![]() |
স্টেটস জেনারেল ও রাজার সঙ্গে দ্বন্দ্ব |
(ক.) স্টেটস জেনারেলের পরিচয় :-
বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সের পার্লামেন্ট বা জাতীয় সভার নাম ছিলো স্টেটস জেনারেল। ১৩০২ খ্রিঃ ফিলিপ দ্য ফেয়ার স্টেটস জেনারেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বেশ কিছুদিন কাজ করার পর এই প্রতিষ্ঠানটি খাতায় কলমে টিকে থাকলেও, বুরবোঁ রাজারা নিজেদের স্বৈরতন্ত্রকে সুদৃঢ় করার জন্য ১৬১৪ খ্রিঃ থেকে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে স্টেটস জেনারেলে যাজক, অভিজাত ও তৃতীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে পাঠাতো। ফাস্ট, সেকেন্ড ও থার্ড এস্টেটের প্রতিনিধিদের বসার জন্য স্টেটস জেনারেলে ৩ টি পৃথক কক্ষ ছিলো। স্টেটস জেনারেলে ভোটদান পদ্ধতি ছিলো সম্প্রদায় ভিত্তিক। এখানে মোট ভোট ছিলো তিনটি অর্থাৎ যাজক, অভিজাত ও তৃতীয় সম্প্রদায় - এদের সকলের সম্প্রদায়গত ভাবে ভোট ছিলো একটি করে মোট তিনটি। এই নিয়ম অনুযায়ী যেকোন দুই কক্ষ কোন বিষয়ে অনুমোদন দিলে সেটা স্টেটস জেনারেলের সিদ্ধান্ত বলে গৃহীত হতো।
পরামর্শ দান ছিলো স্টেটস জেনারেলের মূল কাজ। রাজাকে কর ধার্যের ব্যাপারে এই সভা পরামর্শ দিতো, যদিও সেই পরামর্শ গ্রহন করা রাজার পক্ষে বাধ্যতামূলক ছিলো না। বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সে রাজাই স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকতেন, আবার ইচ্ছামতো এর অধিবেশন ভেঙ্গেও দিতেন। ১৬১৪ খ্রিঃ পর এর অধিবেশন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৬১৪ থেকে ১৭৮৮ খ্রিঃ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৭৫ বছর স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন বন্ধ থাকে।
(খ.) স্টেটস জেনারেল আহ্বানের প্রেক্ষাপট :-
১৭৭৪ খ্রিঃ বুরবোঁ রাজা ষোড়শ লুই সিংহাসনে বসার অল্প দিনের মধ্যেই প্রবল অর্থসংকটে পড়েন। এমতাবস্থায় অর্থমন্ত্রীদের সুপারিশ মেনে ষোড়শ লুই অভিজাতদের ওপর কর বসালে অভিজাতরা সম্মিলিত ভাবে এর প্রতিবাদ করে জানায় কর বসানোর কোন নৈতিক ও একতরফা অধিকার রাজার নেই। তা নির্ধারন করার ক্ষমতা আছে একমাত্র স্টেটস জেনারেলের।
অভিজাত বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে ষোড়শ লুইয়ের অর্থমন্ত্রী ব্রিঁয়া ১৭৮৮ খ্রিঃ ৫ ই জুলাই প্রতিশ্রুতি দেন ১৭৮৯ খ্রিঃ ১ মে স্টেটস জেনারেলের সভা আহ্বান করা হবে। অবশেষে দীর্ঘ ১৭৫ বছর পরে ১৭৮৯ খ্রিঃ ৫ ই মে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন বসেছিলো ভার্সাই শহরে।
(গ.) ষোড়শ লুইয়ের আমলে স্টেটস জেনারেলের পুনর্গঠন :-
ষোড়শ লুইয়ের আমলে দীর্ঘ ১৭৫ বছর পরে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকার ফলে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়। যেমন স্টেটস জেনারেলের সদস্যদের নতুন করে নির্বাচিত করা, সভার নিয়মকানুন ঠিক করা ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ১৭৫ বছর বন্ধ থাকায় নির্বাচিত সদস্যদের সকলেই মারা গিয়েছিলেন। তাছাড়া দীর্ঘ সময় অধিবেশন বন্ধ থাকায় সভার নিয়ম কানুনও সকলের জানা ছিলো না।
ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেল ডাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর এজন্য সকল শ্রেণীর প্রজাদের কাছ থেকে স্টেটস জেনারেল সভা সম্পর্কে তাদের প্রস্তাব ও অভিযোগ জানাতে সরকারের কাছে "কোহিয়ার্স" বা আবেদনপত্র পাঠাতে বলেন। ১৭৮৮ খ্রিঃ ২৩ শে সেপ্টেম্বর, অভিজাতদের প্রতিষ্ঠান প্যারিসের পার্লেমেন্ট প্রস্তাব দেয়, স্টেটস জেনারেলে আগের মতোই তিনটি এস্টেট আলাদা কক্ষে বসবে এবং সম্প্রদায়গত ভাবে আলাদা সিদ্ধান্ত ও ভোট দেবে। অন্যদিকে তৃতীয় সম্প্রদায় শ্রেনীগত সংখ্যাধিক্যের কারনে এইসময় যাজক ও অভিজাতদের মোট আসনের দ্বিগুন আসন বৃদ্ধির দাবি পেশ করে এবং সম্প্রদায়গত ভোটের বদলে মাথাপিছু ভোটের দাবি তোলে। রাজার তরফে সব দিক বিবেচনা করে তৃতীয় সম্প্রদায়ের মোট সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলেও, মাথা পিছু ভোটের দাবি মানা হয় নি।
যাইহোক, পূর্ব ঘোষনা অনুযায়ী ১৭৮৯ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে স্টেটস জেনারেলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন প্রক্রিয়া ছিলো অত্যন্ত জটিল। স্টেটস জেনারেলে মোট নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ছিলো - ১২১৪। এর মধ্যে যাজকদের প্রতিনিধি ছিলো - ৩০৮ জন, অভিজাতদের প্রতিনিধি ছিলো - ২৮৫ জন এবং তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ছিলো - ৬২১ জন। তৃতীয় সম্প্রদায়ের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে বুর্জোয়াদের সংখ্যাই ছিলো বেশি।
(ঘ.) স্টেটস জেনারেলে শ্রেনী - সংঘাত ও রাজার সঙ্গে দ্বন্দ্ব :-
১৭৮৯ খ্রিঃ ৫ ই মে প্যারিস থেকে ১০ মাইল দূরে অবস্থিত রাজধানী ভার্সাইয়ে স্টেটস জেনারেলের প্রথম অধিবেশন বসেছিলো। ৫ ই মে বর্নাঢ্য রাজকীয় শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন শুরু হয়। প্রথম অধিবেশনে সকল সদস্যদের উপস্থিতিতে রাজা সংক্ষিপ্ত ভাবে উদ্বোধনী ভাষন দেন। রাজা তার ভাষনে অধিবেশন কক্ষ কিভাবে পরিচালিত হবে তার কোন দিক নির্দেশ করেন নি। অধিবেশন একসাথে হবে না শ্রেনীগত ভাবে আলাদা হবে তার কোন পন্থা তিনি দেন নি।
বক্তৃতা শেষে রাজা সভাস্থল ত্যাগ করলে অভিজাত ও যাজকরা তাদের পৃথক পৃথক কক্ষে চলে যান। এর আগে অবশ্য ষোড়শ লুইয়ের অর্থমন্ত্রী নেকার তাঁর দীর্ঘ ভাষনে রাজস্ব ব্যবস্থার কি করে উন্নতি হবে তার বিবরন দেন এবং সম্প্রদায়গত ভাবে ভোটদানের নির্দেশ দিয়ে যান।
প্রথম থেকেই স্টেটস জেনারেল নিয়ে থার্ড এস্টেটের প্রতিনিধিদের মনে ক্ষোভ ছিলো। বারবার আবেদন পাঠানো সত্ত্বেও রাজা স্টেটস জেনারেলে থার্ড এস্টেটের মাথাপিছু ভোটের দাবি মানেন নি। এর উপর স্টেটস জেনারেলের শতাব্দী প্রাচীন পুরাতন নিয়ম কানুন থার্ড এস্টেটের প্রতিনিধিদের কাছে অত্যন্ত অপমানজনক মনে হয়েছিলো। প্রথম থেকেই রাজা স্টেটস জেনারেলের অধিবেশনে প্রোটকোল বা আদব কায়দা, প্রথা নিয়ে ভয়ানক কড়াকড়ি করায় তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিরা অপমানিত বোধ করেন। পোশাকের দিক থেকে স্টেটস জেনারেলে থার্ড এস্টেটের সদস্যদের ম্যাড়ম্যাড়ে কালো রঙয়ের পোশাক পরতে বাধ্য করা হয়। অন্যদিকে অভিজাতরা পালক লাগানো জমকালো পোশাক পরার অনুমতি পায়। এছাড়া, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী স্টেটস জেনারেলে যাজক - অভিজাতরা বসার পরে থার্ড এস্টেটের প্রতিনিধিরা প্রবেশের অনুমতি পেতেন। এইসব নিয়মকানুনের জন্য স্টেটস জেনারেলের বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের মনে প্রচন্ড ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম হয়।
১৭৮৯ খ্রিঃ ৬ ই মে, স্টেটস জেনারেলের অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে থার্ড এস্টেটের প্রতিনিধিরা দাবি জানান স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন একসঙ্গে করতে হবে। অভিজাত ও যাজকরা এই দাবির তীব্র বিরোধিতা করে। এই বিরোধিতার ফলে রাজা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি। ফলে স্টেটস জেনারেলে মাসাধিক কাল জুড়ে অচলাবস্থা চলে।
ইতিমধ্যে স্টেটস জেনারেলের অভ্যন্তরে নানা পরিবর্তন আসে। মিরাবো, লাফায়েত, আবেসিয়াস প্রমুখ উদারপন্থী অভিজাতরা তৃতীয় সম্প্রদায়ে যোগ দেন। তারা বুর্জোয়াদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে প্যাট্রিয়ট দল গঠন করে। স্টেটস জেনারেলে রাজার সামনে তারা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি তুলে ধরে। প্রথমটি ছিলো - প্রথম দুই শ্রেনীর বিশেষ অধিকার নাকচ করার দাবি। দ্বিতীয়টি ছিলো - অতীতের নীতি অনুযায়ী প্রত্যেকটি শ্রেনীর প্রতিনিধিদের পৃথক সভাকক্ষে না বসে একই সভায় মিলিত হতে হবে। তৃতীয় দাবিটি ছিলো - মাথাপিছু এক ভোট প্রদানের নীতিকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
যাজক ও অভিজাতরা তৃতীয় সম্প্রদায়ের এইসব দাবি মেনে নেয় নি। রাজাও যাজক ও অভিজাতদের চাপে তৃতীয় শ্রেণীর দাবি গুলি বাতিল করে দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাজার ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ১৭৮৯ খ্রিঃ ১৭ ই জুন বেইলির নেতৃত্বে তৃতীয় শ্রেনী রাজার অনুমতি না নিয়েই নিজেদের কক্ষকে "জাতীয় সভা" বলে ঘোষনা করেন। এই সভার অনুমতি ছাড়া রাজা কোন কর আদায় করতে পারবেন না বলেও তারা হুঁশিয়ারি দেয়। ফলে স্টেটস জেনারেলে রাজা বনাম থার্ড এস্টেটের সংঘাত তীব্র আকার ধারন করে।
তৃতীয় এস্টেটের নিজেদের কক্ষকে "জাতীয় সভা" হিসাবে ঘোষনা ছিলো একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। কারন এই ঘোষনা ছিলো সংবিধান ও প্রচলিত আইন বিরোধী। যাজক, অভিজাতদের সুবিধাবাদ ও রাজাকে উপেক্ষা করে এই ঘোষনা করা হয়েছিলো। এই ঘোষনার মাধ্যমে থার্ড এস্টেট একদিকে যেমন রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতার বিরুদ্ধাচারন করেছিলো, তেমনি এটাও বুঝিয়ে দিয়েছিলো ৯৬% জনগনের শ্রেনী - "থার্ড এস্টেট" ই হলো প্রকৃত জাতি ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের মূল উৎস।
এই সময় আবেসিয়াস তাঁর "What is Third Estate?" গ্রন্থে এই ভাব ও মতকেই বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন - সুবিধাভোগী যাজক ও অভিজাতরা হলো মোট জনসংখ্যার ভগ্নাংশ মাত্র। তৃতীয় শ্রেনীই হলো আসল ও প্রকৃত ফরাসি জাতি।
যাইহোক, তৃতীয় শ্রেণির সদস্যদের বিদ্রোহী আচরনে রাজা এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন যে, তৃতীয় শ্রেণীর সব কাজকর্মকে অবৈধ ঘোষনা করে তৃতীয় শ্রেণীর কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন। প্রায় তিনদিন সভাকক্ষ বন্ধ দেখে ১৭৮৯ খ্রিঃ ২০ জুন ডাঃ গিলোটিনের পরামর্শে তৃতীয় সম্প্রদায় স্টেটস জেনারেলের পাশে টেনিস খেলার মাঠে বিখ্যাত টেনিস কোর্টের শপথ নেন। এই শপথনামাতে ফ্রান্সের সব শ্রেনীর নাগরিকদের অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য একটি গ্রহনযোগ্য শাসনতন্ত্র বা সংবিধান রচনার শপথ নেওয়া হয়।
ইতিমধ্যে স্টেটস জেনারেলের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রে বদল আসে। উদারপন্থী যাজক ও অভিজাতদের বেশ কিছু সদস্য (১৭০ জন যাজক ও ৫০ জন অভিজাত) তৃতীয় সম্প্রদায় তথা জাতীয় সভায় যোগ দিলে স্টেটস জেনারেলের পুরো রাশটাই যাজক - অভিজাতদের হাত থেকে তৃতীয় সম্প্রদায়ের হাতে চলে যায়।
এই সময় সম্মিলিত জনমতের চাপে রাজা ১৭৮৯ খ্রিঃ ২২ শে জুন রাজকীয় অধিবেশনে তৃতীয় সম্প্রদায়ের যৌথ অধিবেশনের দাবি মেনে নেন। ২৩ জুন স্টেটস জেনারেলে তিন শ্রেনীর একত্র অধিবেশন বসে। বেশ কিছুদিন টালবাহানার পর ১৭৮৯ খ্রিঃ ২৭ শে জুন তৃতীয় সম্প্রদায়ের মাথা পিছু ভোটের দাবিটিও মেনে নেন। এই ঘোষনার পরেই জাতীয় সভা ১৭৮৯ খ্রিঃ ৯ ই জুলাই সংবিধান রচনার কাজে হাত দিলে "জাতীয় সভা" - "সংবিধান সভা" তে পরিনত হয়।
স্টেটস জেনারেলে তৃতীয় সম্প্রদায়ের বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের দাবির জয় ও সাফল্যকেই "বুর্জোয়া বিপ্লব" বলা হয়। বুর্জোয়া বিপ্লব সফল হওয়ায় ফ্রান্সের রাজধানী সারা ভার্সাই নগরীকে আলোক সজ্জায় সজ্জিত করা হয়। কিন্তু বুর্জোয়াদের এই জয়কে রাজা খোলা মনে মেনে নিতে পারেন নি। তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সৈন্য এনে প্যারিস এবং ভার্সাইয়ের আশে পাশে মোতায়েন করেন। ফলে স্টেটস জেনারেলের বুর্জোয়া সদস্যদের মনে রাজার অভিসন্ধি সম্পর্কে সংশয় ও সন্দেহ তৈরি হয়। ভয় ও সন্ত্রাসের বাতাবরন বুর্জোয়া বিপ্লবকে ম্লান করে দেয়।
এরই ফলে স্টেটস জেনারেলে সাধারন শ্রেনীর সঙ্গে রাজার যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিলো, আপাতভাবে সেখানে সাময়িক সমঝোতা হলেও, পরে স্টেটস জেনারেলের বাইরে রাজার বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব ও বিরোধিতার ক্ষেত্র আরোও সম্প্রসারিত হয়েছিলো।
(ঙ.) ফরাসি বিপ্লবে স্টেটস জেনারেল অধিবেশনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য :-
ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে স্টেটস জেনারেল অধিবেশনের তাৎপর্য ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। স্টেটস জেনারেলের সভা আহ্বান এবং স্টেটস জেনারেলের সামগ্রিক কর্মকান্ডের মধ্য থেকে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সত্য উঠে আসে।
প্রথমত, স্টেটস জেনারেল সভার আহ্বান রাজার স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তিতে আঘাত হেনে প্রমান করে দিয়েছিলো, জনগনই হলো সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস।
দ্বিতীয়ত, তৃতীয় সম্প্রদায়ের বুর্জোয়া প্রতিনিধিরা প্রথমদিকে অভিজাত বিদ্রোহকে সমর্থন করলেও, স্টেটস জেনারেল আহ্বানের পর অভিজাতদের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র সম্পর্কে অবহিত হন। অভিজাতরা স্টেটস জেনারেলে যৌথ অধিবেশন ও মাথাপিছু ভোটের দাবি সমর্থন করেন নি। মাথায় রাখতে হবে যাজক ও অভিজাতদের শ্রেনী স্বার্থ ছিলো অভিন্ন। স্টেটস জেনারেলে যাজক - অভিজাতরা সম্মিলিত ভোটের মাধ্যমে তাদের ওপর বর্ধিত করের বোঝা ঝেড়ে ফেলে করের বোঝা তৃতীয় সম্প্রদায়ের ঘাড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলো।
তৃতীয়ত, স্টেটস জেনারেলে যেভাবে রাজা যাজক ও অভিজাত পক্ষকে সমর্থন করেন তাতে প্রমানিত হয় রাজা সুবিধাবাদীদের পক্ষেই আছেন এবং তিনি বিপ্লব বিরোধী।
চতুর্থত, রাজার বিপ্লব বিরোধী ভূমিকা, স্বৈরাচারিতা, যাজক ও অভিজাতদের সুবিধাবাদ স্টেটস জেনারেল আহ্বানের পর অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিভাত হয়।
সর্বোপরি, স্টেটস জেনারেলে রাজার সংস্কার বিরোধিতা ফ্রান্সের সমাজ বিপ্লবকে রাজনৈতিক বিপ্লবের অভিমুখে ঠেলে দিয়েছিলো।
একঝলকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-
- বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সের পার্লামেন্ট বা জাতীয় সভার নাম ছিলো - স্টেটস জেনারেল।
- স্টেটস জেনারেল প্রতিষ্ঠা করেন - ফিলিপ দ্য ফেয়ার, ১৩০২ খ্রিঃ।
- বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে স্টেটস জেনারেল সভার অধিবেশন বন্ধ করে দেওয়া হয় - ১৬১৪ খ্রিঃ।
- বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে স্টেটস জেনারেল সভার অধিবেশন বসেছিলো - ১৭৫ বছর পরে ১৭৮৯ খ্রিঃ।
- ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেলের সভা আহ্বান করেন - অভিজাত বিদ্রোহের চাপে।
- স্টেটস জেনারেলের প্রথম অধিবেশন বসে - ১৭৮৯ খ্রিঃ ৫ ই মে, ভার্সাই নগরীতে।
- বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে স্টেটস জেনারেলের ভোটদান ছিলো - সম্প্রদায় ভিত্তিক।
- স্টেটস জেনারেলে তৃতীয় শ্রেনী নিজেদের কক্ষকে জাতীয় সভা বলে ঘোষনা করে - ১৭৮৯ খ্রিঃ ১৭ জুন।
- টেনিস কোর্টের শপথ নেওয়া হয় - ১৭৮৯ খ্রিঃ ২০ জুন।
- স্টেটস জেনারেলে রাজা যৌথ অধিবেশনের দাবি মেনে নেন - ১৭৮৯ খ্রিঃ ২৩ শে জুন।
- স্টেটস জেনারেলে রাজা মাথা পিছু ভোটের দাবি মেনে নেন - ১৭৮৯ খ্রিঃ ২৭ শে জুন।
- স্টেটস জেনারেলে "জাতীয় সভা" সংবিধান সভাতে পরিনত হয় - ১৭৮৯ খ্রিঃ ৯ ই জুলাই।
- "What is Third Estate?" - গ্রন্থটির লেখক হলেন - আবেসিয়াস।