![]() |
ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর হিসাবে ফ্রান্স |
ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তাঁর "ওয়েলথ অফ নেশনস" গ্রন্থে বিপ্লব পূর্ব অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সের অর্থনীতিকে "ভ্রান্ত অর্থনীতির এক বিশাল জাদুঘর" বলে অভিহিত করেছিলেন।
"ভ্রান্ত অর্থনীতি" বলতে ভুল অর্থনৈতিক নীতিকে বোঝায়। আর "জাদুঘর" হলো এমন এক স্থান যেখানে পুরাতনধর্মী নানা অত্যাশ্চর্যের জিনিস মজুত থাকে।
কোন দেশের অর্থব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার জন্য সরকারি উদ্যোগকেই সাধারনত" অর্থনৈতিক নীতি" বলা হয়। দেশের অর্থনৈতিক নীতিতে (১.) কর কাঠামো, (২.) করের হার নির্ধারন, (৩.) আর্থিক তহবিল গঠন (৪.) বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প বা খাতে ব্যয় বরাদ্দ, (৫.) শিল্প স্থাপন বা কৃষির উন্নয়ন ইত্যাদি দিক গুলি নির্দিষ্ট করা হয়।
একটি দেশের অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই সেই দেশের রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের অর্থ সঞ্চয় বা ব্যয় নির্ভর করে। বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজাদের প্রচলিত অর্থনৈতিক নীতি "অর্থনীতির নিয়ম বিরুদ্ধ" ও "অবৈজ্ঞানিক" ছিলো বলেই প্রখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ ফ্রান্সের অর্থনীতিকে "ভ্রান্ত অর্থনীতি" বলে অভিহিত করেছিলেন।
ফ্রান্স কিভাবে ও কেন ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘরে পরিনত হয়?
![]() |
ভ্রান্ত অর্থনীতির দশ দিক |
বিপ্লব পূর্ব কালে যেসব অর্থনৈতিক ত্রুটির কারনে ফ্রান্স "ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘরে" পরিনত হয়েছিলো তা হলো -
(১.) রাষ্ট্রে নির্দিষ্ট কর বিভাগ না থাকা :-
বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে কর ব্যবস্থা পরিচালনা করার জন্য বুরবোঁ রাজাদের কোন নির্দিষ্ট কর বিভাগ ছিলো না। কর স্থাপন ও সংগ্রহের কাজটি করতো কন্ট্রাকটররা, যাদের বলা হতো ফারমিয়ের জেনারেল। এরা ছিলেন অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত ও অত্যাচারী। ফারমিয়ের জেনারেলরা নিলামের মাধ্যমে কর আদায়ের ব্যবস্থা করতেন। নিলামদাররা আবার ঠিকাদারের মাধ্যমে কর আদায়ের ব্যবস্থা করতো।
নিলামের মাধ্যমে কর সংগ্রহের জন্য ফ্রান্সের কৃষক ও করদাতাদের ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হতে হতো। আদায়ীকৃত করের অনেকটাই দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মচারী ও ঠিকাদাররা আত্মসাৎ করতেন।
(২.) ক্রুটিপূর্ন কর কাঠামো :-
ফ্রান্সের কর কাঠামো ছিলো বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ন।
(i) ফ্রান্সে করভার সকলের ওপর বা সব অঞ্চলের ওপর সমান ছিলো না।
(ii) সম্পদ অনুযায়ী কর ধার্য হলে করভার সহনীয় হয়। কিন্তু ফ্রান্সে তা হয় নি। মূল প্রত্যক্ষ তিনটি করই তৃতীয় সম্প্রদায়ের সাধারন মানুষদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।
(iii.) সব ও মূল করভার সাধারন, দরিদ্র মানুষদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ায় রাজার করের ক্ষেত্র শুধু যে সংকুচিত হয়েছিলো, তা নয়, জরুরি অবস্থায় অর্থের প্রয়োজন হলে রাজা আর অর্থ সংগ্রহ করতে পারতেন না।
ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থার কারনে দেখা গিয়েছিলো, যাদের হাতে যথেষ্ট জমি, সম্পদ ও আয় ছিলো, সেই যাজক ও অভিজাতদের ওপর ফ্রান্সে কোন প্রত্যক্ষ কর স্থাপন করা হয় নি। একতরফা ভাবে যাবতীয় কর বসানো হয়েছিলো তৃতীয় সম্প্রদায়ের ওপর।
সমগ্র ফ্রান্সে মোট সম্পদের ৯৫ ভাগের মালিক ছিলো প্রথম শ্রেনীতে থাকা যাজক ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে থাকা অভিজাতরা। অপরদিকে মাত্র ৫ ভাগ সম্পদের অধিকারী ছিলো তৃতীয় সম্প্রদায়। তা সত্ত্বেও, যাবতীয় করভার তৃতীয় সম্প্রদায়ের ওপরেই চাপানো হয়।
ফ্রান্সে কর ব্যবস্থার ক্রুটির কারনে সমগ্র রাজস্বের ৯৬ % বহন করতেন তৃতীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা। মাত্র ৪% স্বেচ্ছাকর দিতেন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির লোকেরা। অভিজাত ও যাজকদের সামান্য কিছু স্বেচ্ছাকর দেওয়ার কথা থাকলেও, অনেক সময় নানা কৌশলে কর ব্যবস্থা থেকে অব্যাহতি তারা আদায় করে নিতো। ফলে ফ্রান্সে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ধরনের করের বোঝা একমাত্র তৃতীয় সম্প্রদায়কেই বহন করতে হতো।
(৩.) বিশেষ কিছু শ্রেনীকে কর ছাড়ের সুবিধা :-
বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে (১.) কর ছাড়ের বিশেষ অধিকার, (২.) অর্থবানদের কম হারে কর দেওয়া, (৩.) বিশেষ কিছু শ্রেনীর লোককে কর ছাড়ে সুবিধা প্রদান কর ব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্থ করে তুলেছিলো।
যাজক ও অভিজাতরা বিশেষ অধিকারবলে ফ্রান্সে কর ছাড়ের সুবিধা পেতেন। মূল প্রত্যক্ষ করের একটিও তাদের ওপর বসানো হয় নি। অভিজাতদের ওপর সামান্য কটি পরোক্ষ কর বসানো হলেও, রাজকীয় প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে ফ্রান্সে বহু অভিজাত করদান থেকে বিশেষ ছাড় লাভ করেছিলেন।
এছাড়া, রাজা রানির বহু অনুগত কর্মচারী ও অপনজন করদান থেকে বিশেষ ছাড় পেতেন। যথেষ্ট সক্ষমতা সত্ত্বেও, করদান থেকে বিশেষ কিছু শ্রেনীকে অব্যাহতি দেওয়া বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সের রাজস্ব ব্যবস্থাকে শুধু ত্রুটিপূর্ণ করে তুলেনি, করে তুলেছিলো দুর্নীতিগ্রস্থ।
(৪.) যুদ্ধখাতে অতিরিক্ত খরচ :-
বুরবোঁ রাজারা ছিলেন অত্যন্ত যুদ্ধপ্রিয়। পুরো অষ্টাদশ শতক জুড়ে ফ্রান্স বেশ কয়েকটি বড়ো মাপের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলো। এই যুদ্ধ গুলির সঙ্গে ফ্রান্সের জাতীয় স্বার্থের তেমন সংযোগ ছিলো না। যুদ্ধ করার জন্য ফ্রান্সকে বিদেশ থেকে প্রচুর ঋন নিতে হয়। ১৭৬৩ থেকে ১৭৮৩ খ্রিঃ মধ্যে শুধু যুদ্ধের জন্যই ফ্রান্সের খরচ হয়েছিলো ২০ কোটি স্টার্লিং পাউন্ড।
(ক.) চতুর্দশ লুইয়ের আমলে (১৬৪৩ - ১৭১৫) ফ্রান্স কয়েকটি ব্যয়বহুল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, যার মধ্যে অন্যতম ছিলো স্পেনের উত্তরাধিকার যুদ্ধ। এই যুদ্ধ গুলিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়।
(খ.) পঞ্চদশ লুয়ের রাজত্বকালে ফ্রান্স অষ্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ ও সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলো। এই দুই যুদ্ধে ফ্রান্সের তেমন লাভ হয় নি, উল্টে যুদ্ধ করতে গিয়ে ফ্রান্স বিরাট ঋনের জালে জড়িয়ে পড়েছিলো।
(গ.) ষোড়শ লুইয়ের আমলে ফ্রান্স আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পাঁচ বছরের এই যুদ্ধে ফ্রান্সের খরচ হয় ১৮০ থেকে ২০০ কোটি লিভর। যুদ্ধ করতে গিয়ে ফ্রান্সের রাজকোশ দেউলিয়া হয়ে যায়।
ষোড়শ লুইয়ের এই যুদ্ধে আমেরিকা স্বাধীনতা পেলেও, এই যুদ্ধের ফলে ফ্রান্সে অর্থসংকট তীব্র আকার ধারন করে বিপ্লবকে অনিবার্য করে তুলেছিলো। ঐতিহাসিক কোবান তাই যথার্থই বলেছেন, "আমেরিকার স্বাধীনতার মূল্য ছিলো ফরাসি বিপ্লব"। ষোড়শ লুইয়ের আমলে তাঁর অর্থমন্ত্রী টুর্গো যুদ্ধ সম্পর্কে লুইকে আগেই সতর্ক করে বলেছিলেন -
" আর একটি কামান দাগা হলেই রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যাবে।" বাস্তবে তাই হয়েছিলো। অর্থমন্ত্রীর নিষেধ উপেক্ষা করে ষোড়শ লুই আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এর ফলে ফ্রান্স দেউলিয়া হয়ে যায়।
(৫.) বিলাস প্রিয়তায় অতিরিক্ত ব্যয় :-
বুরবোঁ রাজবংশের বিলাস প্রিয়তার জন্য ফ্রান্সের প্রচুর অর্থ খরচ হয়।
(ক) "সূর্যরাজা" চতুর্দশ লুই তার জাঁকজমক ও আড়ম্বরপ্রিয়তা দেখাতে অর্থ অপচয়ের যে দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন, তা তার পরবর্তী উত্তরাধিকারীদের আমলে বহুগুন বৃদ্ধি পায়।
(খ) "প্রজাপতি রাজা" পঞ্চদশ লুই ছিলেন ভোগ বিলাসের প্রতীক। শিকার ও নারীদেহলোভী এই রাজার জন্য ফ্রান্সের প্রচুর অর্থ ব্যয় হতো। পঞ্চদশ লুইয়ের স্ত্রী মাদাম পম্পাদ্যুরও স্বামীর মতো অকাতরে অর্থ ব্যয় করতেন। তিনি রাজকোশের অর্থ দ্বারা প্রচুর মনিমুক্তো ও মূল্যবান রত্ন কিনতেন।
(গ.) পরবর্তী রাজা ষোড়শ লুই ও তার রানী মেরি আঁতোয়ানেত ছিলেন আড়ম্বরপ্রিয়তার শীর্ষে। ঐতিহাসিক গুডউইন দেখিয়েছেন, ষোড়শ লুইয়ের সময়ে ভার্সাইয়ের রাজসভায় ১৮,০০০ কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে ১৬,০০০ কর্মচারীকে শুধুমাত্র রাজপ্রাসাদের কাজের জন্যই নিযুক্ত করা হয়েছিলো। রানি আঁতোয়ানেতের খাস চাকরের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৫০০ জন। রানি নিত্য নতুন ভোজসভা ও পোশাকের জন্য প্রচুর অর্থ খরচ করতেন।
বুরবোঁ রাজপরিবারের এই অতিরিক্ত খরচ মেটানোর জন্য ফ্রান্সের সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। তৃতীয় সম্প্রদায়ের লোকেদের দেওয়া করের টাকাতেই ফ্রান্স চলতো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই রাজাদের ভোগবিলাসে অর্থের এই অপচয় ও প্রাচুর্য্য তাদের মনে প্রচন্ড ক্ষোভের জন্ম দেয়।
(৬.) অবৈজ্ঞানিক অর্থ বাজেট :-
বুঁরবো রাজাদের রাষ্ট্রীয় অর্থ বাজেট অর্থাৎ অর্থ বরাদ্দের পদ্ধতি ও পরিমান শুধু অবৈজ্ঞানিকই ছিলো না, জাতীয় স্বার্থেরও পরিপন্থী ছিলো। বুরবোঁ রাজতন্ত্রের স্বার্থ পূরনেই অর্থের সিংহভাগ ব্যয় বরাদ্দ করা হয়।
(১.) বুরবোঁ রাজারা অত্যন্ত যুদ্ধপ্রিয় ছিলেন বলে বাজেটের ৭৫ শতাংশ অর্থ তারা সামরিক ও সুদ খাতে ব্যয় করেন।
(২.) রাজার প্রাসাদ ও কর্মচারীদের জন্য বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ ছিলো ২৫ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় আয়ের ১২% শুধু প্রাসাদের জন্য ব্যয় হতো। বাকি ১২% সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাবদ খরচা করা হতো।
(৩.) এইসব খরচা বাদ দিয়ে রাজারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনকল্যানমূলক কাজের জন্য বাজেটের মাত্র ২% অর্থ ব্যয় করতেন।
বলা বাহুল্য, বুরবোঁ রাজাদের এই বিভ্রান্তিমূলক অর্থনৈতিক নীতির কারনে বুরবোঁ রাজতন্ত্র ফরাসি বাসীদের কাছে কল্যাণকর না হয়ে, দেশের পক্ষে বোঝাস্বরূপ হয়ে উঠেছিলো।
(৭.) সরকারি বাজেটে ঘাটতি ও ঋন বৃদ্ধি :-
বুরবোঁ রাজাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় ছিলো অনেক বেশি। বুরবোঁ রাজাদের সাধারনত গড়ে বার্ষিক ৫০০ মিলিয়ন লিভর আয় হতো। এই আয়ের অর্ধেক আসতো ভূমিরাজস্ব "তেইলি" থেকে, বাকি অর্ধেক আসতো সম্পত্তিকর "ক্যাপিটেশন", আয়কর "ভাঁতিয়েম", শুল্ককর "অ্যাদ" এবং লবনকর "গাবেল" থেকে।
বুরবোঁ রাজাদের সরকারি বাজেটে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ার কারনে খুব স্বাভাবিক ভাবেই রাজাদের ঋনের পরিমান দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। মোট আয়ের ৫০% ব্যাংকারদের সুদ মেটাতেই চলে যেতো। ১৭৮৮ খ্রিঃ রাজার আয় ছিলো ৫০৩ মিলিয়ন লিভর, কিন্তু ঐ বছর ব্যয় হয়েছিলো ৬২৯ মিলিয়ন লিভর। অর্থাৎ আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতি ছিলো ১২৬ মিলিয়ন লিভর।
ধীরে ধীরে আয় - ব্যায়ের ঘাটতি এবং ঘাটতি ও ঋনের সুদ মেটাতে পুনরায় ঋন গ্রহনের মতো একটি দুষ্ট চক্রের মধ্যে বুরবোঁ রাজাদের অর্থনীতি পড়ে গিয়েছিলো।
ফরাসি সরকারকে ঋন ও তার সুদ বাবদ প্রায় ৩২ কোটি লিভ্র প্রতি বছর মেটাতে হতো। এই টাকা বছরের পর বছর বেড়েই চলেছিলো। ষোড়শ লুইয়ের আমলে ফ্রান্সের ঋন বেড়েছিলো প্রায় তিন গুন। বিপ্লবের প্রাক্কালে ষোড়শ লুইয়ের ঋন ছিলো ৫০০ কোটি লিভর। এটি তার দশ বছরের আয়ের সমান ছিলো।
ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের জাতীয় ঋনের মোট পরিমান ছিলো ২৫০ কোটি লিভ্র। এর সঙ্গে অন্যান্য খরচ যুক্ত হলে মোট ঘাটতির পরিমান দাড়ায় ৬৩০,০০০,০০০ লিভ্র। এই অর্থ না থাকায় ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হন। ১৭৮৯ খ্রিঃ ৫ ই মে রাজা স্টেটস জেনারেল আহ্বান করলে বিপ্লব শুরু হয়ে যায়।
(৮.) মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি রোধে ব্যর্থতা :-
ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ইওরোপের সব দেশেই জিনিস পত্রের দাম অল্প বিস্তর বেড়েছিলো। এই দাম বাড়ার প্রধান কারন ছিলো ইওরোপের বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বা জোগান বেড়েছিলো কিন্তু উৎপাদন সেভাবে বাড়েনি। মেক্সিকো সহ দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি থেকে প্রচুর সোনা ও রূপার আমদানির ফলে এইসময় ইওরোপের বাজারে সোনা রূপার জোগান বেড়ে গিয়েছিলো। ফ্রান্সের বাজারেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত সোনা রূপার মুদ্রা ছড়িয়ে পড়ে।
উৎপাদন না বাড়িয়ে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বাড়ালে মুদ্রাস্ফীতি দেখা যায়। জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। ফ্রান্সের ক্ষেত্রে একারনে বিপ্লবের প্রাক্কালে মুদ্রাস্ফিতি দেখা যায় এবং জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। ফ্রান্সে দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারন ছিলো দেশের বার্ষিক জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি। ইওরোপের অন্য দেশের তুলনায় বিপ্লবের সমসাময়িক বছর গুলিতে জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। বর্ধিত জনসংখ্যার সঙ্গে ফ্রান্সে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর কোন উদ্যোগ বুরবোঁ রাজারা নেন নি। আধুনিক কৃষি সংস্কার ও উৎপাদন ব্যবস্থায় বুরবোঁ রাজারা গুরুত্ব না দেওয়ায় ফ্রান্সের সর্বত্র খাদ্যের অভাব দেখা যায়।
বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে খাদ্যদ্রব্যের দাম ৬০% বৃদ্ধি পেয়েছিলো কিন্তু শ্রমিকদের মজুরির হার বেড়েছিলো মাত্র ২২%। শহরের নিন্ম মধ্যবিত্তদের আয়ের ৫০% - ৭৫% অর্থ খাদ্য দ্রব্য কিনতেই খরচ হয়ে যেতো। লাব্রুস তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে খাদ্য, বস্ত্র ও মাংসের দাম প্রায় ১০০ - ১৩০% বৃদ্ধি পেয়েছিলো।
বিপ্লবের প্রাক্কালে কৃষিতে সংকট ও মন্দা দেখা দিলে তা খাদ্যের অভাবকে আরোও প্রকট করে তোলে। খাদ্যের দাবিতে ফ্রান্সের সর্বত্র দাঙ্গা শুরু হয়।
(৯.) বুরবোঁ রাজাদের শিল্পবিরোধী নীতি :-
অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে উন্নত ব্যাংকিং পরিষেবা বা স্টক এক্সচেঞ্জ ছিলো না। বিদেশিরা ফ্রান্সে ব্যাংকিং কারবার করতো। কিন্তু শিল্প ঋন পাওয়া সহজ ছিলো না।
ফ্রান্স অর্থনীতিতে মার্কেন্টাইলবাদ অনুসরন করতো। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পের মুক্ত বিকাশ সম্ভব ছিলো না। ফ্রান্সে দেশের মধ্যে অসংখ্য শুল্ক চৌকি ছিলো। শিল্প ও বাণিজ্যের সংগঠন গিল্ডগুলি উৎপাদন, সরবরাহ ও পন্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতো। এসব কিছুর ফলে ফ্রান্সে অভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে জাতীয় বাজার গড়ে উঠতে পারে নি। ফলে বুরবোঁ রাজাদের অর্থনৈতিক নীতি ব্যবসা বানিজ্যের সঙ্গে যুক্ত বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের মনে গভীর অর্থনৈতিক ক্ষোভের জন্ম দেয়।
(১০.) রাজাদের আর্থিক সংস্কার বিমুখতা :-
ফরাসি রাজাদের অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধনীতি ও অতিরিক্ত বিলাসপ্রিয়তার জন্য ষোড়শ লুইয়ের আমলে ফ্রান্সে প্রবল আর্থিক সংকট দেখা যায়। এই আর্থিক সংকট থেকে দেশকে মুক্তির জন্য রাজার সামনে দুটি বিকল্প পথ খোলা ছিলো। এক, ব্যয় কমানো, দুই, আয় বাড়ানো।
রাজাদের পক্ষে ব্যয় কমানো কখনই সম্ভব ছিলো না। তাই ষোড়শ লুইয়ের পক্ষে দ্বিতীয় বিকল্পটি গ্রহন করা ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। অর্থ সংকট থেকে মুক্তির জন্য তিনি অল্প সময়ের ব্যবধানে পর পর চারজন অর্থমন্ত্রীকে নিযুক্ত করেন। এরা হলেন যথাক্রমে - তুর্গো, কালোন, ব্রিয়েন ও নেকার। এরা প্রত্যেকেই কর ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব দেন এবং যাজক ও অভিজাতদের ওপর কর বসানোর কথা তুলে ধরেন।
কিন্তু বুরবোঁ রাজারা ছিলেন সংস্কার বিমুখ। তাই ষোড়শ লুই অর্থমন্ত্রীদের সংস্কারের প্রস্তাব কার্যকর করতে বহু সময় অপচয় করেন। অর্থমন্ত্রীদের ব্যয় সঙ্কোচন নীতি বা অভিজাতদের ওপর কর বসানোর প্রস্তাবকে রাজা খোলামনে মেনে নিতে পারেন নি। তাই একের পর এক অর্থমন্ত্রীকে পদচ্যুত করে রাজা বিকল্প পথের দিশা খুঁজতে আরম্ভ করেন, এবং এটি করতে গিয়ে রাজা যে শুধু সময়ের অপচয় করেন, তা নয়, নিজের দুর্বলতা ও বিপ্লবকেও অনিবার্য করে তোলেন।
মূল্যায়ন :-
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পাই বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সে -
(১.) বুরবোঁ রাজারা ছিলেন অত্যন্ত অমিতব্যয়ী, (২.) তাঁরা প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয় করতেন (৩.) তাদের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য ছিলো না (৪.) বৈদেশিক ঋন নিয়ে তারা যুদ্ধ করতেন ও আর্থিক ঘাটতির মোকাবিলা করতেন, (৪.) দেশের কৃষি ও শিল্পের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে তারা কার্যকরী কোন অর্থনৈতিক নীতি বা সংস্কার করেন নি। (৫.) কর আদায়ের জন্য কোন নির্দিষ্ট কর বিভাগ ও স্থায়ী সরকারী কর্মচারী তারা নিয়োগ করেন নি। (৬.) আর্থিক দিক থেকে সম্পত্তিবানদের ওপর কর আরোপ না করে দুর্বল তৃতীয় সম্প্রদায়ের ওপর তারা সব করের বোঝা চাপিয়ে দেন। (৭.) আর্থিক সংকটকে মোকাবিলা করার জন্য কোন অর্থনৈতিক তহবিল তারা গঠন করেন নি বা কর ব্যবস্থার সংস্কার তারা করেন নি। (৮.) চার্বাক দর্শন "যাবৎ জীবেৎ, সুখং জীবেৎ, ঋনং কৃত্বা ঘৃতং পিবেত" অর্থাৎ যতদিন বাঁচো সুখে বাঁচো,প্রয়োজনে ঋন করেও ঘি খাও - এই নীতি ও আপ্তবাক্যকে মেনে বুরবোঁ রাজারা তাদের সময়কালের অর্থনীতিকে পরিচালনা করেন।
এই কারনে বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সের অর্থনীতিকে তীব্র কটাক্ষ ও ব্যঙ্গ করে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ ফ্রান্সকে "ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর" বলে অভিহিত করেছিলেন।
একঝলকে সংক্ষিপ্ত তথ্য :-
- ফ্রান্সকে ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর বলেছিলেন - ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ।
- বুরবোঁ রাজাদের ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থা ও আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয়ের জন্যই অ্যাডাম স্মিথ - ফ্রান্সকে ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর বলেছিলেন।
- "ওয়েলথ অফ নেশনস" গ্রন্থটির লেখক ছিলেন - অ্যাডাম স্মিথ।
- বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সের কর ব্যবস্থা ছিলো - বৈষম্যমূলক।
- ফ্রান্সে রুটির দাঙ্গা হয়েছিলো - ১৭৭৫ - ১৭৮৮ খ্রিঃ প্যারিস, লায়ন্স প্রভৃতি শহর গুলিতে।