ইতিহাসের উপাদান : মৃৎশিল্প ও মৃৎপাত্র
(ক.) মৃৎশিল্প ও মৃৎপাত্র সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও পরিচয় :-
(১.) প্রাগৈতিহাসিক, প্রায় ঐতিহাসিক ও ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মৃৎশিল্প ও মৃৎপাত্র।
(২.) মানব সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে মৃৎপাত্র নির্মান ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত ছিলো। নব্য প্রস্তর যুগে আদিম মানুষ কৃষিকাজের জীবনে প্রবেশ করবার পরেই মৃৎপাত্র নির্মান শুরু করেছিলো।
(৩.) নব্য প্রস্তর যুগের শুরুতেই অবশ্য মৃৎশিল্পের বিকাশ ঘটে নি। গবেষকরা মৃৎশিল্প বিকাশের দুটি পর্যায়ের কথা বলেছেন। যথা - "প্রাক মৃৎশিল্প নব্য প্রস্তর - এ", এবং "প্রাক্ মৃৎশিল্প নব্য প্রস্তর - বি"। এই দুটি পর্যায় অতিক্রম করেই মৃৎশিল্পের যথার্থ বিকাশ ঘটে।
(৪.) কৃষিজ ফসল সংরক্ষণ করার তাগিদেই নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ মৃৎপাত্র তৈরি করে। এই সময় নদী তীরবর্তী এলাকায় কাদামাটি সহজলভ্য হওয়ায় তা দিয়ে মানুষ মৃৎপাত্র তৈরি করে।
(৪.) মৃৎপাত্র নির্মান ও ব্যবহারের সূচনা প্রথম মহিলাদের দ্বারাই হয়েছিলো বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। প্রথমে তারা কাদামাটি দিয়ে ছোটো ছোটো পাত্র তৈরি করেছিলো। পরে চাকার আবিষ্কার হওয়ায় মৃৎপাত্র নির্মানে দক্ষতা আসে। চাকার সাহায্যে একই মাপ ও আকার আয়োতনের মৃৎপাত্র তৈরি করা সম্ভব হয়। এছাড়া, চাকার ব্যবহার করে কম সময়ে অনেক বেশি মৃৎপাত্র নির্মান করাও সম্ভব হয়।
(৫.) মাটি দিয়ে হাঁড়ি, থালা, বাটি ইত্যাদি তৈরি করা হতো। শুধু তাই নয়, রান্নার উনুন, গহনা ও নানাবিধ অলংকার, শিশুদের খেলনা ইত্যাদিও নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ মাটি দিয়ে তৈরি করতো।
(৬.) ঐ সময় মৃৎপাত্রের গায়ে নানা নকশা আঁকা থাকতো। পাত্রের গায়ে অনেক জীব জন্তুর চিত্রও আঁকা থাকতো। মৃৎপাত্রে আদিম মানুষ নানা রঙের ব্যবহারও করতো। সাধারনত লাল ও কালো রঙ দিয়ে মৃৎপাত্র রাঙানো হতো। নব্য প্রস্তর যুগের শেষ দিকে মানুষ মাটির পাত্রে জ্যামিতিক নকশার ব্যবহার করতে শিখেছিলো।
(৭.) প্যালেস্টাইনের জেরিকো, ইরানের সিয়ালিক, ইরাকের জারমো ও গ্রিসের মূল ভূখন্ডে মাটির পাত্রে নানা রংয়ের ব্যবহার দেখা যায়।
(৮.) ভারতে নব্য প্রস্তর যুগের অনেক আগেই মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষ মাটির পাত্র তৈরি ও ব্যবহার করতো বলে জানা গেছে। মোরহানা পাহাড়ের পাদদেশ এবং মির্জাপুরের কাছে লেখনিয়া ও ভঘাইখোর থেকে এযুগের লাল রঙের মাটির অনেক পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে।
(খ.) মৃৎপাত্রের প্রাচীনত্ব নির্নয় কিভাবে করা হয়?
(১.) "থার্মোলুমিনিসেন্স পদ্ধতি" ব্যবহার করে মৃৎপাত্রের প্রাচীনত্ব নিরুপন করা হয়।
(২.) সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মৃৎপাত্রের রঙেও বদল আসে। মৃৎপাত্রের রঙ বিশ্লেষন করে এই পদ্ধতিতে মৃৎপাত্রের প্রাচীনত্বের নিরুপন করা হয়।
(গ.) মৃৎশিল্প ও মৃৎপাত্রকে কেন ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়?
(১.) মৃৎশিল্প থেকে মানব সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক গুলির বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়। মৃৎপাত্রের গায়ে নকশা, মাটির বিভিন্ন গহনা বা অলংকার ইত্যাদি দেখে যেকোন সময়কালের মানুষের সৌন্দর্যবোধ, নন্দন তত্ত্ব ও রুচিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়।
(২.) মৃৎপাত্রে নির্মিত শিশুদের খেলনা থেকে সেই সময়ের যানবাহন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। সুমেরের টেপ গাওয়াতে দু চাকা ও চার চাকার অনেক খেলনা পাওয়া গেছে। ৩০০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে এলাম, মেসোপটেমিয়া ও সিরিয়াতে চাকা গাড়ি ও যুদ্ধরথের প্রমান মাটির খেলনা থেকেই জানা গেছে। ভারতের হরপ্পা সভ্যতাতে যানবাহনের প্রমান ঐ সভ্যতায় প্রাপ্ত মাটির খেলনা গুলি থেকেই জানতে পারা গেছে।
(৩.) মৃৎশিল্পের নিদর্শন থেকে ধর্মীয় দিকেরও পরিচয় পাওয়া যায়। বালুচিস্তানের বেশ কয়েকটি স্থানে পোড়ামাটির মাতৃকা মূর্তি পাওয়া গেছে। বিহারের চিরান্দে পোড়ামাটির সাপের মূর্তি আবিষ্কার হয়েছে। এগুলি থেকে বোঝা যায়, নব্য প্রস্তর যুগের লোকেরা মাতৃকাদেবী ও সাপের পূজা করতো। অনুরূপ ভাবে হরপ্পা সভ্যতায় একাধিক মাটির নারী মূর্তি থেকেও জানা গেছে ঐ সভ্যতার লোকেরাও মাতৃ আরোধনা করতো।
(৪.) মৃৎপাত্রের রঙ বিশ্লেষন করে লৌহ যুগের আগমনের কথাও জানা যায়। ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ৩০০ টি জায়গায় চিত্রিত ধূসর বর্নের মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্রের ছাই রঙ থেকে অনুমান করা হয় ঐ সময়কালে উক্ত অঞ্চল গুলিতে লোহার ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল। ঐ সমস্ত অঞ্চলে লোহার প্রাপ্তি থেকে ঐতিহাসিকদের অনুমান সত্য প্রমাণিত হয়।
(৫.) মৃৎপাত্রের রঙ বিশ্লেষন করে কোন একটি সভ্যতার সময়কাল ও প্রাচীনত্বের ধারনাও খুব সহজে করা যায়।"থার্মোলুমিনিসেন্স পদ্ধতি" ব্যবহার করে মাটির পাত্রের প্রাচীনত্ব নিরুপন করা হয়।
(৬.) মৃৎপাত্রের আকার ও প্রকার প্রত্যেক সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যবোধের পরিচয় তুলে ধরে। মৃৎশিল্পের মূর্তি বিশ্লেষন করে সাজ পোশাক সম্পর্কে বহু তথ্য প্রমান পাওয়া যায়। ভারতের প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার পোশাকের রীতি ও ধরন ঐ যুগে প্রাপ্ত মাটির মূর্তি গুলি থেকেই জানা সম্ভব হয়েছে।
(৭.) মাথায় রাখতে হবে, প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার সিলমোহর গুলি পোড়া মাটি দিয়েই তৈরি করা হয়েছিলো। সুমেরীয় সভ্যতার কিউনিফর্ম লিপি কাদামাটির ওপরেই খোদাই করা হতো। কাদামাটির উপরেই পৃথিবীর প্রথম আইন সংহিতা হামুরাবির আইন সংহিতা লেখা হয়েছিলো। হরপ্পা ও মেহরগড় সভ্যতার সব কিছুই কাঁচা বা পোড়া মাটির ইঁট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিলো। সুতরাং প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসের উপাদানের গুরুত্ব হিসাবে মৃৎশিল্পকে কখনোই উপেক্ষা করা যায় না।
(৮.) সবচেয়ে বড়ো কথা, মানুষ উৎপাদনের জীবনে (কৃষিকাজ) প্রবেশ করার পরেই শস্য সংরক্ষণের জন্য মৃৎপাত্রের নির্মান করেছিলো। তাই কোন একটি সময়ে মৃৎপাত্রের প্রাপ্তি মানুষের জীবন যাত্রার পরিবর্তনের দিকটিকেও নির্দেশ করে। ভারতে বহু জায়গায় মধ্য প্রস্তর যুগের মৃৎপাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এটি থেকে বোঝা যায়, মধ্য প্রস্তর যুগেই এখানকার মানুষ কৃষিকাজ ও উৎপাদনের জীবনে প্রবেশ করেছিলো।
এইভাবে মৃৎপাত্র ও মৃৎশিল্প ইতিহাসের অনেক অজানা দিক ও সূত্রের সন্ধান দেয়। এজন্য মৃৎশিল্পকে ইতিহাসের উপাদান হিসাবে এত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।