বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সের সমাজ কাঠামো

(ক.) বিপ্লব - পূর্ব ফরাসি সমাজের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য :-

ইওরোপের অন্যান্য দেশ গুলির মতো ফ্রান্সের সমাজও ছিলো মধ্যযুগীয় ও সামন্ততান্ত্রিকঅসাম্যই ছিলো এই সমাজ ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য। শ্রেনীগত দিক থেকে ফ্রান্সের সমাজ তিনটি এস্টেট বা সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিলো। যথা - 

  • (১.) প্রথম শ্রেনী বা "ফাস্ট এস্টেট", যার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাজকরা, 
  • (২.) দ্বিতীয় শ্রেনী বা "সেকেন্ড এস্টেট", যার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন অভিজাতরা, এবং 
  • (৩.) যাজক ও অভিজাত বাদ দিয়ে বাদবাকি অন্যান্য সাধারন শ্রেণির লোকেদের নিয়ে গঠিত ছিলো "তৃতীয় শ্রেনী বা "থার্ড এস্টেট"।

খ্রিষ্টান ধর্মে ত্রিত্বের যে ধারনা ছিলো তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফ্রান্সের সমাজকে ৩ টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিলো। যখন ফরাসি বিপ্লব হয়, তখন ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যা ছিলো প্রায় আড়াই কোটি। এর মধ্যে - 

  • (১.) যাজকরা সংখ্যায় ছিলেন মাত্র ১,০০,০০০ থেকে ১,২০,০০০, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার মাত্র ১%। 
  • (২.) অভিজাতরা সংখ্যায় ছিলেন মাত্র ৩,৫০,০০০ থেকে ৫,০০,০০০ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার মাত্র দেড় বা দুই শতাংশ। অন্যদিকে 
  • (৩.) যাজক ও অভিজাত বাদ দিয়ে তৃতীয় এস্টেটের লোকসংখ্যা ছিলো দুই কোটি চল্লিশ লক্ষের অধিক। এরা ছিলেন মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৭ % (মতান্তরে ৯৩%)।

তৃতীয় এস্টেটের জনগন সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও, ফরাসি সমাজে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা ভোগ করতো প্রথম দুটি শ্রেনী, অর্থাৎ যাজক ও অভিজাতরা। শ্রেনীগত দিক থেকে সমাজ ৩ টি ভাগে বিভক্ত হলেও, আর্থ - সামাজিক ক্ষেত্রে সমাজ সুবিধাভোগী (যাজক ও অভিজাত) এবং সুবিধাহীন (তৃতীয় সম্প্রদায়) - এই দুটি শিবিরে বিভক্ত ছিলো।

বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সের সমাজ কাঠামো
বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সের সমাজ কাঠামো 


(খ.) প্রথম এস্টেটে যাজকদের সামাজিক অবস্থান :-

বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে সমাজের একেবারে উচ্চস্থানে "ফাস্ট এস্টেটের" অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাজকরা। এরা ফ্রান্সে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১% হয়েও, রাষ্ট্রে অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং সুবিধাবাদী শ্রেনী ছিলো। রাষ্ট্রের মোট ২০ ভাগ জমি তাদের দখলে থাকলেও, তারা এর জন্য কোন কর দিতেন না। "কনট্রাক্ট অফ পেইসির" মাধ্যমে রাজাকে সামান্য কিছু স্বেচ্ছাকর দিতেন।

(১.) যাজকদের সামাজিক সুবিধা :- 

চার্চ ও যাজকরা ছিলেন ফ্রান্সে "রাষ্ট্রের মধ্যে একটি রাষ্ট্র"। চার্চের নিজস্ব আইন প্রণয়নকারী সভা ছিলো, এমনকি নিজস্ব বিচার ও রাজস্ব ব্যবস্থাও ছিলো। এইসব নিয়েই চার্চ ও যাজকতন্ত্র ফ্রান্সে একটি সমান্তরাল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চালাতো। ধর্ম ও শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ন ভাবে যাজকদের নিয়ন্ত্রনে ছিলো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সমাজের ওপর যাজকদের প্রভাব ছিলো ব্যাপক ও গভীর। যাজকরা ফ্রান্সে রাজার আইন ও শাসনের বাইরে ছিলেন। 

যাজকরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নিয়মিত ভাবে টাইথ বা ধর্মকর আদায় করতো। এছাড়া মৃত্যুকর, বিবাহকরও আদায় করতো। এইসব মিলিয়ে ফরাসি চার্চ গুলোর বার্ষিক আয় ছিলো প্রায় ১৩ কোটি লিভর, যার মধ্যে "কনট্রাক্ট অফ পেইসির" মাধ্যমে যাজকরা রাষ্ট্রকে মাত্র ৩৫ লক্ষ লিভর কর প্রদান করতেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই আয়ের তুলনায় তাদের দেয় করের পরিমান ছিলো খুবই সামান্য।

বিপুল পরিমান অর্থ আদায়ের ফলে অষ্টাদশ শতক থেকেই যাজকদের মধ্যে নানা নৈতিক অবক্ষয় দেখা যায়। ধর্মকর্ম ভুলে যাজকরা ভোগবিলাস ও ব্যাভিচারে মগ্ন হয়ে পড়েন। তাদের প্রভাবে ফ্রান্সের চার্চ গুলো দুর্নীতির আঁতুরঘরে পরিনত হয়ে যায় । অবস্থাটি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে ষোড়শ লুই একবার ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন - "অন্তত একজন আর্চ বিশপকে চাই, যিনি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন।"

(২.) যাজকদের শ্রেনীগত অর্ন্তদ্বন্দ্ব ও দলাদলি :-

যাজকরা ফ্রান্সে কোন ঐক্যবদ্ধ শ্রেনী ছিলো না । সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক সামর্থ্যের মাপকাঠিতে যাজকরা দুটি ভাগে বিভক্ত ছিলেন। যথা - উচ্চতর যাজক ও নিন্মতর যাজক

উচ্চতর যাজকদের শ্রেনীভুক্ত ছিলেন - আর্চবিশপ, বিশপ, অ্যাবট ও কার্ডিনালরা। এরা শুধু ধনীই ছিলেন না, পদমর্যাদায় নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ ও কুলীন বলে মনে করতেন। গীর্জার সিংহভাগ অর্থ এরাই ভোগ করতেন। ফরাসি বিপ্লবের আগে এদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটে। এরা অলস, অর্কমন্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। 

নিন্মতর যাজকদের শ্রেনীভুক্ত ছিলেন - গ্রামের ছোট খাটো চার্চের পাদরিরা। এদের আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো ছিলো না। পাদরিরা খুবই সাধারন জীবন যাপন করতেন। ফ্রান্সে এরাই ছিলেন প্রকৃতপক্ষে শিক্ষিত যাজক। রীতিমত পড়াশোনার জগতে থাকতেন বলে নিন্মতর যাজকরা ফরাসি দার্শনিকদের রচনা পড়ে সমাজের প্রচলিত বৈষম্য সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। উচ্চশ্রেনীর যাজকদের অনাচার ও উচ্ছৃঙ্খলাকে এরা সহ্য করেন নি। 

সমাজের উচ্চশ্রেনীর যাজকদের প্রতি তাদের ক্ষোভ ছিলো। সেই শ্রেনীগত ক্ষোভের কারনেই নিন্মতর যাজকদের একটি বড়ো অংশ বিপ্লবে তৃতীয় সম্প্রদায়ের পক্ষ অবলম্বন করে ফরাসি বিপ্লবকে অনিবার্য করে তুলতে সাহায্য করেছিলেন।

(গ.) দ্বিতীয় এস্টেটে অভিজাতদের অবস্থান :- 

বিপ্লব পূর্ব ফরাসি সমাজের দ্বিতীয় এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত ছিলো অভিজাতরা। ফ্রান্সে মোট জনসংখ্যার মাত্র দেড় শতাংশ /মতান্তরে দুই শতাংশ হয়েও, অভিজাতরা ছিলেন সমাজের সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশ। ফ্রান্সে সামন্ততান্ত্রিক যুগে অভিজাত সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিলো। 

পরবর্তীকালে জাতীয় রাজতন্ত্রের উত্থানের কালে রাজতন্ত্রের সঙ্গে অভিজাতদের সংঘাত এবং পরে সমঝোতা হয়েছিলো। এই সমঝোতার পরিপ্রেক্ষিতে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রের অধিকাংশ পদ গুলি অভিজাতরাই নিজেদের দখলে ও নিয়ন্ত্রনে রাখতেন। ফ্রান্সে রাজা ও অভিজাতদের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও স্বার্থরক্ষার যে অলিখিত সমঝোতা ছিলো, তা বুরবোঁ রাজবংশের আমলেও অক্ষত ছিলো। ষোড়শ লুই অভিজাতদের ওপর কর আরোপ করে এই পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিমূলে আঘাত হানলে ফ্রান্সে বিপ্লবের সূচনা ঘটেছিলো। 

(১.) অভিজাতদের সামাজিক সুবিধা :- 

বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধাবাদী স্থানে ছিলো অভিজাতরা। ফ্রান্সের মোট কৃষিজমির প্রায় ৬০% এরা ভোগ করতো। এজন্য তারা কোন কর দিতো না। তাদের ভূমিকর "তেইলি" দিতে হতো না। এছাড়া, সম্পত্তিকর "ভাতিয়েম", উৎপাদনকর "ক্যাপিটেশন" এবং বাধ্যতামূলক শ্রমকর "কর্ভি"ও দিতে হতো না। 

নিজেরা কর না দিলেও, অভিজাতরা কৃষকদের কাছ থেকে বিভিন্ন সামন্ততান্ত্রিক কর আদায় করতেন। এরা বংশ কৌলিন্যের জোরে সরকারি উচ্চপদগুলির একচেটিয়া অধিকার ভোগ করতেন। শাসন, সৈন্যবাহিনী ও চার্চের উচ্চপদ গুলিতে এদেরই একাধিপত্য ছিলো। এছাড়া ফ্রান্সে পার্লেমোর (বিচারসভা) পদ গুলি এরা বংশানুক্রমিক ভাবে ভোগদখল করতো। 

অভিজাত শ্রেনী ফরাসি সমাজে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করতো। এই বিশেষ মর্যাদার প্রতীক হিসাবে তারা সর্বত্র তরবারি বহন করতো। তাদের পোশাক ছিলো জমকালো এবং তারা তাদের নামের আগে আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে "লর্ড", "ব্যারন", "মার্কুইস" ইত্যাদি খেতাব ব্যবহার করতেন। 

(২.) অভিজাতদের শ্রেনীগত অর্ন্তদ্বন্দ্ব ও   দলাদলি :- 

যাজকদের মতো অভিজাতদের মধ্যেও শ্রেনীগত দ্বন্দ্ব ছিলো। 

(i.) যারা জন্মসূত্রে অভিজাত ছিলেন এবং  যাদের বংশকৌলিন্য বেশি ছিলো, তারা পরিচিত ছিলো "সাবেকি অভিজাত" নামে। এরা নিজেদের নীলরক্তের ও আসল অভিজাত বলে মনে করতেন। 

(ii.) সাবেকি অভিজাত ছাড়াও, ফ্রান্সের শাসকেরা প্রশাসনের প্রয়োজনেও অভিজাত শ্রেনীর সৃষ্টি করতেন। তাদের বলা হতো "পোশাকি অভিজাত"। সাধারনত সম্পদশালী উচ্চ বুর্জোয়ারা টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন সরকারি পদ কিনে এই "অভিজাত" পদমর্যাদা লাভ করেছিলেন। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে পোশাকি অভিজাতদের সংখ্যা ছিলো আনুমানিক ৩২,০০০ থেকে ৫০,০০০ মতো। 

ফ্রান্সে "সাবেকি অভিজাত" ও "পোশাকি অভিজাতদের" পারস্পরিক সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিলো না। সাবেকি অভিজাতরা বংশকৌলিন্য না থাকার কারনে পোশাকি অভিজাতদের ঘৃনার চোখে দেখতেন। বংশকৌলিন্য না থাকার কারনে তারা পোশাকি অভিজাতদের সঙ্গে কোনরূপ সামাজিক বা বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপন করতো না। প্রকৃতপক্ষে তারা রাজা কর্তৃক সৃষ্ট পোশাকি অভিজাতদের আদৌ গুরুত্ব দিতেন না। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সামাজিক মর্যাদা ও গুরুত্ব লাভের প্রশ্নে "সাবেকি অভিজাতদের" বিরুদ্ধে "পোশাকি অভিজাতদের" চাপা অসন্তোষ ও ক্ষোভ ছিলো। 

ফ্রান্সে অভিজাতদের একটি অংশ শহরে এবং একটি অংশ গ্রামে বসবাস করতো। অভিজাতদের মধ্যে প্রায় ১০,০০০ অভিজাত ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে রাজপ্রাসাদের পাশে বিলাস বহুল প্রাসাদ বানিয়ে বাস করতেন। এই সমস্ত অভিজাতরা রাজদরবারের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত ছিলেন। অত্যন্ত আভিজাত্য, বিপুল ঐশ্বর্য এবং জাঁকজমকের মধ্য দিয়ে এরা জীবন অতিবাহিত করতেন। 

অভিজাতদের একটি অংশ ফ্রান্সের গ্রাম গুলিতে বসবাস করতেন। এদের জীবনযাত্রা ছিলো অনেকটা সম্পন্ন, ধনী ভূস্বামীর মতো। মাতিয়ে এদের "দরিদ্র অভিজাত" বলে বর্ননা করেছিলেন। এরা কৃষক শোষন করে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা চালাতো। এজন্য ফরাসি বিপ্লবের আগে এইসব গ্রামীন অভিজাতদের বিরুদ্ধে কৃষকসমাজের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিলো। 

অভিজাতরা ফ্রান্সে কখনই একটি ঐক্যবদ্ধ শ্রেনী ছিলো না। তাদের মধ্যে নানা স্বার্থের দ্বন্দ্ব ছিলো (১.) সামাজিক মর্যাদা লাভের প্রশ্নে পোশাকি অভিজাতদের সঙ্গে সাবেকি অভিজাতদের দ্বন্দ্ব, ঈর্ষা ও ক্ষোভ ছিলো। (২.) গ্রামীন অভিজাতরা রাজকীয় অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত ছিলো। ভার্সাইয়ের রাজকীয় অভিজাতরা এদের অবজ্ঞা ও করুনার চোখে দেখতো। এসব কারনে শহুরে রাজকীয় অভিজাতদের বিরুদ্ধে গ্রামীন অভিজাতদের ক্ষোভ, দ্বন্দ্ব ও ঈর্ষা ছিলো। 

অভিজাতদের মধ্যে নানা দ্বন্দ্ব ও দলাদলি নানাভাবে ফরাসি বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করেছিলো। (১.) শহুরে সাবেকি অভিজাতরা রাজকীয় স্বৈরাচারের বিরোধিতায় আন্দোলনে নেমেছিলো। অন্যদিকে (২.) মুক্তপন্থী ও উদার অভিজাতরা প্রচলিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন। ফরাসি বিপ্লবের সময় উদার অভিজাতদের একটি অংশ তৃতীয় এস্টেটে যোগ দিয়ে "স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র" ও "অভিজাততন্ত্রের" ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করেন। এইসব উদার অভিজাতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - কন্দরসে, লাফায়েত, অ্যাবেসিয়াস, মিরাবো।

মাথায় রাখতে হবে, দ্বিতীয় এস্টেটে অভিজাতদের সকলেই প্রচলিত সামাজিক কাঠামোতে সন্তুষ্ট ও ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না। অভিজাতদের মধ্যে নানা শ্রেনীগত অর্ন্তদ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক ঈর্ষা ছিলো। আবার অভিজাতদের বিরুদ্ধে অন্যান্য শ্রেনীদের মনেও ক্ষোভ ও ঈর্ষার জন্ম হয়েছিলো। 

(১.)  সমাজে শহুরে অভিজাতদের বিশেষ সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক সুবিধা উদীয়মান বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের মনে ক্ষোভ ও ঈর্ষার জন্ম দিয়েছিলো। উচ্চবুর্জোয়াদের একাংশ টাকার জোরে প্রশাসনিক পদ কিনেও পূর্ন আভিজাত্যের মর্যদা লাভ করতে পারেন নি। আভিজাত্যের পোশাকেই "পোশাকি অভিজাতদের" সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিলো। 

(২.) অন্যদিকে গ্রামীন অভিজাতদের নানা সামন্ততান্ত্রিক শোষনে ফ্রান্সের কৃষক সমাজও প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট ছিলেন। বিপ্লব চলাকালীন বাস্তিল দুর্গের পতনের সময় কৃষক সমাজের এই সীমাহীন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। 

গ্রামীন অভিজাতদের সঙ্গে শহুরে রাজকীয় অভিজাতদের কোন সামাজিক সম্বন্ধ ও সদ্ভাব ছিলো না। শ্রেনীগত ঐক্য না থাকায় তারা শ্রেনীগত বিপর্যয় বা আঘাতকেও সম্মিলিত ভাবে প্রতিহত করতে পারেন নি। 

সুতরাং একথা অত্যন্ত স্পষ্ট, অভিজাতদের মধ্যেকার নানা শ্রেনী দ্বন্দ্ব ফরাসি বিপ্লবকে অনিবার্য করে তুলেছিলো। রাজার স্বৈরাচারীতাকে আঘাত করে অভিজাতদের একটা অংশ যেমন বিপ্লবের পথকে মসৃন করেন। তেমনি উদারপন্থী অভিজাতদের একটি অংশ বিপ্লব চলাকালে তৃতীয় পক্ষে যোগদিয়ে ফরাসি বিপ্লবে নতুন দিশা ও আশার সঞ্চার করেন।

(গ.) তৃতীয় এস্টেটের পরিচয় ও শ্রেনী বিন্যাস :- 

প্রাক্ বিপ্লব ফ্রান্সে আড়াই কোটি মানুষের মধ্যে তৃতীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলো প্রায় দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষ। আবে সিয়েস তাঁর "তৃতীয় এস্টেট কী" পুস্তিকায় তৃতীয় এস্টেটকেই ফ্রান্সের প্রকৃত ও আসল জাতি বলে অভিহিত করেন। কারন একমাত্র তৃতীয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই রাষ্ট্রকে কর দিতো এবং তাদের দেয় অর্থেই দেশ চলতো। সংখ্যার দিক থেকেও তারাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। 

তৃতীয় সম্প্রদায় ছিলো সুবিধাহীন শ্রেনী। ফ্রান্সে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৬ % লোকজনই তৃতীয় শ্রেনী বা Third Estate এর অন্তর্ভুক্ত ছিলো। যাজক ও অভিজাত বাদ দিয়ে ফ্রান্সের অন্যসব শ্রেণির ও পেশার মানুষজনদের নিয়েই তৃতীয় সম্প্রদায়ের গঠন করা হয়েছিলো। বংশকৌলিন্য না থাকায় তৃতীয় সম্প্রদায় যোগ্য সামাজিক সম্মান ও সবধরনের রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। 

ফ্রান্সের আগের দুই এস্টেটের মতো Third Estate সুগঠিত, ঐক্যবদ্ধ এবং সংহতিপূর্ন সামাজিক শ্রেনী ছিলো না। তৃতীয় সম্প্রদায় ৩ টি ভাগে বিভক্ত ছিলো। যথা - (১.) বুর্জোয়া (২.) কৃষক এবং (৩.) সাঁকুলেৎ। 

(১.) বুর্জোয়াশ্রেনীর পরিচয় ও শ্রেনী বিন্যাস :- 

মধ্যযুগে যারা Burg বা শহরের উপকন্ঠে বসবাস করতো এবং ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প ও কারিগরের কাজ দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতো তাদের বলা হতো Burgess বা বার্গার। এই বার্গার শব্দটি থেকে আধুনিক "বুর্জোয়া" শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিলো।

বুৎপত্তিগত দিক থেকে বুর্জোয়াদের একটি শহরবাসী শ্রেনী মনে হলেও, সকল বুর্জোয়া শহরবাসী ছিলো না। ফ্রান্সে বহু বুর্জোয়া গ্রামে বাস করতো। শহরবাসী বুর্জোয়ারা কয়েকটি সুযোগ সুবিধা পেতো। যেমন প্যারিস, তুর ও বোর্দোর বুর্জোয়াদের ভূমিকর তেই দিতে হতো না। প্যারিসের বুর্জোয়াদের বানিজ্য শুল্ক অ্যাদ দিতে হতো না। 

ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে বুর্জোয়াদের সংখ্যা কত ছিলো তা নিয়ে সঠিক কোন পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও, অনেক ঐতিহাসিকের মতে, বুর্জোয়াদের সংখ্যা ছিলো মোট জনসংখ্যার ৮ - ৯%। ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে এদের সংখ্যা খুব দ্রুত বেড়ে চলেছিলো। ফ্রান্সে ব্যাংকিং, শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে বুর্জোয়াদের একচেটিয়া প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। 

অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পার্থক্যের জন্য বুর্জোয়াদের মধ্যে ৩ টি স্তর গড়ে উঠেছিলো। যথা - (i) উচ্চ বুর্জোয়া, (ii) মধ্য বুর্জোয়া এবং (iii) নিন্ম বুর্জোয়া। 

(i) উচ্চ বুর্জোয়া :- উচ্চ বুর্জোয়ারা ছিলো অতিধনীবৃহৎ ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও ব্যাঙ্কাররা উচ্চ বুর্জোয়াশ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এরা অভিজাতদের জীবনযাত্রা নকল করতো। তাদের মতো বিলাস বহুল প্রাসাদ ও জীবন যাপন করতো। উচ্চ বুর্জোয়াদের অনেকে টাকার জোরে সরকারি পদ কিনে "পোশাকি অভিজাত" হতে পারলেও, বংশকৌলিন্য না থাকায় কাঙ্খিত সামাজিক মর্যাদা লাভ করতে পারেন নি। এজন্য ফ্রান্সের প্রচলিত সামাজিক কাঠামো এবং সাবেকি অভিজাতদের বিরুদ্ধে এদের ব্যাপক ক্ষোভ ছিলো। এই ক্ষোভের নিষ্পত্তির জন্যই তারা বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। 

(ii) মধ্য বুর্জোয়া :- উচ্চ বুর্জোয়াদের নীচের স্তরে ছিলো মধ্য বুর্জোয়ারা। এই শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত ছিলো আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক, অভিনেতা, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী। বুর্জোয়াদের মধ্যে মধ্য বুর্জোয়ারা ছিলো সবচেয়ে শিক্ষিত ও বুদ্ধিদীপ্ত শ্রেনী। এরা ছিলেন ফ্রান্সের শিক্ষা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। ফরাসি বিপ্লবের আগে দার্শনিকদের রচনা পড়ে এরা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। উচ্চ বুর্জোয়াদের সঙ্গে এদের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ছিলো। ১৭৮৯ খ্রিঃ ফরাসি বিপ্লবে মধ্য বুর্জারা নেতৃত্ব দিয়ে বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। 

(iii) নিন্ম বুর্জোয়া :- মধ্য বুর্জোয়ার নীচের স্তরে ছিলেন নিন্ম বুর্জোয়ারা। এদের আয় তেমন ছিলো না। পড়াশোনাও তেমন ছিলো না। ছোটখাটো কারিগরের কাজ ও পেশাদারি কাজ করে এরা জীবিকা নির্বাহ করতো। অনেক দোকানদারও নিন্ম বুর্জোয়া শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। 

(২.) কৃষক শ্রেনীর পরিচয় ও শ্রেনী বিন্যাস :- 

অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্স ছিলো একটি কৃষি নির্ভর দেশ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার ৮০% ছিলো কৃষক শ্রেনী। বুর্জোয়াদের মতো কৃষকদের মধ্যেও তিনটি স্তর ছিলো।
  • বড়ো কৃষকদের "জোতদার" বলা হতো। এরা শহরে বাস করতেন এবং গ্রামের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক ছিলো না। ফ্রান্সে এদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৬ লক্ষের কাছাকাছি। 
  • গ্রামে বাসকরা কৃষকদের মধ্যে একটি শ্রেনী ছিলো বেশ ধনী। এদেরকে বলা হতো "লেবোরার"। 
  • তবে গ্রামে বসবাসকরা সিংহভাগ কৃষক ছিলেন "ভূমিহীন ভাগচাষী"। এদের অবস্থা মোটেই ভালো ছিলো না। ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এদের কাজ ও মাথাপিছু আয় কমে যায়। 

(৩.) সাঁকুলেৎ শ্রেনীর পরিচয় ও ক্ষোভের কারন :-

প্রাক্ বিপ্লব ফ্রান্সের শহরের দরিদ্র মানুষদেরকে সাঁকুলেৎ বলা হতো। এরা ছিলেন কায়িক শ্রমদানকারী শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষ। খেটে খাওয়া দিনমজুর, কারখানার শ্রমিক, গৃহভৃত্য, রাজমিস্ত্রি, বাগানের মালি, ভবঘুরে ভিক্ষুক - এদের সকলকেই সাঁকুলেৎ বলা হতো। এদের নির্দিষ্ট জীবিকা যেমন ছিলো না, তেমনি ভালো বাসস্থানও ছিলো না। 

গ্রামের সামন্ততান্ত্রিক শোষনে জর্জরিত অনেক মানুষ কাজের সন্ধানে ফ্রান্সের শহর গুলোতে ভিড় করতো। এরাই সাঁকুলেৎ নামে পরিচিত হয়েছিলো। সমাজের উচ্চস্থানে থাকা লোকেরা সাঁকুলেৎদের শুধু ঘৃনাই করতো না, তাদের প্রতি অবজ্ঞাও দেখাতো। তাদের দুরাবস্থা নিয়ে কেউই চিন্তা করতো না। 

ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে খাদ্যশস্যের দাম প্রায় ৬০% বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সেই অনুপাতে মজুরি বাড়ে মাত্র ২২%। এর ফলে ফরাসি সমাজে সাঁকুলেৎ শ্রেনী অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতো। সাঁকুলেৎরা আশা করেছিলো, এমন একদিন আসবে, যেদিন তারাও কিছু সম্পত্তির মালিক হবে এবং তাদের সামাজিক শ্রেনী অবজ্ঞার অবসান ঘটবে। 

এই আকাঙ্খার জন্যই সাঁকুলেৎ শ্রেনী বিপ্লবের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে অংশগ্রহণ করে। প্রকৃতপক্ষে তারাই ছিলেন ফরাসি বিপ্লবে সংগ্রামী শ্রেনী। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলেই ফ্রান্সে বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটেছিলো। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post