ইতিহাসবোধ ও ইতিহাস চেতনা

 ইতিহাস পড়বার আগে ইতিহাসবোধ ও ইতিহাস চেতনা সম্পর্কে ধারনা থাকাটা খুবই দরকারি। যদিও ইতিহাস পাঠের পূর্ব অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই আছে। কারন এর আগে আমরা ইতিহাস পড়েছি। বিভিন্ন ক্লাসে ইতিহাস পড়বার মধ্য দিয়ে ইতিহাস বিষয়টির প্রতি একটি পৃথক ধারনা বা কনসেপ্ট আমাদের এমনিই তৈরি হয়ে গেছে। সেই কনসেপ্ট বা ধারনার কারনেই আমরা ইতিহাসকে অন্য কোন সাবজেক্টের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি না। 

ইতিহাসবোধ ও ইতিহাস চেতনা সম্পর্কে আলাদা করে আলোচনার হয়তো কোন দরকার ছিলো না। কিন্তু পরিবর্তনশীল জগতে ইতিহাস চেতনা ও ইতিহাসবোধেরও নিরন্তর পরিবর্তন ঘটে। 

 মাথায় রাখতে হবে অতীতে একেবারে শুরুর দিকের ইতিহাস রচয়িতারা ইতিহাসকে যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিলেন, বর্তমানে ইতিহাস লেখকরা কিন্তু ইতিহাসকে সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন না। ইতিহাসের জনক বলে আখ্যায়িত হেরোডোটাস এক সময় ইতিহাসকে দর্শনের এক শাখা বলে অভিহিত করেছিলেন। অনেকসময় ইতিহাসকে রাজনীতির আলোচ্য একটি সাবজেক্ট হিসাবেও দেখা হতো। কারন অতীতের রাজনীতির উত্থান পতনের নানা দিক গুলো ইতিহাসে খুব গভীর ভাবে আলোচনা ও বিশ্লেষন করা হয়। 

আধুনিক কালে ইতিহাস সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির আরোও বদল ঘটেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, আমাদের অতীতচর্চা কেন কেবল রাজনীতি আর রাজবংশের উত্থান পতনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? মানব সভ্যতার বিবর্তন ও ক্রমবিকাশকে অন্বেষন করাই ইতিহাসের প্রধান লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু হওয়া উচিত। আধুনিক কালে ঐতিহাসিকরা তাই ইতিহাসকে রাজনীতির কোন বিষয় বলে ভাবেন না। একে দর্শনের কোন শাখা বলেও মানতে চান না। তাদের মতে, ইতিহাস হলো "সমাজ বিজ্ঞানের" একটি শাখা। 

মানুষের সামাজিক বোধ গুলির বিকাশ এবং মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারাকে সঠিকভাবে বোঝা এবং তার সূত্র গুলিকে সুগভীর ভাবে অন্বেষন বা অনুসন্ধান করার নামই হলো ইতিহাস

এখানে মাথায় রাখতে হবে, ইতিহাস শব্দটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন একটি শব্দ। এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় "অর্থব বেদে"। সাধারণ অর্থে ইতিহাস বলতে আমরা বুঝি "অতীতের কথা" বা "প্রাচীন বৃত্তান্ত"। কিন্তু গ্রিক ঐতিহাসিক থুকিডিডিস বলেছিলেন, অতীতের সব ঘটনাই ইতিহাস নয়, কেবলমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই ইতিহাসের বিষয়বস্তু। 

যদিও সাম্প্রতিক কালে ঐতিহাসিকরা কোন কিছু বাদ না দিয়ে অতীতের সব ঘটনা ও দিক গুলিকে পরিপূর্ণ ভাবে জানা ও বোঝাকেই ইতিহাসের মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য এবং বিষয়বস্তু বলে উল্লেখ করে থাকেন। তাদের মতে, ইতিহাস চর্চার মূল উদ্দেশ্যই হওয়া উচিত "TOTAL HISTORY" কে জানা ও বোঝা। 

ইতিহাসবোধ ও ইতিহাস চেতনা
ইতিহাসবোধ ও ইতিহাস চেতনা 


(১.) ইতিহাস শব্দটির উৎপত্তিগত অর্থ :- 

ইতিহাস শব্দটি এসেছে সংস্কৃত "ইতি হ আস" শব্দ থেকে, যার অর্থ ঐতিহ্য বা পরম্পরা। ঐতিহ্য বা পরম্পরা বলতে বোঝায়, এমন প্রথা ও কথা, যা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত হয়ে চলেছে।

অন্যদিকে ইতিহাস শব্দটির ইংরেজি পরিভাষা হলো HISTORYইংরেজি HISTORY শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ Histor (যার অর্থ জ্ঞান) এবং গ্রীক শব্দ Historia থেকে।  গ্রীক Historia শব্দটির অর্থ হলো - অনুসন্ধান করা / গবেষণা করা / আবিষ্কার করা বা সত্যকে খুঁজে বের করা

মনে রাখতে হবে, ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়ে কিন্তু আমরা অতীতকে অনুসন্ধান করার চেষ্টাই করি। অতীতকালে কিভাবে মানুষের উৎপত্তি হলো? কেমন ছিলো সেই সময়ের মানুষদের জীবনযাত্রা ও বিনোদনের ধরন? অতীতকালে সংঘঠিত কোন একটি যুদ্ধ কেন হয়েছিলো? তার ফলাফলই বা কি হয়েছিলো, ইত্যাদি অতীতের বহুবিধ দিক গুলিকে অনুসন্ধান, গবেষনা এবং অতীতে প্রকৃত কি ঘটনা ঘটেছিলো সে সম্পর্কে প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধান করাই হলো ইতিহাসের মূল লক্ষ্য ও আলোচ্য বিষয়বস্তু। 

(২.) ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত :-

গ্রিস :-

অতীতে সর্বপ্রথম যথার্থ ইতিহাস লেখার সূত্রপাত ঘটে প্রাচীন গ্রিস দেশে। সেখানে গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস গ্রিক ও পারসিক যুদ্ধকে অবলম্বন করে প্রথম ইতিহাস লেখেন, যার নাম ছিলো - "Historia" । এখানে কালানুক্রমিক অনুযায়ী তিনি ঘটনাগুলিকে তুলে ধরেন। এজন্য রোমান পন্ডিত মার্কাস তুল্লিয়াস সিসেরো হেরোডোটাসকে "ইতিহাসের জনক" বলে অভিহিত করেন। 

হেরোডোটাসের পরবর্তীকালে "পেলোপনেসীয় যুদ্ধের ইতিহাস" রচনা করেন গ্রিক ঐতিহাসিক থুকিডিডিস। ইতিহাসের মূল বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখে ইতিহাস রচনায় তিনি সমালোচনামূলক পদ্ধতি সর্বপ্রথম প্রয়োগ করেন। এজন্য তাঁকে "বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের জনক" বলা হয়। 

চিন, আরব ও জার্মানি :- 

গ্রিসের পরবর্তীকালে চিন ও আরবে ইতিহাস চর্চার অভূতপূর্ব প্রসার ঘটেছিলো। আরবে ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে ইবন খালদুন যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এজন্য তাকে "আধুনিক ইতিহাস চর্চার জনক" বলে অভিহিত করা হয়। 

ঊনবিংশ শতাব্দীতে আধুনিক ইতিহাস চর্চার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিলো জার্মানিতে। সেখানে লিওপোল্ড ভন র্যাঙ্কে ও অন্যান্য ঐতিহাসিকরা ইতিহাস চর্চায় বিজ্ঞানসম্মত পথ দেখান। এইজন্য তাকে আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মত ইতিহাসের জনক বলা হয়। 

ভারত :- 

আমাদের দেশ ভারতবর্ষে ইংরেজরা আসবার পরেই যথার্থ অর্থে আধুনিক ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত ঘটে। ইংরেজরা ভারতবর্ষে বানিজ্য ও প্রশাসনিক কাজ চালানোর তাগিদে প্রাচ্য বিদ্যার চর্চা শুরু করেন। প্রাচ্য বিদ্যা চর্চার হাত ধরেই ভারতে আধুনিক ইতিহাস চর্চার বিকাশ ঘটতে শুরু করেছিলো। 

বর্তমানে আমরা স্কুল, কলেজে যে ইতিহাস পড়ছি, সেটা অনেকটাই ইউরোপীয় মডেল বা ছাঁচে ঢালা ইতিহাস। এজন্য এই ইতিহাস আমাদের অনেকের কাছেই বাস্তবের চাইতে অনেক বেশি কৃত্রিম ও নিরস বলে মনে হয়। 

(৩.) "ইতিহাস" সম্পর্কে প্রখ্যাত কয়েকজন ঐতিহাসিকদের উক্তি :- 

ইতিহাসকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন এবং সংজ্ঞায়িত করেছেন। সেইসব ঐতিহাসিকদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু উক্তি ছকের সাহায্যে তুলে ধরা হলো।

উক্তি নাম
১. ইতিহাস হলো দর্শনের এক শাখা। হেরোডোটাস
২. ইতিহাস হলো প্রকৃত অর্থেই বিজ্ঞান - তার বেশিও নয়, কমও নয়। জে বি বিউরি
৩. ইতিহাস হলো মানব সমাজের অতীতের কার্যাবলীর বিবরনী। রমেশচন্দ্র মজুমদার
৪. ইতিহাস হলো অন্য সকল বিষয়ের জননী। জে এম ট্রেভেলিয়ন
৫. অতীতের সকল ঘটনাই ইতিহাস নয়, কেবলমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই ইতিহাসের বিষয়বস্তু। থুকিডিডিস
৬. ইতিহাস হলো অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে অন্তহীন কথোপকথন। ই এইচ কার
৭. ইতিহাস হলো কালের সীমারেখায় আবদ্ধ মানুষের বিজ্ঞান ভিত্তিক কাহিনী। মার্ক ব্লখ
৮. আমি পুরাতত্ত্ববিদ নই, পুরাতাত্ত্বিক উপাদান খুঁজে বেড়ায় না। আমি ঐতিহাসিক জীবনের সন্ধান করি, জীবনকে ভালোবাসি। হেনরি পিরেন
৯. ইতিহাস হলো মানব মুক্তির ক্রমবিকাশের কাহিনী। লর্ড অ্যাকটন
১০. এটাও ইতিহাসের শিক্ষা যে, কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। উইলহেল্ম ফ্রেডারিখ হেগেল
                 

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-

১. ইতিহাস শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় - অথর্ব বেদে।

২. HISTORY শব্দটি এসেছে - ল্যাটিন শব্দ Histor এবং গ্রীক শব্দ Historia থেকে।

৩. Histor শব্দটির অর্থ হলো - জ্ঞান।

৪. Historia শব্দটির অর্থ হলো - অনুসন্ধান করা বা সত্যকে জানা।

৫. ইতিহাসের জনক হলেন - হেরোডোটাস।

৬. গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসকে ইতিহাসের জনক বলে অভিহিত করেন - রোমান রাষ্ট্রনীতিবিদ মার্কাস তুল্লিয়াস সিসেরো।

৭. Historia গ্রন্থটি লিখেছিলেন - গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস।

৮. গ্রীক ও পারসিক যুদ্ধের ঘটনাকে অবলম্বন করে লেখা হয়েছিলো - Historia গ্রন্থটি।

৯. বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের জনক বলা হয় - থুকিডিডিসকে।

১০. আধুনিক ইতিহাস চর্চার জনক ছিলেন - ইবন খালদুন।

১১. আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মত ইতিহাস চর্চার জনক বলা হয় - লিয়োপোল্ড ভন রেঙ্কে কে। 


ইতিহাস কাকে বলে সে সম্পর্কে আরোও বিস্তারিত ভাবে জানতে নিন্মলিখিত  লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন।

ইতিহাস কাকে বলে?

ডেক্সটপ সাইডে ওপেন করুন👇




Post a Comment (0)
Previous Post Next Post