মধ্যযুগে ভারতে আগত বিদেশী পর্যটকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আলবেরুনী। একাদশ শতাব্দীতে সুলতান মামুদের সঙ্গে আলবেরুনীও ভারতে আসেন এবং ভারত ভ্রমনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচনা করেন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ - "কিতাব - উল - হিন্দ" বা "তহকিক - ই - হিন্দ"।
আলবেরুনী ও তাঁর গ্রন্থ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে অবধারিত ভাবেই এসে যায় সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের প্রসঙ্গ। একটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে না মামুদের বারংবার ভারত অভিযানের সূত্রেই আলবেরুনী ভারতে আসার অনুকূল সুযোগ পেয়েছিলেন। তাই মামুদের ভারত আগমনের পূর্বে তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থাটি কেমন ছিলো সেটি আলোচনার গোড়াতেই তুলে ধরা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে আমরা মনে করি। মনে রাখতে হবে, ইতিহাসের সমস্ত ঘটনাই কার্য - কারন সম্বন্ধে আবদ্ধ। এটিকে উপেক্ষা করে বা এড়িয়ে গিয়ে কখনই ইতিহাসের কোন অংশের আলোচনা পূর্নতা লাভ করতে পারে না।
![]() |
আলবেরুনীর ভ্রমন বৃত্তান্ত |
(১.) আল - বেরুনীর ভারত আগমনকালে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা :-
ভারতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যখনই ভারতে কেন্দ্রীয় রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিলো বা তাতে ভাঙ্গন দেখা গিয়েছিলো, তখনই বারে বারে ভারতের মাটিতে বিদেশী আক্রমনকারীদের আগমন ঘটেছিলো। একাদশ শতকে গজনীর সুলতান মামুদের ভারত আক্রমনকালেও এই ঘটনার ব্যতিক্রম হয় নি।
মামুদ ও আলবেরুনীর ভারত আগমনের সমসাময়িক কালে (দশম থেকে দ্বাদশ শতকে) ভারতে কোন কেন্দ্রীয় শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থা ছিলো না। এই সময় শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থার বদলে ভারতবর্ষ বেশ কতকগুলি স্বাধীন ও আঞ্চলিক রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো।
মূলত ৬৪৭ খ্রিঃ কনৌজের অধিপতি হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর থেকে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হয় এবং উত্তর ভারত সহ সমগ্র ভারতবর্ষে এইসময় কতকগুলি ছোট ছোট আঞ্চলিক রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। এইসব আঞ্চলিক রাজ্য গুলিতে বিভিন্ন রাজবংশ শাসন করতো।
বলা বাহুল্য, এই সময় বিভিন্ন স্বাধীন আঞ্চলিক রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজপুত রাজবংশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। ভারতের বেশিরভাগ আঞ্চলিক রাজ্য গুলিতে তারাই শাসন করতেন। দশম থেকে দ্বাদশ শতকে এইসব আঞ্চলিক রাজ্য গুলির মধ্যে অন্যতম ছিলো -
(১.) পূর্ব ভারতে বাংলায় পাল ও সেন বংশের শাসন।
(২.) উত্তর ভারতে দিল্লি ও আজমিরে চৌহান বংশের শাসন, কনৌজে, অযোধ্যা ও বারানসী অঞ্চলে গাহড়বাল বংশের শাসন, কাশ্মীরে উৎপল ও লোহার বংশের শাসন।
(৩.) পশ্চিম ভারতে পাঞ্জাবে শাহীবংশ ও গুজরাটে চালুক্যবংশের শাসন।
(৪.) মধ্য ভারতে মালব বা উজ্জয়িনীতে পারমার বংশের শাসন, বুন্দেলখন্ডে চান্দেল্ল বংশের শাসন, মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুর ও জব্বলপুরে কলচুরিদের শাসন।
(৫.) দক্ষিণ ভারতে চোল, রাষ্ট্রকূট, চালুক্য, হোয়েসল, যাদব বংশের নেতৃত্বে একাধিক স্বাধীন রাজ্যের শাসন।
খুব সহজ করে ও সংক্ষেপে বলতে গেলে দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে একটি রাজবংশের নেতৃত্বে শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থার বদলে ভারতবর্ষ বিভিন্ন রাজবংশ শাসিত অসংখ্য পরস্পর বিরোধী আঞ্চলিক রাজ্যে বিভক্ত ছিলো। সেই সব রাজ্য গুলির মধ্যে কোন রাজনৈতিক ঐক্য বা সদ্ভাব ছিলো না। এই সময়ে দুটি ভারতীয় রাজ্যে বিদেশী শাসনও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এই রাজ্য দুটি ছিলো যথাক্রমে সিন্ধু ও মূলতান। এই রাজ্য দুটি (সিন্ধু ও মূলতান) আরবদের অধীনে ছিলো। সিন্ধু ও মূলতান ছাড়াও দক্ষিণ ভারতের মালাবার অঞ্চলেও আরব বনিকদের বেশ কয়েকটি উপনিবেশ গড়ে উঠেছিলো।
ভারতবর্ষের এই রাজনৈতিক অনৈক্য ও দুর্বলতার কালে ১০০০ খ্রিঃ থেকে ১০২৭ খ্রিঃ মধ্যে গজনীর সুলতান মামুদ ভারত লুন্ঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে মোট ১৭ বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। প্রত্যেক বারেই ভারতে আক্রমণ ও লুঠতরাজ চালিয়ে তিনি প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে গজনিতে ফিরে যান। ১০১৯ খ্রিঃ মামুদের ভারত আক্রমণের সময় মামুদের সঙ্গেই ভারত পরিভ্রমনে আসেন তাঁর অন্যতম সভাসদ আলবেরুনী।
![]() |
মামুদের সাম্রাজ্য ও ভারত আক্রমণ |
(২.) আলবেরুনীর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও পরিচয় :-
- আলবেরুনী কে ছিলেন? আলবেরুনী ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভূত একজন মুসলমান। একাদশ শতাব্দীতে ভারতে আগত আরব পর্যটকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন - আল বেরুনী। তিনি ছিলেন একাদশ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ার একজন অন্যতম জ্যোতির্বিদ, গনিতজ্ঞ, দার্শনিক, ভূগোলবিদ ও ঐতিহাসিক। অসাধারন পান্ডিত্যের জন্য আলবেরুনী খোয়ারিজম শাসকের উপদেষ্টার পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এছাড়া, আলবেরুনী মধ্যযুগের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম ভারততত্ত্ববিদও ছিলেন। প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আল বেরুনীকে "The first scientific Indologist" বলে অভিহিত করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে "ইসলামি জগতের কাছে ভারতীয় সভ্যতার একজন আদর্শ ভাষ্যকার" ছিলেন আল বেরুনী। আলবেরুনীই প্রথম পৃথিবীর ব্যাসার্ধ গণনার সূত্র আবিষ্কার করেন।
- সম্পূর্ন নাম/প্রকৃত নাম :- আলবেরুনীর সম্পূর্ণ নাম ছিল - "আবু রিহান মুহাম্মদ বিন আহমদ আল বিরুনী অল খরিজিমি" বা আবু রিহান। তবে ইওরোপে তিনি Ali Boran (আলি বোরান) নামেই অধিক পরিচিত।
- জন্ম :- ৯৭৩ খ্রিঃ মধ্য এশিয়ার খিবা বা খোয়ারিজম / খাওয়ারিজম প্রদেশে আল বেরুনীর জন্ম হয়। এটি বর্তমান উজবেকিস্তানের অন্তর্গত ছিলো। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, খোয়ারিজম প্রদেশের" "বিরুন" নামে এক জায়গায় আলবেরুনী জন্মগ্রহন করেন। এই বিরুন থেকেই তিনি বিরুনী বা আল বেরুনী নামে পরিচিতি লাভ করেন। আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ফার্সি শব্দ" বিরুনী"র অর্থ হলো বহিরাগত। আলবেরুনীরা ইরানি বংশোদ্ভূত বিদেশী ছিলেন বলে তাদের বিরুনী বলা হতো।
- খোয়ারিজম রাজ্যের পরিচয় :- বর্তমান তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তানের মধ্যবর্তী আমুদরিয়া নদীর ধারে অবস্থিত ছিলো খোয়ারিজম রাজ্য। এই রাজ্যটিকে শাসন করতো মামুনি রাজবংশ। তৎকালীন সময়ে জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিক্ষা চর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র খোয়ারিজম। এই রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিলো উরগঞ্জ। খোয়ারিজম রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দিলে এর সুযোগ নিয়ে পার্শ্ববর্তী গজনী রাজ্যের সুলতান মামুদ ১০১৭ খ্রিঃ খোয়ারিজম রাজ্য আক্রমণ করেন এবং এই রাজ্যটিকে গজনী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করেন। আলবেরুনী তাঁর জীবনের প্রথম ২৫ বছর খোয়ারিজমে কাটিয়ে ছিলেন।
- ভাষা সংক্রান্ত জ্ঞান :- আলবেরুনী বেশ কয়েকটি ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারতেন। এর মধ্যে ছিলো - মাতৃভাষা খোয়ারিজিমি, হিব্রু, সিরিয়ান, আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত। তবে আলবেরুনী গ্রীক ভাষা জানতেন না। গ্রীক ভাষা না জানলেও, আরবি অনুবাদের মধ্য দিয়ে তিনি বহু গ্রীক গ্রন্থ পাঠ করেছিলেন।
- মামুদের সঙ্গে সম্পর্ক :- গজনির সুলতান মামুদ ১০১৭ খ্রিঃ পার্শ্ববর্তী খোয়ারিজম রাজ্য আক্রমণের সময় বহু পন্ডিত সহ ৪৪ বছরের জ্ঞানী পুরুষ আল বেরুনীকেও বন্দী করে গজনীতে নিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে আল বেরুনী মামুদের অন্যতম প্রিয়পাত্রে পরিনত হন এবং তার রাজসভায় অন্যতম সভাসদ (রাজজ্যোতিষী) হিসাবে নিযুক্ত হন। গজনীতে থাকাকালীন সময়েই আলবেরুনী বিভিন্ন পন্ডিত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে এবং ভারতের জ্ঞান - বিজ্ঞানের নানা অনুবাদ গ্রন্থ পাঠ করে ভারত সম্পর্কে অত্যন্ত আগ্রহান্বিত হন এবং ভারতে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
- মামুদের সঙ্গে আলবেরুনীর ভারতে আগমন :- গজনীর সুলতান মামুদ ১০০০ খ্রিঃ থেকে ১০২৭ খ্রিঃ মধ্যে প্রায় ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন। মামুদের ভারত আক্রমণের সময় আল বেরুনী মামুদের সঙ্গে ১০১৯ খ্রিঃ ভারতে আসেন এবং ১০১৯ থেকে ১০২৯ খ্রিঃ পর্যন্ত প্রায় দশ বছর ভারতে থাকেন। এই সময় আলবেরুনী ভারতের পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিভ্রমন করেন এবং ভারতীয় ভাষা, জ্ঞান বিজ্ঞান ও সাহিত্য সম্পর্কে গভীর ভাবে অধ্যায়ন করেন। পাঞ্জাব গজনভি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলে আলবেরুনীকে ভারতে দশ বছর থাকার (১০১৯ - ১০২৯) নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো। এইসময় আলবেরুনী ভারতের সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে গভীরভাবে অধ্যায়ন করেন এবং এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে তাঁর ভ্রমন বৃত্তান্ত ("তহকিক - ই - হিন্দ") রচনা করেন।
- মৃত্যু :- সুলতান মামুদের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র আলবেরুনী দশ বছর থাকার পর শেষপর্যন্ত গজনীতে ফিরে যান। আলবেরুনীর ভারতে প্রত্যাবর্তনের পরে ১০৩১ খ্রিঃ সুলতান মামুদের মৃত্যু হয়, অন্যদিকে ১০৪৮ খ্রিঃ ৭০ বছর বয়সে গজনিতেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন আলবেরুনী।
(৩.) আল বেরুনীর গ্রন্থের পরিচয় :-
- লিখিত গ্রন্থের তালিকা :- আলবেরুনী সারা জীবনে ১৮০ টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে ৪০ টি গ্রন্থ পাওয়া গিয়েছে। আলবেরুনী বেশ কিছু সংস্কৃত গ্রন্থের যেমন আরবিতে অনুবাদ করেন (যেমন পতঞ্জলির ব্যাকরণ, সাংখ্যসূত্র, যোগসূত্র, বরাহমিহিরের বৃহৎ সংহিতা, লঘুজাতক, ব্রহ্মগুপ্তের ব্রহ্মফুট সিদ্ধান্ত ও খন্ডখাদ্যক ইত্যাদি) তেমনি অনেক গ্রীক ও আরবি গ্রন্থেরও সংস্কৃতে অনুবাদ করেন (যেমন ইউক্লিডের জ্যামিতি, টলেমীর "আলমা - গেস্ত)। এছাড়া গজনীতে সুলতান মামুদের সভাপন্ডিত হিসাবে প্রথমদিকে "আল - তানজিম" ও "আল - নজম" নামে বিজ্ঞান বিষয়ক দুটি গ্রন্থ তিনি রচনা করেন।
- "কিতাব - উল - হিন্দের" পরিচয় :- তবে যে গ্রন্থটি লিখে আল বেরুনী ভারত ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেন সেটি হলো - "কিতাব - উল - হিন্দ" বা তহকিক - ই - হিন্দ", যার বাংলা নাম হলো -" হিন্দুস্থান অনুসন্ধান"।
- আরবি ভাষায় লেখা "কিতাব উল হিন্দ" ৮০ টি অধ্যায়ে বিভক্ত একটি বিশাল গ্রন্থ ছিলো। ১০৩০ খ্রিঃ আলবেরুনী ভারত বিষয়ক এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। প্রাচীন ও তৎকালীন ভারতবর্ষের সাহিত্য, ধর্মগ্রন্থ ও জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা গ্রন্থ অধ্যায়ন করে ভারত ও ভারতীয়দের সম্পর্কে আল বেরুনীর যে ধারনা গড়ে উঠেছিলো, তার ভিত্তিতেই আল বেরুনী এই ভ্রমন বৃত্তান্ত রচনা করেন।
- একজন বৈদেশিক মুসলিম হিসাবে আল বেরুনীই সর্বপ্রথম "কিতাব - উল - হিন্দ" গ্রন্থের মধ্য দিয়ে ইসলামীয় জগতের কাছে ভারততত্ত্বকে (ভারতের দর্শন, সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জ্ঞান - বিজ্ঞান, ভাষা, মানসিকতা, অভ্যাস ও আচরনকে) তুলে ধরেন। এইজন্য আল বেরুনীকে "ইসলামি জগতের কাছে ভারতীয় সভ্যতার আদর্শ ভাষ্যকার" বলে অভিহিত করা হয়।
(৪.)" কিতাব - উল - হিন্দ" গ্রন্থের বিষয়বস্তু :-
- সাধারন হিন্দুদের সম্পর্কে ধ্যান ধারনার পর্যালোচনা,
- আল্লাহ সম্পর্কে হিন্দুদের বিশ্বাস,
- বোধগম্য ও অবোধগম্য দুই প্রকার পদার্থ সম্পর্কে হিন্দুদের বিশ্বাস,
- কর্মের কারন ও আত্মার প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক,
- আত্মার দশা ও পুনর্জন্মের দ্বারা জগত সংসারে তার আসা যাওয়া,
- বিভিন্ন লোক তথা স্বর্গ ও নরকে প্রতিফলের স্থান,
- ভব বন্ধন থেকে মুক্তির স্বরূপ ও সেই পর্যন্ত পৌঁছানোর পথ,
- প্রানীদের বিভিন্ন শ্রেনী ও তাদের নাম,
- জাতিসমূহ, যাদের বর্ন বলা হয় তাদের নিন্মতম শ্রেনী,
- হিন্দুদের ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নিয়মাবলীর মূল উৎস, তাদের একক আইন রদ,
- মূর্তিপূজার উদ্ভব ও ভিন্ন ভিন্ন মূর্তির বর্ননা,
- বেদ, পুরান ও অন্যান্য শ্রেনীর দেশীয় সাহিত্য,
- হিন্দুদের ব্যাকরন ও ছন্দশাস্ত্র সম্পর্কিত গ্রন্থ,
- গনিত - জ্যোতিষ, ফলিত জ্যোতিষ ও অন্য শাস্ত্র সম্পর্কিত হিন্দুদের সাহিত্য,
- ভারতীয় পরিমাপ বিদ্যার বিবরন,
- হিন্দুদের লিখন সামগ্রী ও বহু বিচিত্র রীতি রেওয়াজের বিবরন,
- হিন্দুদের শাস্ত্র সমূহ, যাতে সাধারনভাবে অজ্ঞানতার প্রশ্রয় পাওয়া যায়,
- তাদের দেশ, নদনদী, সাগর, মহাসাগর, বিভিন্ন রাজ্য ও দেশের সীমানা থেকে তাদের দূরত্বের বিবরন,
- গ্রহসমূহের নাম, রাশি, চাঁদ ও নক্ষত্র সম্পর্কিত বিষয়,
- ব্রহ্মান্ড,
- হিন্দুদের ধর্মীয় ধ্যান ধারনা অনুসারে আকাশ ও পৃথিবীর বর্ননা,
- ধ্রুবতারা সম্পর্কিত ধ্যান ধারনা,
- পুরান ও অন্যান্য গ্রন্থের রচয়িতাদের বিশ্বাস অনুসারে মেরু পর্বতের বর্ননা,
- সাতটি দ্বীপ সম্পর্কে পৌরাণিক ধ্যান ধারনা,
- ভারতের নদনদী, তার উৎস ও গতিপথ,
- হিন্দু জ্যোর্তিবিজ্ঞানীদের মতে আকাশ ও পৃথিবীর আকার,
- জ্যোতির্বিদ ও পুরান রচয়িতাদের মতবাদ,
- দশটি দিকের পরিভাষা,
- হিন্দুদের মতে বাসযোগ্য পৃথিবীর পরিভাষা,
- লঙ্কা বা পৃথিবীর গম্বুজ,
- দ্রাঘিমাগত প্রভেদ অনুসারে বিভিন্ন দেশের পার্থক্য,
- সাধারনভাবে কাল ও স্থিতিকাল সম্পর্কিত ধারনা ও জগতের সৃষ্টি ও বিনাশ,
- দিন বা রাত্রির বিভিন্ন প্রকার ও তার পরিচয়,
- অহর্নিশের সময়কে লঘু কনায় বিভাজন,
- বিভিন্ন প্রকারের মাস ও বর্ষ,
- সাময়ের চারটি মাপ,
- মাস ও বর্ষ ভাগ,
- সময়ের বিভিন্ন পরিমান যাতে দিবস ও ব্রহ্মার আয়ুও অন্তর্ভূক্ত,
- সময় - পরিমান, যা ব্রহ্মার আয়ুর চেয়েও বড়ো,
- সন্ধি, দুই কালান্তরের মধ্যে ব্যবহার ও সংযোগ,
- কল্প, চর্তুযুগ ইত্যাদি শব্দাবলীর পরিভাষা ও একের দ্বারা অন্যের ব্যাখ্যা,
- চতুর্যুগকে যুগে বিভক্তিকরন ও যুগ সম্পর্কে বিভিন্ন মত,
- চার যুগের অন্তে সংঘঠিত বিভিন্ন ঘটনা,
- মন্বন্তর,
- সপ্তর্ষির তারামন্ডল,
- নারায়ন, বিভিন্ন যুগে অবতরন ও তার নাম,
- বাসুদেব ও ভারত যুদ্ধ,
- অক্ষৌহিনীর পরিমান সম্পর্কিত ব্যাখ্যা,
- সংবতের সংক্ষিপ্ত বিবরন,
- এক কল্প ও এক চতুর্যুগে কতটা তারা চক্র হয়,
- অধিমাস, ঊনরাত্রি ও অহর্গন শব্দসমূহের ব্যাখ্যা,
- সাধারনভাবে অহর্গনের হিসাব এবং বছরের ও মাসের দিনে রূপান্তর ও তার বিপরীত পদ্ধতি,
- কালের কতিপয় তিথি বা পঞ্জিকা,
- নক্ষত্র পুঞ্জের মাধ্যস্থানসমূহের বর্ননা,
- নক্ষত্র পুঞ্জের ক্রম, সে সবের দূরত্ব ও আয়তন,
- চন্দ্রের বিভিন্ন কক্ষ,
- সূর্য উদয়ে হিন্দুদের বিভিন্ন সংস্কার ও অনুষ্ঠান,
- সমুদ্রে জোয়ার ভাটা কীভাবে আসে,
- সূর্য ও চন্দ্রগ্রহন,
- পর্বন,
- ধর্ম ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সময়ের অধিষ্ঠাতা ও আনুষঙ্গিক বিষয়,
- সংবৎসর বা ষষ্টাব্দ প্রসঙ্গ,
- এমন বিষয় সমূহ যা বিশেষ ভাবে ব্রাহ্মনদের সঙ্গে সম্পর্কিত,
- ধার্মিক কৃত্য ও রীতি রেওয়াজ,
- যজ্ঞ,
- তীর্থস্থান ও তীর্থযাত্রা,
- দান, অর্থোপার্জন ও ব্যায়ের বিধিমালা,
- পানাহার সম্পর্কিত বিধিনিষেধ,
- বিবাহ, রজঃস্রাব, ভ্রুন এবং সন্তান প্রসব,
- মামলা মোকদ্দমা,
- দন্ডবিধান ও প্রায়শ্চিত্ত,
- উত্তরাধিকার ও মৃতের অধিকার,
- জীবিত ও মৃত লোকেদের সঙ্গে ব্যবহার,
- বিভিন্ন প্রকারের ব্রত,
- ব্রতের দিন গুলির নির্ধারন,
- ব্রত ও আমোদ প্রমোদের দিন,
- পুন্যদিবস ও শুভ সময়,
- করন,
- যোগ,
- হিন্দু ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্রের মূল সিদ্ধান্ত ও ফলিত জ্যোতিষ সম্পর্কিত তাদের গননা পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
(৫.) ভারত সম্পর্কে আল বেরুনীর অভিমত :-
- (১.) হিন্দুদের মানসিকতা :- আলবেরুনী হিন্দুদের মানসিকতা বিশ্লেষন করে বলেন - হিন্দুরা অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং অহংকারী প্রকৃতির। তারা সবদিক থেকেই নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। হিন্দুদের এরকম মানসিকতার প্রধান কারণ ছিলো পৃথিবীর অন্য কোন দেশের সঙ্গে তাদের কোন যোগাযোগ ছিলো না।
- (২.) হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস :- হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে একেশ্বরবাদের ধারনা থাকলেও, অধিকাংশ হিন্দুরাই বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করে তা মন্দিরে স্থাপন করে পুজা করতো। হিন্দুরা পরমাত্মা, জীবাত্মা, কর্মফল ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী ছিলো। হিন্দুরা জগৎকে "লোক" নামে অভিহিত করতো। তাদের মতে, এই লোক ছিলো তিনটি। হিন্দুরা বিভিন্ন দেবতার নামে উপবাস করতো। এক মধ্যাহ্ন থেকে পরের দিনের মধ্যাহ্ন পর্যন্ত এরা উপবাস করতো, যা "একনগু" নামে পরিচিত ছিলো। আবার পূর্নিমার দিনের উপবাসকে "চন্দ্রায়ন" বলা হতো। হিন্দুদের বিশ্বাস ছিলো ১২ মাসে ১২ টি সূর্যের উদয় হয়।
- (৩.) হিন্দুদের পালনীয় কর্তব্য :- আলবেরুনীর মতে, হিন্দুদের পালনীয় কর্তব্য ছিলো নয়টি। এগুলি হল - প্রানীহত্যা না করা, মিথ্যা কথা না বলা, চুরিজোচ্চুরি না করা, ধনসম্পদ ও ঐশ্বর্যের প্রতি লোভ না করা, সর্বদা শুচিতা ও পবিত্রতা বজায় রাখা, পোশাক পরিচ্ছদে সরলতা ও দীনতা বজায় রাখা, সর্বদা ঈশ্বরে আস্থা রাখা ও ওম শব্দকে অন্তরে স্থান দেওয়া, চারিত্রিক শুদ্ধতা বজায় রাখা, শাস্ত্রানুয়ায়ী উপবাস করা। আলবেরুনীর মতে, হিন্দুরা তাদের প্রাত্যহিক ও সামাজিক জীবনে নৈতিকতার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করতো।
- (৪.) হিন্দুদের বর্ন ও জাতি ব্যবস্থা :- হিন্দুরা ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র - এই চারটি বর্নে বিভক্ত ছিলো। এর বাইরে ছিলো নানা অন্ত্যজ শ্রেনী (ধোপা, মুচি, মেথর, মাঝি, জেলে)। সমাজে সব দিক থেকেই ব্রাহ্মনরা বিশেষ সুবিধা ভোগ করতো। অন্যদিকে শূদ্র, অন্ত্যজ ও নারীরা নানা সামাজিক শোষন ও অবিচারের শিকার হতেন। তারা সমাজে অবহেলিত ছিলেন।
- (৫.) হিন্দুদের অনৈক্য :- হিন্দুদের মধ্যে যেমন সামাজিক ঐক্য ছিলো না। তেমনি কোন রাজনৈতিক ঐক্যও ছিলো না। তৎকালীন সময়ে সারা ভারতবর্ষ অসংখ্য ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিলো। এরকম কয়েকটি রাজ্য ছিলো - মালব, সিন্ধু, কনৌজ, কাশ্মীর। রাজন্যবর্গ সর্বদাই আত্মকলহে লিপ্ত থাকতেন।
- (৬.) হিন্দুদের বিবাহ পদ্ধতি :- আলবেরুনী বলেছেন, হিন্দুদের খুব কম বয়সে বিবাহ হতো। বিবাহ বিচ্ছেদ সমাজে প্রচলিত ছিলো না। সমাজে সতীদাহপ্রথা ও চতুরাশ্রম প্রথার প্রচলন ছিলো। পুরুষেরা চারটি বিবাহ করার অনুমতি পেতো। চারজন স্ত্রীর মধ্যে কারো মৃত্যু হলে তারা অধিক বিবাহও করতে পারতো। তবে স্বামীর মৃত্যু হলে কোনো স্ত্রী দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারতো না। তাকে হয় বিধবা থাকতে হতো, নাহয় সহমরনে জীবন ত্যাগ করতে হতো।
- (৭.) হিন্দুদের জীবিকা ও অর্থনীতি :- আলবেরুনীর লেখা থেকে জানা যায়, তৎকালীন সময়ে ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষের প্রধান জীবিকা ছিলো কৃষিকাজ। কৃষিকাজের পাশাপাশি অবসর সময়ে ভারতীয়রা নানা কুটির শিল্পে নিয়োজিত হতেন। সরকারি আয়ের প্রধান উৎস ছিলো ভূমিরাজস্ব। উৎপন্ন ফসলের ১/৬ অংশ কৃষকদের কাছ থেকে ভূমিরাজস্ব আদায় করা হতো। ব্রাহ্মনদের দেশে কোনপ্রকার করই দিতে হতো না।
- (৮.) হিন্দুদের বিচার ব্যবস্থা :- তৎকালীন ভারতবর্ষের বিচার ব্যবস্থা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আলবেরুনী লিখেছেন, বিচার পেতে গেলে অভিযুক্তর বিরুদ্ধে প্রমান দিতে হতো। সে সময়ে ফৌজদারি আইন খুব বেশি কঠোর ছিলো না। গুরুতর অপরাধে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলেও, ব্রাহ্মনদের তা দেওয়া হতো না।
- (৯.) হিন্দুদের লিখন পদ্ধতি :- আলবেরুনী হিন্দুদের লিখন পদ্ধতি সম্পর্কে বলেছেন, উত্তর ও মধ্য ভারতের পন্ডিতরা লেখার ক্ষেত্রে গাছের ছাল ব্যবহার করতেন, যাকে "ভুর্জ" বলা হতো। অন্যদিকে দক্ষিন ভারতের লোকেরা লেখার ক্ষেত্রে তালপাতার ব্যবহার করতেন। ভারতীয়রা বইকে কাপড় দিয়ে মুড়ে রাখতেন, যাকে পুথি বলা হতো। হিন্দু গ্রন্থগুলির শুরুতেই ওম লেখা থাকতো। গ্রিকদের মতো হিন্দুরা বাম দিক থেকে শুরু করে ডান দিকে লিখতো, আরবি লেখার ক্ষেত্রে যা এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলো। আলবেরুনীর মতে, সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা ছিলো খুবই কঠিন একটি কাজ। হিন্দুরা লেখার ক্ষেত্রে কখনই চামড়ার ব্যবহার করতো না।
- (১০.) হিন্দুদের জ্ঞান - বিজ্ঞান ও ইতিহাস বোধ :- আলবেরুনী হিন্দু দর্শন ও বিজ্ঞানের বিষয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেছিলেন। তিনি দর্শন ও গনিতশাস্ত্রে হিন্দুদের পারদর্শিতার কথা তুলে ধরেছিলেন। তাঁর মতে, হিন্দুদের সংখ্যার গননা এক হাজারেরও বেশি। হিন্দুরা ধারাবাহিকতার আঠারো ধাপ পর্যন্ত গননা করতে পারতো। এগুলি হল - একম, দশম, শতম, সহস্রম, অযুত, লক্ষ, প্রযুত, কোটি, ন্যার্বুদ, পদ্ম, খর্ব, নিখর্ব, মহাপদ্ম, শঙ্কু, সমুদ্র, মধ্য, অন্ত্য, পরার্ধ। হিন্দুদের উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতির উল্লেখ করতে গিয়ে আলবেরুনী চরকসংহিতা ও সুশ্রুতসংহিতার কথা তুলে ধরেন। হিন্দুদের সাহিত্য ও জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রভূত প্রশংসা করলেও, আলবেরুনীর মতে, হিন্দুদের ইতিহাসবোধ নেই। তার মতে, ইতিহাস বাদে ভারতে সব আছে। তারা সাল, তারিখ ও ঘটনার পরম্পরা সম্পর্কে সম্পূর্ন উদাসীন ছিলো।হিন্দুদের সময়ের ধারনার সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য জাতিদের কোন মিল ছিলো না। হিন্দুরা সত্য, দ্বাপর, ত্রেতা ও কলি এই চার যুগের ধারনায় বিশ্বাসী ছিলো।
- (১১.) মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের মনোভাব :- হিন্দু - মুসলমান সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে আলবেরুনী লেখেন, ভারতীয় হিন্দুরা মুসলমানদের ম্লেচ্ছ বলে ঘৃনা করতো। মুসলমানদের সঙ্গে তাদের ধর্মগত ও ভাষাগত প্রভেদ ছিলো। হিন্দুরা মুসলমানদের সঙ্গে বিবাহ সহ সমস্ত সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনকেই অপবিত্র বলে মনে করতো। মুসলমানদের ছোঁয়া জল ও আগুন হিন্দুরা গ্রহন করতো না।
- (১২.) রাজনৈতিক তথ্য :- আলবেরুনীর গ্রন্থ থেকে সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনার কিছু তথ্যও পাওয়া যায়। আলবেরুনী পাঞ্জাবের শাহী বংশ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন। আলবেরুনীর বিবরন থেকে জানা যায়, পাঞ্জাবের শাহি বংশীয় নরপতি জয়পাল, আনন্দপাল, ত্রিলোচনপাল মামুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শেষপর্যন্ত পরাজিত হন। এছাড়া, মামুদের সোমনাথ মন্দির লুন্ঠনের বিস্তৃত বর্ননাও আলবেরুনীর গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার তাঁর "The Early India" গ্রন্থে লিখেছেন সোমনাথ মন্দির সম্পর্কিত অন্যান্য তথ্যকারদের থেকে আলবেরুনীর বিবরন সর্বাপেক্ষা যথাযথ। আলবেরুনী ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্যের কথাও তুলে ধরেছেন।
- (১৩.) হিন্দুদের অদ্ভুত আচরন ও প্রথা :- হিন্দুদের মধ্যে কিছু বিচিত্র সামাজিক রেওয়াজের কথা বলতে গিয়ে আলবেরুনী লিখেছেন, হিন্দুরা শরীরের কোন অংশের কেশ মুন্ডন করতো না। তারা বিশ্বাস করতো কেশ মুন্ডন করলে শরীরে কাম প্রবৃত্তির জাগরন ঘটৈ। গরমকালে তারা উদোম হয়ে চলাফেরা করতো। এমনকি তারা হাতের নখও কাটতো না। জাতি বা বর্ন অনুয়ায়ী তারা আলাদা আলাদা বসে খাবার খায়। বাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখতে এবং শুদ্ধিকরনের জন্য হিন্দুরা গোমূত্র ও গোবর ব্যবহার করতো। তারা জেলে, নাপিত ও মুচিকে ম্লেচ্ছ বলে মনে করতো।
- (১৪.) হিন্দুদের সংস্কৃতির ধারনা :- ভারতীয়দের শতরঞ্জ বা দাবা খেলা, বিভিন্ন দিন ও মাসের পরিচয়, নদনদীর পরিচয়, পৃথিবী ও গ্রহ নক্ষত্রের আকার সম্পর্কে হিন্দুদের ধারনা ও আবিষ্কার, হিন্দুদের দশদিক, সত্য, দ্বাপর, ত্রেতা ও কলিযুগের বৈশিষ্ট্য ও পরিচয়, হিন্দুদের দ্রাঘিমা নির্ধারন করার পদ্ধতি, নারায়ন বা বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার, শকাব্দ, বিক্রমাব্দ ইত্যাদি ক্যালেন্ডারের বর্ননা, বিভিন্ন জাতির কর্তব্যকর্ম ও কাজ, খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে হিন্দুদের সংস্কার ও নিষেধাজ্ঞা, বিবাহের প্রকারভেদ, হিন্দুদের বিভিন্ন আইনের পরিচয়, মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের নিয়ম, হিন্দুদের বিভিন্ন বারব্রত, উপবাস, অমাবস্যা, পূর্নিমা, সংক্রান্তি উদযাপন ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আলবেরুনী তার গ্রন্থে তুলে ধরেছেন।
- (১৫.) হিন্দুদের সৎকার পদ্ধতি :- আলবেরুনী লিখেছেন, কারো মৃত্যু হলে হিন্দুরা পারিবারিক ভাবে একবছর শোক পালন করে থাকে। হিন্দুরা প্রথমে মৃতদেহকে খোলা বাতাসে রেখে দিতো। পরে বাসুদেব নারায়ন হিন্দুদের মৃতদেহকে অগ্নিতে দগ্ধ করার বিধান দেন। হিন্দুদের বিশ্বাস ছিলো, অগ্নিদগ্ধ ধোঁয়া খুব দ্রুত উপরে উঠে মৃতের আত্মাকে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে দেবে। তবে তিনবছরের কমবয়সী শিশুদের মৃতদেহ অগ্নিতে দগ্ধ করার বিধান ছিলো না। তাদের সমাধিস্থ করা হতো।