অর্থশাস্ত্রের পরিচয় ও বিষয়বস্তু

 প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ওপর লেখা সর্বপ্রথম ও একমাত্র রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক তাত্ত্বিক গ্রন্থ ছিলো "অর্থশাস্ত্র"। অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা ছিলেন কৌটিল্য,যিনি চানক্য বা বিষ্ণুগুপ্ত নামেও পরিচিত ছিলেন।

অর্থশাস্ত্রের পরিচয় ও বিষয়বস্তু
অর্থশাস্ত্রের পরিচয় ও বিষয়বস্তু 

(ক.) অর্থশাস্ত্রের আবিষ্কার :- 

প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন গ্রন্থে অর্থশাস্ত্রের উল্লেখ থাকলেও, দীর্ঘদিন মূল গ্রন্থটির কোন হদিশ পাওয়া যায় নি। মহীশূরের ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক পন্ডিত শ্যামশাস্ত্রী ১৯০৫ খ্রিঃ মূল অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি আবিষ্কার করেন এবং ১৯০৯ খ্রিঃ এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়

অর্থশাস্ত্রের আবিষ্কারের পর এটি ভারত সহ বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। ১৯১৫ খ্রিঃ অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি "Kautilya's Arthasastra" নামে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষায় "কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র" প্রথম প্রকাশ করেছিলেন পন্ডিত রাধাগোবিন্দ বসাক

(খ.)  অর্থশাস্ত্রের রচনাকাল ও রচয়িতা :-

অর্থশাস্ত্রের রচনাকাল ও রচয়িতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। এই বিতর্কের অনেকগুলি অভিমুখ আছে। যেমন - 

(১.) কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, অর্থশাস্ত্র কৌটিল্য বা বিষ্ণুগুপ্তের লেখা। 

(২.) অনেকে আবার কৌটিল্য ও বিষ্ণুগুপ্তকে এক ব্যক্তি বলে মনে করেন না। আবার অন্যদিকে 

(৩.) একশ্রেনীর ঐতিহাসিকের মতে, অর্থশাস্ত্র কোন একজন ব্যক্তি রচনা করেন নি। অর্থশাস্ত্রের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকদের দ্বারা রচিত হয়। উভয় পক্ষের ঐতিহাসিকই নিজ নিজ বক্তব্যের সমর্থনে জোরালো যুক্তি ও তথ্য প্রমান হাজির করেছেন। 

অন্যদিকে অর্থশাস্ত্রের রচনাকাল সম্পর্কেও ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। এক শ্রেণীর ঐতিহাসিক দীর্ঘদিন ধরেই নানা তথ্য প্রমান হাজির করে মত প্রকাশ করেছেন, অর্থশাস্ত্র মৌর্য পরবর্তী যুগের রচনা। আবার এর বিপরীতে পাল্টা তথ্য প্রমান উপস্থাপন করে একদল ঐতিহাসিক বলতে চেয়েছেন, অর্থশাস্ত্র মৌর্য যুগেই রচিত হয়। 

তবে অর্থশাস্ত্রের রচনাকাল নিয়ে যতই বিতর্ক থাক, অর্থশাস্ত্র যে খ্রিঃ পূর্ব চতুর্থ শতকে লেখা হয়েছিলো, তার সমর্থনে একাধিক যুক্তি আমরা তুলে ধরতে পারি। যেমন -

(১.) অর্থশাস্ত্রে বৌদ্ধদের প্রতি তেমন সম্মান দেখানো হয় নি। যা থেকে অনুমান করা যায়, অর্থশাস্ত্র অশোকের আগে অর্থাৎ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়কালেই লেখা হয়েছিলো।

(২.) কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ভারতবর্ষের যে সমাজচিত্র পরিলক্ষিত হয়, তার সঙ্গে মৌর্য যুগের সমাজ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব মিল দেখা যায়।

(৩.) অর্থশাস্ত্রের বহু তথ্য চন্দ্রগুপ্তের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে মিলে যায়। এছাড়া, 

(৪.) মেগাস্থিনিসের বিবরনের সঙ্গে কৌটিল্যের বক্তব্যের অনেক মিল থেকেও একথা জোর দিয়েই বলা যায়, অর্থশাস্ত্র চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়কালেই রচিত হয়েছিলো।

মনে রাখতে হবে, অর্থশাস্ত্র মূলত রাষ্ট্র বিজ্ঞানের একটি তাত্ত্বিক গ্রন্থ ছিলো। এখানে একটি কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিৎ তাই আলোচনা করা হয়েছিলো। কোন বিশেষ সময়কালের রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত হয় নি। এই কারনেই মৌর্য যুগে রচিত হওয়া সত্ত্বেও, অর্থশাস্ত্রের মধ্যে কোথাও মৌর্য রাজবংশ, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নাম বা তার রাজধানী পাটলিপুত্রের নাম সম্বলিত মৌর্য যুগের কোন তথ্য পাওয়া যায় নি।

(গ.) অর্থশাস্ত্রের নামকরন :-

অর্থশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায় পাঠ করলে বোঝা যায়, কৌটিল্য শুরুর দিকে তার গ্রন্থটির নামকরন করেছিলেন "দন্ডনীতি"। রাজা বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থাৎ সমাজে অন্যায় ও দুরাচারকে প্রতিহত করার জন্য প্রয়োজন হয় দন্ডের অর্থাৎ শাস্তির। রাজা কিভাবে দন্ডনীতির মধ্য দিয়ে সমাজে বা রাষ্ট্রে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন, তার সম্বন্ধীয় বৈজ্ঞানিক গ্রন্থই ছিলো "দন্ডনীতি"

পরবর্তীকালে কৌটিল্য অবশ্য তার গ্রন্থটির নামকরন করেন অর্থশাস্ত্র। অর্থশাস্ত্রের শেষ পৃষ্ঠায় কৌটিল্য তার রচনাকে "শাস্ত্র" বলে উল্লেখ করেন। এই কথাটি "অর্থশাস্ত্র" বা "দন্ডনীতিশাস্ত্র" উভয়েরই একটি সংক্ষিপ্তকরন ছিলো।

অর্থশাস্ত্রের আবিষ্কারক পন্ডিত শ্যামশাস্ত্রী ১৯০৯ খ্রিঃ মূল গ্রন্থটিকে "অর্থশাস্ত্র" নামেই প্রকাশ করেন। তাছাড়া, প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন গ্রন্থে কৌটিল্য লিখিত গ্রন্থটিকে অর্থশাস্ত্র নামেই অভিহিত করা হয়। আক্ষরিক অর্থে" অর্থশাস্ত্র" হলো অর্থনীতি সংক্রান্ত বিজ্ঞান, কোন রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বই নয়। এখন রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক একটি গ্রন্থের নামকরন কৌটিল্য শেষপর্যন্ত কেন অর্থশাস্ত্র করেন, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন ওঠে।

কৌটিল্য গ্রন্থের শেষে নিজেই অর্থশাস্ত্রের নামকরনের যাবতীয় সংশয় দূর করেছেন এবং তার একটি যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, মানুষের পরম পুরুষার্থ ও কামনার বিষয় হলো অর্থ। এই পৃথিবী ও মানুষের জীবনধারনের একমাত্র উপায়ও হলো সম্পদ বা অর্থ। এই অর্থ পাওয়ার একমাত্র উপায় বা উৎস হলো ভূমি বা জমি। ভূমি থেকে রাজা খনিজ সম্পদ লাভ করেন। তাছাড়া কৃষি ও বানিজ্য থেকে যে প্রভূত রাজস্ব বা অর্থ প্রাপ্ত হয়, তাও ভূমিকেন্দ্রীক। এককথায়, ভূলোকের যাবতীয় অর্থ প্রাপ্তির মূল উৎস হলো ভূমি। 

এই ভূমি লাভ, তার সংরক্ষন ও পরিচালনা অর্থাৎ ভূ লোকের শাসন সংক্রান্ত যে বিজ্ঞান গ্রন্থ বা শাস্ত্র তাই হলো "অর্থশাস্ত্র"। অর্থাৎ অর্থশাস্ত্র বলতে কোন এলাকার শাসন পরিচালনা সংক্রান্ত বিজ্ঞানকে বোঝায়।

(ঘ.) অর্থশাস্ত্রের বিষয়বস্তু :-

অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছিলো। সমগ্র গ্রন্থটি ১৫ টি অধিকরন, ১৮০ টি প্রকরন ও ১৫০ টি অধ্যায়ে বিভক্ত ছিলো। গ্রন্থটিতে ছিলো প্রায় ছয় হাজার শ্লোক। শুরুর দিকে গ্রন্থটি পদ্যাকারে রচিত হলেও, পরে একে গদ্যরূপ দেওয়া হয়েছিলো। মূল গ্রন্থটির প্রায় ২৫ % পাওয়া যায় নি

অর্থশাস্ত্র ছিলো রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কীত একটি তাত্ত্বিক গ্রন্থ। অর্থশাস্ত্রের মূল আলোচ্য বিষয়বস্তু ছিলো - রাজা ও রাষ্ট্র সম্বন্ধীয়(১.)  রাষ্ট্রের রূপ ও বৈশিষ্ট্য, (২.) রাজার দায়িত্ব, কর্তব্য ও কার্যাবলী (৩.) রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি (৪.) রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্র, বিভিন্ন বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থা এবং (৫.) রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে এই গ্রন্থে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছিলো।

অর্থশাস্ত্রের ১৫ টি অধিকরনের নাম ও আলোচ্য বিষয়বস্তু থেকেও এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় ও তার পরিধি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। অর্থশাস্ত্রের ১৫ টি অধিকরনে আলোচ্য বিষয়সূচি ছিলো এইরকম :-

(১.) প্রথম অধিকরন :- "বিনয়াধিকারিক" নামে পরিচিত প্রথম অধিকরনে রাজকুমারদের শিক্ষা, রাজার দায়িত্ব ও কর্তব্য, রাজকার্যে মন্ত্রী, দূত ও গুপ্তচর ব্যবস্থার কথা আলোচিত হয়েছে।

(২.) দ্বিতীয় অধিকরন :- "অধ্যক্ষ প্রচার" নামে দ্বিতীয় অধিকরনের আলোচ্য বিষয় ছিলো - জনপদ গঠন, দুর্গ নির্মান, শুল্ক আদায়, আমলাতন্ত্র গঠন, অধ্যক্ষ নিয়োগ, রাজকর্মচারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

(৩.) তৃতীয় অধিকরন :- তৃতীয় অধিকরনের নাম ছিলো "ধর্মাস্থীয়", যেখানে দেওয়ানী আইন ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছিলো।

(৪.) চতুর্থ অধিকরন :- চতুর্থ অধিকরনের নাম ছিলো "কন্টকশোধন", যেখানে ফৌজদারি আইন ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছিলো।

(৫.) পঞ্চম অধিকরন :- পঞ্চম অধিকরনের নাম ছিলো "যোগবৃত্ত"। এখানে আলোচিত বিষয় ছিলো - রাষ্ট্রের শত্রুনিধন, রাজকোষে অর্থাগম ব্যবস্থা, সরকারি কর্মচারীদের বেতনদান, রাজার সভাসদ ও পরিষদদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়।

(৬.) ষষ্ঠ অধিকরন :- ষষ্ঠ অধিকরনের নাম ছিলো "মন্ডলযোনি", যেখানে রাষ্ট্রের সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব অর্থাৎ সাতটি অঙ্গের বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছিলো। এই সাতটি অঙ্গ হলো যথাক্রমে - স্বামী অর্থাৎ রাজা, অমাত্য বা রাজকর্মচারী, জনপদ বা রাষ্ট্র, দুর্গ, কোশ বা অর্থভান্ডার, দন্ড বা শক্তি ও মিত্র বা বন্ধু । 

(৭.) সপ্তম অধিকরন :- সপ্তম অধিকরন "ষাড়গুন্য" নামে পরিচিত ছিলো। এখানে বিদেশনীতি পরিচালনার জন্য ছয় প্রকার রাজনীতির কথা বলা হয়েছিলো, যেগুলি ব্যবহার করে রাজা রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাবেন। এগুলি হলো যথাক্রমে - সন্ধি (মিত্রতা), বিগ্রহ (যুদ্ধ), আসন (নিরপেক্ষ থাকা), যান (যুদ্ধ প্রস্তুতি), সংশ্রয় (অপরের আশ্রয় খোঁজা), এবং দ্বৈধীভাব ( একের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষ)। 

(৮.) অষ্টম অধিকরন :- অষ্টম অধিকরনের নামকরন করা হয়েছিলো "ব্যসনাধিকারিক"। এখানে আলোচ্য বিষয় ছিলো অপরাধীদের দ্বারা সৃষ্ট বিপদ, রাষ্ট্রকার্যে অসৎ ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরন, রাজার অযোগ্যতা ও তার প্রনাম এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে রাষ্ট্রের করনীয় কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়।

(৯.) নবম অধিকরন :- "অভিযাস্যৎকর্ম" নামে নবম অধিকরনে সামরিক অভিযানে রাজার কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছিলো।

(১০.) দশম অধিকরন :- "সাংগ্রামিক" নামে পরিচিত দশম অধিকরনে যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব, সৈন্যবাহিনীর গঠন ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছিলো।

(১১.) একাদশ অধিকরন :-" সংঘবৃত্ত" নামে পরিচিত একাদশ অধিকরনের আলোচ্য বিষয় ছিলো - যুদ্ধ জয়ের উপায়, শত্রুদের মধ্যে ভেদনীতির প্রয়োগ, সংঘ ও নিগম সংক্রান্ত নীতি ইত্যাদি বিষয়।

(১২.) দ্বাদশ অধিকরন :- "আবলীয়স" নামে পরিচিত দ্বাদশ অধিকরনে দুর্বল রাজার করনীয় বিষয় বা বিপদের হাত থেকে রক্ষার উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

(১৩.) ত্রয়োদশ অধিকরন :- "দুর্গলম্ভোপায়" নামে পরিচিত এয়োদশ অধিকরনে দেশরক্ষা ও দেশবিজয় ও দুর্গ অধিকারের উপায় সম্পর্কে আলোচনা আছে।

(১৪.) চতুর্দশ অধিকরন :- "ঔপনিষদিক" নামে পরিচিত চতুর্দশ অধিকরনে শত্রুরাজ্য জয়ের নানা অপকৌশল ও গুপ্ত কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

(১৫.) পঞ্চদশ অধিকরন :-" তন্ত্রযুক্তি" নামে পরিচিত এই অন্তিম অধিকরনটিতে কৌটিল্যের পরিচয় ও অর্থশাস্ত্র নামকরনের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিলো। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post