অষ্টাদশ শতকে ইওরোপের প্রায় সব দেশেই কমবেশি একই ধরনের রাজনৈতিক, আর্থ - সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থা ছিলো। তা সত্ত্বেও একমাত্র ফ্রান্সেই কেন বিপ্লব হয় - তা নিয়ে শুরু থেকেই ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক চলছে। আজও এই বিতর্কের নিষ্পত্তি ঘটে নি। ঐতিহাসিকদের এই বিতর্ক থেকে ফ্রান্সে প্রথম বিপ্লব হওয়ার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারনকে আমরা তুলে ধরতে পারি।
![]() |
ফ্রান্সে কেন প্রথম বিপ্লব হয়? |
প্রথমত, ঐতিহাসিক থিয়ার্স ও মিশেল মনে করেন ফ্রান্সে স্বৈরাচারী বুরবোঁ রাজতন্ত্রের জন্যই বিপ্লব হয়েছিলো। অষ্টাদশ শতকে ইওরোপের অনেক দেশের রাজারা জ্ঞানদীপ্তির আলোকে তাদের রাজতন্ত্রকে যুগপোযোগী ও প্রজাকল্যানের আদর্শে আলোকিত করে তোলার চেষ্টা করলেও, বুরবোঁ রাজারা নিজেদের আপডেট করেন নি। তারা পুরাতন স্বৈরাচারিতাকে আঁকড়ে ধরে থাকেন। ফলে স্বৈরতন্ত্রের অত্যাচারে ফ্রান্সের সাধারন নাগরিকদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার ঘটে। বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের স্বৈরাচারী বুরবোঁ রাজতন্ত্র এজন্য জনগনের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য হারিয়ে ফেলে। এর ফলেই ইওরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ফ্রান্সেই প্রথম বিপ্লবের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো।
দ্বিতীয়ত, ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের ব্যর্থতা ফরাসি বিপ্লবকে অনিবার্য করে তুলেছিলো। চতুর্দশ লুইয়ের পর পঞ্চদশ লুই ও ষোড়শ লুইয়ের আমলে বুরবোঁ রাজতন্ত্র দুর্বল এবং অপদার্থ হয়ে পড়েছিলো। এই সুযোগে ফ্রান্সে অভিজাতশ্রেনী প্রশাসনের সর্বত্র তাদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। ফ্রান্সে রাজতন্ত্রও নিরঙ্কুশ ছিলো না। যাজক ও অভিজাতদের ওপর রাজা তার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। যাজক ও অভিজাতদের সঙ্গে আপোস সমঝোতা করে রাজা রাজতন্ত্র চালিয়ে যান। এই আপোসমুখী মনোভাবের কারনে আর্থিক সংকটে পড়ে ষোড়শ লুই একের পর এক অর্থমন্ত্রী হিসাবে তুর্গো, কালোন, ব্রিয়েন ও নেকারকে নিযুক্ত করেও, অভিজাতদের চাপে আর্থিক সংস্কার বাস্তবায়িত করতে পারেন নি।ঐতিহাসিক ফিসার তাই বলেছেন, ফরাসি রাজতন্ত্র সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণির বিশেষ সুযোগ সুবিধা গুলিকে লোপ করতে পারেন নি বলেই ফরাসি দেশে প্রথম বিপ্লব হয়েছিলো। ডেভিড টমসন এপ্রসঙ্গে বলেছেন, একজন বিপ্লবী রাজাই শুধু বিপ্লব থেকে দেশকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজতন্ত্র ছিলো অত্যন্ত রক্ষনশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল। তাই ফ্রান্সেই প্রথম বিপ্লবের আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং সংস্কারের অভাবে বিপ্লব অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
তৃতীয়ত, বিপ্লবের আগে অন্যান্য ইওরোপীয় দেশের তুলনায় ফ্রান্সের আর্থিক স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভালো থাকলেও, বুরবোঁ রাজাদের বিলাসিতা, আত্মঘাতি যুদ্ধনীতি, রাজপরিবারের বার ও প্রশাসনিক ব্যয়বহুলতা ফ্রান্সের অর্থনীতিকে একেবারে রক্তশূন্য করে দিয়েছিলো। ভ্রান্ত করনীতির কারনে যাজক ও অভিজাতরা বিপুল আয় ও সম্পত্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রকে কোন কর বা ট্যাক্স দিতেন না। সব কর সাধারন মানুষদের কাছ থেকে আদায় করা হতো। মনে রাখতে হবে, ইওরোপের অন্যান্য দেশে সাধারণ নাগরিকদের প্রতি এই ধরনের আর্থিক অসাম্য থাকলেও, ফ্রান্সে এর মাত্রা ছিলো অনেক বেশি। বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, খাদ্যাভাব সাধারন দরিদ্র নাগরিকদের জীবনকে খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দেয়। এমতাবস্থায় লড়াই করে অধিকার ও অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা করা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ালে বিপ্লব অনিবার্য হয়ে পড়ে। তীব্র আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি লাভের জন্য ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হন। এর পরিনতিতেই ফ্রান্সে বিপ্লব শুরু হয়।
চতুর্থত, ফ্রান্সে প্রথম বিপ্লব হওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারন ছিলো ফ্রান্সের সামন্তপ্রভুদের অপদার্থতা। বিপ্লবপূর্ব কালে ইওরোপের অন্যান্য দেশগুলির মতো ফ্রান্সে সামন্তপ্রথা প্রচলিত থাকলেও ফ্রান্সের সামন্তপ্রভুরা ছিলেন অলস, অপদার্থ ও দায়িত্বহীন। তারা সমাজে নানা সুবিধা ভোগ করলেও কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে কোন দায়িত্ব পালন করতো না। ফ্রান্সের অধিকাংশ কৃষক ছিলো স্বাধীন ও মুক্ত। তাদের মধ্যে অনেকে শিক্ষিতও ছিলো। বিপ্লবপূর্ব সময়কালে কৃষিতে সংকট, উৎপাদন হ্রাস, খাদ্যাভাব ফ্রান্সের সচেতন কৃষকদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন করে তুলেছিলো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ইওরোপের অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় ফরাসি কৃষকদের মধ্যে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিলো সবচেয়ে বেশি। সামন্ততন্ত্রকে আক্রমণ ও উৎখাত করা ছিলো বিপ্লবীদের অন্যতম একটি লক্ষ্য। ইওরোপের অন্যান্য দেশ অপেক্ষা ফ্রান্সের কৃষকদের অপেক্ষাকৃত উন্নত অবস্থা ও শ্রেনী সচেতনতার কারনেই ফ্রান্সে প্রথম বিপ্লব হয়েছিলো।
পঞ্চমত, ফরাসি বিপ্লবের আগে ইওরোপের দেশ গুলির মধ্যে একমাত্র ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে বুর্জোয়া শ্রেনীর উত্থান ঘটে। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের ব্যবসা বাণিজ্য কয়েক গুন বৃদ্ধি পায়। এই সূত্রে ফ্রান্সের বুর্জোয়াদের হাতে প্রচুর অর্থ ও সম্পদ জমা হয়। প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়েও ফ্রান্সের বুর্জোয়া শ্রেনী বংশকৌলিন্য না থাকায় যোগ্য সামাজিক সম্মান, ক্ষমতা বা রাজনৈতিক অধিকার লাভ করতে পারেন নি। এজন্য বিপ্লবের আগে তাদের মনে প্রচন্ড ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এই ক্ষোভই বিপ্লবকে অনিবার্য করে তুলেছিলো। ইংল্যান্ডের বুর্জোয়াদের চেয়ে ফ্রান্সের বুর্জোয়ারা অনেক বেশি সচেতন ছিলেন। তারা দার্শনিকদের রচনা পড়ে প্রচলিত বৈষম্য ও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত ফ্রান্সে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে ও তাদের হাত ধরেই ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়েছিলো। ফ্রান্সের মতো সচেতন ও বিক্ষুব্ধ বুর্জোয়া শ্রেনী ইওরোপের অন্য কোন দেশে ছিলো না বলেই ফ্রান্সে প্রথম বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটেছিলো।
ষষ্ঠত, সবশেষে ফ্রান্সে প্রথম বিপ্লব হবার পিছনে ফরাসি দার্শনিকদের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করতে হয়। বিপ্লবের বেশ কয়েক বছর আগে ধারাবাহিক ভাবে ফ্রান্সে একের পর এক দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছিলো। এইসব দার্শনিকরা তাদের বিভিন্ন গ্রন্থে ফ্রান্সের প্রচলিত বৈষম্য ও সামাজিক ত্রুটি গুলি সম্পর্কে জনগনকে সচেতন করে তুলেন। বিপ্লবের স্বপক্ষে জনগনের মানসিক প্রস্তুতির কাজটি ফরাসি দার্শনিকরা করে দেন। বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে পত্র পত্রিকার সংখ্যা ছিলো ইওরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই সময় ফ্রান্সে প্রায় ১৬৯ টি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এই সব পত্রিকায় দার্শনিকদের মতবাদ ও রচনা গুলি নিয়ে বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হতো। দার্শনিকদের মতবাদ গুলি নিয়ে ফ্রান্সের সালো, ক্যাফে, পানশালা ও রেস্তোরাঁ গুলিতে নিয়মিত আলোচনা হতো। ফ্রান্সের মতো এইরকম বৌদ্ধিক আন্দোলন ইওরোপের অন্য কোন দেশে, এমনকি ইংল্যান্ডেও ছিলো না। এইসব কারনের জন্যই অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে প্রথম বিপ্লবের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো।
মাথায় রাখতে হবে, ফ্রান্সে প্রথম বিপ্লব হওয়ার যেমন অনেক কারন ছিলো। তেমনি ফ্রান্স বাদ দিয়ে অবশিষ্ট ইওরোপীয় দেশ গুলিতে বিপ্লব না হওয়ারও বহু কারন ছিলো। কোন একটি কারনে বিপ্লব হয় না। আবার কোন একটি শ্রেনীর স্বার্থে বিপ্লবী আন্দোলন সীমাবদ্ধও থাকে না। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজারা প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার আলোকে নিজেদের রাজতন্ত্র অথবা দেশ কোনটাকেই আপডেট করার চেষ্টা করেন নি। বিপ্লবকে একমাত্র যুগপোযোগী সংস্কারের মাধ্যমে আটকে দেওয়া সম্ভব। ইওরোপের অন্যান্য দেশ অপেক্ষা ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজারা ছিলেন একেবারেই সংস্কার বিমুখ। দীর্ঘদিন আর্থ - সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে কোন সংস্কার না হওয়ায় সাধারন, বঞ্চিত মানুষদের মধ্যে ক্ষোভ জন্ম নেয়। প্রচলিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের বন্ধনও শিথিল হতে থাকে। সংস্কার বিমুখ দেশে আর্থিক সংকট, শ্রেনী শোষন, শ্রেনী অসন্তোষ ও স্বৈরাচারিতা যে ঘোরালো পরিস্থিতি তৈরি করে, তার ফলেই ফ্রান্সে বিপ্লবের আগুন জ্বলে ওঠে।
(১.) ফ্রান্সের মতো সংস্কার বিমুখ, ঘোরালো পরিস্থিতি ইওরোপের অন্য কোন দেশে ছিলো না, (২.) ফ্রান্সের মতো দার্শনিকদের বৌদ্ধিক আন্দোলনের ধারাও ইওরোপের অন্য কোন দেশে ছিলো না, (৩.) শ্রেনী শোষনের তীব্রতা, সামন্তপ্রভুদের অদক্ষতা, স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের অপদার্থতা ও ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক সংকট অন্যান্য ইওরোপীয় দেশ অপেক্ষা ফ্রান্সেই বেশি ছিলো। (৪.) ফ্রান্সের মতো সচেতন বুর্জোয়া শ্রেনী, কৃষক শ্রেনী, সক্রিয় মধ্যবিত্ত শ্রেনী ইওরোপের অন্য কোন দেশে ছিলো না। - এইসব কারন গুলি থাকার জন্য একদিকে যেমন ফ্রান্সে প্রথম বিপ্লব হয়েছিলো। তেমনি এইসব কারন গুলি না থাকার জন্য অন্যান্য ইওরোপীয় দেশ গুলিতে বিপ্লব সংগঠিত হতে পারে নি।