ইতিহাসের উপাদান - লিপি
(I.) লিপি কাকে বলে?
(১.) প্রাচীন কালে রাজারা তাদের বক্তব্য প্রচারের জন্য পাহাড়ের গায়ে, প্রস্তর স্তম্ভে বা তাম্র ফলকে লেখমালা খোদাই করাতেন। এগুলিকেই বলা হয় "লিপি" বা "লেখ"।
(২.) ঐতিহাসিক যুগে অসংখ্য লিপি পৃথিবীর নানান সভ্যতার মানুষ ব্যবহার করতো।
(৩.) উৎকীর্নের ধরন অনুযায়ী লিপি গুলিকে নানা ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন -
- শিলালেখ (প্রস্তর খন্ডে লিখিত)
- স্তম্ভ লেখ (পাথরের স্তম্ভের গায়ে লিখিত)
- গুহালেখ (গুহাগাত্রে লিখিত)
- তাম্রলেখ (তামার ফলকে লিখিত)
- মন্দির গাত্র লেখ (মন্দিরের গায়ে লিখিত) ইত্যাদি।
(II.) কিভাবে লিপির উদ্ভব হয়?
(১.) আদিম মানুষ প্রথমে ছবি এঁকে তাদের মনের ভাব ও অভিব্যক্তি প্রকাশ করতো। দীর্ঘ বিবর্তনের পর অবশেষে এই ছবি থেকেই লিপি বা বর্নমালার জন্ম হয়।
(২.) ছবি বা চিত্র থেকে জন্ম হওয়ার কারনে পৃথিবীর প্রাচীনতম সমস্ত সভ্যতার লিপিই ছিলো চিত্রলিপি। প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা এবং ভারতের হরপ্পা সভ্যতার লিপি ছিলো চিত্র লিপি।
(III.) প্রাচীন সভ্যতার লিপি গুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় :-
(ক.) সুমেরীয়দের লিপি :-
নাম :- কিউনিফর্ম লিপি। এই লিপিকে কোনাক্ষর লিপি, কীলক লিপি বা বানমুখো লিপিও বলা হয়।
পাঠোদ্ধার :- ১৮২৩ খ্রিঃ জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ Friedrich Grotefend সর্বপ্রথম কিলক লিপির পাঠোদ্ধার করেন। পরবর্তীকালে হেনরি ক্রেসউইক রোলিনসন এই কাজকে আরোও এগিয়ে নিয়ে যান।
হামুরাবির আইন সংহিতা :- (১.) কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা "হামুরাবির আইন সংহিতা" ছিলো পৃথিবীর প্রথম লিখিত আইন সংহিতা।
(২.) প্রাচীন ব্যবিলন রাজ্যের শাসক হামুরাবি ১৭৫৫ - ১৭৫০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে এই আইন সংহিতা রচনা করেন।
(৩.) বর্তমানে এটি প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
(৪.) ২২৮ টি সূত্রাকারে লেখা এই আইন সংহিতা থেকে ব্যবিলনের সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ কথা জানা যায়।
(খ.) মিশরীয়দের লিপি :-
নাম :- হায়ারোগ্লিফিক লিপি।
(১.) মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিলো দেবতারা এই লিপির উদ্ভাবক ছিলেন। এজন্য একে পবিত্র লিপিও বলা হতো।
(২.) হায়ারোগ্লিফ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিলো দুটি গ্রিক শব্দ হায়রো (পবিত্র) এবং গ্লিফো (লিপি) শব্দ থেকে।
(৩.) সাধারনত মন্দিরের গায়ে বা কবরের গায়ে এই লিপি উৎকীর্ন করা হতো।
পাঠোদ্ধার :- ফরাসি পন্ডিত শাঁ পোলিয়েঁ ১৯২০ খ্রিঃ হায়ারোগ্লিফিক লিপির পাঠোদ্ধার করেন।
অন্যান্য লিপি :- (১.) হায়ারোগ্লিফিক লিপি জটিল আকার ধারন করলে মিশরে হায়রেটিক লিপির জন্ম হয়। মিশরের পুরোহিতরা এই লিপির উদ্ভাবক ও ব্যবহারকারী ছিলেন।
(২.) মিশরের সাধারণ মানুষদের লিপির নাম ছিলো ডিমোটিক লিপি।
(৩.) প্রাচীন মিশরীয়রা "প্যাপিরাস" বা শর জাতীয় গাছের ছালে লিখবার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলো। প্যাপিরাস থেকেই পেপার শব্দটির জন্ম হয়েছিলো।
(গ.) ভারতের লিপি :-
(i.) সিন্ধু লিপি :-
(১.) সিন্ধু লিপি ভারতের প্রাচীনতম লিপি হলেও তার পাঠোদ্ধার করা যায় নি।
(২.) সিন্ধু লিপির চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য ছিলো - চিত্র লিপি।
(ii.) সোহগোর লিপি :-
(১.) সোহাগর তাম্র লিপি ছিলো ভারতের প্রাচীনতম লিপি।
(২.) সিন্ধু সভ্যতার সিলমোহর গুলি লিপি কিনা তা নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেন। এজন্য অনেক ঐতিহাসিক সোহাগর তাম্রলিপিকে ভারতের প্রাচীনতম লিপি বলেন।
(৩.) অশোকের জন্মের প্রায় ৫০ বছর আগে এই লিপি উৎকীর্ন করা হয়েছিলো।
(iii.) অশোকের লেখ :-
(১.) ভারতে প্রথম পাঠোদ্ধার করা লিপির নাম ছিলো অশোকের শিলালেখ। জেমস প্রিন্সেপ ১৮৩৭ খ্রিঃ সর্বপ্রথম অশোকের লেখ পাঠোদ্ধার করেন।
(২.) অশোকের বেশিরভাগ লেখ ব্রাহ্মী লিপিতে ও প্রাকৃত ভাষায় উৎকীর্ন।
(৩.) তবে উত্তর পশ্চিম ভারতে গ্রীক, খরোষ্ঠী ও আরামাইক লিপিতে উৎকীর্ন লেখও পাওয়া গেছে।
(৪.) অবিভক্ত বাংলা, আসাম, তামিলনাড়ু, কেরল বাদে ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে অশোকের লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে।
(iv.) অশোক (মৌর্য) পরবর্তী যুগের লেখ :-
(১.) মৌর্য পরবর্তী যুগের লেখ গুলি অশোক প্রচারিত লেখ থেকে আলাদা। লেখ গুলি বেশির ভাগ লেখা হয়েছে প্রাকৃত ভাষায় এবং কিছু সংস্কৃত ভাষায়।
(২.) খ্রিঃ পূর্ব ২০০ থেকে ৩০০ খ্রিঃ পর্যন্ত শুঙ্গ, চেদি,শক, পহ্লব, কুষান, সাতবাহন এবং গুপ্ত যুগের বহু লেখ এই সময় পাওয়া গেছে।
(৩.) লেখগুলিকে (I.) সরকারি লেখ ও (II) বেসরকারি লেখ - এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
(I.) সরকারি লেখ :-
সরকারি লেখ গুলিকে (অ.) প্রশস্তি ও (আ.) ভূমিদান এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
(অ.) প্রশস্তি :-
প্রশস্তিসূচক লেখ গুলি রাজাদের প্রশংসা বা গুনকীর্তন করে লেখা হয়। এই ধরনের লেখের মধ্যে অন্যতম ছিলো -
- সমুদ্র গুপ্তের সভাকবি হরিষেনের লেখা - এলাহাবাদ প্রশস্তি, ( সংস্কৃত ভাষায় লেখা)
- চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশির সভাকবি রবিকীর্তির লেখা - আইহোল প্রশস্তি,
- গৌতমীপুত্র সাতকর্নীর - নাসিক প্রশস্তি,
- প্রতিহার রাজ ভোজের - গোয়ালিয়র প্রশস্তি,
- বিজয়সেনের - দেওপাড়া প্রশস্তি, (উমাপতিধর রচিত)
- কলিঙ্গরাজ খারবেলের - হাতিগুম্ফা লেখ, (প্রাকৃত ভাষায় লেখা)
- শক মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামনের - জুনাগড় লেখ ( সংস্কৃত ভাষায় লেখা)।
- গুপ্ত যুগের দামোদরপুর তাম্রশাসন,
- গৌড়রাজ শশাঙ্কের এগরা তাম্র শাসন,
- পাল রাজা দেব পালের মুঙ্গের তাম্র শাসন,
- পাল রাজা ধর্মপালের খলিমপুর তাম্র শাসন।
(II.) বেসরকারি লেখ :-
ভারত সম্পর্কিত বৈদেশিক লেখ :-
- এশিয়া মাইনরের আনাতোলিয়ায় প্রাপ্ত "বোঘাজকোই শিলালিপি",
- ইরানে প্রাপ্ত "তেল এল আর্মানা লেখ", "নকশ ই রুস্তম লেখ"।
(IV.) ইতিহাসের উপাদান হিসাবে লেখ কেন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান?
(৩.) কলিঙ্গরাজ খারবেল, গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত, দাক্ষিনাত্যের চালুক্যবংশীয় দ্বিতীয় পুলকেশী, তামিলনাড়ুর রাজেন্দ্রচোল, প্রভৃতি মহাপরাক্রান্তশালী রাজাদের সম্পর্কে ভারতের সাহিত্যিক উপাদানে কোন তথ্যই পাওয়া যায় না। একমাত্র শিলালেখ ও মুদ্রা থেকেই এদের কৃতিত্ব সম্পর্কে জানতে পারা যায়।
(৪.) লেখের প্রাপ্তি স্থান থেকে রাজ্য বা সাম্রাজ্যের আয়তন বা বিস্তৃতি, প্রাচীন অব্দের প্রচলন,(যেমন শকাব্দ, বিক্রমাব্দ প্রচলন) রাজাদের সিংহাসন আরোহনের সন ও তারিখ, রাজ্য শাসন পদ্ধতি, রাজার ধর্মীয় নীতি ও রাজ বংশের পরিচয়, ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য লেখ থেকে পাওয়া যায়।
(৫.) ভারতের মধ্যে বহু ভাষাভাষির দেশে বিভিন্ন ভাষা, লিপি ও বর্নমালার বিবর্তন একমাত্র প্রাচীন লেখমালা থেকেই জানা সম্ভব হয়।
ভারতের ইতিহাসে লেখের গুরুত্ব যে কি অপরিসীম তা এককথায় তুলে ধরা খুবই কঠিন। তাই ইতিহাসের উপাদান হিসাবে লেখমালার অপরিসীম গুরুত্বকে বোঝানোর জন্য ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকার লিখেছিলেন -
"আজ পর্যন্ত প্রাচীন ভারতের লুপ্ত ইতিহাস যতটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তার তিন চতুর্থাংশেরও বেশির জন্য আমরা সে যুগের লেখমালার কাছে ঋনী।"
(V.) ভারতের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লেখের নাম ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যদি :-
(১.) ভারতের বাইরে প্রাপ্ত "বোঘাজকোই লেখ" থেকে ইন্দ্র, বরুন, মিত্র প্রমুখ আর্য দেবতার নাম জানা যায়। এই লেখর ভিত্তিতে ঐতিহাসিকরা মনে করেন, আর্য জাতি এশিয়া মাইনর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলো।
(২.) "তেল এল আর্মানা" ও "নক্শ ই রুস্তম" শিলালেখ থেকে ভারতের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের কথা জানা যায়।
(৩.) অশোকের লেখ থেকে তাঁর রাজ্যসীমা, কলিঙ্গজয় ও তার প্রতিক্রিয়া, বৌদ্ধধর্মগ্রহন, ধম্মনীতি, মানুষ ও সমস্ত প্রানীদের প্রতি তার উদার দৃষ্টিভঙ্গী ও আদর্শের কথা জানা যায়। অশোকের ধর্মীয় লেখ গুলি থেকে বহু প্রশাসনিক তথ্য পাওয়া যায়।
(৪.) ওড়িশার উদয়গিরির হাতিগুম্ফা গুহায় প্রাপ্ত "হাতিগুম্ফা লেখ" থেকে কলিঙ্গরাজ খারবেলের কীর্তি কাহিনীর কথা জানা যায়। হাতিগুম্ফা ছিলো প্রাকৃত ভাষায় লেখা ১৭ লাইনের একটি প্রশস্তি লেখ, যা পাওয়া গিয়েছিল মহানদী অঞ্চলে।
(৫.) শক ক্ষত্রপ রুদ্রদামনের "জুনাগড় লেখ" থেকে সৌরাষ্ট্রের সুদর্শন হ্রদ নির্মানের কথা জানা যায়। গুজরাটে প্রাপ্ত জুনাগড় লেখটি সংস্কৃত ভাষায় গদ্যে লেখা হয়েছিলো।
(৬.) সাতবাহন রাজা প্রথম সাতকর্নীর রানি নাগনিকা "নানাঘাট লেখ" থেকে রাজসূয় ও দুটি অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা জানা যায়।
(৭.) সাতবাহন বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্নীর রাজত্বকাল সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে "নাসিক প্রশস্তি"।তাঁর মৃত্যুর ১৯ বছর পরে তাঁর মা গৌতমী বলশ্রী এই প্রশস্তি রচনা করেন। এই লেখ থেকে সাতকর্নীর যুদ্ধজয়, রাজ্যসীমা ও শাসনসংস্কার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।
(৮.) সমুদ্র গুপ্তের সভাকবি হরিষেনের "এলাহাবাদ প্রশস্তি" থেকে সমুদ্র গুপ্তের উত্তর ও দক্ষিণ ভারত বিজয়ের কথা জানা যায়। সংস্কৃত ভাষায় ৩৩ টি পঙতিতে আংশিক গদ্য ও পদ্যে এই লেখটি এলাহাবাদে অশোকের প্রস্তর স্তম্ভের গায়ে লেখা হয়েছিলো।
(৯.) দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের "উদয়গিরি ও সাঁচি লেখ" থেকে গুপ্ত যুগের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের নানা তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া, স্কন্দগুপ্তের "ভিতারি স্তম্ভ লেখ" থেকে গুপ্ত যুগে হুন আক্রমণের কথা জানা যায়।
(১০.) জৈন কবি রবিকীর্তি রচিত "আইহোল প্রশস্তি" থেকে দ্বিতীয় পুলকেশির রাজ্য বিস্তারের বিস্তৃত বিবরন পাওয়া যায়।
(১১.) "গোয়ালিয়র প্রশস্তি" থেকে প্রতিহার বংশীয় রাজা মিহির ভোজ এবং উমাপতি ধর রচিত "দেওপাড়া প্রশস্তি" থেকে বিজয় সেনের শাসনকাল সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।
(১২.) গঞ্জাম লেখ ও এগরা তাম্রশাসন থেকে বাংলার প্রথম সার্বভৌম রাজা শশাঙ্ক সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায়।
(১৩.) ধর্মপালের "খলিমপুর তাম্রশাসন" থেকে শশাঙ্কের মৃত্যুর পরবর্তীকালের বাংলার "মাৎস্যান্যায়" বা অরাজক অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়।
(১৪.) দেবপালের "নালন্দা তাম্রশাসন" থেকে পাল রাজাদের সঙ্গে যবদ্বীপ, সুমাত্রা ও মালয়েশিয়ার শৈলন্দ্র বংশীয় বৌদ্ধ রাজাদের বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্কের কথা জানা যায়।