ইতিহাসের উপাদান - মুদ্রা |
(ক.) মুদ্রা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-
(১.) প্রাচীন যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে লিপির পরেই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মুদ্রা।
(২.) মুদ্রা হলো নির্দিষ্ট সন, তারিখ ও প্রতীক সম্বলিত এমন এক ধাতবখন্ড যা, বিনিময়ের মাধ্যম ও অর্থনৈতিক পরিমাপের একক হিসাবে পরিগনিত হয়।
(৩.) মুদ্রার পঠন পাঠন বিদ্যাকে বলা হয় - "নিউমিসমেটিক্স"।
(৪.) যিনি মুদ্রা নিয়ে চর্চা বা গবেষনা করেন, তাকে বলা হয় - "নিউমিসম্যাটিস্ট"।
(৫.) ভারতবর্ষের একজন প্রখ্যাত মুদ্রাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ হলেন - ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
(৬.) মুদ্রা সাধারনত সোনা, রূপা, তামা, ব্রোঞ্জ, সিসা প্রভৃতি ধাতু দিয়ে তৈরি করা হতো।
(৭.) স্বর্নমুদ্রাকে বলা হতো দীনার বা মোহর। একটি দীনার বা মোহর ১৬ টি রৌপ্য মুদ্রার সমান ছিলো।
(খ.) মুদ্রাতে প্রথম সম্পর্কিত তথ্য :-
(১.) পানিনির "অষ্টাধ্যায়ী" গ্রন্থেই সর্বপ্রথম ভারতে ধাতব টুকরো বা মুদ্রার উল্লেখ পাওয়া যায়।
(২.) মুদ্রা বিশেষজ্ঞদের মতে, খ্রিঃ পূর্ব ষষ্ঠ - পঞ্চম শতকে ভারতে প্রথম মুদ্রার প্রচলন হয়েছিলো।
(৩.) এই সময়ের মুদ্রা গুলিকে বলা হতো - ছাপযুক্ত কার্যাপন মুদ্রা বা Punch marked মুদ্রা বা অঙ্কচিহ্নিত মুদ্রা। এই মুদ্রা গুলিতে নানা ধরনের পাখি, চন্দ্র, সূর্য, তারা ইত্যাদির ছাপ দেওয়া থাকতো।
(৪.) খ্রিঃ পূর্ব ষষ্ঠ শতকে গ্রীকদের হাত ধরেই ভারতে প্রথম বিদেশী মুদ্রার আমদানি হয়।
(৫.) ভারতে গ্রীক আক্রমণের পর রাজার নাম খোদাই ও সন তারিখ দেওয়া মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়।
(৬.) কুষান শাসকরাই ভারতে প্রথম ও ব্যাপকভাবে স্বর্নমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন।
(৭.) খ্রিঃ প্রথম শতকে কুষান রাজ বিম কদফিসের আমলেই প্রথম ভারতে স্বর্নমুদ্রার প্রচলন ঘটে।
(৮.) শাসকের নাম ও মূর্তি সহ প্রথম স্বর্নমুদ্রার প্রচলন করেন - গ্রীক রাজা মিনান্দার।
(৯.) সম্রাট কনিষ্কের মুদ্রাতেই সর্বপ্রথম বুদ্ধদেবের মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। এর আগে বুদ্ধের উপস্থিতি প্রতীক চিহ্নের মাধ্যমে প্রকাশ করা হতো।
(১০.) চতুর্ভুজ শিবের ছবিও কুষান মুদ্রাতেই সর্বপ্রথম উৎকীর্ন হতে দেখা যায়।
(গ.) বিভিন্ন সময়কাল ও রাজাদের মুদ্রার নাম :-
প্রাচীন ভারতের মুদ্রার নাম |
(১.) বৈদিক যুগের মুদ্রা :- নিষ্ক, মনা, শতমান ( উক্ত নামের ধাতব খন্ডের উল্লেখ ঐতিহাসিক উপাদানে পাওয়া গেলেও, এগুলি যথার্থ মুদ্রা কিনা তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে)
(২.) নন্দ ও মৌর্য যুগের মুদ্রা :- punch marked মুদ্রা বা ছাপযুক্ত কার্যাপন মুদ্রা বা অঙ্কচিহ্নিত মুদ্রা।
(৩.) মৌর্যোত্তর যুগ : কুষান ও সাতবাহনদের মুদ্রা :-
- কনিষ্কের স্বর্নমুদ্রা - বড্ডো,
- সাতবাহনদের মুদ্রা - পোতিন ( সিসা ও তামা মিশ্রিত ধাতুর মুদ্রা)
- গুপ্ত সম্রাটগন ছিলেন প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বর্নমুদ্রার প্রবর্তক।
- সমুদ্র গুপ্ত আট প্রকার স্বর্নমুদ্রার প্রচলন করেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল - বিনাবাদনরত মুদ্রা
- দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত প্রথম পশ্চিম ভারতে রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন করেন।
- গুপ্ত রাজাদের মধ্যে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তই সর্বপ্রথম তাম্র মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন।
- কুমার গুপ্তের মুদ্রার নাম ছিল - অপ্রতীঘ,
(ঘ.) ইতিহাসের উপাদান হিসাবে মুদ্রা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ?
(ক.) রাজনৈতিক তথ্য :-
- (I.) মুদ্রার সন ও রাজার নাম থেকে রাজাদের রাজত্বকালের তারিখ জানা যায়।
- (II.) মুদ্রার প্রাপ্তি স্থান থেকে একজন শাসকের রাজ্যসীমা নির্ধারন করা সম্ভব।
- (III.) একই মুদ্রার দুই দিকে একই বংশের দুজন রাজার নাম থেকে দ্বৈত শাসনের কথা জানা যায়। অনেক সময় বিদেশের বিশেষত রোমান মুদ্রাকে ঈষৎ পরিবর্তন করে এখানকার কুষান রাজারা নিজেদের রাজ্যে চালু করেছিলেন।
- (IV.) গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত যে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন, তার উল্লেখ এলাহাবাদ প্রশস্তি বা অন্য কোথাও নেই। "অশ্বমেধ পরাক্রমঃ" এই যুগ্ম শব্দ সম্বলিত বিশেষ মুদ্রা থেকেই এই ঘটনার কথা জানতে পারা যায়।
- (V.) মহারাষ্ট্রের জোগালথেম্বি মুদ্রা ভান্ডারে এমন বহু মুদ্রা পাওয়া গেছে যেগুলি এক সময় ছিলো শক শাসক নহপানের। এই মুদ্রা গুলির দুই তৃতীয়াংশের ওপর গৌতমীপুত্র সাতকর্নীর মুদ্রার ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। এ থেকে অনুমান করা যায়, গৌতমীপুত্র শকক্ষত্রপ নহপানকে পরাজিত করেছিলেন।
- (VI.) এই রাজনৈতিক তথ্য গুলি ছাড়াও, মুদ্রা থেকে "শকাব্দ" ও "গুপ্তাব্দ" প্রচলনের প্রমানও পাওয়া যায়।
(খ.) অর্থনৈতিক তথ্য :-
- (I.) প্রাচীন যুগে ব্যবসা বানিজ্যের লেনদেনের ক্ষেত্রেই মুদ্রার ব্যবহার করা হতো। তাই যেকোন সময়কালে মুদ্রার বহুল প্রচলন ও প্রাপ্তি ঐ সময়কালের ব্যবসা বাণিজ্যের অগ্রগতির সাক্ষ্য তুলে ধরে।
- (II.) রোমান সাম্রাজ্যের অসংখ্য স্বর্নমুদ্রা এদেশে আবিষ্কৃত হয়েছে, যা থেকে ভারত - রোম বানিজ্যের কথা জানা গেছে। ভারতের পক্ষে লাভজনক ভারত - রোম বানিজ্যের চিহ্ন স্বরূপ ভারতে রোমের মুদ্রার ৬৮ টি ভান্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে ৫৭ টিই পাওয়া গেছে বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিন। এই প্রাপ্ত রোমান মুদ্রা গুলির ভিত্তিতে বলা যায়, রোমান সম্রাট অগাস্টাস থেকে নীরো পর্যন্ত ভারত রোম বানিজ্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিলো।
- (III.) মুদ্রাতে ধাতুর গুনগত মান, খাদের পরিমান বা মুদ্রামানের ক্রমাবনতি থেকে অর্থনৈতিক উত্থান পতনের রেখাচিত্র বেশ স্পষ্ট ভাবেই ধরা পড়ে। যেমন যখন বর্হিবানিজ্য উন্নত তখন মুদ্রার গুনগত মান ও সংখ্যাও উন্নত থাকে। আবার যখন তা নিন্মমুখী তখন মুদ্রাও নিন্মমানের এবং পরিমানেও অল্প।
(৩.) ধর্ম ও সাংস্কৃতিক তথ্য :-
- (I.) মুদ্রা থেকে যেকোন সময়কালের ভাষা ও লিপি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় ।
- (II.) মুদ্রায় নকশা বা Design থেকে যেকোন সময়কালের শিল্প রুচি ও কারিগরি জ্ঞানের দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।
- (III.) কুষান মুদ্রায় ভারতীয় দেব দেবীর ছবি দেখে বোঝা যায়, কুষানরা মধ্য এশিয়ার অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও তারা শিব ও বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন।
- (IV.) গুপ্ত সম্রাটদের মুদ্রায় গরুড়ের ছবি অঙ্কিত থাকায় অনুমান করা হয় তারা বৈষ্ণব ধর্মের অনুরাগী ছিলেন।
- (v.) সমুদ্রগুপ্তকে একটি মুদ্রায় বীনাবাদক রূপে উপস্থাপিত করা হয়েছিলো, যা থেকে বোঝা যায়, সমুদ্রগুপ্ত সংগীতজ্ঞ ছিলেন।