আধুনিককালে অর্থশাস্ত্র সম্পর্কিত আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অর্থশাস্ত্রে বর্নীত কৌটিল্যের রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রকৃতি বা চরিত্র। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতে কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র নামক রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক তাত্ত্বিক গ্রন্থটি লিখেছিলেন। এই গ্রন্থে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রায় সকল দিক গুলিকে নিয়েই কৌটিল্য আলোচনা করেছিলেন।
অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত কৌটিল্যের রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত নির্দেশ ও আলোচনা থেকে কৌটিল্যীয় রাষ্ট্রের স্বরূপ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা করা যায়। অর্থশাস্ত্রে বর্নীত রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য গুলি গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষন করে কৌটিল্যের রাষ্ট্র ব্যবস্থার যে প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে তা নিন্মলিখিত ভাবে আমরা তুলে ধরতে পারি।
![]() |
অর্থশাস্ত্রে বর্নীত রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রকৃতি |
(ক.) সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব :-
কৌটিল্য যে কল্পিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই রাষ্ট্র ছিলো রাজতন্ত্র শাসিত। কৌটিল্য তাঁর রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করে এর সাতটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কথা তুলে ধরেছিলেন। যথা - (১) স্বামী বা রাজা, (২) অমাত্য বা আমলা, (৩) জনপদ বা রাষ্ট্র, (৪) পুর বা দুর্গ, (৫) কোশ বা অর্থভান্ডার, (৬) দন্ড বা শাস্তিবিধান/ন্যায় বিচারের জন্য শক্তি প্রয়োগ,(৭) মিত্র বা বন্ধু। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ সম্পর্কিত কৌটিল্যের এই তত্ত্বকে একত্রে "সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব" বলা হয়ে থাকে।
- রাজা :- সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের সর্বপ্রথম অঙ্গ ছিলো স্বামী বা রাজা, যাকে রাষ্ট্রের মস্তিষ্কের সঙ্গে তুলনা করা হয়। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা রাজার হাতেই ন্যস্ত থাকে। তিনি আইন, শাসন, বিচার, সামরিক বাহিনী সব কটি বিভাগেরই প্রধান। জনসমর্থন ও প্রজা অনুগত্যের জন্য কৌটিল্য উচ্চবংশের বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
- অমাত্য :- রাষ্ট্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি ছিলো অমাত্য বা আমলা। রাষ্ট্রের সমস্ত শ্রেণির রাজকর্মচারীদের অমাত্যদের মধ্য থেকেই নিযুক্ত হবার কথা কৌটিল্য বলেছিলেন।
- জনপদ :- রাষ্ট্রের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিলো জনপদ বা জনবেশিষ্টিত ভূভাগ। রাজার শাসন যেমন জনপদে বর্ষিত হয় তেমনি জনপদ থেকেই রাজা রাজস্ব ও সৈন্য সংগ্রহ করেন। অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, জনপদ কতগুলি "স্থানীয়" তে (জেলা) বিভক্ত ছিলো। স্থানীয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলো ৮০০ টি গ্রাম। সাধারনত ১০০ থেকে ৫০০ পরিবার নিয়ে এক একটি গ্রাম গঠিত হতো।
- পুর :- পুর বা দুর্গ হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কৌটিল্যের মতে, শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান ছিলো দুর্গ। কৌটিল্য ঔদক (জলবেষ্টিত এলাকা), পার্বত (পার্বত্য অঞ্চল ), ধান্বন (মরু বা জনমানবহীন অঞ্চল), অরন্য (বনাঞ্চল এলাকায়) - ৪ ধরনের দুর্গ নির্মানের সুপারিশ করেছেন। এর মধ্যে ঔদক কে রাজধানী হিসাবে গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন।
- কোশ :- রাষ্টের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো কোশ বা অর্থভান্ডার। কৌটিল্য সর্বদা রাজকোষকে পরিপূর্ন রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। কারন রাজ্যের সেনা সংগঠন থেকে শুরু করে, প্রজাকল্যানমূলক নানা কাজ, যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য, রাজকর্মচারীদের বেতন এসব কিছুর জন্য অর্থ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
- দন্ড :- দন্ড বা বল হলো রাষ্ট্রের ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। দন্ড বা শাস্তিবিধানের মাধ্যমে রাজা একদিকে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করেন, তেমনি দন্ড বা বলের সাহায্যে সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে রাজা দেশ বিরোধী শক্তিগুলিকেও দমন করেন।
- মিত্র :- কৌটিল্য বর্নীত রাষ্ট্রের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি ছিলো মিত্র বা বন্ধু। কৌটিল্যের মতে, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য বন্ধু রাজা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্র স্বভাবগত শত্রু হয় এবং শত্রুরাষ্ট্রের পরবর্তী রাষ্ট্র স্বভাবগত মিত্র হয়।