ফরাসি বিপ্লবের রূপ ও তার গতিপ্রকৃতির ধারা

ইওরোপের ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লব ছিলো একটি স্মরণীয় অধ্যায়। বিপ্লব পূর্ব শ্রেনীদ্বন্দ্বে জর্জরিত ফ্রান্সে অর্থনৈতিক সংকট যে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির জন্ম দেয়, তার ফলেই ১৭৮৯ খ্রিঃ বিপ্লবের আগুন জ্বলে ওঠে। প্রকৃতিগত দিক থেকে ফরাসি বিপ্লব ছিলো একটি শ্রেনী সংগ্রাম। এই বিপ্লবের অন্যতম প্রধান শ্লোগানই ছিলো - সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। শ্রেনীদ্বন্দ্বে জর্জরিত ফ্রান্সে সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা করা এবং স্বৈরতন্ত্রের বিলোপ ঘটিয়ে ব্যক্তি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা স্থাপনের মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ফরাসি দেশে বিপ্লব সম্পন্ন হয়। 

ফরাসি বিপ্লবের রূপ ও তার গতিপ্রকৃতির ধারা
ফরাসি বিপ্লবের রূপ ও তার গতিপ্রকৃতির ধারা 

(ক.) ফরাসি বিপ্লবের বিভিন্ন স্তর ও পর্যায় :- 

১৭৮৯ খ্রিঃ থেকে ১৭৯৯ খ্রিঃ পর্যন্ত ছিলো ফরাসি বিপ্লবের সময়কাল। এই সময়কালে একাধিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বিপ্লবের স্রোত প্রবাহিত হয়। 

(১.) ১৭৮৮ খ্রিঃ রাজার স্বৈরাচারীতার বিরুদ্ধে এবং নিজেদের সুবিধাবাদকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য সর্বপ্রথম অভিজাতরা বিদ্রোহ করে। 

(২.) ১৭৮৯ খ্রিঃ রাজা দীর্ঘ ১৭৫ বছর পর স্টেটস জেনারেলের সভা আহ্বান করলে স্টেটস জেনারেলের বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে "বুর্জোয়া বিপ্লব" সম্পন্ন হয়। বুর্জোয়া বিপ্লব ফ্রান্সে সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদ, আইনানুগ ভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা, স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বদলে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। 

(৩.) বুর্জোয়া বিপ্লবের পরবর্তী পর্যায়ে বিপ্লবের রাশ সাধারন মানুষের হাতে নেমে এসেছিলো। গনবিপ্লবের ধারা এই পর্বে লক্ষ্য করা যায়। রাজতন্ত্রের ধ্বংস ও উচ্ছেদ, প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি দিক গুলি এই পর্বে বাস্তবায়িত করা হয়। এই পর্বের শেষেই সন্ত্রাসের শাসনের মধ্য দিয়ে নিন্মবর্গের মানুষদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার গুলি প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। 

(৪.) বিপ্লবের অন্তীম পর্যায়ে ফ্রান্সে পার্লামেন্টীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই পর্বে ১৭৯৫ খ্রিঃ শুরু হয় ডাইরেক্টরির শাসন। এই পর্বের ব্যর্থতা বিপ্লবী জনতার মধ্যে প্রচন্ড হতাশা সৃষ্টি করলে, তার অনুকূল সুযোগ নিয়ে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ফ্রান্সে ক্ষমতা দখল করেন এবং তার সংস্কার ও কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী আদর্শকে সারা ইওরোপে সম্প্রসারিত করে দেন। নেপোলিয়ন এবং ফরাসি বিপ্লবের আদর্শকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে ইওরোপীয় মহাদেশের রাজনীতি নতুন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। 

(খ.) ফরাসি বিপ্লবের প্রকৃতি ও চরিত্র :- 

ফরাসি বিপ্লব ছিলো "সমাজ বিপ্লব" ও "রাষ্ট্র বিপ্লবের" এক সংমিশ্রিত রূপ। এই বিপ্লবের ফলে ফরাসি সমাজ ও রাষ্ট্রের নতুন কাঠামো বা স্ট্রাকচারের নির্মান হয়। বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সে সমাজ কাঠামোতে তিনটি শ্রেনী ছিলো। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেনীতে থাকা যাজক ও অভিজাতরা ছিলো সুবিধাভোগী শ্রেনী। অন্যদিকে তৃতীয় সম্প্রদায়ে থাকা সাধারন নাগরিকরা ছিলো সুবিধাহীন, অধিকারহীন ও করভারে জর্জরিত শ্রেনী। বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সে পুরাতনতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও যাজকতন্ত্রের প্রধান রক্ষক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলো স্বৈরাচারী বুরবোঁ রাজতন্ত্র। শুরুর দিকে সুবিধাভোগী যাজক ও অভিজাতদের বিরুদ্ধে বিপ্লব শুরু হলে, রাজা সুবিধাভোগী শ্রেনীরই পক্ষাবলম্বন করে। এর ফলে বিপ্লব রাজতন্ত্র বিরোধী হয়ে ওঠে, এবং সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যে রাষ্ট্র বিপ্লব অপরিহার্য হয়ে ওঠে। 

ফ্রান্সের প্রচলিত শ্রেনী গুলির সুবিধা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের প্রতিফলন ফরাসি বিপ্লবের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। এই বিপ্লবের মধ্যে বেশ ৩ টি স্তরভেদ লক্ষ্য করা যায়। এগুলি হলো - (১.) অভিজাত বিপ্লব - (২.) বুর্জোয়া বিপ্লব - (৩.) কৃষক, সাঁকুলেৎ ও নিন্মবর্গের জনতার বিপ্লব। 

ফরাসি বিপ্লবের রূপ ও পর্যায়
ফরাসি বিপ্লবের রূপ ও পর্যায়



বিপ্লবের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো অভিজাত বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। ষোড়শ লুই সিংহাসনে বসার অল্পদিনের মাথায় ফ্রান্সে অর্থ সংকট তীব্র আকার ধারন করেছিলো। এমতাবস্থায় ষোড়শ লুই অর্থ সংকট থেকে মুক্তিলাভের উপায় খোঁজার জন্য ক্রমান্বয়ে পরপর চারজন অর্থমন্ত্রীকে নিযুক্ত করেন। এরা হলেন যথাক্রমে রবার্ট তুর্গো (১৭৭৪ - ১৭৭৫), জ্যাকস নেকার (১৭৭৬ - ১৭৮৩), চার্লস ক্যালোন (১৭৮৩ - ১৭৮৭) এবং লমেনি দ্য ব্রিয়াঁ (১৭৮৭ - ১৭৮৮)। এই অর্থমন্ত্রীদের সকলেই অভিজাতদের ওপর কর বসানোর প্রস্তাব দেন। 

ফরাসি বিপ্লবের বিশ্লেষন করতে গিয়ে ঐতিহাসিক তকভিল বলেছিলেন, শুধু অধিকারহীন মানুষ বিপ্লব করে না, অধিকার ক্ষুন্ন হবার সম্ভাবনা দেখা দিলে মানুষ বিপ্লবের পথে পা বাড়ায়। ১৭৮৯ খ্রিঃ ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিলো। রাজা শেষপর্যন্ত অভিজাতদের ওপর কর বসানোর সিদ্ধান্ত নিলে ফ্রান্সের অভিজাতরা রাজার স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে বিদ্রোহ শুরু করে এবং জানায় কর বসানোর অধিকার রাজার নেই, আছে স্টেটস জেনারেলের। 

অভিজাতদের বিদ্রোহ রাজার দৈব ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে চূর্ন বিচূর্ন করে দেয়। স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন শুরু হবার পর ফ্রান্সে বিপ্লবের রাশ বুর্জোয়াদের হাতে চলে যায়। রাজার স্বৈরতন্ত্রকে চূর্ন করার যে সূচনা অভিজাতরা তাদের বিদ্রোহের মাধ্যমে শুরু করেন, বুর্জোয়ারা তাকে পূর্নতা দেয়। স্টেটস জেনারেলের অধিবেশনে বুর্জোয়ারা অভিজাত ও যাজকদের সুবিধাবাদের অবসান ঘটাতে যৌথ অধিবেশন ও মাথাপিছু ভোটের দাবি তোলেন। স্বৈরাচারি রাজা বেশ কিছুদিন টালবাহানার পর জনমতের চাপে বুর্জোয়াদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। 

বুর্জোয়া বিপ্লবের সাফল্য ফ্রান্সের অন্যান্য শ্রেনীদের উৎসাহিত করে তোলে। বুর্জোয়া বিপ্লবের পর ফ্রান্সে গ্রাম ও শহরে নিন্মবর্গীয় প্রান্তিক মানুষের গনবিপ্লব শুরু হয়। গ্রাম থেকে শহরে হাজার হাজার কৃষকের আগমন, অন্যদিকে গ্রামীন এলাকায় জোটবদ্ধ কৃষকদের সামন্তপ্রভুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উদীয়মান বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের আতঙ্কিত করে তোলে। এমতাবস্থায় কৃষক বিদ্রোহ প্রশমিত করতে স্টেটস জেনারেলের প্রতিনিধিরা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ফ্রান্সে আইনানুগ ভাবে সামন্ততন্ত্রকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। সব শ্রেনীর নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষনাপত্র পেশ করে। একটি নতুন সংবিধানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রকে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে পরিনত করারও ব্যবস্থা করা হয়। 

বুর্জোয়া বিপ্লবকে রাজা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে ফ্রান্সের বিপ্লবী প্রচেষ্টাকে বানচাল করার জন্য রাজা গোপনে বিদেশী শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন এবং দেশত্যাগের পরিকল্পনা করেন। বুর্জোয়া বিপ্লব ফ্রান্সে বুর্জোয়াদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও, কৃষক ও সাঁকুলেৎদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে নি। ফলে ফরাসি বিপ্লবের পরেও, ফ্রান্সের নিন্মবর্গের একটি বৃহৎ অংশ অসন্তুষ্ট ছিলো। এরা প্রকৃতিগত দিক থেকে ছিলো অত্যন্ত উগ্র, চরমপন্থী ও রাজতন্ত্রের বিরোধী। এই জনগোষ্ঠীর লোকেদের সংগঠিত করে জেকোবিন দলের নেতৃত্বে ফরাসি বিপ্লবের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়। এই পর্বটি ছিলো প্রকৃতিগত দিক থেকে উগ্র ও চরমপন্থী। 

এই পর্বে রাজা ও রাজপন্থীদের নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। কঠোর স্বৈরাচারের মধ্য দিয়ে নিন্মবর্গের মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ফ্রান্সে জেকোবিন দলের নেতৃত্বে "সন্ত্রাসের শাসন" শুরু হয়। এই পর্বেই কৃষকদের জমি বন্টন, সর্বোচ্চ মূল্যের আইন, সার্বজনীন শিক্ষার বিস্তার ইত্যাদি বিপ্লবাত্মক কর্মসূচি গুলিকে বাস্তবায়িত করা হয়। এইভাবে বিভিন্ন শ্রেণীর লড়াই ও একাধিক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের বিপ্লব সম্পন্ন হয়। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post