ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা ছিলো - "টেনিস কোর্টের শপথ"।
![]() |
টেনিস কোর্টের শপথ |
(১.) প্রেক্ষাপট :-
(ক.) স্টেটস জেনারেল নিয়ে তৃতীয় সম্প্রদায়ের ক্ষোভ :-
তীব্র অর্থসংকটে পড়ে এবং অভিজাত বিদ্রোহের চাপে বুরবোঁ রাজা ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হন। দীর্ঘ ১৭৫ বছর পরে ১৭৮৯ খ্রিঃ ৫ ই মে ভার্সাই নগরীতে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন বসেছিলো।
স্টেটস জেনারেলের প্রথম অধিবেশনে সকল সদস্যের উপস্থিতিতে রাজা সংক্ষিপ্তভাবে উদ্বোধনী ভাষন দিয়েছিলেন। কিন্তু কিভাবে অধিবেশন চলবে তার কোন স্পষ্ট নির্দেশ রাজার বক্তৃতার মধ্যে ছিলো না। অধিবেশন একসঙ্গে হবে না শ্রেনীগত ভাবে আলাদা ভাবে হবে তার কোন স্পষ্ট নির্দেশ রাজা দেন নি।
পুরাতন নিয়ম অনুযায়ী স্টেটস জেনারেলে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা পৃথক পৃথক কক্ষে বসতেন। ভোটদান পদ্ধতি ছিলো সম্প্রদায় ভিত্তিক, অর্থাৎ যাজক, অভিজাত ও তৃতীয় শ্রেনীর সম্মিলিত ভোট ছিলো একটি করে মোট তিনটি। স্টেটস জেনারেলে কোন প্রস্তাবের পক্ষে দুটি শ্রেণির সম্মিলিত ভোটের সিদ্ধান্তকেই সরকারি ভাবে গ্রহন করা হতো। অভিজাত ও যাজকদের শ্রেনীস্বার্থ সর্বদা একই হওয়ায় স্টেটস জেনারেলে তৃতীয় শ্রেণীর দাবি সর্বাদাই উপেক্ষিত হতো।
এমতাবস্থায়, স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ও ভোটদান পদ্ধতি নিয়ে প্রথম থেকেই তৃতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিলো। স্টেটস জেনারেলের প্রথম অধিবেশনে উদ্বোধনী ভাষনের শেষে রাজা সভাস্থল ত্যাগ করলে যাজক ও অভিজাত শ্রেনী যে যার কক্ষে চলে গিয়েছিলেন।
পরদিন সভার কাজ শুরু হলে তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিরা যৌথ অধিবেশন ও মাথাপিছু ভোটের দাবি তোলেন। কিন্তু যাজক ও অভিজাতরা তৃতীয় শ্রেণির দাবিতে রাজি হননি, অন্যদিকে রাজাও কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি। ফলে স্টেটস জেনারেলে মাসাধিককাল ধরে অচলাবস্থা চলে।
(খ.) নিজেদের কক্ষকে "জাতীয় সভা" রূপে ঘোষনা :-
শেষপর্যন্ত তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা অপর দুই শ্রেণির প্রতিনিধিদের চূড়ান্ত ভাবে জানিয়ে দেয়, তারা একত্রে অধিবেশনে বসতে রাজী না হলে তাদের বাদ দিয়েই তৃতীয় শ্রেনী জাতির প্রতিনিধিসভা হিসাবে কাজ আরম্ভ করবে। এইসময় তৃতীয় সম্প্রদায় নিজেদের স্বপক্ষে শক্তিশালী জনমত গঠনে উদ্যোগী হন। আবে সিয়েস "What is the Third Estate?" - গ্রন্থ প্রকাশ করে তৃতীয় সম্প্রদায়ের স্বরূপ তুলে ধরে তাদেরকেই আসল ফরাসি জাতি বলে তুলে ধরেন। তাঁর মতে, অভিজাত ও যাজকরা ছিলো মোট জনসংখ্যার ভগ্নাংশ মাত্র।
তৃতীয় সম্প্রদায়ের বৌদ্ধিক প্রচারে প্রভাবিত হয়ে এইসময় উদারপন্থী অভিজাত ও যাজকদের কিছু অংশ তৃতীয় শ্রেনীকে সমর্থন করলে তৃতীয় শ্রেনীর শক্তি বৃদ্ধি পায়। কন্দরসে, তালেরাঁ, মিরাবো, লাফায়েত, আবেসিয়েস প্রমুখ উদারপন্থী অভিজাতরা তৃতীয় সম্প্রদায়ে যোগ দিলে এই সম্প্রদায় আরোও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলো। এই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ১৭৮৯ খ্রিঃ ১৭ ই জুন, তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা রাজার অনুমতি না নিয়েই তাদের সভাকে "জাতীয় সভা" বা "ন্যাশনাল এসেম্বলী" বলে ঘোষনা করেন। এই ঘোষনার সাথে সাথেই তারা জানিয়ে দেয়, জাতীয় সভার অনুমতি ছাড়া রাজা কোন কর আদায় করতে পারবেন না। বেইলীকে জাতীয় সভার সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
তৃতীয় সম্প্রদায়ের নিজেদের সভাকে জাতীয় সভা হিসাবে ঘোষনা ছিলো একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। এই ঘোষনার মাধ্যমে একদিকে তৃতীয় সম্প্রদায় (ক.) রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতা ও যাজক - অভিজাতদের সুবিধাবাদের বিরোধিতা করেছিলো, অন্যদিকে (খ.) তৃতীয় সম্প্রদায় যে আসল জাতি এবং তাদের সভাই যে জাতীয় সার্বভৌমত্বের মূল উৎস, তারও ঈঙ্গিত দিয়েছিলো।
(গ.) জাতীয় সভার অধিবেশন কক্ষে তালা :-
এইসময় প্যারিসের অবস্থা ছিলো ছিলো অগ্নিগর্ভ। খাদ্যাভাব ও বেকারত্ব জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো। এই অবস্থায় স্টেটস জেনারেলে তৃতীয় সম্প্রদায়ের বিদ্রোহী আচরনকে রাজার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলো না। রাজা তৃতীয় সম্প্রদায়ের বিদ্রোহকে দমন করার জন্য তৃতীয় শ্রেণীর সদস্যদের তাদের সভায় ঢুকতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কোনরূপ পূর্ব ঘোষনা ছাড়াই তিনি স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন কক্ষ বন্ধ করে দেন।
(২.) টেনিস কোর্টের শপথনামার উদ্যোগ :-
প্রায় তিনদিন পর ১৭৮৯ খ্রিঃ ২০ জুন, তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা তাদের জন্য নির্দিষ্ট সভা কক্ষে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখেন তাদের সভা কক্ষের দরজা ভিতর থেকে তালাবদ্ধ রয়েছে। প্রায় ১৭৫ বছর স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন কক্ষ বন্ধ থাকায় স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন কক্ষের সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছিলো। এই সময় তৃতীয় সম্প্রদায়কে বলা হয়, তাদের কক্ষে সংস্কারের কাজ হচ্ছে বলেই অধিবেশন কক্ষ তালাবন্ধ আছে।
এইসময় স্টেটস জেনারেলের সংস্কার কাজকে ক্ষুব্ধ তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা খোলা মনে মেনে নিতে পারেন নি। প্রথম থেকেই রাজা তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবি দাওয়াকে যেভাবে উপেক্ষা করে আসছিলেন, তা থেকে তৃতীয় সম্প্রদায়ের মনে হয়, রাজা অভিজাতদের সঙ্গে নিয়ে স্টেটস জেনারেল থেকে তৃতীয় সম্প্রদায় ও জাতীয় সভাকে বহিস্কার বা উপেক্ষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই উদ্দেশ্যেই সংস্কারের অজুহাতে রাজা তৃতীয় সম্প্রদায়ের কক্ষে তালা দিয়ে রেখেছেন।
এমতাবস্থায় ক্ষুব্ধ তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ডাঃ গিলোটিন নামক সদস্যের পরামর্শে এবং মিরাবো ও অ্যাবেসিয়াসের নেতৃত্বে ১৭৮৯ খ্রিঃ ২০ জুন স্টেটস জেনারেলের পার্শ্ববর্তী একটি টেনিস খেলার মাঠে সমবেত হয়ে বিপ্লব ও অধিকার রক্ষার স্বপক্ষে যে শপথ নেন তাকেই ইতিহাসে "টেনিস কোর্টের শপথ" বা "Tennis Court Oath" বলা হয়।
(৩.) শপথনামার মূল বক্তব্য :-
মুনিয়ের নামে জনৈক সদস্য টেনিস কোর্টের শপথনামার বয়ান রচনা করেন। টেনিস কোর্টের শপথে বলা হয় -
- (i.) যতদিন না ফ্রান্সের একটি নতুন সংবিধান রচিত হচ্ছে, ততদিন "জাতীয় সভা" র অধিবেশন রদ হবে না।
- (ii.) নতুন সংবিধান রচনা না হওয়া পর্যন্ত তৃতীয় সম্প্রদায় কোন মতেই জাতীয় সভা ত্যাগ করবে না।
- (iii.) রাজা জাতীয় সভা বন্ধ ঘোষনা করলেও, সদস্যরা তা স্বীকার করবে না।
- (iv.) যে স্থানে এই সভার অধিবেশন বসবে, সেই অধিবেশনকেই বৈধ বলে গন্য করা হবে।
- (v.) সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং একসাথে কাজ করে যাবে।
- (vi.) বেইলী নামক ব্যক্তিকে তৃতীয় শ্রেণির সদস্যরা সভাপতি নির্বাচিত করে সংবিধান রচনার কাজ চালিয়ে যাবে।
(৪.) টেনিস কোর্টের শপথের গুরুত্ব :-
একঝলকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-
- বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সের পার্লামেন্ট বা জাতীয় সভার নাম ছিলো - স্টেটস জেনারেল।
- বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে স্টেটস জেনারেলের ভোটদান পদ্ধতি ছিলো - সম্প্রদায় ভিত্তিক একটি করে ভোট।
- "What is the Third Estate?" গ্রন্থটির রচয়িতা ছিলেন - অ্যাবে সিয়েস।
- তৃতীয় সম্প্রদায় নিজেদের কক্ষকে জাতীয় সভা হিসাবে ঘোষনা করে - ১৭৮৯ খ্রিঃ ১৭ জুন।
- টেনিস কোর্টের শপথ নেওয়া হয় - ১৭৮৯ খ্রিঃ ২০ জুন।
- টেনিস কোর্টের শপথনামা রচনা করেন - মুনিয়ের।
- টেনিস কোর্টের শপথনামায় নেতৃত্ব দেন - মিরাবো ও অ্যাবেসিয়াস।