কৌটিল্যের লেখা "অর্থশাস্ত্র" ছিলো প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতির ওপর লেখা সর্বপ্রথম ও একমাত্র তাত্ত্বিক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে একটি (১.) আদর্শ রাষ্ট্রের রূপ বৈশিষ্ট্য, (২.) রাষ্ট্রশাসন পদ্ধতি এবং (৩.) রাষ্ট্র পরিচালনার সকল দিক গুলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিজ্ঞান ও বাস্তব সম্মত আলোচনা করা হয়েছিলো।
যে বাস্তবিক নিয়ম বা বিধিব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত হয়, তাকেই এককথায় "রাষ্ট্রনীতি" বলা হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কোন সঠিক নীতি ও পদ্ধতির অনুসরন করা উচিত তা যথাযথ ও বৈজ্ঞানিক ভাবে তুলে ধরার জন্যই কৌটিল্য "অর্থশাস্ত্র" গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।
সংস্কৃত ভাষায় লেখা ছয় হাজার শ্লোক সম্বলিত "অর্থশাস্ত্র" গ্রন্থটি ১৫ টি অধিকরন ও ১৮০ টি প্রকরনে বিভক্ত ছিলো। ১৫ টি অধিকরনের মধ্যে রাষ্ট্রনীতির যে মূল দিক গুলিকে তুলে ধরা হয়েছিলো সেগুলি হল -
- (ক.) রাষ্ট্রের স্বরূপ
- (খ.) যোগ্য রাজার নির্বাচন ও গুনাবলী,
- (গ.) রাজার ক্ষমতা,
- (ঘ.) রাজার দায়িত্ব, কর্তব্য ও কার্যাবলি,
- (ঙ.) কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র
- (চ.) স্থানীয় প্রশাসন ও কর্মচারীবৃন্দ
- (ছ.) রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা
- (জ.) রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বা বিদেশনীতি,
- (ঝ.) রাষ্ট্রের জনকল্যানমূলক নীতি।
 |
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্নীত রাষ্ট্রনীতি |
(ক.) রাষ্ট্রের স্বরূপ :-
কৌটিল্য রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে মনু কর্তৃক প্রচলিত মতবাদকে সমর্থন করে বলেছিলেন, রাষ্ট্রহীন মাৎস্যন্যায় অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের জন্যই জনগন একজনকে রাজা নির্বাচন করেছিলো এবং উৎপাদনের ১/৬ অংশ আনুগত্য স্বরূপ প্রদান করেছিলো। কৌটিল্যের রাষ্ট্রের সৃষ্টি তত্ত্বের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে আধুনিক পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তাবিদ টমাস হবস, জন লক এবং রুশোর সামাজিক চুক্তির সাদৃশ্য দেখা যায়।
তবে কৌটিল্যের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র নিছকই কোন কৃত্রিম প্রতিষ্ঠান ছিলো না। তিনি রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করে এর সাতটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কথা তুলে ধরেছিলেন। অর্থশাস্ত্রের ষষ্ঠ অধিকরনের প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখিত এই সাতটি অঙ্গকে একত্রে "সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব" বলা হয়। এই সাতটি অঙ্গ হলো -
- স্বামী (রাজা)
- অমাত্য (আমলাগোষ্ঠী)
- পুর (দূর্গ বা সুরক্ষিত রাজধানী)
- জনপদ ( জনবেশিষ্ট এলাকা)
- কোশ (অর্থভান্ডার)
- দন্ড (শাস্তি বিধান)
- মিত্র (বন্ধু রাজা)।
কৌটিল্যের মতে, রাষ্ট্রের এই সাতটি অঙ্গেরই পৃথক পৃথক কাজ রয়েছে। কোন একটি অঙ্গকে উপেক্ষা করে কোন রাষ্ট্রই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না। কৌটিল্যের সপ্তাঙ্গতত্ত্ব বিশ্লেষন করলেই বোঝা যায়, কৌটিল্য বর্নীত রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বরূপ ছিলো রাজতন্ত্রশাসিত।
আধুনিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগন রাষ্ট্রকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেন, তাতে রাষ্ট্রের কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কথা তুলে ধরা হয়। এগুলির মধ্যে অন্যতম হলো - জনবেশিষ্টিত ভূখন্ড, সুগঠিত সরকার, সর্বভৌমত্ব, অন্য রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃতিদান, সামরিক ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য ইত্যাদি। কৌটিল্য বর্নীত সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের মধ্যে আধুনিক রাষ্ট্রের সকল বৈশিষ্ট্য গুলিকেই খুঁজে পাওয়া যায়।
(খ.) যোগ্য রাজার নির্বাচন ও গুনাবলী :-
কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই রাষ্ট্র ছিলো প্রকৃতিগত দিক থেকে রাজতান্ত্রিক অর্থাৎ রাজা শাসিত। অর্থশাস্ত্রে এজন্য রাজাকে রাষ্ট্রের সর্বময় প্রভু বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো। কৌটিল্যের মতে, একজন দুর্বল ও অসংযমী রাজা শুধু নিজের পতন ডেকে আনেন না, সমগ্র রাষ্ট্রের পতন ডেকে আনেন।
অর্থশাস্ত্রে এজন্য রাজপদের জন্য যোগ্য রাজার নির্বাচন এবং রাজাকে অতি যোগ্যতা সম্পন্ন, কঠোর এবং পরিশ্রমী হবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো।
অর্থশাস্ত্রে বর্নীত রাজাকে বহুগুনের অধিকারী হতে হতো। অর্থশাস্ত্রে একারনে রাজা হবার জন্য এবং রাজধর্ম যথাযথ ভাবে পালন করার জন্য ৪ টি রাজকীয় গুনের কথা তুলে ধরা হয়। এগুলি হল -
(১.) উত্থান গুন :- সব সময় উৎসাহ ও উদ্যমী বা আগ্রহী হয়ে কাজ করার বিশেষ গুনাবলীকেই "উত্থান গুন" বলা হয়। অর্থশাস্ত্রে ৪ ধরনের উত্থান গুনের উল্লেখ আছে।
এগুলি হলো -
- নির্ভয় বা সাহসিকতা,
- নিষ্পাপ বা পবিত্র মন,
- শীঘ্রতা বা সত্বর ও
- নিপুনতা বা দক্ষতা।
(২.) প্রজ্ঞা গুন :- রাজার প্রজ্ঞা গুন হলো - প্রখর স্মৃতিশক্তি, দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, যেকোন সমস্যার সঠিক বিশ্লেষন ও সমস্যার গুরুত্বকে উপলব্ধি করার গুনাবলী।
রাজার প্রজ্ঞা গুন রাজকার্য পরিচালনায় অত্যন্ত অপরিহার্য। অর্থশাস্ত্রে ষষ্ঠ অধিকরনে রাজার মোট ৮ টি প্রজ্ঞা গুনের কথা বলা হয়েছে। এগুলি হলো -
- শুশ্রুষা,
- শ্রবন,
- গ্রহন
- ধারন,
- বিজ্ঞান,
- যুক্তিবাদী
- দোষীকে পরিহার
- নির্দোষকে গ্রহন করার মানসিকতা।
(৩.) অভিগামিক গুন :- যে সমস্ত গুনাবলী গুলি রাজার আকর্ষন, জনসমর্থন ও উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরে সেই গুন গুলিকেই "অভিগামিক গুন" বলা হয়। অর্থশাস্ত্রে রাজার ১৬ টি অভিগামিক গুনের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো -
- রাজার ন্যায়পরায়নতা,
- ধর্মপরায়নতা,
- নম্রতা,
- বিচক্ষনতা,
- সত্যবাদিতা,
- ধৈর্য্যশীলতা,
- সেবাধর্মিতা,
- পরোপকারিতা,
- দৃঢ়চেতা মনোভাব ইত্যাদি।
(৪.) ব্যক্তিগত গুন :- অর্থশাস্ত্রে উপরে উল্লেখিত ৩ টি গুনের বাইরে রাজার বিশেষ কিছু ব্যক্তিগত গুনাবলীরও উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলি হলো -
- তীক্ষ্ণ মেধা,
- বাকপটুতা,
- আপদে বিপদে সংযম ও স্থির থাকা,
- বলবান ও সংযমী হওয়া,
- প্রখর ধীশক্তি,
- প্রসন্নচিত্তে মনোভাব গোপন করা ইত্যাদি।
এইসব ব্যক্তিগত গুনাবলীর সাহায্যে রাজা যেকোন কঠিন পরিস্থিতিকে সহজ করে নিতে পারেন এবং প্রতিকূল পরিবেশকে নিজ অনুকূলে নিয়ে আসতে পারেন।
অর্থশাস্ত্রে বংশানুক্রমিক রাজপদের উল্লেখ থাকলেও, সেখানে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছিলো, রাজা একজন যোগ্য রাজকুমারকেই রাজপদে নির্বাচিত করবেন। রাজা হবার জন্য উপযুক্ত রাজকীয় গুনাবলীর পাশাপাশি রাজাকে বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শী ও শিক্ষিতও হতে হবে।
অর্থশাস্ত্রে রাজপুত্রদের যথাযথ শিক্ষা এবং রাজকাজে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিলো। সেই সময় বহু বিবাহ প্রচলিত ছিলো বলে যোগ্যতায় শ্রেষ্ঠ রাজপুত্রকেই রাজপদের জন্য নির্বাচন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিলো। কৌটিল্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেছিলেন, কোন রাজপুত্র যদি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে অথবা যদি তার যোগ্যতার ঘাটতি থাকে, তাহলে তাকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে।
কৌটিল্য এই বিষয়ে এতই অনমনীয় ছিলেন যে, তিনি বলেছিলেন রাজার একমাত্র পুত্রের আচরনও যদি রাজা হওয়ার অনুপযুক্ত হয় তাহলে তাকে পর্যন্তও কোনভাবেই সিংহাসনে বসানো যাবে না। এ থেকেই বোঝা যায়, কৌটিল্য রাজার যোগ্যতা ও গুনাবলীর ওপর কতখানি কঠোর ছিলেন।
(গ.) রাজার ক্ষমতা :-
অর্থশাস্ত্রে রাজাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী বলে ঘোষনা করা হয়েছে। কৌটিল্য রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করে রাষ্ট্রের যে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কথা তুলে ধরেছিলেন, তার মধ্যে প্রথম ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিলো স্বামী বা রাজা। রাজা সমগ্র রাষ্ট্রের অভিভাবক বলেই রাজাকে স্বামীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিলো।
কৌটিল্যের মতে, রাজা পার্থিব জগতের চূড়ান্ত সর্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী। তাঁর কর্তৃত্বকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারও নেই। রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে রাজাই অবস্থান করেন। কৌটিল্য সর্বদা রাজাকে চূড়ান্ত ক্ষমতাশালী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে, যে রাজ্যে রাজা যেমন, সেই রাজ্যও তেমন রূপ ধারণ করে।
তবে চূড়ান্ত ক্ষমতাশালী রাজার কামনা করা হলেও, অর্থশাস্ত্রে কখনই রাজার স্বেচ্ছাচারিতা বা স্বৈরাচারীতা সমর্থন করা হয় নি। অর্থশাস্ত্রে স্পষ্টতই বলা হয়েছে, রাজা রাষ্ট্র নয়, তিনি রাষ্ট্রের একটি অংশ মাত্র। রাজা কখনই একা রাজ্য পরিচালনা করবেন না। কারন ভুল সিদ্ধান্ত ব্যক্তিমাত্রই হয়। অর্থশাস্ত্রে একারনে প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজাকে মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ গ্রহনের কথা বলা হয়েছে। রাজা সব সময় রাষ্ট্রের যেকোন সিদ্ধান্ত মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করে গ্রহন করবেন।
এছাড়া "পোরান পোকিতি" অর্থাৎ প্রচলিত নিয়ম কানুন, প্রথা ও রীতিনীতিকে মান্যতা করার কথাও অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে। এসব থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, কৌটিল্য কখনই রাষ্ট্র বা রাজাকে স্বৈরতন্ত্রের স্তম্ভ হিসাবে দেখতে চান নি। তিনি রাজতন্ত্রের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেই রাজতন্ত্রকে কখনই একনায়কতন্ত্রে পরিনত হবার কথা বলেন নি। তিনি প্রজা আনুগত্যের লক্ষ্যে উচ্চবংশজাত বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের কথা বলেছিলেন, কিন্তু বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রে সর্বদা যোগ্য ও শিক্ষিত রাজকুমারকেই রাজপদে নির্বাচিত করার বিষয়ে পরামর্শ ও নির্দেশ দিয়েছিলেন।
(ঘ.) রাজার দায়িত্ব, কর্তব্য ও কার্যাবলী :-
অর্থশাস্ত্রে রাজার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কৌটিল্যের মতে, রাজাকে সর্বদা উদ্যমী হতে হবে এবং নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান নীতি নির্ধারক ছিলেন রাজা। তাকে কেন্দ্র করেই রাষ্ট্র আবর্তিত হয়। সুতরাং রাষ্ট্রের সকল কাজের পরিচলনা ও তদারকির প্রধান দায়িত্ব হলো রাজার। অর্থশাস্ত্রের রাজা সৈন্যবাহিনীর প্রধান পরিচালক। তিনি যুদ্ধ, সন্ধি ঘোষনা, আইনপ্রনেতা, বিচারক, প্রশাসক, আমলাতন্ত্র ও গুপ্তচর ব্যবস্থার নিয়ন্তা।
অর্থশাস্ত্রে রাজার যেসব কার্যাবলির উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলি হলো -
(১.) দেশে সুশাসন প্রনয়ন করা,
(২.) বিভিন্ন রাজকর্মচারী নিয়োগ ও তাদের কাজের তত্ত্বাবধান করা,
(৩.) রাজস্ব আদায়ে নজরদারি,
(৪.) সামরিক অভিযান পরিচালনা করা,
(৫.) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধান করা,
(৬.) অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের সংবাদ সংগ্রহের জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করা,
(৭.) বিচারকার্য সম্পাদন করা ইত্যাদি।
অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, রাজপদ ভোগবিলাসের জন্য নয়। কর্তব্য পালনের জন্য। অর্থশাস্ত্রে রাজার কর্তব্যকর্মের যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তার তালিকা অতি দীর্ঘ।
- (১.) রাজা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে যেমন দেশকে রক্ষা করবেন, তেমনি অভ্যন্তরীন শত্রুদের হাত থেকেও সাধারন মানুষের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করবেন।
- (২.) প্রাচীন ঐতিহ্য, রীতিনীতি ও প্রথাকে যথাযথ ভাবে মর্যাদার সঙ্গে পালন করা ও বজায় রাখবার ব্যবস্থা করাও রাজার কর্তব্য।
- (৩.) ধনী - দরিদ্র নির্বিশেষে কোন মানুষ যাতে নিপীড়িত ও বঞ্চনার শিকার না হয়, তা দেখাও রাজার কর্তব্যকর্মের মধ্যে পড়ে।
- (৪.) রাজা কখনই বিচারপ্রার্থীকে অবজ্ঞা করবেন না।
- (৫.) অনাথ ও বিধবাদের নিরাপত্তা বিধান করাও রাজার অবশ্য পালনীয় একটি কর্তব্য।
অর্থশাস্ত্রে রাজার দৈনন্দিন কাজকর্মের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। এই তালিকা অনুযায়ী দিন ও রাত্রির সময়কে সমান আট ভাগে বিভক্ত করে প্রতি দেড় ঘন্টা অন্তর রাজার কি কি কাজ করা উচিত তার বিধান দেওয়া হয়েছিলো। এই বিধান অনুযায়ী রাজাকে খাওয়া দাওয়া ও বিশ্রামের জন্য সময় দেওয়া হয়েছে মাত্র সাত ঘন্টা। এর বাইরে বাকি সময় রাজা রাষ্ট্রের কোন না কোন কাজে ব্যস্ত থাকবেন। আয়ব্যয়ের হিসাব দেখা দিয়ে রাজা তার কাজ শুরু করবেন। রাজা আগের দিনের রাতেই পরবর্তী দিনের যাবতীয় কাজের পরিকল্পনা তৈরি করে রাখবেন।
ভাগ |
দিবাকালীন কাজ |
প্রথম ভাগ |
আগের দিনের আয় ব্যায়ের হিসাব দেখবেন। |
দ্বিতীয় ভাগ |
জনপদবাসীর কাজ পর্যবেক্ষণ করবেন। |
তৃতীয় ভাগ |
স্নান, ভোজন ও ধর্মগ্রন্থ পাঠ করবেন। |
চতুর্থ ভাগ |
রাজস্ব সংক্রান্ত কাজের তত্ত্বাবধান করবেন। |
পঞ্চম ভাগ |
মন্ত্রীপরিষদের সঙ্গে পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ ও নির্দেশ প্রদান করবেন। |
ষষ্ঠ ভাগ |
বিহার বা মন্ত্রনা করবেন |
সপ্তম ভাগ |
হাতিশাল, ঘোড়াশাল ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করবেন। |
অষ্টম ভাগ |
সেনাপতির সঙ্গে যুদ্ধ বিষয়ে আলোচনা করবেন।
|
ভাগ |
রাত্রিকালীন কাজ |
প্রথম ভাগ |
গুপ্তচরদের কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করবেন |
দ্বিতীয় ভাগ |
ভোজন ও উপাসনা করবেন। |
তৃতীয় ভাগ |
সঙ্গীত ও বিনোদন উপভোগ করবেন। |
চতুর্থ ভাগ |
বিশ্রাম নেবেন ও ঘুমাবেন। |
পঞ্চম ভাগ |
বিশ্রাম নেবেন ও ঘুমোবেন |
ষষ্ঠ ভাগ |
ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও পরের দিনের কাজ নিয়ে চিন্তা করবেন। |
সপ্তম ভাগ |
গুপ্তচরদের বিভিন্ন স্থানে প্রেরন করবেন। |
অষ্টম ভাগ |
পুরোহিতের আর্শীবাদ নেবেন ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। |
(ঙ.) কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র :-
কৌটিল্যের মতে, একটি চাকা যেমন নিজের থেকে চলতে পারে না, তেমনি কোন সরকারই কেবল রাজা কর্তৃক পরিচালিত হতে পারে না। অর্থশাস্ত্রে একারনে বিভিন্ন রাজকর্মচারী নিয়োগের কথা বলা হয়েছিলো। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - অমাত্য, মন্ত্রিন, প্রধানমন্ত্রী, অধ্যক্ষ প্রভৃতি।
অর্থশাস্ত্রে রাজকার্য পরিচালনার জন্য অমাত্য নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। ধর্ম, অর্থ, কাম ও ভয় এই চার প্রলোভনের পরীক্ষায় যেসব অমাত্য জয়ী হতেন রাজা তাদের মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করতেন। কৌটিল্যের মতে মন্ত্রীর সংখ্যা তিন বা চার জনের কম বা বেশি হওয়া উচিত নয়। তাঁর মতে, মন্ত্রীর সংখ্যা কম হলে রাজার পক্ষে কাজ করা যেমন অসুবিধাজনক হবে, তেমনি বেশি হলে রাজার পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অসুবিধাজনক হবে।
অর্থশাস্ত্রে রাজাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য মন্ত্রীদের দুটি পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছিলো। একান্ত বিশ্বাসযোগ্য মন্ত্রী বা মন্ত্রিনদের নিয়ে একটি ছোট পরিষদ এবং বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে একটি বড়ো মন্ত্রীপরিষদ গঠনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, রাজা যেকোন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে পরিষদে সে বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করবেন। সকলের সহিত আলোচনা করেই তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
অর্থশাস্ত্রে রাজকর্মচারীদের যে তালিকা দেওয়া হয়, তা ছিলো অতি দীর্ঘ। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে - (১.) সর্বাগ্রে ছিলেন পুরোহিত বা প্রধানমন্ত্রী। (২.) এরপরেই ছিলেন মন্ত্রীনরা, (৩.) কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের অপর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিলেন - সমাহর্তা, সন্নিধাতা, প্রতিহারী, সেনাপতি।
সমাহর্তা কথার অর্থ হলো যিনি সম্যকভাবে কর আদায় করেন। সমাহর্তা ছিলেন গোটা সাম্রাজ্যের মুখ্য কর সংগ্রাহক। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজকর্মচারী সন্নিধাতা ছিলেন মুখ্য হিসাব রক্ষক। তার কাজ ছিলো প্রাপ্ত করের হিসাব রাখা ও আদায়ীকৃত অর্থকে নিরাপদে রাখা। তৃতীয় রাজকর্মচারী প্রতিহারী ছিলেন রাজদ্বারের নিরাপত্তা রক্ষী। অন্যদিকে সেনাপতি ছিলেন সেনাবিভাগের প্রধান।
অর্থশাস্ত্রে বিভিন্ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মোট ৩২ জন অধ্যক্ষের নাম নাম পাওয়া যায়। এরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের পরিচালক ছিলেন। যেমন - বলাধ্যক্ষ, নগরাধ্যক্ষ, আকরাধ্যক্ষ, অশ্বাধ্যক্ষ, হস্তীধ্যক্ষ, নাবধ্যক্ষ, রথাধ্যক্ষ, সীতাধ্যক্ষ, সূত্রাধ্যক্ষ, শূল্কাধ্যক্ষ, মদিরাধ্যক্ষ।
অর্থশাস্ত্রে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে রাজকর্মচারীদের যে বিস্তৃত তালিকার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা থেকে কেন্দ্রে একটি এককেন্দ্রিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার ছবি ফুটে ওঠে।
(চ.) স্থানীয় প্রশাসন ও কর্মচারীবৃন্দ :-
অর্থশাস্ত্রে একটি কেন্দ্রীয় শক্তিশালী আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কথা তুলে ধরা হলেও, সেখানে স্থানীয় শাসন কখনই উপেক্ষিত ছিলো না। শাসন ব্যবস্থার একেবারে শেষ স্তরে ছিলো গ্রাম। গ্রামের প্রধান কর্মচারী ছিলেন "গোপ"। তারা কয়েকটি গ্রামের সমষ্টির কাজকর্মের পরিদর্শন করতো।
গ্রামের উচ্চ পর্যায়ের শাসনতান্ত্রিক ইউনিট ছিলো জেলা। জেলা পর্যায়ের শাসন ব্যবস্থা দেখাশুনা করতেন "স্থানিক" নামক কর্মচারীরা। তারা গোপদের কাজকর্মের ওপর নজরদারি চালাতো।
অর্থশাস্ত্রে গ্রাম বৃদ্ধ নামে কর্মচারীদের উল্লেখ আছে, যারা গ্রামের ছোট খাটো বিবাদ মেটানোর কাজে সরকারি কর্মচারীদের সাহায্য করতেন। "প্রদেশত্রী" নামক এক শ্রেণীর উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীদের কাজকর্মের পরিদর্শন করতেন ও তদারকি করতেন। রাজকর্মচারীরা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা তা অনুসন্ধানের জন্য কৌটিল্য গুপ্তচর নিয়োগের কথা বলেছিলেন। গুপ্তচররা সন্ন্যাসী, গৃহস্থ, ভিখারি, ছাত্র, ব্যবসায়ী, বারবনিতা ইত্যাদি নানা ছদ্মবেশে সংবাদ সংগ্রহ করে সম্রাটের কর্নগোচর করতেন।
(ছ.) রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা :-
কৌটিল্য রাষ্ট্রে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তার মতে, ন্যায়পরায়ন রাজা সর্বদাই নিশ্চিন্ত মনে সিংহাসন ভোগ করেন। সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কৌটিল্য প্রতিটি জনপদে বিচার ব্যবস্থা রাখার কথা বলেছিলেন।
অর্থশাস্ত্রে দেওয়ানী ও ফৌজদারি অপরাধের বিচারের জন্য ধর্মস্থ ও প্রদেষ্টা নামক বিচারকের উল্লেখ করা আছে। ধর্মস্থরা ধর্মাস্থীয় আদালতে দেওয়ানি মামলার এবং প্রদেষ্টারা কন্টকশোধনে ফৌজদারি মামলার বিচার করতেন।
কৌটিল্য বারো বৎসর বয়স্ক স্ত্রীলোক এবং ষোলো বছর বয়সী পুরুষকে প্রাপ্তবয়স্ক মনে করে তাদের বিচারযোগ্য বলে উল্লেখ করেন। বিচারকার্য পরিচালনার সময় অনেক ক্ষেত্রে বাদী - বিবাদী পক্ষে সাক্ষী পাওয়া যায় না। কৌটিল্য এই অসুবিধা দূর করার জন্য আগুন, জল ইত্যাদির সাহায্যে কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে দোষী বা নির্দোষীদের নির্নয় করার কথা বলেছিলেন। বিচারে দোষী ব্যক্তির শাস্তিদানের ক্ষেত্রে কৌটিল্য জরিমানা আদায়, কারারুদ্ধ করা, বেত্রাঘাত করা, এবং মৃত্যুদণ্ডের উল্লেখ করেছিলেন। কৌটিল্যের মতে, অপরাধের তারতম্য যাচাই করে মৃত্যুদন্ড দুইভাবে দেওয়া যেতে পারে, যথা - নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড এবং নির্যাতনবিহীন শান্তিপূর্ন মৃত্যুদন্ড।
কৌটিল্য রাজাকে বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে রেখে আদালতের ওপর রাজা বা সম্রাটের ক্ষমতাকে জোরদার করার কথা বলেছিলেন। সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কৌটিল্য দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের নির্দেশ দেন। তার মতে, "কোন রাজা দন্ডদানে ভুল করলে তারও দন্ড হবে"।
(জ.) রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বা বিদেশনীতি :-
কৌটিল্যের মতে, কোন ব্যক্তি যেমন একক ভাবে চলতে পারেন না। তেমনি কোন রাষ্ট্রও একক ভাবে চলে না। বৈদেশিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাত ও মিত্রতার নানা অভিঘাতে যেকোন দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য, রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি রূপায়নের ক্ষেত্রে ৬ টি পদ্ধতির কথা বলেছিলেন, যাকে "ষাড়গুন্য নীতি" বলা হয়। এগুলি হলো -
- সন্ধি বা বন্ধুত্ব :- "সন্ধি" হলো পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে যুদ্ধ না করার এবং পারস্পরিক সহযোগিতার চুক্তি বা সিদ্ধান্ত। কৌটিল্যের মতে, সবসময় শক্তিশালী রাজার সহিত সন্ধি করা উচিত।
- বিগ্রহ :- "বিগ্রহ" বলতে বোঝায় শত্রু রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। কৌটিল্যের মতে প্রতিবেশী কোন রাজ্য রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে চাইলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করা উচিত।
- আসন :- "আসন" কথার অর্থ হলো নিরপেক্ষ থাকা। কৌটিল্যের মতে, দুই প্রতিবেশী মিত্র রাষ্ট্রের পারস্পরিক বিরোধে রাজার নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া উচিত।
- যান :- "যান" শব্দের অর্থ হলো যুদ্ধ প্রস্তুতি। কৌটিল্য শান্তিকালীন অবস্থার আড়ালে যুদ্ধের প্রস্তুতি চালানোর কথা বলেছিলেন।
- সংশ্রয় :- "সংশ্রয়" কথার অর্থ হলো অপরের আশ্রয় খোঁজা। কৌটিল্যের মতে, দুর্বল রাজা সর্বদা শক্তিশালী রাজার আশ্রয় গ্রহণ করবেন এবং তার সাথে শত্রু বিরোধী জোট গড়ে তুলবেন।
- দ্বৈধীভাব :- "দ্বৈধীভাব" হলো এক বিশেষ ধরনের কূটনীতি। এর দ্বারা রাজা এক শত্রুর সঙ্গে সন্ধি বা মিত্রতা করে অপর শত্রুকে আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি চালাবেন।
কৌটিল্যের মতে, চিরস্থায়ী শান্তি বলে কিছু নেই। একমাত্র শক্তিই শান্তি বজায় রাখতে পারে। শক্তি বৃদ্ধির জন্য কৌটিল্য তাই রাজাকে যুদ্ধের পরামর্শ দিয়েছেন। অর্থশাস্ত্রে ৩ ধরনের যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। যথা - ধর্ম বিজয়, লোভ বিজয় এবং অসুর বিজয়।
ধর্মবিজয় বলতে কৌটিল্য বুঝিয়েছেন, পরাজিত রাজাকে সামন্তরাজার মর্যাদা দান। লোভ বিজয় বলতে বুঝিয়েছেন, ধনসম্পদের লোভে অপর কোন দেশ জয় করা। অন্যদিকে অসুর বিজয় বলতে কৌটিল্য শত্রুরাজ্যকে জয় করে তাকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করাকে বুঝিয়েছেন। তিন ধরনের যুদ্ধযাত্রার মধ্যে কৌটিল্য অসুরবিজয়কেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। অর্থশাস্ত্র অনুসারে যুদ্ধবিগ্রহের মূল উদ্দেশ্য হলো মাথাপিছু সম্পদ সংগ্রহ এবং বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করা।
পররাষ্ট্রনীতি পরিচলনার ক্ষেত্রে কৌটিল্য কূটনীতি অনুসরনের কথা বলেছিলেন। এক্ষেত্রে প্রথমেই মন্ডলতত্ত্বের কথা উল্লেখ করতে হয়। কৌটিল্যের মতে, কোন রাজার সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলো স্বভাবজাত শত্রু বা অরি। আবার তার পরবর্তী রাষ্ট্র হলো স্বভাবজাত মিত্র। একই ভাবে মিত্র রাষ্ট্রের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলো শত্রুর মিত্র এবং তার পরের প্রতিবেশী হলো মিত্রের মিত্র। কৌটিল্যের মতে একজন বিবেচক রাজার কর্তব্য হলো মিত্র রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বা সন্ধি স্থাপন করে অরি বা শত্রু রাষ্ট্রকে মন্ডলাকারে ঘিরে ধরে রাখা। একেই "মন্ডলতত্ত্ব" বলা হয়।
মন্ডলতত্ত্বের অনুসরনেই রাজাকে শত্রু ও মিত্র নির্ধারণ করে বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালিত করতে হবে। কৌটিল্য প্রতিবেশী রাজ্যকে নিজ বশে আনার জন্য ৪ টি কৌশলের কথা বলেছিলেন। এগুলি হলো - সাম, দান, দন্ড ও ভেদ।
- "সাম" বলতে সন্তুষ্টি, সাম্যতা বা সমঝোতার কথা বোঝানো হয়েছে। এই কূটনীতির মাধ্যমে রাজা প্রতিবেশী রাজার মন থেকে অবিশ্বাস ও সন্দেহ দূর করবেন। তাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তার মনের সংশয় দূর করে নিজের বশে বা আয়ত্তের মধ্যে রাখবেন।
- "দান" বলতে আর্থিক সাহায্য বা শক্তিশালী রাজা কর্তৃক দুর্বল রাজাকে অভয়দান বোঝায়। এই কূটনীতির সাহায্যে শক্তিশালী রাজা অনায়াসে দুর্বল রাজাকে নিজের বশে রাখতে পারেন।
- "দন্ড" কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো বলপ্রয়োগ করা। সাম ও দান অকার্যকর হলে অথবা প্রয়োগের অনুপযুক্ত হলে কৌটিল্য সরাসরি দন্ড প্রয়োগের বিধান দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী কোন শত্রু রাজ্য কোন অনিষ্টকর পদক্ষেপ গ্রহন করলে কৌটিল্য সরাসরি দন্ড বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শাস্তির বিধান দিয়েছিলেন।
- "ভেদ" বলতে বোঝায় শত্রু পক্ষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া। ভেদ হলো একটি কূটনীতি, যার মাধ্যমে শত্রু রাজার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে শত্রুরাষ্ট্রকে দুর্বল করে দেওয়া হয়।
(ঝ.) রাষ্ট্রের জনকল্যানমূলক নীতি :-
কৌটিল্যের রাষ্ট্রনীতিতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছিলো সমাজ। একটি সুশৃঙ্খল সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে তিনটি বিষয়ের ওপর সবথেকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। এগুলি হলো - শক্তিশালী রাজা, শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং প্রজাকল্যান। অনেক ঐতিহাসিক কৌটিল্যের প্রজাকল্যানকামী রাষ্ট্রকে "যোগক্ষেম" বলে অভিহিত করেছিলেন।
কৌটিল্যের প্রজাকল্যানকামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিলো দুটি। যথা - সামাজিক নিরাপত্তামূলক কাজ এবং জনসেবামূলক কাজ।
সামাজিক নিরাপত্তামূলক কাজের ক্ষেত্রে দুর্ভিক্ষে ত্রানের ব্যবস্থা করা, অনাথ ও বিধবা নারীদের নিরাপত্তা ও ভরনপোষনের যাবতীয় দায়িত্ব রাষ্ট্রের করা উচিত বলে কৌটিল্য মত প্রকাশ করেন।
অন্যদিকে রাষ্ট্রের জনসেবামূলক কাজগুলি ছিলো - কৃষির উন্নতির জন্য জলসেচের ব্যবস্থা করা, রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মান, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম বেঁধে দেওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মান এবং সমাজের নৈতিক মান বজায় রাখবার জন্য মদ্যপান, জুয়াখেলা ইত্যাদি অনৈতিক কাজ কর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
মূল্যায়ন :-
কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে যে রাষ্ট্রনীতির অবতারনা করেন, তা পরবর্তীকালে দেশ বিদেশের নানা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকদের দ্বারা প্রভূত প্রশংসিত হয়। কৌটিল্যের রাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত আলোচনায় কয়েকটি মৌলিক দিকের প্রসঙ্গ সবশেষে আমরা তুলে ধরবো। কারন কৌটিল্যের রাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত এই মৌলিক দিক গুলি তুলে না ধরলে, আমাদের আলোচনা অনেকাংশে অসম্পূর্ন থেকে যাবে।
(১.) রাষ্ট্রনীতিকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে কৌটিল্যই সর্বপ্রথম রাজধর্মকে লোকায়ত ধর্ম থেকে পৃথক করেন। তাঁর মতে, সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন, সমাজে নিরাপত্তা বিধান এবং সমস্ত লোককে স্বধর্মে থাকার সুযোগ করে দেওয়াই হলো রাজধর্ম।
(২.) কৌটিল্যের মতে, একটি আদর্শ রাষ্ট্রের সমাজ হবে উদার ও মুক্ত। সেখানে সকলের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা থাকবে। রাষ্ট্র কোন নাগরিকের প্রতি বৈষম্যের নীতি নেবে না। সকল মানুষের জন্য রাষ্ট্র একই আইন প্রণয়ন করবে। সামাজিক শোষন বন্ধ করা ও আর্ত এবং অসহায় মানুষের সেবা করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য নীতি ও আদর্শ হওয়া উচিত বলে কৌটিল্য মত প্রকাশ করেছিলেন।
(৩.) কৌটিল্য তাঁর রাষ্ট্রনীতিতে বিশেষ কোন ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেন নি। নিজে ব্রাহ্মন হওয়া সত্ত্বেও, পুরোহিত বা ব্রাহ্মন কোন শাস্তি যোগ্য অপরাধ করলে কঠিন শাস্তির বিধান তিনি দিয়েছিলেন। ড. রামশরন শর্মার মতে, কৌটিল্যের রাষ্ট্র দর্শন ছিলো প্রকৃতিগত দিক থেকে ধর্মনিরপেক্ষ। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের বদলে রাজার প্রতি অনুগত থাকারই নির্দেশ দিয়েছিলেন।
(৪.) কৌটিল্যই প্রথম প্রাচীন ভারতে সমাজের প্রচলিত নৈতিকতা বোধ থেকে রাষ্ট্র নীতিকে পৃথক করেন। অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রের হিতের প্রয়োজনে প্রতারনা, ষড়যন্ত্র, গুপ্তচরবৃত্তি, বৈদেশিক রাষ্ট্রে হত্যাকাণ্ড চালনা কোন কিছুই নিন্দনীয় ছিলো না। এক্ষেত্রে কৌটিল্যের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ইতালীয় চিন্তাবিদ মেকিয়াভেলির কোন পার্থক্য ছিলো না।
(৫.) অর্থশাস্ত্র রচনার সময়ে আর্য উপজাতি রাজ্য গুলির পতন ঘটিয়ে বৃহৎ রাষ্ট্রের পত্তন ঘটেছিলো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এর ছাপ কৌটিল্যের রাষ্ট্র নীতির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এজন্য যুদ্ধজয় দ্বারা বৃহৎ রাষ্ট্র স্থাপনের জন্য রাজাকে বারে বারে উৎসাহিত করা হয়েছিলো। কৌটিল্য সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র নির্মানের কথা তুলে ধরেছিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনুমান করা অসঙ্গত নয়, কৌটিল্য একটি বৃহৎ আয়তনের রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
(৬.) কৌটিল্য তার রাষ্ট্র নীতিতে একদিকে যেমন দৃঢ় শক্তিশালী আমলাতন্ত্র গঠনের কথা বলেন। তেমনি রাষ্ট্রের অর্থ যাতে রাজকর্মচারীরা সহজে আত্মসাৎ করে নিতে না পারেন, তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও তুলে ধরেন। তিনি প্রশাসনে দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য রাজকর্মচারীদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বদলি এবং কর্মচারীদের পিছুনে গুপ্তচর নিয়োগের কথা তুলে ধরেন।
(৭.) কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্র সম্পর্কে যে ধারণা পেশ করেছেন, তাতে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় শক্তির কথা বলা হয়েছে। ওই শক্তি আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রন করবে। অর্থশাস্ত্রে প্রত্যন্ত জনপদ, গভীর বনাঞ্চল, গোচারনভূমি থেকে বেশ্যালয় কোন কিছুই রাষ্ট্রের দৃষ্টির বাইরে নয়। সব কিছুর জন্যই অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের উল্লেখ আছে।
(৮.) কৌটিল্য তাঁর রাষ্ট্রনীতিতে সবথেকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন অর্থনীতির ওপর। তাঁর মতে, একজন ভালো রাজাকে আগে ভালো অর্থনীতিবিদ হতে হয়। কৌটিল্য বলেছেন, রাজা রাজকোশের আয় বৃদ্ধির দিকে যেমন সর্বদা সচেষ্ট হবেন, তেমনি অর্থের সঠিক ব্যবহার ও অপচয় সম্পর্কেও সচেতন থাকবেন। কৌটিল্য রাজার প্রাত্যহিক কাজের যে তালিকা তৈরি করেছিলেন, সেখানে আয় ব্যায়ের হিসাব দেখেই রাজা তার রাজকার্য শুরু করেন। কৌটিল্য প্রচলিত ভূমি রাজস্ব ছাড়াও গোচারন ভূমি, খনি, সেতু, ব্যক্তিগত আয় এমনকি বারবনিতা পল্লি থেকে কৌটিল্য রাজকীয় কর সংগ্রহের কথা বলেছিলেন। রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রকে যেভাবে কৌটিল্য রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎস হিসাবে তুলে ধরেছিলেন, তা থেকে একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট কৌটিল্য এক সর্বনিয়ন্ত্রনবাদী অমিত শক্তিশালী কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, আদি থেকে আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসের সকল রাষ্ট্রই যে লক্ষ্যে আজও আবর্তিত হয়ে চলেছে।
মনে রাখতে হবে, অর্থশাস্ত্র এমন এক সময়ে রচনা করা হয়, যখন ভারতে নানা রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছিলো। একদিকে ছিলো দেশীয় রাজন্যবর্গ নন্দবংশীয়দের অপশাসন ও অত্যাচার। অন্যদিকে ছিলো বৈদেশিক আক্রমণ। এরূপ অবস্থায় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে এক শক্তিশালী রাষ্ট্রের কামনা করেই কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি রচনা করেন। কৌটিল্যের লক্ষ্য ছিলো সমগ্র ভারতীয় ভূখন্ডকে এক শক্তিশালী রাজার ছত্রছায়ায় নিয়ে আসা। আধুনিককালে রাষ্ট্রদার্শিকরা যে নিরঙ্কুশ, সর্বনিয়ন্ত্রনবাদী, শক্তিশালী প্রজাকল্যানকামী রাষ্ট্রের কথা তুলে ধরেন অর্থশাস্ত্রে বর্নীত কৌটিল্যের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিলো তার প্রথম স্বার্থক মডেল।