ইতিহাসের উপাদান - সমাধি ও প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ
সমাধি ও প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-
(১.) প্রাচীন যুগের ইতিহাস রচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হলো - সমাধি, ধর্মস্থান ও স্থাপত্য ভাষ্কর্যের ধ্বংসাবশেষ।
(২.) এই উপাদান গুলি থেকে প্রাচীন যুগের "রাজনৈতিক ইতিহাস" সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও, এগুলি শিল্প সংস্কৃতির বিবর্তন, মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের ধরন, নগর ও সভ্যতার প্রসার এবং আর্থ - সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে নানা তথ্য সরবরাহ করে।
*********************************************
(অ.) ইতিহাসের উপাদান : সমাধি
(১.) পৃথিবীর প্রায় সব দেশে ও যুগেই মৃতদেহকে কবর দেওয়া হতো। একেই "সমাধি" বলা হয়।
(২.) সমাধি থেকে মানুষের ধর্ম ও অতিন্দ্রীয় জগৎ সম্পর্কে চিন্তা ভাবনার ধারনা পাওয়া যায়। পৃথিবীর সব দেশ, যুগ ও সভ্যতায় সমাধির ধরন এবং পদ্ধতি এক ছিলো না।
(ক.) প্রাচীন প্রস্তর যুগের সমাধি :-
প্রাচীন প্রস্তর যুগে মৃতদেহকে হাঁটু মুড়ে বসিয়ে কবর দেওয়া হতো। কবর দেওয়ার সময় মৃতদেহে লাল রঙ লাগানো হতো। কবরের মধ্যে জীবন্ত পশু ও মৃত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেওয়া হতো। এগুলি থেকে বোঝা যায়, সেই সময় মানুষ বিশ্বাস করতো মৃত্যুর পরেই জীবন শেষ হয়ে যায় না। লৌকিক জগতের বাইরেও আরেকটি জগৎ আছে।
(খ.) মধ্য প্রস্তর যুগের সমাধি :-
মধ্য প্রস্তর যুগেও মৃতদেহকে সমাধিস্থ করা হতো। তবে এযুগে যে সমস্ত সমাধি পাওয়া গেছে, সেগুলিতে মাথার খুলি বিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এটি থেকে অনেক ঐতিহাসিক অনুমান করেন, নির্মম ভাবে মেরে তারপর সমাধিস্থ করা হতো। কেন এমন করা হতো তার সঠিক কারন আজও জানা যায় নি।
(গ.) নব্য প্রস্তর যুগের সমাধি :-
নব্য প্রস্তর যুগে ঘরের আশে পাশেই মৃতদেহকে কবর দেওয়া হতো। কখনও সম্পূর্ন মৃতদেহকে কবরস্থ করা হতো, কখনোবা মৃতদেহ থেকে মাংস বের করে মৃতদেহের কঙ্কালটিকেই শুধু কবর দেওয়া হতো। কবরে রান্না করা খাবার ও মৃতদেহের প্রিয় বস্তু গুলিকেও রেখে দেওয়া হতো। এসব থেকে বোঝা যায়, ঐ সময় মানুষ বিশ্বাস করতো মৃত্যুর পরেও মানুষ বেশ কিছুকাল বেঁচে থাকে। এই বিশ্বাসের কারনেই মৃতদেহকে ঘরের আশে পাশে কবর দেওয়া হতো।
(ঘ.) হরপ্পা সভ্যতার সমাধি :-
হরপ্পা সভ্যতার মানুষের গড় আয়ু ছিলো ৩০ বছর। হরপ্পা সভ্যতার মানুষ মৃতের সৎকার কিভাবে করতো, তা ১৯১৪ খ্রিঃ স্যার মার্টিমার হুইলারের অনুসন্ধান ও গবেষনা থেকে জানা যায়। হরপ্পা সভ্যতার সমাধি ক্ষেত্র ছিলো দুটি - সমাধি ক্ষেত্র আর - ৩৭, এবং সমাধি ক্ষেত্র - এইচ।
হরপ্পাতে তিন ধরনের সমাধি দেখা যায়। যথা -
- পূর্ন সমাধি,
- আংশিক সমাধি এবং
- দাহোত্তর সমাধি।
পূর্ন সমাধি সাধারনত বসতবাড়ী থেকে কিছুটা দূরে দেওয়া হতো। পূর্ন সমাধিতে মৃতের ব্যবহার্য জিনিসপত্র রেখে কবর দেওয়া হতো। রোপার, হরপ্পা, লোথাল, কলিবঙ্গান ও মহেঞ্জোদাড়োতে প্রচুর পূর্ন সমাধির নিদর্শন পাওয়া গেছে।
আংশিক সমাধির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মৃতদেহের কঙ্কালকেই কবরস্থ করা হতো। অন্যদিকে দাহোত্তর সমাধির ক্ষেত্রে মৃতদেহ দাহ করে তার ভস্ম একটি পাত্রে ভরে সমাধিস্থ করা হতো। প্রত্যেক সমাধির ক্ষেত্রেই মৃতদেহের মাথা থাকতো উত্তর মুখে।
(ঙ.) সুমেরীয় সভ্যতার সমাধি :-
সুমেরীয়রা সাধারনত কফিন বা অন্য কোন লৌকিক বস্তু ছাড়াই মৃতদেহকে মাটি চাপা দিয়ে কবর দিতো। এ থেকে বোঝা যায়, মৃত্যু পরবর্তী জীবন বা জগৎ সম্পর্কে তাদের কোন স্পষ্ট ধারনা ছিলো না।
তবে সুমেরীয় সভ্যতায় রাজা যেহেতু ধর্মের প্রধান ছিলেন, তাই রাজার কবরে তার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস দেওয়া হতো। এমনকি রাজার ভৃত্যদের নেশার দ্রব্য খাইয়ে অচৈতন্য করে কবরস্থ করা হতো। রাজা ও রানির আলাদা কবর থাকতো। প্রত্নতাত্ত্বিক স্যার লিওনার্ড ঊর নগরের রাজকীয় সমাধি ক্ষেত্রের বিশ্লেষন করে বলেছেন, সুমেরীয়রা বিশ্বাস করতো মৃত্যুর পর কিছুদিন অস্পষ্ট ছায়াময় স্থানে মৃত ব্যক্তির প্রেতাত্মা ঘোরাফেরা করে।
(চ.) মিশরীয় সভ্যতার সমাধি :-
প্রাচীন মিশরবাসীরা পরলোক তত্ত্বে বিশ্বাস করতো। তারা বিশ্বাস করতো মানুষের শরীরে "কা" ও "বা" র অবস্থান করে। "বা" হলো আত্মা এবং "কা" হলো দ্বিতীয় সত্তা। মৃত্যুর পর বা ও কা দুজনেই চলে যায়, আর মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে। পরে বা ও কা ফিরে এসে মানুষের জীবনে প্রবেশ করে পুনরায় দেহকে নবজন্ম দেয়।
এই কারনে মিশরীয়রা মৃতদেহকে নানা রাসায়নিক উপায়ে সংরক্ষণ করে রাখতো। একে বলা হতো "মমি"। মমিকে সমাধিস্থ করে যে ত্রিভুজাকৃতি সমাধি সৌধ নির্মান করা হতো, তাকে বলা হতো "পিরামিড"।
মিশরে "ফ্যারাও" বা রাজা ও ধনী ব্যক্তিদের জন্যই পাথরের পিরামিড তৈরি করা হতো। মিশরের সবথেকে বড়ো পিরামিড হলো গিজার পিরামিড বা খুফুর পিরামিড। পিরামিড হলো পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি। মিশরের রাজধানী কায়রোর কাছে নীলনদের তীরে প্রায় ৪০ টি পিরামিড পাওয়া গেছে।
(আ.) সমাধি ইতিহাসের উপাদান হিসাবে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ?
(১.) সমাধি থেকে যে কোন সময়কালের মানুষের ধর্ম ও অতিন্দ্রীয় জগৎ (পরলোক) সম্পর্কে ধারনার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।
(২.) একই সভ্যতায় সমাধির তারতম্য ও ভিন্নতার ধরন থেকে ঐ সভ্যতার সমাজের শ্রেনী বৈষম্যের দিকটি সম্পর্কে জানতে পারা যায়। উদাহরন হিসাবে হরপ্পা সভ্যতার তিন ধরনের আলাদা আলাদা সমাধির কথা বলা যেতে পারে। হরপ্পার বৈষম্য মূলক সমাজের জন্যই তিনটি আলাদা শ্রেণির জন্য তিনটি পৃথক সমাধির রীতি ছিলো।
(৩.) সমাধিকে কেন্দ্র করে অনেক সময় বৃহৎ স্থাপনারও নির্মান করা হতো। উদাহরন হিসাবে মিশরের পিরামিডের কথা বলা যেতে পারে। প্রাচীন মিশরের বিজ্ঞান ও শিল্প সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপনা ছিলো পিরামিড। তাই শিল্প সংস্কৃতির ইতিহাস রচনায় সমাধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান বলে বিবেচিত হয়।
*********************************************
(অ.) ইতিহাসের উপাদান : ধর্মস্থান
(১.) সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের মনে জন্ম নিয়েছিলো অতিন্দ্রীয় চিন্তা ও জাদু বিদ্যা। মানুষ বিশ্বাস করতো এই লৌকিক জগতের বাইরেও আরেকটি পৃথক অতিন্দ্রীয় জগৎ আছে এবং সেই জগতের একজন অধিশ্বর আছেন। তিনি একাধারে যেমন অতিন্দ্রীয় জগতের প্রধান, তেমনই তিনি লৌকিক জগৎকেও নিয়ন্ত্রণ করেন।
(২.) এই আদিম বিশ্বাস থেকে পরবর্তীকালে পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন সভ্যতাতেই ধর্ম ও ঈশ্বরের জন্ম হয়েছিলো। ঈশ্বর বা ধর্মকে স্থাপন করার জন্য পৃথক ধর্মস্থান গড়ে তোলা হয়েছিলো। এই ধর্মস্থান গুলির ধ্বংসাবশেষও ইতিহাসের আকর উপাদান বলে বিবেচিত হয়।
(৩.) নব্য প্রস্তর যুগে ইংল্যান্ডের স্যালসবেরির উইল্টশায়ারে ডলমেন জাতীয় গোলাকার মন্দির পাওয়া গেছে, যেগুলিকে "স্টোনহেজ" বলা হয়। প্যালেস্টাইনের জেরিকোর মন্দিরগৃহ হলো প্রাগৈতিহাসিক যুগের সর্বপ্রাচীন ধর্মীয় ইমারত।
(৪.) প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার প্রত্যেক নগরে একটি করে মন্দির ছিলো। একে বলা হতো "জিগুরাত"। প্রাচীন আক্কাদীয় ভাষার "জাকারু" শব্দ থেকে "জিগুরাত" শব্দটির জন্ম হয়েছিলো।
- বৌদ্ধ ধর্মের ধর্মস্থানের অন্যতম স্থাপনা ছিলো - চৈত্য, স্তুপ ও বিহার।
- জৈন্ ধর্মের ধর্মীয় স্থাপনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো - রেখ দেউল মন্দির।
- মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনার অন্যতম বৈশিষ্ট্যের দিক হলো - গম্বুজ ও খিলানের ব্যবহার।
(আ.) ইতিহাসের উপাদান হিসাবে ধর্মস্থানের ধ্বংসাবশেষ কতখানি গুরুত্বপূর্ণ?
(অ.) ইতিহাসের উপাদান : স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ধ্বংসাবশেষ
(আ.) নব্য প্রস্তর যুগের স্থাপত্য
(ই.) ভারতে স্থাপত্য ও ভাস্কর্য ইতিহাসের উপাদান হিসাবে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ?
- সাহিত্যিক উপাদান থেকে জানা যায় পাটলিপুত্রে মৌর্যদের রাজধানী ছিলো। পরবর্তীকালে সাহিত্যিক উপাদানের ওপর ভর করে প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. ডি বি স্পুনার মৌর্য রাজ প্রাসাদের ৮৪ স্তম্ভ যুক্ত এক বিশাল রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন
- একই ভাবে বিহারে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বৌদ্ধ সাহিত্যে ও হিউয়েন সাঙের বিবরনীতে উল্লেখ ছিলো। স্পুনার ১৯১৭ খ্রিঃ নালন্দায় উৎখনন করে প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যের নিদর্শন আবিষ্কার করেন।
- হিউয়েন সাঙ তার ভ্রমন কাহিনী "সি ইউ কি" তে ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলে বৌদ্ধ বিহারের উপস্থিতির কথা লিখেছিলেন। পরবর্তীকালে তার বিবরনীর ওপর ভিত্তি করে খনন কার্য চালিয়ে বহু বৌদ্ধ স্তুপ ও বিহার আবিষ্কৃত হয়।
- প্রাচীন ভারতের সাহিত্যিক উপাদান গুলিতে বিভিন্ন নগরের উল্লেখ রয়েছে। তক্ষশিলা, সারনাথ, রাজগীর, পাটলিপুত্র ইত্যাদি বিভিন্ন নগরের অস্তিত্বের প্রমাণ ঐ নগর গুলির স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ থেকেই পাওয়া গেছে।