আধুনিককালে অর্থশাস্ত্র সম্পর্কিত আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অর্থশাস্ত্রে বর্নীত কৌটিল্যের রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রকৃতি বা চরিত্র। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতে কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র নামক রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক তাত্ত্বিক গ্রন্থটি লিখেছিলেন। এই গ্রন্থে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রায় সকল দিক গুলিকে নিয়েই কৌটিল্য আলোচনা করেছিলেন।
অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত কৌটিল্যের রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত নির্দেশ ও আলোচনা থেকে কৌটিল্যীয় রাষ্ট্রের স্বরূপ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা করা যায়। অর্থশাস্ত্রে বর্নীত রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য গুলি গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষন করে কৌটিল্যের রাষ্ট্র ব্যবস্থার যে প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে তা নিন্মলিখিত ভাবে আমরা তুলে ধরতে পারি।
 |
অর্থশাস্ত্রে বর্নীত রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রকৃতি |
(ক.) সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব :-
কৌটিল্য যে কল্পিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই রাষ্ট্র ছিলো রাজতন্ত্র শাসিত। কৌটিল্য তাঁর রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করে এর সাতটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কথা তুলে ধরেছিলেন। যথা - (১) স্বামী বা রাজা, (২) অমাত্য বা আমলা, (৩) জনপদ বা রাষ্ট্র, (৪) পুর বা দুর্গ, (৫) কোশ বা অর্থভান্ডার, (৬) দন্ড বা শাস্তিবিধান/ন্যায় বিচারের জন্য শক্তি প্রয়োগ,(৭) মিত্র বা বন্ধু। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ সম্পর্কিত কৌটিল্যের এই তত্ত্বকে একত্রে "সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব" বলা হয়ে থাকে।
- রাজা :- সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের সর্বপ্রথম অঙ্গ ছিলো স্বামী বা রাজা, যাকে রাষ্ট্রের মস্তিষ্কের সঙ্গে তুলনা করা হয়। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা রাজার হাতেই ন্যস্ত থাকে। তিনি আইন, শাসন, বিচার, সামরিক বাহিনী সব কটি বিভাগেরই প্রধান। জনসমর্থন ও প্রজা অনুগত্যের জন্য কৌটিল্য উচ্চবংশের বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
- অমাত্য :- রাষ্ট্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি ছিলো অমাত্য বা আমলা। রাষ্ট্রের সমস্ত শ্রেণির রাজকর্মচারীদের অমাত্যদের মধ্য থেকেই নিযুক্ত হবার কথা কৌটিল্য বলেছিলেন।
- জনপদ :- রাষ্ট্রের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিলো জনপদ বা জনবেশিষ্টিত ভূভাগ। রাজার শাসন যেমন জনপদে বর্ষিত হয় তেমনি জনপদ থেকেই রাজা রাজস্ব ও সৈন্য সংগ্রহ করেন। অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, জনপদ কতগুলি "স্থানীয়" তে (জেলা) বিভক্ত ছিলো। স্থানীয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলো ৮০০ টি গ্রাম। সাধারনত ১০০ থেকে ৫০০ পরিবার নিয়ে এক একটি গ্রাম গঠিত হতো।
- পুর :- পুর বা দুর্গ হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কৌটিল্যের মতে, শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান ছিলো দুর্গ। কৌটিল্য ঔদক (জলবেষ্টিত এলাকা), পার্বত (পার্বত্য অঞ্চল ), ধান্বন (মরু বা জনমানবহীন অঞ্চল), অরন্য (বনাঞ্চল এলাকায়) - ৪ ধরনের দুর্গ নির্মানের সুপারিশ করেছেন। এর মধ্যে ঔদক কে রাজধানী হিসাবে গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন।
- কোশ :- রাষ্টের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো কোশ বা অর্থভান্ডার। কৌটিল্য সর্বদা রাজকোষকে পরিপূর্ন রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। কারন রাজ্যের সেনা সংগঠন থেকে শুরু করে, প্রজাকল্যানমূলক নানা কাজ, যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য, রাজকর্মচারীদের বেতন এসব কিছুর জন্য অর্থ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
- দন্ড :- দন্ড বা বল হলো রাষ্ট্রের ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। দন্ড বা শাস্তিবিধানের মাধ্যমে রাজা একদিকে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করেন, তেমনি দন্ড বা বলের সাহায্যে সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে রাজা দেশ বিরোধী শক্তিগুলিকেও দমন করেন।
- মিত্র :- কৌটিল্য বর্নীত রাষ্ট্রের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি ছিলো মিত্র বা বন্ধু। কৌটিল্যের মতে, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য বন্ধু রাজা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্র স্বভাবগত শত্রু হয় এবং শত্রুরাষ্ট্রের পরবর্তী রাষ্ট্র স্বভাবগত মিত্র হয়।
আধুনিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগন রাষ্ট্রকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেন, তাতে রাষ্ট্রের কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কথা তুলে ধরা হয়। এগুলির মধ্যে অন্যতম হলো - জনবেশিষ্টিত ভূখন্ড, সুগঠিত সরকার, সর্বভৌমত্ব, অন্য রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃতিদান, সামরিক ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য ইত্যাদি। কৌটিল্য বর্নীত সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের মধ্যে আধুনিক রাষ্ট্রের সকল বৈশিষ্ট্য গুলিকেই খুঁজে পাওয়া যায়।
(খ.) রাষ্ট্রের আয়োতন :-
কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে যে রাষ্ট্রের চিত্র অঙ্কন করেন, সেই রাষ্টের আয়তন কেমন ছিলো তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক দেখা যায়। কারন রাষ্ট্রের আয়োতন কেমন হওয়া উচিৎ এ সম্পর্কে কৌটিল্য কোথাও সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য উপস্থাপিত করেন নি। এক্ষেত্রে তাই কৌটিল্যের রাষ্ট্র নীতি অধ্যায়ন করে কেউ কেউ বলেছেন, কৌটিল্য বৃহৎ আয়তনের রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন। অনেকে আবার এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, কৌটিল্য মাঝারি আয়তনের রাষ্ট্রের সমর্থক ছিলেন। দুই মতের প্রবক্তারাই তাদের মতের স্বপক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেছিলেন।
কৌটিল্য রাজাকে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ ও যুদ্ধের দ্বারা শত্রু রাজ্য দখলের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাছাড়া মনে রাখতে হবে, কৌটিল্যের সময় রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস ছিলো ভূমিরাজস্ব। কৌটিল্য শক্তিশালী রাজা ও রাষ্ট্র নির্মানের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। রাজা যত ভূমির মালিক হবেন, তার প্রাপ্ত ভূমিরাজস্বের পরিমান তত বেশি হবে। ভূমির ওপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ছিলো অর্থনীতি। এই কারনে কৌটিল্য তার রচিত গ্রন্থের নামকরন করেছিলেন "অর্থশাস্ত্র"।
অর্থশাস্ত্রের অন্তর্নিহিত মূল উদ্দেশ্য বা ভাবধারা থেকে এটি অত্যন্ত স্পষ্ট, কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে এমন এক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কামনা করেছিলেন যা আয়তনে হবে বিশাল। যদিও আর পি কাঙ্গলে এই মতের বিরোধিতা করে বলেছেন, কৌটিল্য ১২ টি রাষ্ট্র নিয়ে একটি মন্ডল গঠনের উল্লেখ করেছিলেন। রাষ্ট্রের আয়তন যদি খুব বড়ো হয় তাহলে এরূপ মন্ডল গঠন করা সম্ভব ছিলো না। তাই একথা বলা যায়, কৌটিল্য মাঝারি আয়তনের রাষ্ট্রের সমর্থক ছিলেন। তাছাড়া, অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য যে সুশাসিত, সুশৃঙ্খল, জনকল্যানমূলক রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন, তা কখনই বৃহৎ রাষ্ট্রে কার্যকর করা সম্ভব ছিলো না।
তাই সবদিক বিবেচনা করে একথা বলা যায়, কৌটিল্য এমন আয়তনের রাষ্ট্রের সমর্থক ছিলেন, যা সাম্রাজ্যবাদ ও প্রজাকল্যান এই দুয়ের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ন ছিলো। গানিতিক বিচারে যার আয়তনের পরিমাপ এককথায় ছিলো অনির্দিষ্ট।
(গ.) নিরঙ্কুশ রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র :-
অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্যীয় রাষ্ট্র ছিলো রাজতন্ত্র শাসিত। প্রজাদের আনুগত্য লাভের জন্য কৌটিল্য সর্বদা উচ্চবংশজাত বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রকে সমর্থন করেছেন। তবে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের সমর্থন করলেও যোগ্য রাজার অযোগ্য রাজকুমারকে কখনই রাজা করার নীতিতে কৌটিল্য বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর মতে একজন রাজাকে রাজা হতে গেলে বহু গুন ও যোগ্যতার অধিকারী হতে হয়। সেই রাজা একটি দক্ষ আমলাতন্ত্রের সাহায্যে রাষ্ট্রের শাসন পরিচালনা করবেন।
কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে অত্যন্ত তাড়াতাড়ি বা শীঘ্র সমস্যার সমাধানের পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন। কৌটিল্যের এই বক্তব্যে গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা প্রজাতান্ত্রিক শাসনের বিরোধিতার সুর পরিলক্ষিত হয়। সমসাময়িক কালে উপজাতিদের মধ্যে গনতান্ত্রিক ধারার শাসন পদ্ধতির প্রচলন ছিলো। কিন্তু সেই শাসন পদ্ধতিকে কৌটিল্য মোটেই পছন্দ করেন নি। অর্থশাস্ত্রে তিনি উপজাতিদের দমনের জন্য রাজাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি অর্থশাস্ত্রে যে কেন্দ্রীভূত আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার চিত্র অঙ্কন করেন, সেখানে কোন গনতান্ত্রিক বা বিকেন্দ্রীকরনে ধারা প্রশাসনে লক্ষ্য করা যায় নি।
তবে শাসন ব্যবস্থায় গনতান্ত্রিক ধ্যান ধারনাকে অস্বীকার করলেও, প্রশাসনে জনসমর্থনের গুরুত্বকে কৌটিল্য কখনই উপেক্ষা করেন নি। রাষ্ট্রের সর্বাত্মক ক্ষমতার ওপর জোর দেওয়া সত্ত্বেও কৌটিল্য সাধারণ মানুষের শক্তিকে কখনই উপেক্ষা করেন নি। অর্থশাস্ত্রে তিনি সাধারণ মানুষের অসন্তোষের কারন ও তার পরিনামের কথা বার বার রাজাকে স্মরন করিয়ে দিয়েছেন। কৌটিল্য রাজাকে অসন্তুষ্ট মানুষের সঙ্গে সমঝোতা এবং তাদের ভাবনা ও চাহিদাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য রাজাকে সুপরামর্শ দিয়েছেন।
বস্তুতপক্ষে কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রের যে মডেল তৈরি করেছিলেন তাতে রাজতন্ত্র, আমলাতন্ত্র এবং জনসাধারণের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখা হয়েছিলো। প্রজানুরঞ্জন ও প্রজাকল্যানের মাধ্যমে সমগ্র প্রজাশক্তিকে রাজানুগত্যে বেঁধে রাখার পরামর্শ কৌটিল্য দিয়েছিলেন।
(ঘ.) স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র নয় :-
কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে রাজার নিরঙ্কুশ ক্ষমতার পক্ষে যে সুপারিশ করেছিলেন, তাতে রাজার স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠার যথেষ্ট সুযোগ ছিলো। কিন্তু অত্যন্ত সচেতন ভাবেই কৌটিল্য রাজার স্বেচ্ছাচারীকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা করেছিলেন।
রাজাকে যেকোন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মন্ত্রীদের সঙ্গে বা মন্ত্রীদের পরিষদে আলাপ আলোচনা করে পরামর্শ গ্রহন করতে হতো। বলা বাহুল্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মতামতকে রাজা সহজে উপেক্ষা বা বর্জন করতেন না। মন্ত্রীপরিষদের উপদেশ রাজা মানতে বাধ্য না হলেও, তারা রাজার ভুল ও স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তকে প্রতিহত করতে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতেন, তাকে কোন ভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত ছাড়াও পোরান পকিতি বা প্রচলিত সামাজিক অনুশাসন, রাজ পুরোহিতের পরামর্শ, প্রজাকল্যানের আদর্শ ইত্যাদি নানাবিধ দিক গুলিকে উপেক্ষা করা কখনই রাজার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। ফলতঃ অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত রাজতন্ত্র নিরঙ্কুশ ও ক্ষমতাশালী হলেও, স্বেচ্ছাচারী বা স্বৈরাচারী ছিলো না।
(ঙ.) আমলাতান্ত্রিকতা ও সর্বনিয়ন্ত্রনবাদী রাষ্ট্র :-
কৌটিল্যের রাষ্ট্র ব্যবস্থার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিলো দক্ষ আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা। অর্থশাস্ত্রে যে বিপুল পরিমান রাজকর্মচারীদের ভূমিকার উল্লেখ আছে, তা থেকেই দক্ষ আমলাতান্ত্রিকতার ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রনের ছবি ফুটে ওঠে।
কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে এক সর্বনিয়ন্ত্রনবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র কেবল তার অধিবাসীদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করবে না। তাদের অর্থনৈতিক কাজকর্মও নিয়ন্ত্রন করবে। অর্থশাস্ত্রে বড়ো আকারের ব্যবসা বাণিজ্য এবং শিল্পে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া রাষ্ট্রের নাগরিকদের সব রকমের পেশা এবং বৃত্তির ওপর রাষ্ট্রের কার্যকরী নিয়ন্ত্রন থাকবে। রাষ্ট্র সব রকমের আমোদ প্রমোদ ও বিনোদনের ওপরেও নিয়ন্ত্রন রাখবে।
অর্থশাস্ত্রে যে সর্বনিয়ন্ত্রনবাদের কথা বলা হয়েছিলো, তার পরিধির সুতা পারিবারিক ক্ষেত্র পর্যন্ত সম্প্রসারিত ছিলো। অর্থশাস্ত্রে পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক ব্যবহার কি হবে, তাও বিস্তৃত ভাবে লেখা ছিলো। ফলতঃ রাষ্ট্রের সর্বনিন্ম একক যে পরিবার সেখান থেকেই কৌটিল্যের রাষ্ট্রের অনুশাসন শুরু হয়েছিলো।
রাষ্ট্রের সর্বনিয়ন্ত্রনবাদীতার প্রয়োজনেই কৌটিল্যের রাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ রাজকর্মচারীর প্রয়োজন পড়েছিলো। শিল্প, বানিজ্য এবং সেতু, খনি, বনাঞ্চল, পথঘাট, বাজার এমনকি বারবনিতা পল্লী থেকে রাষ্ট্রের আর্থিক আয়ের উৎস গুলির নিয়ন্ত্রনের জন্য দক্ষ রাজকর্মচারীর প্রয়োজন পড়েছিলো। বৃক্ষ যেমন শত সহস্র বিন্যস্ত শিকড়ের মধ্য দিয়ে মৃত্তিকা থেকে তার শক্তির রসদ সংগ্রহ করে নেয়, তেমনি রাষ্ট্রও এক বিশাল দক্ষ আমলাতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে আয়ের উৎস গুলির মধ্যে তার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে শক্তির জাল বিস্তার করবে।
মনে রাখতে হবে, কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্র সম্পর্কে যে ধারণা পেশ করেছেন, তাতে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় শক্তির কথা বলা হয়েছে। ওই শক্তি আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রন করবে। অর্থশাস্ত্রে প্রত্যন্ত জনপদ, গভীর বনাঞ্চল, গোচারনভূমি থেকে বেশ্যালয় কোন কিছুই রাষ্ট্রের দৃষ্টির বাইরে নয়। সব কিছুর জন্যই অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের কথা বলা হয়েছে।
অর্থশাস্ত্রে যে সর্বনিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার বিধানের কথা বলা হয়েছিলো, তা থেকে রাজকর্মচারীরাও বাদ ছিলেন না। অর্থশাস্ত্রের প্রত্যেক কর্মচারীদেরই কতক গুলি স্তর ভেদে একটি শৃঙ্খল বা চেনের মধ্যে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। অধস্তন কর্মচারীদের কাজকর্ম ও হিসাব পরীক্ষা করতেন উর্ধতন কর্মচারীরা। আবার যে কোন স্তরের কর্মচারীদের কাজ কর্মের সংবাদ সংগ্রহ করতো গুপ্তচররা। নিযুক্ত গুপ্তচর ঠিকমত কাজ করছে কিনা তা জানার জন্য গুপ্তচরের পিছনেও গুপ্তচর নিয়োগের কথা অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে।
ফলতঃ কৌটিল্য বর্নীত রাষ্ট্রব্যবস্থা দক্ষ আমলাতন্ত্রের জালে শুধু যে সর্বনিয়ন্ত্রনবাদী ছিলো তা নয় তা পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থার সমতুল হয়ে দাড়িয়েছিলো। রাষ্ট্রের শত সহস্র চোখের বেড়াজালের বাইরে কোন কিছুই ছিলো না।
(চ.) ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা :-
কৌটিল্য মধ্য যুগের মুসলমান তাত্ত্বিকদের মতো ধর্মীয় রাষ্ট্রের কখনই কামনা করেন নি। তিনি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে লোকায়ত ধর্ম থেকে রাজধর্মকে পৃথক করেন। তাঁর মতে, সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা, প্রজাকল্যান, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন, সমাজে নিরাপত্তা বিধান এবং সমস্ত লোককে স্বধর্মে থাকার সুযোগ করে দেওয়াই হলো "রাজধর্ম"।
কৌটিল্য বিশেষ কোন ধর্ম প্রচারের জন্য রাজাকে প্রলুব্ধ করেন নি। তাঁর মতে, রাজার একটিই ধর্ম, তা হলো রাজধর্ম। সমাজে দন্ডের মাধ্যমে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা রাজার অন্যতম কর্তব্য। নিজে ব্রাহ্মন হওয়া সত্ত্বেও কৌটিল্য পুরোহিত বা ব্রাহ্মন কোন শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলে কঠিন শাস্তির বিধান দিয়েছিলেন।
ফলতঃ আধুনিককালে আমরা যে রাষ্ট্রনীতি থেকে ধর্মকে বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলে মেনে নিয়েছি, কৌটিল্য সেই সর্বোত্তম রাষ্ট্রের বিধানই অর্থশাস্ত্রে দিয়েছিলেন।
(ছ.) সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা :-
কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে রাজাকে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, উপনিবেশ বৃদ্ধি পেলে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক আয়তন বাড়বে। রাষ্ট্রের রাজস্ব আদায়ও বাড়বে। বেশি রাজস্ব আদায়ের ফলে রোজকোশ সর্বাদা সমৃদ্ধ থাকবে এবং রাজকোশের অর্থশক্তির সহায়তায় রাজা তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতি বাস্তবায়িত করতে পারবেন।
তবে সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করলেও, কোটিল্য কখনই এককেন্দ্রিক, স্বৈরাচারী বা স্বেচ্ছাচারী রাজাকে সমর্থন করেন নি। তিনি সব রকমের সামাজিক শোষনের বিরোধিতাও করেছিলেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের সমাজ হবে উদার ও মুক্ত। সমাজের সকল মানুষের সমান সুযোগ সুবিধা থাকবে। রাষ্ট্র সকল মানুষের জন্য একই আইন প্রণয়ন করবে। রাজা সর্বদাই প্রজাকল্যানের দিকে তাকিয়ে রাষ্ট্রশাসন করবেন।
(ঝ.) জনকল্যানমূলক রাষ্ট্র :-
কৌটিল্যের রাষ্ট্রনীতিতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছিলো সমাজ। একটি সুশৃঙ্খল সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে তিনটি বিষয়ের ওপর সবথেকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। এগুলি হলো - শক্তিশালী রাজা, শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং প্রজাকল্যান। অনেক ঐতিহাসিক কৌটিল্যের প্রজাকল্যানকামী রাষ্ট্রকে "যোগক্ষেম" বলে অভিহিত করেছিলেন।
কৌটিল্যের প্রজাকল্যানকামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিলো দুটি। যথা - সামাজিক নিরাপত্তামূলক কাজ এবং জনসেবামূলক কাজ।
সামাজিক নিরাপত্তামূলক কাজের ক্ষেত্রে দুর্ভিক্ষে ত্রানের ব্যবস্থা করা, অনাথ ও বিধবা নারীদের নিরাপত্তা ও ভরনপোষনের যাবতীয় দায়িত্ব রাষ্ট্রের করা উচিত বলে কৌটিল্য মত প্রকাশ করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রের জনসেবামূলক কাজগুলি ছিলো - কৃষির উন্নতির জন্য জলসেচের ব্যবস্থা করা, রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মান, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম বেঁধে দেওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মান এবং সমাজের নৈতিক মান বজায় রাখবার জন্য মদ্যপান, জুয়াখেলা ইত্যাদি অনৈতিক কাজ কর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
মূল্যায়ন :-
অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্যের রাষ্ট্র ব্যবস্থার যে স্বরূপ প্রতিফলিত হয়, তাকে অনেক ঐতিহাসিক সমালোচনা করলেও, এর প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্বকে কখনই উপেক্ষা করা যায় না। কৌটিল্য তাঁর রাষ্ট্র তত্ত্বে শক্তিশালী শাসকের কথা তুলে ধরেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদের অপরিহার্যতার কথা তুলে ধরেছিলেন। দক্ষ আমলাতন্ত্র ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রজাকল্যানকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন - এসবই ছিলো আধুনিক যুগের পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত সার সত্য।