ফ্রান্সে "সামাজিক ক্ষমতা" ও "সম্পদ বন্টনের" অসাম্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠন

১৭৮৯ খ্রিঃ ফরাসি বিপ্লব যখন শুরু হয়, তখন এই বিপ্লবের শ্লোগান ছিলো - সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা।  ফরাসি সমাজের অসাম্য দূর করে সব নাগরিকদের মধ্যে (১.) সাম্য(২.) মৈত্রীর ভাবনা অর্থাৎ সদ্ভাব স্থাপন করা এবং (৩.) ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বাদ সকল নাগরিকের কাছে পৌঁছে দেওয়াই ছিলো এই বিপ্লবের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য । এজন্য প্রচলিত "সামাজিক ক্ষমতা" ও "সম্পদ বন্টনের" অসাম্যের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করে ফ্রান্সে বিপ্লব শুরু হয়। 

ফ্রান্সে সামাজিক ক্ষমতা ও সম্পদ বন্টনে অসাম্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠন
ফ্রান্সে সামাজিক ক্ষমতা ও সম্পদ বন্টনে অসাম্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠন 


(ক.) বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সে "সামাজিক ক্ষমতা" ও "সম্পদ বন্টনে" অসাম্যের রূপবৈশিষ্ট্য :- 

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের সমাজ ব্যবস্থার চরিত্র ছিলো বৈষম্যমূলক ও সামন্ততান্ত্রিক। অসাম্যই ছিলো এই সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। খ্রিষ্টান ধর্মে ত্রিত্বের যে ধারনা ছিলো, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফরাসি সমাজকে তিনটি এস্টেটে ভাগ করা হয়েছিলো।

ফ্রান্সে "পুরাতন ব্যবস্থা" অনুযায়ী শ্রেনী বিভাজনের ক্ষেত্রে (১.) কোন সামাজিক সমতা রক্ষা করা হয় নি এবং (২.) অর্থনৈতিক সম্পদের সুষম বন্টনও করা হয় নি। এর ফলে বিপ্লবপূর্ব ফরাসি সমাজে সব সামাজিক ক্ষমতা ও সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছিলো ফ্রান্সের প্রথম দুই শ্রেণির মানুষ যাজক ও অভিজাতরা

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যা ছিলো প্রায় আড়াই কোটি। এর মধ্যে যাজক ও অভিজাতদের মোট সংখ্যা ছিলো মাত্র ৬ লক্ষ। মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩% হয়েও যাজক ও অভিজাতরা ফ্রান্সের সব সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতা এবং সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখেন। বংশকৌলিন্যের দোহাই দিয়ে এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ সমস্ত রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা, সামাজিক সম্মান, বিভিন্ন রাজকীয় পদ ও চাকুরি নিজেদের জন্য সংরক্ষিত রাখেন। 

জনসংখ্যার মাত্র ১% হয়েও যাজকরা মোট কৃষিজমির প্রায় ২০% ভোগ করতো। অন্যদিকে অভিজাতরা মোট জনসংখ্যার মাত্র দেড় থেকে দুই শতাংশ হয়েও দেশের কৃষিজ জমির প্রায় ৬০% ভোগ করতো। সহজ করে বলতে গেলে দেশের মোট ৮০% জমি যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায় কুক্ষিগত করে রাখলেও, এর জন্য রাষ্ট্রকে তারা কোন কর বা ট্যাক্স দিতেন না।

ধর্মীয় পদে থাকার কারনে যাজকরা সমাজে প্রভূত সম্মান লাভ করতেন। তাদের সামাজিক ক্ষমতা এতটাই ছিলো যে তারা রাজার আইন ও অনুশাসন মানতেন না। রাজা কোন যাজকের বিচারও করতে পারতেন না। প্রবল সামাজিক ক্ষমতার জোরে যাজকরা ফরাসি সমাজে সাধারন মানুষের কাছ থেকে টাইথ বা ধর্মকর আদায় করতেন।

অন্যদিকে উচ্চবংশজাত হওয়ার কারনে অভিজাতরা ফরাসি সমাজে প্রবল সামাজিক ক্ষমতা ভোগ করতেন। তাদের সামাজিক সম্মান ও মর্যাদা ছিলো যাজকদের ঠিক পরেই। নিজেদের সামাজিক মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখার কারনে অভিজাতরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা বা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতেন না। উচ্চবংশজাত ও নীলরক্তজাত হওয়ার কারনে রাষ্টের সিংহভাগ জমি, রাজকীয় ও প্রশাসনিক পদ এবং চাকুরিতে নিযুক্ত হবার অধিকার একমাত্র অভিজাতদেরই ছিলো।

আমরা আগেই বলেছি, বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে সম্পদ বন্টনের বৈষম্যের জন্য অভিজাতদের হাতে প্রচুর সম্পদ ও জমি থেকে গিয়েছিলো। নিজেদের সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করে পরবর্তীকালে অভিজাতরা টেক্স ছাড়ের সুবিধা লাভ করে নিজেদের সম্পদকে আরোও স্ফিত করে তোলেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার জোরে অভিজাতদের একাংশ ফ্রান্সে জমিদার বা সামন্তপ্রভুর ভূমিকা পালন করতেন ও কৃষকদের কাছ থেকে বহুবিধ সামন্ততান্ত্রিক কর আদায় করে নিজেদের সম্পদকে শতগুন বৃদ্ধি করেন। 

এককথায় বলতে গেলে বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে সম্পদ ও সামাজিক ক্ষমতার রাশ যাজক ও অভিজাতদের হাতে চলে যায়। অভিজাতদের সামাজিক ক্ষমতা এতখানি ছিলো যে, তাদের অসন্তুষ্ট করে রাজা কখনই শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারতেন না। ফ্রান্সের প্রদেশ গুলিতে পার্লেমঁ নামে অভিজাতদের একধরনের বিচার সভা ছিলো। রাজার তৈরি যেকোন আইন প্রদেশ গুলিতে লাগু করার জন্য পার্লেমঁর অনুমোদন লাগাতো। এথেকেই বোঝা যায়, অভিজাতদের আর্থ - সামাজিক তথা রাজনৈতিক ক্ষমতা কতখানি ছিলো।

সংখ্যার দিক থেকে যথেষ্ট কম হওয়া সত্ত্বেও, যাজক ও অভিজাতরা স্টেটস জেনারেলে পৃথক কক্ষ ও সম্প্রদায়ভিত্তিক ভোটদান ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের সামাজিক ক্ষমতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলো। এক্ষেত্রে স্বৈরাচারী বুরবোঁ রাজবংশ যাজক ও অভিজাতদের বিশেষ সুবিধা নীতির রক্ষক ও ধারক - বাহক ছিলো। 

যাজক ও অভিজাত বাদ দিয়ে ফ্রান্সের অন্যান্য পেশার সাধারন নাগরিকদের নিয়ে গঠিত হয়েছিলো থার্ড এস্টেট। ফ্রান্সের মোট আড়াই কোটি লোকের মধ্যে এদের সংখ্যা দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ। এরা ছিলো মোট জনসংখ্যার ৯৭%। দেশের সাধারণ ও প্রকৃত নাগরিক এরাই ছিলেন। এদের বংশ কৌলিন্য ছিলো না বলে এরা সরকারি কোন পদে বা চাকুরিতে নিযুক্ত হতে পারতো না। উচ্চবংশজাত না হওয়ায় এরা সমাজে কোন সামাজিক সম্মান বা ক্ষমতা ভোগ করতেন না। এদের কোন রাজনৈতিক অধিকারও ছিলো না। দেশের মোট কৃষিজমির মাত্র ২০% এদের হাতে ছিলো। এরা বিভিন্ন করভারে জর্জরিত ছিলেন।

খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে ধর্মীয় পদে থাকার কারনে এবং উচ্চবংশজাত হওয়ার কারনে যাজক ও অভিজাতরা সমাজে উপযুক্ত সামাজিক সম্মান, সুযোগ সুবিধা ও ক্ষমতা ভোগ করতেন। তারা বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন ও সুবিধাভোগী হওয়ায় রাষ্ট্রীয় সম্পদের সিংহভাগও তারা ভোগ করতেন। নিজেদের সামাজিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে এই দুই শ্রেনী সমাজের দুর্বল সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর শোষন চালিয়ে করের মাধ্যমে নিজেদের সম্পদকে আরোও স্ফিত থেকে স্ফিততর করতে থাকেন। ক্রমে বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সের স্বৈরাচারী বুরবোঁ রাজতন্ত্র সুবিধাভোগী ও ক্ষমতাভোগী যাজক এবং অভিজাতদের ক্রীড়নকে পরিনত হয়। এইভাবে বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পদ এবং ক্ষমতার রাশ একচেটিয়া ভাবে অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায় কুক্ষিগত করে ও নিজেদের হাতে ধরে রাখে।

(খ.) সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠন :- 

মাথায় রাখতে হবে, বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে তিনটি এস্টেটের মধ্যে তৃতীয় এস্টেটের মধ্যে সমাজের ৯৭% লোককে ভরে দেওয়া হয়েছিলো। প্রথম ও দ্বিতীয় এস্টেটে মাত্র ৩% লোককে রেখে দিয়ে তাদের হাতে  সব সম্পদ ও সুবিধা যেভাবে পাইয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছিলো, তাতে ফ্রান্সের সামাজিক ক্ষমতার পুরো রাশটাই চলে যায় মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এই প্রতিক্রিয়া থেকেই প্রচলিত বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত হয়। পরবর্তীকালে এই সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ জনমতের চাপেই সংগঠিত হয় বিপ্লব।

(অ.) জনমত গঠনে দার্শনিকদের ভূমিকা :- 

প্রচলিত সামাজিক ক্ষমতা ও সম্পদ বন্টনের অসাম্যের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠনে সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ফ্রান্সের দার্শনিকরা

বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সে যাজক ও অভিজাতদের একচেটিয়া সামাজিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সম্পদ ভোগকে দার্শনিকরা অন্যায়, অসাম্য ও সামাজিক ন্যায় বিচারের পরিপন্থী বলে অভিহিত করেন।

(১.) ফ্রান্সের প্রচলিত বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে "পার্সিয়ান লেটার্স" গ্রন্থে প্রবলভাবে সোচ্চার হন দার্শনিক মন্তেস্কু। তিনি তাঁর অপর গ্রন্থ "স্পিরিট অব লজ" গ্রন্থে সামাজিক ন্যায় বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য "ক্ষমতা বিভাজন নীতি" প্রচার করেন। 

(২.) রুশো তাঁর "অসাম্যের সূত্রপাত" গ্রন্থে সব মানুষের সমান অধিকারের পক্ষে সওয়াল করেন। তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো সওয়াল করে লেখেন, প্রত্যেক মানুষ স্বাধীন ভাবে নিজের ইচ্ছায় জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু জন্মের পর সমাজ তাকে শৃঙ্খলিত অর্থাৎ পরাধীন করে তোলে। এই পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেলার জন্য রুশ আহ্বান জানান, যা ফ্রান্সের অবদমিত ও নিপীড়িত শ্রেনী গুলির কাছে মুক্তির স্বাদ পৌঁছে দেয়। 

(৩.) ভলতেয়ার ফ্রান্সের আর্থ - সামাজিক বৈষম্য এবং শোষনের জন্য স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ও যাজকতন্ত্রকেই দায়ী করেন। 

(৪.) দার্শনিক মরেলি ও লিঙ্গুয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের সমাধানের জন্য সমাজবাদের কথা তুলে ধরেন। 

সামাজিক অসাম্যের পাশাপাশি বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সে সম্পদ বন্টনের অসাম্যের বিরুদ্ধেও দার্শনিকরা সোচ্চার হন এবং শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে জনমত গঠন করেন। 

(১.) রুশো তাঁর "ডিসকোর্সেস অন দ্য আর্টস অ্যান্ড দ্য সাইন্স (১৭৬২)" গ্রন্থে লেখেন, সভ্যতার আদিলগ্নে মানুষের কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিলো না। পরে সমাজের দুর্বল অংশকে শোষন করে একটি শ্রেনী ব্যক্তিগত সম্পত্তির জন্ম দেন। রুশো এই ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে যাবতীয় সমাজিক শোষন ও অসাম্যের মূল কারন বলে চিহ্নিত করেন। 

(২.) রুশোর মতোই দার্শনিক মরেলি ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে যাবতীয় অনর্থের মূল বলে অভিহিত করেন। 

(৩.) অন্যদিকে বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সের অর্থনৈতিক শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তীব্র কটাক্ষ করে মন্তেস্কু লেখেন - "ফরাসি রাজার সোনার খনি নেই, প্রজাদের শোষন করেই তিনি অর্থ জোগাড় করেন।"

দার্শনিকদের মতবাদ ও ভাষ্য ফ্রান্সের প্রচলিত সামাজিক অন্যায় ও শোষনের বিরুদ্ধে শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। বিপ্লবের বিভিন্ন পর্বে শিক্ষিত মানুষদের মধ্য থেকেই নেতৃত্ব উঠে এসেছিলো। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষোভকে বহিঃপ্রকাশের বুদ্ধিদীপ্ত ভাষা ও দিশা দার্শনিকরা দেখিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে দার্শনিকদের মত ও পথকে অবলম্বন করেই বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ বিপ্লবকে সংগঠিত করার ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

(আ.) জনমত গঠনে পত্রপত্রিকা ও সভা সমাবেশের ভূমিকা :-

প্রচলিত সামাজিক ক্ষমতা ও সম্পদ বন্টনের অসাম্যের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ফ্রান্সের বিভিন্ন পত্র পত্রিকা। মাথায় রাখতে হবে, ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সে পত্র পত্রিকার সংখ্যা ইওরোপের মধ্যে সবথেকে বেশি ছিলো। এইসময় ফ্রান্সে প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা ছিলো ১৬৯ টি। এইসব পত্র পত্রিকায় দার্শনিকদের বিভিন্ন মতবাদ ও প্রচলিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের বিরুদ্ধে নানা লেখা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো। এগুলি প্রচলিত বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।

এছাড়া, দার্শনিকদের মতবাদ ও প্রচলিত বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ফ্রান্সে সালো, বসার ঘর, কাফে ও রেস্তোরা গুলিতে নিয়মিত আলোচনা হতো। এইসব আলোচনা বিপ্লবের স্বপক্ষে জনজাগরন ও জনমত সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে দার্শনিকদের রচনা যে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিলো তার প্রমান পাওয়া যায় মন্তেস্কুর "স্পিরিট অব লজ" গ্রন্থটির মধ্যে। অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার কারনে এই গ্রন্থটি মাত্র ১৮ মাসে ২২ টি সংস্করন পুরোপুরি নিঃশেষিত হয়েছিলো। ফ্রান্সে হাট বাজার, আদালত, সভা সমিতি, থিয়েটার ও একাডেমি গুলিতে দার্শনিকদের ভাষ্য ও মতবাদ গুলি নিয়ে তর্ক বিতর্ক ও আলোচনা বিপ্লবের স্বপক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।

(ই.) জনমত গঠনে বুর্জোয়া ও অন্যান্য শ্রেনীগুলির ভূমিকা :-

ফ্রান্সের প্রচলিত সামাজিক ক্ষমতা ও সম্পদ বন্টনে অসাম্যের বিরুদ্ধে সবথেকে অসন্তুষ্ট ছিলেন বুর্জোয়া শ্রেনীর লোকেরা। বুর্জোয়ারা ছিলেন বিপ্লব পূর্ববর্তী ফ্রান্সের সবচেয়ে শিক্ষিত উদীয়মান শ্রেনী। ফরাসি বিপ্লবের আগে ফ্রান্সে ব্যবসা বাণিজ্যের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিলো। এর ফলে বুর্জোয়া শ্রেনীর হাতে যথেষ্ট টাকা পয়সা এসেছিলো। অর্থনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও, ফরাসি সমাজের ক্ষমতার রাশ তাদের হাতে ছিলো না। বংশকৌলিন্য না থাকায় তারা যোগ্য সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করতে পারেন নি। তাই সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও সভা সমাবেশে বক্তব্য রেখে তারা শক্তিশালী জনমত গঠন করেন। বুর্জোয়াদের চিন্তাধারা দ্বারা তৃতীয় সম্প্রদায়ের অন্যান্য শ্রেনী গুলি অর্থাৎ সাধারন কৃষক ও সাঁকুলেৎরা যাজক - অভিজাতদের বিশেষ অধিকার, সুবিধাবাদ ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতন ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলো। 

ক্রমে বুর্জোয়াদের পক্ষে বেশ কিছু উদারপন্থী শিক্ষিত যাজক ও অভিজাত যোগ দিলে ফরাসি বিপ্লবের পক্ষে জনমত আরও শক্তিশালী হয়। উদারপন্থী অভিজাত অ্যাবে সিয়েস "What is the Third Estate?" গ্রন্থের মাধ্যমে সামাজিক ক্ষমতার বৈষম্যের বিরুদ্ধে শক্তিশালী জনমত গঠন করেন। এই গ্রন্থে অ্যাবে সিয়েস তৃতীয় এস্টেটকেই আসল ও প্রকৃত ফরাসি জাতি বলে অভিহিত করেন এবং অভিজাত ও যাজকদের সুবিধাবাদের নিন্দা করেন।

স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান করার পর উদারপন্থী অভিজাত ও যাজকদের অনেকে তৃতীয় সম্প্রদায়ে যোগদান করলে বিপ্লবের স্বপক্ষে জনমত অত্যন্ত শক্তিশালী হয়। মাথায় রাখতে হবে, ফরাসি সমাজে গ্রামীন এলাকায় থাকা নিন্মতর যাজকরা উচ্চ যাজকদের মতো সুযোগ সুবিধা না পেয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব ছিলো। তারা গ্রামগঞ্জে সাধারন মানুষের মধ্যে অসাম্যের বার্তা প্রচার করে জনমত গঠনে সহায়তা করেন।

বিপ্লবপূর্ব সমাজে তিনটি এস্টেটের মধ্যে থাকা মানুষদের মধ্যে নানা শ্রেনীগত দ্বন্দ্ব ছিলো। উচ্চতর যাজকদের বিরুদ্ধে নিন্মতর যাজকদের ক্ষোভ ছিলো। জন্মসূত্রে অভিজাতদের বিরুদ্ধে পোশাকি অভিজাতদের ক্ষোভ ছিলো। এইসব ক্ষোভের কারনে সামাজিক বৈষম্যের শিকার যেমন সকলেই হয়েছিলেন, তেমনি শ্রেনীগত সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে সকলেই সোচ্চার ছিলেন। বিক্ষুব্ধ অবদমিত শ্রেনী গুলির আওয়াজ, ক্ষোভ প্রদর্শন ও নানা বক্তব্য ফরাসি বিপ্লবের স্বপক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

(ঈ.) জনমত গঠনে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও দলের ভূমিকা :-

প্রচলিত সামাজিক ক্ষমতা ও সম্পদ বন্টনের অসাম্যের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠনে ফ্রান্সের বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। এইসব রাজনৈতিক দল গুলির মধ্যে অন্যতম ছিলো - প্যাট্রিয়াটিক দল, জেকোবিন দল, জিরন্ডিস্ট দল, ব্রিসোপন্থী ফিউল্যান্ট দল, হেবার্টিস্ট দল, প্যান্থিয়ান ক্লাব। এইসব রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী গুলির সকলেই সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় জনমত গঠন করেন।

মূল্যায়ন :-

এইভাবে দেখা যায়, বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে ফরাসি দার্শনিক, শিক্ষিত, উদারপন্থী নানা শ্রেনী ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী গুলির উদ্যোগে সামাজিক ক্ষমতা ও সম্পদ বন্টনে অসাম্যের বিরুদ্ধে শক্তিশালী জনমত গঠিত হয়। বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, সভা সমাবেশ, বৈঠকি আড্ডা ইত্যাদিতে ব্যাপক প্রচারের ফলে বৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে সমগ্র জাতির মধ্যে শক্তিশালী জনমত গঠিত হয়। ক্রমে অভিজাত ও যাজকদের সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা প্রতিবাদ জানান ও ক্ষোভ প্রদর্শন করেন। অভিজাত ও যাজকদের সামাজিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে তৃতীয় সম্প্রদায়ের বুর্জোয়া প্রতিনিধিরা স্টেটস জেনারেলে যৌথ অধিবেশন ও মাথা পিছু ভোটের দাবি তোলেন। কৃষকরা সম্পদের অসম বন্টনের বিরুদ্ধে সোচ্চার আওয়াজ তুলে সামন্তপ্রথার বিলোপ ও ভূমি বন্টনের দাবি তোলেন। কৃষক ও সাঁকুলেৎদের মধ্যে সম্পদ বন্টনের অসাম্যের বিরুদ্ধে শক্তিশালী জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় বোবসপিয়ারের জ্যোকোবিন দল

এইভাবে বিপ্লবের আগে ও বিপ্লব চলাকালীন সময়ে (১.) বিভিন্ন শ্রেনী, (২.) রাজনৈতিক গোষ্ঠী, (৩.) বিভিন্ন সভা সমাবেশ(৪.) পত্র পত্রিকার মাধ্যমে সামাজিক ক্ষমতা ও সম্পদ বন্টনে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ফরাসি বাসীদের মধ্যে শক্তিশালী জনমত গঠিত হয়। এই শক্তিশালী জনমতের মাধ্যমেই ফরাসি জাতির মধ্যে "বিপ্লবী চেতনার" প্রসার ঘটেছিলো। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post