ইওরোপে সমগ্র অষ্টাদশ শতক ছিলো আলোকিত ও জ্ঞানদীপ্তির যুগ। ফ্রান্সও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। জ্ঞানদীপ্তি পর্বে ফ্রান্সে বেশ কিছু দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাব ঘটেছিলো, যাদের রচনা ফ্রান্সের বিপ্লবী আন্দোলনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিলো এবং বিপ্লবের স্বপক্ষে "মনস্তাত্ত্বিক পটভূমি" তৈরি করেছিলো।
মাথায় রাখতে হবে, প্রচলিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলেই বিপ্লব সংগঠিত হয় না। বিপ্লবের জন্য "মানসিক প্রস্তুতির" প্রয়োজন পড়ে। ফরাসি বিপ্লবের বহু আগে দার্শনিকরা পুরাতনতন্ত্রের নিরন্তর সমালোচনা করে এই মানসিক প্রস্তুতির ক্ষেত্র তৈরি করেন। ঐতিহাসিক রুদে এই মানসিক প্রস্তুতিকেই "বিপ্লবী চেতনা" বলেছিলেন।
ফরাসি বিপ্লবের বহু আগে থেকেই ফ্রান্সের শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে এই বিপ্লবী চেতনা ও চিন্তাধারার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন যে সব দার্শনিকরা, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - মন্তেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো, বুফো, মাবলি, কন্দরসে, মেসলিয়ে, মরেলি, লিঙ্গুয়ে এবং ফিজিওক্রাট গোষ্ঠীর একাধিক দার্শনিকগন।
![]() |
ফরাসি স্বৈরাচার ও ত্রুটিপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতি বিষয়ে দার্শনিকদের সমালোচনা |
(ক.) অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সের অবস্থা ও দার্শনিকদের ভূমিকা :-
অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্স ছিলো ঘুন ধরা, পুরাতনতন্ত্রে জর্জরিত সংস্কার বিহীন একটি রাষ্ট্র। বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্স "নিরঙ্কুশ স্বৈরাচার" এবং ত্রুটিপূর্ণ "ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘরে" পরিনত হয়েছিলো। সমগ্র অষ্টাদশ শতক জুড়ে ফরাসি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারিতা দেখা গিয়েছিলো। (১.) একদিকে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের চরম স্বৈরশাসনে ফ্রান্স "রাজনৈতিক কারাগারে" পরিনত হয়েছিলো। (২.) অন্যদিকে সুবিধাবাদী অবস্থানে থাকা কয়েকটি শ্রেনীর সামাজিক শোষন ও শ্রেনী - স্বৈরাচারিতায় জর্জরিত হয়েছিলো ফ্রান্সের সমাজ। (৩.) বুরবোঁ রাজাদের ত্রুটিপূর্ণ ভুল অর্থনৈতিক নীতি ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় জীবনে যে অর্থনৈতিক সংকট ডেকে এনেছিলো, তা শুধু রাজাকে নয়, ফরাসি সমাজের দুর্বল, প্রান্তিক শ্রেনী গুলির জীবনকেও বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো।
এই প্রেক্ষাপটে - (ক.) ফ্রান্সের প্রচলিত স্বৈরাচার ও ত্রুটিপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতির স্বরূপ উন্মোচন, (খ.) ফরাসি সমাজে তার যুক্তিহীন উপস্থিতি এবং (গ.) তা থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে ফরাসি দার্শনিকরা যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ও মতবাদ বিভিন্ন গ্রন্থে তুলে ধরেন তা বিপ্লবের স্বপক্ষে মানসিক প্রস্তুতি ও জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।
(খ.) স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দার্শনিকদের সমালোচনা :-
ফ্রান্সের প্রায় সকল দার্শনিকই অষ্টাদশ শতকের ফরাসি সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মের ক্ষেত্রে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ফরাসি দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ছিলেন - মন্টেস্কু, ভলতেয়ার ও রুশো।
(১.) মন্তেস্কু :-
ফরাসি বিপ্লব হওয়ার প্রায় একশ বছর আগে মন্তেস্কু (১৬৮৯ - ১৭৫৫) জন্মগ্রহণ করেন এবং বিপ্লব শুরু হওয়ার ৩৪ বছর আগেই মারা যান। মন্তেস্কুর প্রকৃত নাম ছিলো ব্যারন চার্লস ডি মন্তেস্কু। মন্তেস্কু ফ্রান্সে চতুর্দশ লুই ও পঞ্চদশ লুইয়ের স্বৈর শাসনকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডের নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে ফরাসি স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।
১৭৪৮ খ্রিঃ প্রকাশিত "The Spirit of Laws" গ্রন্থে মন্তেস্কু ফরাসি রাজাদের দৈব অধিকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা বলে কিছু নেই। রাজনীতিতে স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিহত করার জন্য মন্তেস্কু "ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্বের" কথা তুলে ধরেন। তাঁর মতে সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে - শাসন ক্ষমতা, আইন প্রণয়ন ও বিচার ক্ষমতা বিভক্ত হলে একদিকে যেমন শাসকের স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিহত করা যায়, অন্যদিকে জনগনের স্বাধীনতা ও ব্যক্তি অধিকার রক্ষা পায়। মন্তেস্কুর এই মতবাদই "ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতি" নামে পরিচিত।
ফ্রান্সে "ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির" জন্য "স্পিরিট অব লজ" এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলো যে ১৮ মাসে এর ২২ টি সংস্করন নিঃশেষিত হয়েছিলো। মন্তেস্কু তার মতবাদে স্বৈরাচারী দৈব রাজতন্ত্রের তীব্র বিরোধিতা করে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিস্থাপন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ফরাসি বিপ্লব শুরু হওয়ার পর বিপ্লবীরা নতুন সংবিধান রচনার সময় মন্তেস্কুর নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রকে বাস্তবায়িত করেছিলেন।
মন্তেস্কুর অপর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ ছিলো - "The Persian Letters"। ১৭২১ খ্রিঃ প্রকাশিত এই গ্রন্থে ফ্রান্সের স্বৈরাচার, দুর্নীতি, অভিজাতদের সুবিধাবাদ, স্বার্থপরতা, চার্চের গোড়ামি ও রক্ষনশীলতার বিরুদ্ধে মন্তেস্কু সোচ্চার হন।
(২.) ভলতেয়ার :-
ফরাসি বিপ্লব হওয়ার প্রায় ৯০ বছর আগে ভলতেয়ার (১৬৯৪ - ১৭৭৮) জন্মগ্রহণ করেন এবং বিপ্লব শুরু হওয়ার ১০ বছর আগেই মারা যান। ভলতেয়ার ছিলেন ফ্রান্সের একজন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, নাট্যকার, কবি, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রকৃত নাম ছিলো ফ্রাঁসোয়া মারি আরুয়ে।
ভলতেয়ার তাঁর "Philosophical Letters" গ্রন্থে রাজার স্বৈরাচারী শাসনের তীব্র সমালোচনা করেন। ভলতেয়ার ফ্রান্সে চতুর্দশ লুই থেকে ষোড়শ লুই পর্যন্ত সকল শাসকেরই স্বৈর শাসনকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। বুরবোঁ শাসকদের স্বৈর শাসনকে তীব্র কটাক্ষ করে ভলতেয়ার তাঁর "Philosophical Letters" গ্রন্থে ফ্রান্সকে একটি "রাজনৈতিক কারগার" বলে অভিহিত করেন।
"কাঁদিদ" হলো ভলতেয়ারের লেখা অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এখানে তিনি ফ্রান্সের চার্চের দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারকে তীব্র ভাবে আক্রমণ করেন। ক্যাথলিক গির্জাকে তিনি বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত উৎপাত বলে অভিহিত করেন। জনসাধারনকে দুর্নীতিগ্রস্থ চার্চের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। এজন্য ভলতেয়ার নিজেই বলেছিলেন - "লুথার বা কেলভিন অপেক্ষা আমার যুগে আমি কম করিনি।"
(৩.) রুশো :-
ফরাসি বিপ্লব শুরু হওয়ার ৭৭ বছর আগে রুশো (১৭১২ - ১৭৭৮) জন্মগ্রহণ করেন এবং বিপ্লব শুরু হওয়ার ১১ বছর আগেই মারা যান। রুশোর প্রকৃত নাম ছিলো - জাঁ জাকুইস রুশো। রুশো ছিলেন ফ্রান্সের একজন জনপ্রিয়তম দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তাকে "ফরাসি বিপ্লবের জনক", "ফরাসি বিপ্লবের মন্ত্রগুরু" ও "ঝড়ের পাখি" ও "গনতন্ত্রের দেবদূত" বলা হয়।
রুশো পঞ্চদশ লুই ও ষোড়শ লুইয়ের স্বৈরাচারী অপশাসনকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। রুশোর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ গুলির মধ্যে ছিলো - "ডিসকোর্স অন দ্য অরিজিন অব ইনইকুয়ালিটি, সোস্যাল কন্ট্রাক্ট, ডিসকোর্স অন পলিটিক্যাল ইকোনমি, ও এমিল।
"বিপ্লবের বাইবেল" নামে খ্যাত "Social Contract" হলো রুশোর লেখা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। ১৭৬২ খ্রিঃ প্রকাশিত এই গ্রন্থে রুশোর রাজনৈতিক মতামত ব্যক্ত হয়েছিলো। এই গ্রন্থে রুশো দৈবানুগৃহীত স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রকে তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ঈশ্বরের ইচ্ছায় রাষ্ট্র গঠিত হয় নি। শাসক ও শাসিতের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিলো। তাঁর রাষ্ট্রে শাসক বা রাজা নয়, শাসিত শ্রেনী অর্থাৎ জনগনই হলো সার্বভৌমত্বের অধিকারী।
রুশো বলেন জনগন যেহেতু সর্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং রাজার সঙ্গে জনগনের চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে, তাই শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে রাজা অপদার্থতার পরিচয় দিলে জনগন রাজাকে পদচ্যুত করতে পারে। রুশোর "সামাজিক চুক্তি" মতবাদ বংশানুক্রমিক স্বৈরাচারী দৈব রাজতন্ত্রের ভিত্তিমূলে তীব্র আঘাত সৃষ্টি করেছিলো।
রুশোর বিখ্যাত গ্রন্থ গুলির মধ্যে ফরাসি বিপ্লবে প্রভাব ফেলা দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটির নাম ছিলো - "Origin of Inequality"(অসাম্যের সূত্রপাত)। ১৭৫৫ খ্রিঃ প্রকাশিত এই গ্রন্থে রুশো বলেন - "মানুষ স্বাধীন সত্তা নিয়ে জন্মায়, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলে আবদ্ধ।" এই গ্রন্থে রুশো সামাজিক বৈষম্য ও শ্রেনি শোষনের অবসান ঘটিয়ে সাম্যবাদী সমাজ গঠনের যে স্বপ্ন দেখান, তা পরবর্তীকালে বিপ্লবীদের গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিলো।
(৪.) বিশ্বকোষ ও ফিজিওক্র্যাট গন :-
মন্তেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো - বিখ্যাত এই ত্রয়ী ছাড়াও ফ্রান্সে দুটি দার্শনিক গোষ্ঠী ছিলো - বিশ্বকোষ ও ফিজিওক্র্যাট। বিশ্বকোষ গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন ডেনিস দিদেরো, অন্য সদস্যরা ছিলেন - দ্য এলেমবার্ট, হলবাক ও হেলভেটিয়াস। ডেনিস দিদেরো (১৭৫১ - ১৭৭২) ফরাসি বিপ্লব শুরু হবার ৩৮ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বিপ্লব শুরু হবার ১৭ বছর আগে মারা যান।
দিদেরো ফ্রান্সের প্রচলিত রাষ্ট্র, সমাজ ও প্রশাসনের ক্রুটি বিচ্যুতি তুলে ধরতে গিয়ে প্রায় ২৫ বছর ধরে ৩৫ খন্ডে বিশ্বকোষ রচনা করেন। এ ব্যাপারে বিখ্যাত পন্ডিত ডি এলেমবার্ট তাকে সাহায্য করেন। বিশ্বকোষ প্রনেতারা তাদের রচনার মাধ্যমে স্বৈরাচারী ফরাসি রাজতন্ত্র ও চার্চের তীব্র সমালোচনা করেন। বিশ্বকোষ রচনাকারদের মতোই ফিজিওক্র্যাট গোষ্ঠীর দার্শনিকরাও ফরাসি স্বৈরতন্ত্রের প্রবল সমালোচনা করেছিলেন।
উপরে উল্লেখিত দার্শনিকরা ছাড়াও আরোও বেশ কয়েকজন দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী ফরাসি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - বুফো, মাবলি, কন্দরসে, মেসলিয়ে, মরেলি ও লিঙ্গুয়ে।
- বুফো রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারের সমালোচনা করে গনপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আবেদন রাখেন।
- বিজ্ঞানী কন্দরসে রাজনৈতিক অসাম্য ও স্বৈরাচারের বিরোধিতা করে জনগনের অধিকারের কথা বলেন।
- ধর্মযাজক মেসলিয়ে ফরাসি সমাজের সব ধরনের স্বৈরাচারের বিরোধিতায় নামেন এবং নায্য অধিকার আদায়ের জন্য জনগনের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দেন।
(গ.) ফরাসি অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে দার্শনিকদের সমালোচনা :-
অষ্টাদশ শতকে বুরবোঁ রাজাদের অর্থনৈতিক নীতি গুলি ছিলো জনস্বার্থ বিরোধী। তাই বিভিন্ন ফরাসি দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদরা সরকারের আর্থিক নীতিকে প্রবল ভাবে সমালোচনা করেছিলেন।
(১.) মন্টেস্কু এ প্রসঙ্গে তাঁর "গ্রেটনেস অ্যান্ড ডেকাডেন্স অব দ্য রোমানস" গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ভৌগোলিক পরিবেশ, জনসংখ্যা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ কিভাবে একটি দেশের জীবনযাত্রা, আইন, শাসন ও বিচার ব্যবস্থার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। মন্টেস্কু অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও, বুরবোঁ রাজাদের করনীতির প্রবল সমালোচনা করেছিলেন এবং কটাক্ষ করে লিখেছিলেন, "ফ্রান্সের রাজার সোনার খনি নেই, জনগনকে শোষন করেই তিনি অর্থ সংগ্রহ করেন"।
(২.) ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার তাঁর শ্লেষাত্মক রচনার মাধ্যমে ফরাসি চার্চকে তীব্রভাবে কষাঘাত করে লিখেছিলেন, ফ্রান্সের যাবতীয় উন্নয়নের পথ চার্চই বন্ধ করে রেখেছে। তাঁর মতে আর্থিক দুর্নীতির আঁতুরঘর চার্চকে ভেঙ্গে দিলেই দেশের অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ভলতেয়ার তাঁর রচনার মধ্যে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেন কিভাবে ফরাসি সমাজে অভিজাত শ্রেনী সমাজের অপর সকল শ্রেনীকে বঞ্চিত করে সমস্ত অর্থনৈতিক সম্পদ, সুবিধা ও অধিকার কুক্ষিগত করে রেখেছে।
(৩.) অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে আরোও বেশ কয়েকজন দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী ফরাসি স্বৈরাচার ও ত্রুটিপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতির সমালোচনা করেছিলেন। এইসব দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - বুফো, মাবলি, কন্দরসে, মেসলিয়ে, মরেলি ও লিঙ্গুয়ে।
- বুফো দারিদ্র মানুষের দুর্ভাগ্যের জন্য বিত্তশালী লোকেদের দায়ী করেছিলেন।
- মরেলি ও লিঙ্গুয়ে সামাজিক অসাম্য দূর করার জন্য সমাজবাদের কথা বলেছিলেন। তারা সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ ঘটানোর কথা বলেছিলেন।
- দার্শনিক রুশোও প্রচলিত সামাজিক অসাম্যের জন্য ধনবন্টনের বৈষম্যকে দায়ী করছিলেন। "ডিসকোর্সেস অন দ্য আর্টস অ্যান্ড দ্য সাইন্স" (১৭৬২) গ্রন্থে তিনি বলেছেন, মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধির প্রবল ইচ্ছা সমাজে সম্পদ বন্টনে অসাম্য গড়ে তোলে, যা ঠিক নয়।
(৪.) তবে ফরাসি অর্থনৈতিক নীতির প্রবল সমালোচনা করে ফ্রান্সে সবথেকে আলোড়ন সৃষ্টি করেন ফিজিওক্র্যাটসগন। শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্যে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিরোধী ও অবাধ বানিজ্যের প্রবক্তাদেরই "ফিজিওক্র্যাটস" বলা হতো।
ফিজিওক্র্যাট শব্দটির উদ্ভাবক ছিলেন নেমুর। "দি ওয়েলথ অব নেশন" গ্রন্থের লেখক ও "অর্থনীতির জনক" নামে খ্যাত অ্যাডাম স্মিথের মতবাদের দ্বারা ফিজিওক্র্যাটরা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ফ্রান্সে ১৭৫৮ খ্রিঃ "ইয়াবলো ইকনমিক"গ্রন্থ প্রকাশ করে কুইসনে প্রথম ফিজিওক্র্যাট মতবাদ তুলে ধরেন। তিনিই ছিলেন ফিজিওক্র্যাট গোষ্ঠীর প্রধান নেতা ও জনক। এই গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন - তুর্গো, মিরাবো, মাবলি, মালি, কঁদিলাক, নেম্যুর, লা মেত্রি প্রমুখ।
মিরাবো "ফ্রেন্ড অব ম্যানকাইন্ড" গ্রন্থে সমকালীন মার্কেন্টাইল মতবাদের বিরোধিতা করে অবাধ ও মুক্ত বানিজ্যের কথা বলেন। ফ্রান্সের ভিতরে অসংখ্য শুল্ক প্রাচীর গুলি ভেঙ্গে ফেলে বানিজ্যকে উন্মুক্ত ও অবাধ করার কথা বলেন। ফিজিওক্র্যাটদের মতে, সম্পদের একমাত্র উৎস হলো ভূমি। তাই ভূমিকর ছাড়া বাদবাকি সব কর তারা তুলে দিতে বলেছিলেন। এছাড়া, শিল্প, বানিজ্যের উন্নয়নের জন্য সহায়ক পরিমন্ডল গঠনের ওপরেও তারা জোর দেন। ফ্রান্সের বুর্জোয়া শ্রেনী ফিজিওক্র্যাট মতবাদের দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
মূল্যায়ন :-
ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকেই দার্শনিকদের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিলো। এই বিতর্কের অন্যতম কারন হলো - (১.) দার্শনিকরা কেউই বিপ্লবের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন না। (২.) ফরাসি বিপ্লবের বহু আগেই দার্শনিকদের মৃত্যু হয়েছিলো। (৩.) দার্শনিকদের কেউ কখনও বিপ্লব সংগঠিত করার কথাও বলেন নি। (৪.) তাদের মতবাদের মধ্যেও কোন মিল ছিলো না। মন্তেস্কু নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। ভলতেয়ার জ্ঞানদীপ্ত রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, আবার রুশো গনতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। ডেভিড টমসনের মতো অনেক ঐতিহাসিক তাই ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকাকে "পরোক্ষ, দূরবর্তী ও ক্ষীন" বলে অভিহিত করেছেন।
প্রখ্যাত ইংরেজ বাগ্মী, রাষ্ট্রনেতা এডমন্ড বার্ক ফরাসি বিপ্লবের ওপর প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন। "Reflections on the Revolution in France, 1790" গ্রন্থে তিনি ফরাসি বিপ্লবকে দার্শনিকদের ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেন। বার্ককে অনুসরন করে বারুয়েল, তেন, তকভিল, রুস্তাও, মাদলা, শাতোব্রিয়া প্রমুখ ঐতিহাসিকরা বিপ্লবের পশ্চাতে দার্শনিকদের ভূমিকাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন।
দার্শনিকদের ভূমিকার মূল্যায়ন করতে গিয়ে মুনিয়ে, মাতিয়ে, তিয়ের, মিন্যে, জর্জ লেফেভর প্রমুখ আরেকদল ঐতিহাসিকের মত ছিলো বিপ্লবের সঙ্গে দার্শনিকদের ষড়যন্ত্রের কোন সম্পর্ক ছিলো না। ভূমিকাও ছিলো না। তাদের মতে, দার্শনিকদের ভূমিকার থেকেও প্রচলিত আর্থ - সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষোভের তীব্রতা ও ভূমিকা ছিলো বেশি। এদের মতে, তৎকালীন সময়ে ফ্রান্সে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট কম ছিলো। সাধারন মানুষেরা দার্শনিকদের রচনা পড়েন নি। তারা বিপ্লবে নেতৃত্বও দেন নি। বিপ্লবের ডাকও দেন নি।
সমালোচকদের সব তথ্য যুক্তি মেনে নিয়েও দার্শনিকদের ভূমিকার স্বপক্ষে আমরা বলতে পারি -
(১.) অষ্টাদশ শতকে ফরাসি স্বৈরাচার ও অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিলো, তাকে সংহত রূপ ও ভাষ্য দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন দার্শনিকরা।
(২.) আধুনিককালে বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয় একটি রাজনৈতিক দল। জনগনের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষোভকে রাজনৈতিক দলই সংগঠিত করে। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সে কোন রাজনৈতিক দল ছিলো না। দার্শনিকরা সেই অভাব পূরন করেছিলেন। বিপ্লবের বহু আগে থেকেই ফ্রান্সের আর্থ - সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষোভকে সংগঠিত করে তারা জনমত গঠন করেন এবং বিপ্লবী মানসিকতার রচনা করেন।
(৩.) একথা ঠিক, ফরাসি সামাজের সকলেই দার্শনিকদের রচনা পড়েন নি। কিন্তু শিক্ষিত মানুষদের অনেকেই দার্শনিকদের চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ফ্রান্সের সালো, কাফে রেস্তোরাঁ ও পানশালা গুলিতে দার্শনিকদের মতবাদ নিয়ে আলোচনা হতো। বিপ্লবের প্রাক্কালে সারা ইওরোপের মধ্যে ফ্রান্সেই সব থেকে বেশি পত্রিকা প্রকাশিত হতো, যার সংখ্যা ছিলো ১৬৯। হাটে বাজারে, অফিসে, একাডেমিতে দার্শনিকদের মত গুলি নিয়ে আলোচনা চলতো।
(৪.) দার্শনিকরা বিপ্লবের কথা না বললেও, প্রচলিত ব্যবস্থার ত্রুটি গুলির কথা বলেছিলেন। পুরাতন ব্যবস্থার নিরন্তর সমালোচনা করে পুরাতনতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও অনুগত্যের ভিত্তিমূলে তারা ফাটল সৃষ্টি করেন। তারা পরিবর্তনের কথা বলেন, নতুন ব্যবস্থার কথা বলেন এবং মানুষকে নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখতে শেখান। সুতরাং ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো, তাকে কোনভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।
সবদিক বিচার বিশ্লেষণ করে মূল্যায়নে তাই আমরা একথা বলতে পারি, একমাত্র দার্শনিকদের জন্য ফ্রান্সে বিপ্লব হয়েছিলো একথা যেমন ঠিক নয়। তেমনি প্রচলিত আর্থ - সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলেই বিপ্লব হয়, একথাও সঠিক নয়। উচ্চনৈতিক আদর্শ, মূল্যবোধ ও উন্নততর ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা বিপ্লবী আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। দার্শনিকদের বিভিন্ন মতবাদ সেই অভাব পূরন করেছিলো। ফরাসি বিপ্লবের বিভিন্ন পর্ব ও পর্যায় গুলিতে দার্শনিকদের মতাদর্শের যেভাবে প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়ন লক্ষ্য করা যায়, তাতে একথা নির্দ্ধিদায় একথা বলা যায়, ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত স্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ।