরই কেউ কেউ এইসময় দাঁত কিড়মিড় করে বলতে থাকলেন, এসব আবার কি বেয়াদপি! 

তৃতীয় সম্প্রদায়ের বেয়াদপি টা অবশ্য রাজাও মানলেন না। ষোড়শ লুই স্পষ্টতই বলে দিলেন তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবি মানা কখনই সম্ভব নয়। তৃতীয় সম্প্রদায়ও পাল্টা হুমকি দিয়ে রাখলো, তাদের দাবি না মানলে তাদের পক্ষেও আর ভোট দেওয়া সম্ভব নয়। দু পক্ষের অনমনীয় মনোভাবে সভার কাজ প্রায় ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত বন্ধই থাকলো। কেউ এক চুল নড়বার পাত্র নয়, না রাজা, না তৃতীয় সম্প্রদায়। 

তৃতীয় সম্প্রদায় মাথাপিছু ভোটের আড়ালে একদিকে যেমন যাজক অভিজাতদের গোপন পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিতে চেয়েছিলো, অন্যদিকে তেমনি যৌথ অধিবেশনের মধ্য দিয়ে  অভিজাতদের তৃতীয় সম্প্রদায়ে পরিনত করে দিতে চেয়েছিলো। এবং এইভাবেই তারা তাদের ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলো। এই ব্যাপারটা অবশ্য বুদ্ধিমান অভিজাতদের কয়েকজন বুঝতেও পেরেছিলেন।এদেরই কেউ কেউ এইসময় রাগে গর গর করতে করতে বলেছিলেন, আর যাই হোক, ছোটলোক গুলোর সঙ্গে কিছুতেই আমরা একসঙ্গে বসবো না। 

এইসব অভিজাতদের কয়েকজন এই সময় রাজার পাশে গিয়ে রাজাকে একটু বল দেওয়ারও চেষ্টা করলেন। এর সঙ্গে রাজাকে তারা পরামর্শ দিলেন - রাজা যেন এই ছোটলোক গুলোর বেয়াদপি একদম সহ্য না করেন। তিনি যেন তার সিদ্ধান্তেই অটল থাকেন। 

একদা অভিজাত বিদ্রোহে মচকে যাওয়া রাজার মেরুদন্ড সোজা করতে অভিজাতদের একাংশ যখন রাজাকে তৈলমর্দনে ব্যস্ত ছিলেন, তখন অন্যদিকে তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যরাও কিন্তু চুপটি করে বসে ছিলেন না। 

জাতীয় সভার ঘোষনা

সভার কাজ তিন সপ্তাহ বন্ধ ছিলো। সেই ফাঁকে অ্যাবে সিয়েস নামে তৃতীয় সম্প্রদায়ের একটা লোক "What is Third Estate" নামে একটা বইও লিখে ফেলেছিলো। এই বইটাতে ফ্রান্সের যাজক, অভিজাত শ্রেনী দুটিকে নসাৎ করে তৃতীয় শ্রেনীকেই ফ্রান্সের আসল জাতি বলে তুলে ধরা হয়। 

এর দুএকদিন পর ১৭ জুন, ১৭৮৯খ্রিঃ, অ্যাবে সিয়েসের বইটাকে হাতিয়ার করে তৃতীয় সম্প্রদায় তাদের সভাকে আসল জাতীয় সভা বলে ঘোষনা করে দিলো। এই ঘোষনার সঙ্গে সঙ্গে তারা এটাও পরিষ্কার করে বলে দিলো, জাতীয় সভার অনুমতি ছাড়া রাজা কোন কর আদায় করতে পারবেন না।

তৃতীয় সম্প্রদায়ের এই বেয়াদপিটা রাজার আর সহ্য হলো না। ইতিমধ্যেই কয়েকজন অভিজাত মচকে যাওয়া রাজার পাশে দিনরাত এক করে থাকছিলেন। এদেরই কেউ একজন রাজাকে দুষ্টু বুদ্ধি দিলো, কদিন ছোটলোক গুলোকে স্টেটস জেনারেলে যেন ঢুকতে না দেওয়া হয়।

টেনিস কোর্টের শপথ

জাতীয় সভা ঘোষনা করার দুদিন পর ১৭৮৯ খ্রিঃ ২০ জুন একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটলো। তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যরা স্টেটস জেনারেলে তাদের সভাকক্ষে ঢুকতে গিয়ে দেখেন সেটা তালাবন্ধ। এইসময় কেয়ারটেকার গোছের কেউ একজন এসে বলেছিলো, সভাকক্ষে কিছু মেরামতির কাজ হবে, তাই কদিন সভা কক্ষ বন্ধ থাকবে।

তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যরা বুঝতে পারলেন, কয়েকজন অভিজাতদের সঙ্গে নিয়ে রাজা কোন বদ মতলবেই একাজ করেছেন। স্টেটস জেনারেল বন্ধ করে দিলে সমবেত তৃতীয় সম্প্রদায়ের ঐক্যশক্তি সহজেই ভেঙে ফেলা যাবে, এমন কিছু ভেবেই হয়তো রাজা তৃতীয় সম্প্রদায়ের সভাকক্ষ বন্ধ করে দিতে চেয়েছেন।

এই অবস্থায় তৃতীয় সম্প্রদায়ের ঐক্য যাতে কোন মতেই ভেঙ্গে না পড়ে, সেইজন্য ড. গিলোটিন তৃতীয় সম্প্রদায়ের সব সদস্যদের স্টেটস জেনারেলের পাশে টেনিস খেলার মাঠটিতে জড়ো হতে বললেন। সবাই টেনিস খেলার মাঠে সমবেত হওয়ার পর গিলোটিনের নেতৃত্বে সকল সদস্য একে অপরের হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করলেন, যতদিন না ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান তৈরি হচ্ছে, ততদিন তারা ঐক্যবদ্ধ থাকবেন এবং এক সঙ্গে কাজ করে যাবেন। এর সাথে সাথে এটাও বলা হলো, সংবিধান তৈরি না হওয়া পর্যন্ত একদিনের জন্যও জাতীয় সভার অধিবেশন মুলতুবি করা হবে না। তৃতীয় সম্প্রদায়ের এই শপথটি টেনিস কোর্টের শপথ নামে পরিচিত হলো। 

তৃতীয় সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধতা এবং অনমনীয় মনোভাব দেখে রাজা যথেষ্ট বিচলিত হয়ে পড়লেন।

 ইতিমধ্যে তৃতীয় সম্প্রদায় তাদের আদর্শ অ্যাবে সিয়েসের লেখা বইটির মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। ওটা তখন অনেক যাজক, অভিজাতদের কাছেও পৌঁছে গিয়েছিলো। তাদের অনেকেই যুগ বদলের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন। তাই কাল বিলম্ব না করে এই সময় ১৭০ জন যাজক এবং ৫০ জন অভিজাত তৃতীয় সম্প্রদায়ে যোগ দিলেন। এর ফলে তৃতীয় সম্প্রদায়ের শক্তি আর পাল্লা দুটোই ভারি হয়ে এলো।

বুর্জোয়া বিপ্লবের সাফল্য

শেষপর্যন্ত ষোড়শ লুই আর কোনরকম ঝুঁকি নিতে রাজি হলেন না। ১৭৮৯ খ্রিঃ ২৭ জুন তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবি গুলোকে মেনেই নিলেন। জয় হলো তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের। জয়ের আনন্দে সেদিন সারা ফ্রান্স জুড়ে শহরগুলোকে রঙ্গিন আলোতে সাজিয়ে তোলা হলো।

স্টেটস জেনারেলে তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের বেশির ভাগই ছিলেন শহুরে সদস্য। এই সদস্যদের বুর্জোয়া বলে ডাকা হতো। 

মধ্যযুগে শহর গুলো প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকতো। এই প্রাচীরকে বলা হতো বার্জ। আর যারা এর ভিতরে বসবাস করতো, তাদের বলা হতো বুর্জোয়া। সেই সময় থেকেই শহরের ব্যবসায়ী, ধনী শ্রেনীকে বুর্জোয়া বলে ডাকার রেওয়াজ ছিলো। ফরাসি বিপ্লবের প্রথম পর্বে স্টেটস জেনারেলের দখল এবং নিয়ন্ত্রন এই বুর্জোয়া শ্রেনীদের হাতেই গিয়েছিলো বলে ২৭ জুনের ঘটনাকে ইতিহাসে বুর্জোয়া বিপ্লব বলা হয়ে থাকে।

ষোড়শ লুই যৌথ অধিবেশন এবং মাথাপিছু ভোটের দাবি মেনে নেওয়ার পর তৃতীয় সম্প্রদায় ফ্রান্সের জন্য একটা নতুন সংবিধান তৈরির দিকে মন দিলো।

জাতীয় সভা থেকে সংবিধান সভা

১৭৮৯ খ্রিঃ ৯ জুলাই জাতীয় সভা সংবিধান রচনার কাজ শুরু করে দিলো। এই সময় থেকে জাতীয় সভার নাম বদলে হয়ে গেলো সংবিধান সভা। এই সংবিধান সভা প্রায় দু বছরের চেষ্টায় ফ্রান্সের জন্য নতুন একটা সংবিধান তৈরি করেছিলো। ১৭৯১ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসে এই সংবিধান লেখার কাজ শেষ হলো। 

কিন্তু ফ্রান্সের নতুন সংবিধান লেখার ফাঁকে অনেক ঘটনাই ঘটে গিয়েছিলো। সেইসব ঘটনা গুলির হাত ধরে বিপ্লব ওপর তলা থেকে একেবারে নীচ পর্যন্ত ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিলো। এবার আমরা সেই সব রোমহর্ষক ঘটনা গুলোর কথাই বলবো..।

প্যারিসের গন অভ্যুত্থান 

বুর্জোয়া বিপ্লবের সাফল্যের কথা অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ফ্রান্সের গ্রামগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিলো। ১৭৮৮ খ্রিঃ সারা ফ্রান্স জুড়ে চলেছিলো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ১৭৮৯ খ্রিঃ অজন্মার ফলে খাবারের দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে গিয়েছিলো। এই অবস্থায় সবথেকে খারাপ দশা হয় সাঁকুলেৎদের। তারা ক্ষুদার্থ ছিলো,তাই রাজার ওপর তাদের রাগটাও ছিলো অন্যদের থেকে অনেক বেশি। 

বুর্জোয়া বিপ্লবের সাফল্যের কথা শুনে সাঁকুলেৎরা জুন মাসের শেষদিক করে হাজারে হাজারে প্যারিসে সমবেত হতে থাকলেন। ওদিকে প্যারিসে অভিজাতদেরও মূল ঘাঁটি ছিলো। এতদিন পর্যন্ত অভিজাতদের যা কিছু অশান্তি সব প্যারিস থেকেই শুরু হয়েছিলো। মাথাপিছু ভোট আর যৌথ অধিবেশনের বিষয়টা অভিজাতরা কিছুতেই হজম করতে পারছিলো না। এজন্য রাজার ওপর তাদের ভারি রাগও হলো।

রাজাও এইসময় কেউকেটা কয়েকটা গোয়েন্দার কাছ থেকে খবর পেলেন, অভিজাতরা মাথাপিছু ভোটের ব্যাপারটা নিয়ে খুব তেতে আছে। যখন তখন দাঙ্গা হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দিতে পারে।আগের বারের মতো অভিজাতরা যাতে আর বেয়াদপি করতে না পারে সেজন্য লুই আগে ভাগেই কিছু ব্যবস্থা নিয়ে রাখলেন।

তিনি প্যারিসে একদল ভাড়াটে জার্মান সেনা পাঠিয়ে দিলেন। প্যারিসে তখন হাজার হাজার সাঁকুলেৎ গ্রাম থেকে এসে গিয়েছিলো। এদেরই কেউ একজন এসময় সেনার দাপাদাপি দেখে গুজব ছড়িয়ে দিলো, জাতীয় সভা ভেঙ্গে ফেলবার জন্যই রাজা প্যারিসে সেনা পাঠিয়েছে। এই গুজব সারা প্যারিস জুড়ে আগুনের মতো ছড়িয়ে গেলো।

শেষ পর্যন্ত আতঙ্ক থেকে জন্ম নিলো হিংসা। রাজপথে জনতা সেনা খন্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। সেনা পিছু হটতেই শুরু হয়ে গেলো লুঠতরাজ। একের পর এক দোকান, মঠ, ধনশালীদের বাড়ি গুলো লুঠ করে উত্তেজিত জনতা প্যারিসের বাস্তিল দুর্গের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো।

বাস্তিল দুর্গের পতন

বাস্তিল দুর্গ ছিলো বুঁরবো রাজাদের স্বৈরাচার আর অত্যাচারের প্রতীক। রাজতন্ত্রের বিরোধীদের এই দুর্গে আটক রেখে অত্যাচার করা হতো। সাঁকুলেৎ জনতা যখন প্যারিসের অস্ত্রের দোকান গুলো লুঠ করছিলো, তখন কেউ একজন বলে দিয়েছিলো, বাস্তিল দুর্গেই আছে রাজার মূল অস্ত্র ভান্ডার। ওকথা শুনেই একদল উত্তেজিত জনতা তেড়ে চলে এলো বাস্তিল দুর্গের কাছে। দুর্গের প্রহরীদের মেরে ফেলবার পর ওখানে বন্দী হাজার হাজার লোকেদের মুক্তি দেওয়া হলো। বাস্তিলের বিপুল অস্ত্রভান্ডার গুলো জনতা লুঠ করে নিলো। আর সবশেষে দূর্গের মাথায় রাজ পতাকাকে নামিয়ে লাল, নীল, সাদা রঙের বিপ্লবী পতাকাকে উড়িয়ে দিলো।

১৭৮৯ খ্রিঃ ১৪ জুলাইয়ের এই ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে স্মরণীয় করে রাখবার জন্য দিনটি জাতীয় দিবস হিসাবে ঘোষনা করা হলো। প্যারিসের কয়েক হাজার অভিজাত এই ঘটনার আতঙ্কে দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করলেন। ফ্রান্সে গ্রাম গুলোতে যে কয়জন অভিজাত ছিলেন, তাদের মনেও বাস্তিল দুর্গের পতন ভয়ানক ত্রাসের সঞ্চার করেছিলো। সে গল্পটা অবশ্য আমরা একটু পরে বলবো।

প্যারিস কমিউন

প্যারিসের গন অভ্যুত্থান শুধু যে অভিজাতদের আর রাজার মনে আতঙ্ক ধরিয়ে দিয়েছিলো তাই নয়, তৃতীয় সম্প্রদায়ের বুর্জোয়া সদস্যদের মনেও ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলো। তারা বুঝতে পারেন বিপ্লব তাদের হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার থেকেও বড়ো কথা, যেভাবে উত্তেজিত জনতা লুঠপাট চালাচ্ছে, তার থেকে যে করেই হোক নিজেদের ধনসম্পত্তি গুলোকে বাঁচাতে হবে।

এইজন্য প্যারিসের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগরিকরা নিজেদের ধনসম্পত্তি রক্ষা করবার তাগিদে প্যারিস কমিউন গড়ে তুললেন। এই ব্যবস্থাটা ছিলো অনেকটা আধুনিক কালের পৌর স্বায়ত্ত্ব শাসন ব্যবস্থার মতো। প্যারিসের শাসন ক্ষমতা বুর্জোয়াদের হাতে চলে গেলো।

প্যারিস কমিউনকে রক্ষা করবার জন্য জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করা হলো। লাফায়েত নামে এক  মস্ত গুনধর লোককে এই বাহিনীর প্রধান করে দেওয়া হলো।

রাজা এবং অভিজাতদের হাত থেকে প্যারিসের শাসন ক্ষমতা মধ্যবিত্ত বুর্জোয়াদের হাতে চলে গেলো।রাজা শেষ পর্যন্ত প্যারিস কমিউনকে মেনে নিলেন। সাঁকুলেৎদের কোন সমস্যার সমাধান হলো না বটে, কিন্তু তা হলেও তারা এই ঘটনায় খুশিই হলো। রাজা এবং অভিজাতদের ভয়ানক ক্ষতি তারা করে দিতে পেরেছে, এটা ভেবেই সাঁকুলেৎদের অনেকে স্বস্তি এবং সান্তনা পেয়ে গ্রামে ফিরে গেলো।

কয়েক দিনের মধ্যেই প্যারিস কমিউনের আদর্শে অন্যান্য শহর গুলিতেও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লো এবং সেখানেও একের পর  কমিউন গড়ে উঠতে আরম্ভ করলো। শেষপর্যন্ত এইভাবেই ফ্রান্সের প্রায় সব ছোট বড়ো শহরগুলির শাসন ক্ষমতা মধ্যবিত্তদের হাতে চলে গেলো।

মহাআতঙ্ক

সাঁকুলেৎদের কেউ কেউ গ্রামে ফিরে এসেছিলো। তাদেরই কেউ গ্রামের লোকেদের কাছে প্যারিসের গন অভ্যুত্থান আর বাস্তিল দুর্গের পতনের খবরটা পৌঁছে দিয়েছিলো। সেসব শুনে গ্রামের কৃষকরা ভয়ানক রকম উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলো।

 গ্রামের এই কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরেই সামন্ততান্ত্রিক শোষনে জর্জরিত ছিলেন। এবার তারাও মুক্তির স্বপ্ন দেখতে থাকলেন।এই সময়ে একটা ঘটনা ঘটলো। কেউ একজন গুজব রটিয়ে দিলো, শহর থেকে অভিজাতরা ভাড়াটে সৈন্য নিয়ে নিয়ে আসছে। তারা গ্রামের সব ফসল গুলোতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। এই গুজব কৃষকদের মনে ভয়ানক আতঙ্ক তৈরি করলো। ক্রমে এই আতঙ্ক থেকে জন্ম নিলো ক্রোধ, আর ক্রোধ রূপান্তরিত হলো হিংসায়।

এই মহা আতঙ্কে ফ্রান্সের একের পর এক গ্রাম গুলোতে কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেলো। কৃষকরা গ্রামের অভিজাতদের ঘরবাড়ি গুলোতে লুঠপাট চালাতে আরম্ভ করেছিলো। তাদের শস্য ভান্ডার গুলিতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিলো। পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিলো।

গ্রামের অরাজকতা খবর প্যারিসেও এসে পৌঁছেছিলো। তৃতীয় সম্প্রদায়ের বুর্জোয়া সদস্যরা তখন নতুন সংবিধান রচনায় ব্যস্ত ছিলেন। গ্রামের কৃষক বিদ্রোহ তাদের মনেও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলো। এই সময় কেউ একজন বলেছিলো, কৃষকদের জন্য এখুনি ভালো কিছু একটা ঘোষনা করতেই হবে। নচেৎ বিদ্রোহের আগুন গ্রাম থেকে শহরে আসতে বেশি সময় নেবে না। বিদ্রোহের আগুনে সবকিছু পুড়ে যাওয়ার আগেই তাকে নিভিয়ে ফেলতে হবে।

সামন্ততন্ত্রের বিলোপ

এই ঘটনার পর ১৭৮৯ সালের ৪ ঠা আগস্ট সংবিধান সভা তড়িঘড়ি করে ঘোষনা করে দিলো, আজ থেকে ফ্রান্সে সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি ঘোষনা করা হচ্ছে। সামন্ততন্ত্র যেমন থাকছে না, তেমনি ভূমিদাস প্রথা, ম্যানর প্রথা, বেগার প্রথা, ধর্ম কর এগুলোও আর থাকছে না। 

এর কিছুদিন পর ১১ ই আগস্ট একটা আদেশনামা বের করে সামন্ততন্ত্রকে পাকাপাকি ভাবে বিদায় করে জানিয়ে দেওয়া হলো, ফ্রান্সে আর যাজক, অভিজাত বলে কোন আলাদা শ্রেনী থাকছে না। সকল নাগরিক একটিই শ্রেনী এবং একটিই জাতি। এই ঘোষনার ফলে অভিজাতদের সব জমিদারি গুলোকেও বাতিল করে দেওয়া হলো। সরকারি পদগুলোর গনতন্ত্রীকরন করে ঘোষনা করে দেওয়া হলো, এখন থেকে আর বংশকৌলিন্য নয়, যোগ্যতাই হবে চাকরি পাবার একমাত্র মাপকাঠি। 

৪ ঠা আগস্ট আর ১১ই আগস্টের ঘোষনার মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের পুরাতনতন্ত্রের সব শিকড়কে একেবারেই উপড়ে ফেলে দেওয়া হলো। এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই বিপ্লবের একটি অধ্যায় আপাতত শেষ হলো বটে, কিন্তু সবকিছুই শেষ হয়ে গেলো না। 

রাজতন্ত্রের শবযাত্রা 

১৭৮৯ সালের অক্টোবর মাসটিতে প্যারিসে ভয়ানক খাদ্যসংকট দেখা দিলো। লোকেরা এর জন্য ষোড়শ লুই ক দায়ী করে রুটির দাঙ্গা শুরু করলো। এই দাঙ্গা হাঙ্গামাতে লুই ভয় পেয়ে ভার্সাই রাজপ্রাসাদকে বাঘা বাঘা নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে ঘিরে ফেললেন। 

সামন্ততন্ত্র বিলুপ্তির ঘোষনা পত্রে লুইয়ের এমদমই সম্মতি ছিলো না। রাজার সম্মতি ছাড়া সামন্ততন্ত্র বিলোপের আদেশটিকে আইনে পরিনতও করা যেতো না। এই অবস্থায় জাতীয় সভার কয়েকজন ভাবতে আরম্ভ করলেন, রাজাকে বাগে না আনা গেলে কিচ্ছুটি হবার নয়। 

ওদিকে প্যারিসে তখন একদল মহিলা খাদ্যের দাবিতে রুটির আন্দোলন চালাচ্ছিলো। রাজার অবশ্য সেসব দিকে কোন লক্ষ্য ছিলো না। বিরক্ত মহিলারা ঠিক করলেন, তারা ভার্সাই রাজপ্রাসাদে যাবেন, আর ওখান থেকে রাজাকে টেনে আনবেন প্যারিসে। প্যারিসে থাকলেই রাজা প্যারিসের কষ্টটা বুঝতে পারবেন। 

ঠিক করা হলো, মহিলাদের দলটিকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্যারিসের জাতীয় রক্ষীবাহিনীর ২০,০০০ সেনাও সঙ্গে করে যাবে। সেইমতো ৫ অক্টোবর মহিলারা ভার্সাই প্রাসাদে এলেন। ওখানকার নিরাপত্তা রক্ষীরা মহিলাদের ঢুকতে না দেওয়ায় জাতীয় রক্ষী বাহিনীর সঙ্গে ওদের বেশ ছোট রকম একটা যুদ্ধও হয়ে গেলো। শেষপর্যন্ত, রাজার নিরাপত্তা বাহিনী পিছু হটলো। মহিলারা রাজাকে প্যারিসে ফিরে যেতে অনুরোধ করলেন। 

এই ঘটনার পর রাজা তার বউ এবং ছেলেপুলেদের সঙ্গে নিয়ে ভার্সাই প্রাসাদ ত্যাগ করলেন। এছাড়া আর তার কিছুই করার ছিলো না। মহিলারা এইসময় একটা অতি সাধারন নড়বড়ে ঘোড়ার গাড়িতে রাজা, রানী আর তাদের ছেলেদেরকে তুলে দিলো। ঘোড়ার গাড়িটিকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিলো, যাতে রাজার কোন অসম্মান না হয়। তারপর ঐ গাড়িটাকে টানতে টানতে প্যারিসে নিয়ে এলো। এই সময় তারা আনন্দে চিৎকার করতে করতে বলতে থাকে - পেয়েছি, পেয়েছি, আমরা রুটিওয়ালা, তার বউ আর ছেলেপুলেদের পেয়েছি। 

রাইকার নামের একজন ঐতিহাসিক ভার্সাই থেকে রাজার প্যারিসে এই আগমনটাকে রাজতন্ত্রের শবযাত্রা বলে উল্লেখ করেছিলেন। 

যাইহোক, প্যারিসে আসবার পর রাজা কার্যত তৃতীয় সম্প্রদায়ের হাতে একপ্রকার বন্দী হয়েই থাকলেন। এই সুযোগে জাতীয় সভার সদস্যরা সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি এবং নাগরিকের ঘোষনা পত্র দুটিতে রাজার সই করিয়ে নিতে চাইলো। গোমরা মুখ করে রাজা তাতে সইও করে দিলেন। 

এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই যাবতীয় অশান্তির আপাতত ইতি ঘটলো। 


চলবে.... 





Post a Comment (0)
Previous Post Next Post