ভারত বহু ভাষাভাষীর একটি দেশ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীনতা লাভের পর "ভাষাকেন্দ্রিক সমস্যা" ভারতের একটি অন্যতম বড়ো সমস্যা হিসাবে উঠে আসে। এই সমস্যার দুটি দিক ছিলো -
এক, ভারতের রাষ্ট্র ভাষা সংক্রান্ত সমস্যা,
দুই, ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন সংক্রান্ত সমস্যা। ভাষা সংক্রান্ত এই দুটি দিককে নিয়েই স্বাধীন ভারতে বিস্তর বিতর্ক ও সমস্যা সৃষ্টি হয়।
![]() |
ভাষার ভিত্তিতে ভারতে রাজ্য পুনর্গঠন |
(১.) গনপরিষদে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত সমস্যা ও বিতর্ক :-
স্বাধীনতা লাভের আগেই স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য গনপরিষদ গঠিত হয়। মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাব অনুসারে ১৯৪৬ খ্রিঃ এটি গঠন করা হয়েছিলো। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ গনপরিষদের স্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু মুসলিম লিগ গনপরিষদে যোগ না দেওয়ায় এবং পরবর্তীকালে ভারত বিভাজন অনিবার্য হওয়ায় বিভাজিত ভারত রাষ্ট্রের মধ্য থেকেই নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গনপরিষদ তার কাজ শুরু করে। ১৯৪৬ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাস থেকে ১৯৪৯ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ৩ বছর দীর্ঘ আলাপ আলোচনা ও বিতর্কের পর ভারতের সংবিধান রচিত হয়। স্বাধীন ভারতের সংবিধান কার্যকর করা হয়েছিলো ১৯৫০ খ্রিঃ ২৬ শে জানুয়ারি দিনটিতে।
গনপরিষদে যেসব বিষয় গুলি নিয়ে সবচেয়ে বেশি তর্ক বিতর্ক চলেছিলো, তার মধ্যে অন্যতম হলো ভাষা সংক্রান্ত বিতর্ক। স্বাধীন ভারতের সংসদে কী ভাষায় কথা বলা হবে, সংবিধান কোন ভাষায় লেখা হবে, কোন ভাষাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হবে, এই নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে হিন্দুস্থানি ভাষাকে ভারতের সরকারি ও সর্বভারতীয় ভাব বিনিময়ের ভাষা হিসাবে গ্রহন করার পক্ষে উত্তর ভারতীয় সদস্যরা জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন। পরে অধিকাংশ সদস্য এমনকি জওহরলাল নেহেরুও হিন্দির পক্ষে সওয়াল করেন।
"হিন্দু - হিন্দি সংহতির" প্রবক্তাদের প্রবল চাপের মুখে নেহেরু বলেন, সর্বভারতীয় ভাব বিনিময়ের ভাষা হিসাবে হিন্দিই সবচেয়ে উপযুক্ত। হিন্দি বলা ও শেখা সহজ। যারা হিন্দি জানেন না বা বোঝেন না, তাদের মধ্যে সরকারি উদ্যোগে হিন্দি ভাষার প্রসারের পক্ষেও তিনি বক্তব্য পেশ করেন। শেষ পর্যন্ত গনপরিষদে মাত্র ১ ভোটের ব্যবধানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, হিন্দি হবে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা।
গনপরিষদের দক্ষিণ ভারতীয় সদস্যরা প্রথম থেকেই হিন্দি ও হিন্দুস্থানি দুই ভাষারই তীব্র বিরোধিতা করে আসছিলেন। তাদের মত ছিলো, ভারতের কোন একটি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দিলে অন্য আঞ্চলিক ভাষা গুলি অবদমিত হবে এবং অবশিষ্ট ভারতের ওপর ভাষাসন্ত্রাস বা ভাষা সাম্রাজ্যবাদ নেমে আসবে। সবদিক বিবেচনা করে তারা প্রস্তাব দেন, ব্রিটিশ আমলের মতোই ইংরেজি ভাষাতেই সরকারের সব কাজকর্ম চলুক। সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজিকে রেখে দিলে নতুন করে কোন বিতর্ক সৃষ্টিও হবে না।
হিন্দিকে যখন সংবিধান সভায় জাতীয় ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হয় তখন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির টি টি কৃষ্ণমাচারি এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, গনপরিষদের উত্তর ভারতীয় প্রতিনিধিরা "হিন্দি ভারত" চান নাকি "ঐক্যবদ্ধ ভারত" চান, এর কোন একটিকে তাদের বেছে নিতে হবে। যদি তারা হিন্দি ভারতের পক্ষে সওয়াল করেন তবে তা হিন্দি সাম্রাজ্যবাদেরই নামান্তর হবে। বলা বাহুল্য, দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও হিন্দির বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার হন।
শেষপর্যন্ত প্রবল বাধা ও চাপের মুখে আপসরফা হয়, "ভারতীয় সংঘের সরকারি ভাষা হবে দেবনাগরী অক্ষরে লিখিত হিন্দি", কিন্তু "সংবিধান চালু হওয়ার পর ১৫ বছর পর্যন্ত ভারত সরকারের সমস্ত সরকারি ও প্রশাসনিক কাজ পূর্ববর্তী ব্রিটিশ আমলের মতোই ইংরেজিতেই করা হবে"।
সংবিধান সভায় গৃহীত এই সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কারন গনপরিষদের এই সিদ্ধান্তটি অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষা গোষ্ঠীর মানুষদের মনে যে আশঙ্কা ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছিলো, তা থেকেই স্বাধীন ভারতের ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবি উঠেছিলো। ফলতঃ গনপরিষদ বা সংবিধান সভাকেই ভারতের ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠনের "আঁতুরঘর" বলা চলে।
স্বাধীন ভারতের সংবিধান সভায় যেভাবে হিন্দি ভাষার পক্ষে জোরালো আওয়াজ ও বক্তব্য উঠে আসে, তা আঞ্চলিক ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের আশঙ্কিত করে তুলেছিলো। ১৫ বছরের অস্থায়ী ব্যবস্থাটির পরে কি হবে? তাদের ওপর কি বাধ্যতামূলক ভাবে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হবে? যদি চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তাদের আঞ্চলিক ভাষা কি সরকারি কৌলিন্য না পেয়ে উপেক্ষিত ও অবহেলিত থেকে যাবে না? - এইসব একাধিক প্রশ্ন যে উদ্বেগ ও আশঙ্কার জন্ম দিয়েছিলো, তা থেকেই স্বাধীন ভারতে ঘনিভূত হয়ে উঠেছিলো ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠনের মেঘ। ভাষার স্বাতন্ত্রের স্বপক্ষে জোরালো মেঘনাদ যেমন দক্ষিণ ভারত থেকে উঠেছিলো, তেমনি ভাষা কেন্দ্রীক স্বাতন্ত্র্যবোধের আন্দোলনও দক্ষিণ ভারতে প্রথম তীব্র আকার ধারন করেছিলো।
(২.) স্বাধীনতার আগে জাতীয় কংগ্রেসের ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের অঙ্গীকার :-
ভারতে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের সবথেকে বড়ো সমর্থক ছিলো জাতীয় কংগ্রেস। মহাত্মা গান্ধী থেকে জওহরলাল নেহেরু, কংগ্রেসের সব প্রথম শ্রেণীর নেতারাই ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের প্রস্তাবকে সমর্থন করতেন এবং বিষয়টি নিয়ে মাঝে মধ্যেই সোচ্চার হতেন।
১৯১৭ সালেই জাতীয় কংগ্রেস স্বাধীন ভারতে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের অঙ্গীকার করেছিলো। ১৯২০ খ্রিঃ নাগপুর অধিবেশনে কংগ্রেস তার রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের নীতিকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করে। এই সময় ভাষা অঞ্চলের ভিত্তিতে কংগ্রেস বিভিন্ন "প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি"(PCC) গুলি গঠন করে। যেমন - কর্নাটক পিসিসি, ওড়িশা পিসিসি, মহারাষ্ট্র পিসিসি ইত্যাদি। ব্রিটিশ ভারতের প্রাদেশিক ইউনিট গুলিকে অস্বীকার করেই কংগ্রেস তার এই ভাষাভিত্তিক প্রাদেশিক ইউনিট গুলিকে গঠন করেছিলো।
জওহরলাল নেহেরু ১৯৩৭ খ্রিঃ লিখিত "দ্য কোশ্চেন অব ল্যাঙ্গুয়েজ" নামক এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, "ভারত হলো বহু ভাষাভাষীর দেশ। ভারতের প্রতিটি ভাষার রয়েছে নিজস্ব লিপি, ব্যাকরন, শব্দভান্ডার আর সাহিত্য ঐতিহ্য। জনসাধারনের শিক্ষা আর সংস্কৃতি একমাত্র তাদের নিজস্ব ভাষার মাধ্যমেই বিকাশলাভ করতে পারে।" স্বাধীনতার আগে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের স্বপক্ষে জওহরলাল নেহেরু জোরালো যুক্তি ও বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন।
ব্রিটিশ সরকার অবশ্য কোন কালেই ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের প্রস্তাবকে সমর্থন করতো না। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলো, ভাষার ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশ গুলিকে গঠন করলে, ভারতের জাতীয়তাবাদ অন্য রূপ নেবে। শেষে শত শত ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধের মোকাবিলা করতে হবে ব্রিটিশ প্রশাসনকে। তাছাড়া, ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন করলে ভাষাকেন্দ্রীক নানা জটিলতারও সৃষ্টি হবে। এসব ভেবে ব্রিটিশ সরকার কখনই ধর্মের মতো ভাষা উস্কানি দেয় নি বা ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন করতে চায় নি।
(৩.) গনপরিষদে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন :-
আগেই বলেছি, স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য ১৯৪৬ খ্রিঃ গনপরিষদ গঠিত হয়। গনপরিষদে স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক কাঠামো কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে বহু তর্ক, বিতর্ক ও আলাপ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
গনপরিষদে রাষ্ট্র ভাষা সংক্রান্ত বিতর্কের অব্যবহিত পর বেশ কিছু সদস্য ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করলে কংগ্রেস তার অতীতের স্বীকৃত অবস্থান থেকে সরে আসে। এইসময় জওহরলাল নেহেরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারীর মতো কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা কংগ্রেসের স্বীকৃত অবস্থান বদলানোর আপ্রান চেষ্টা করেন এবং বলেন, ভাষা ভিত্তিক প্রদেশ গঠনের উপযুক্ত সময় এখন নয়।
এই সময় জওহরলাল নেহেরু গনপরিষদে এক ভাষনে বলেন, ধর্মের ভিত্তিতে সদ্য বিভক্ত হওয়ার পর দেশকে আবার ভাষার ভিত্তিতে বিভক্ত করার উপযুক্ত সময় এখন নয়। এখন দেশকে ভাঙ্গার নয়, গড়ার সময় এবং ঐক্যবদ্ধ থাকার সময়। রাজা গোপালাচারীও বিশেষ জোর দিয়ে বলেন, "সব ধরনের বিভেদকামী শক্তিকে এখন ঠেকানোর সময়।"
ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের "আশা ও আশঙ্কার" কথা মহাত্মা গান্ধীও ১৯৪৮ খ্রিঃ ১৫ ই জানুয়ারি, প্রার্থনা সভার এক ভাষনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন -
"আজ থেকে কুড়ি বছর আগেই কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে, দেশে যতগুলি প্রধান প্রধান ভাষা আছে, ততগুলি রাজ্য থাকা উচিত। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর এখন কংগ্রেস সে অঙ্গীকার কাজে পরিনত করতে পারে। ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশে গঠনে কোন ক্ষতি নেই যদি তারা দিল্লির কর্তৃত্ব মেনে নেয়। কিন্তু তারা সবাই যদি স্বাধীন হতে চায় আর দিল্লির কর্তৃত্ব অস্বীকার করতে চায় তাহলে সেটা খুবই খারাপ ও উদ্বেগের হবে।"
(৪.) কংগ্রেস কেন ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে?
ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন বিষয়ে গান্ধীজির যে আশঙ্কা ও উদ্বেগ ছিলো, সেটা কংগ্রেসের প্রথম সারির সব নেতাদের মধ্যেই ছিলো। ভারতবর্ষ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিলো। এই অবস্থায় ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠন করলে ভারতে একটি বিক্ষুদ্ধ ভাষাগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হবে। ভাষাকে অবলম্বন করে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব ও প্রবনতা বৃদ্ধি পাবে
জওহরলাল নেহেরু বলেন, এখনই যদি ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন করা হয় তাহলে সারা দেশ জুড়ে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। কারন প্রতিটি প্রদেশে এবং শহরে বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষেরা মিলেমিশে আছে। সদ্য দেশভাগের পর বহু মানুষ পাকিস্তান থেকে এদেশে আসছে এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ও শহরে এই লক্ষ লক্ষ লোকেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে একে অপরের পাশে বসবাস করছে। এইরূপ অবস্থায় কোন একটি মূলভাষাকে স্বতন্ত্র করে প্রদেশ গঠনের ব্যবস্থা করলে অন্যদের মনে ক্ষোভ ও বিচ্ছেদের মনোভাব দেখা দেবে। সদ্য স্বাধীন দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে নির্দিষ্ট ভাষাভিত্তিক অঞ্চল চিহ্নিত করার কাজটিও বেশ কঠিন।
তাই ভাষা ভিত্তিক প্রদেশ গঠনের দাবি যুক্তিসঙ্গত হলেও, বর্তমান সময়ে তা একেবারেই অনুপযুক্ত। গান্ধীজিও বলেছিলেন, বর্তমানে দুঃখজনক ও নিরানন্দময় পরিবেশে ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ পুনর্গঠনে সরকারের অনিচ্ছা যুক্তিসম্মত।
কংগ্রেসের মতে ভাষা ভিত্তিক প্রদেশ গঠনের থেকেও এখন গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সদ্য স্বাধীন দেশের জ্বলন্ত সমস্যা গুলির সমাধান করা। যেমন -
- নতুন সংবিধান রচনা করা,
- দেশীয় রাজ্য গুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা,
- সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অবসান ঘটানো,
- উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান করা,
- ঔপনিবেশিক শোষনে জর্জরিত ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষত নিরাময় করা,
- কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধের সমস্যার সমাধান করা,
- বিভেদকামী শক্তি গুলিকে নির্মূল করে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন করে ভারতকে একটি শক্তিশালী নেশন ও রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা।
(৫.) কংগ্রেসের অবস্থান বদলের প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ :-
(৬.) ভাষা ভিত্তিক কমিশন ও কমিটি গঠন :-
ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য গনপরিষদ ১৯৪৮ খ্রিঃ বিচারপতি এস কে দারের নেতৃত্বে "দার কমিশন" গঠন করে। অন্যদিকে ঐ একই বছর কংগ্রেস পার্টির উদ্যোগে "জেভিপি কমিটি" গঠন করা হয়েছিলো।
কমিশন ও কমিটি গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো দুটি।
এক, ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের যে সোচ্চার দাবি উঠেছে তার যথার্থতার দিকটি খতিয়ে দেখা। এবং
দুই, ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনকারীদের ক্ষোভ ও বিরুদ্ধ কন্ঠস্বরকে প্রশমিত করা।
কোন জটিল ও বিতর্কিত বিষয় নিয়ে গন অসন্তোষকে প্রশমিত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে কমিশন ও কমিটি গঠন করা হয়। এটি ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে ব্রিটিশ সরকারেরই একটি অন্যতম কূট কৌশল ছিলো। ইংরেজদের কাছে শেখা এই কূট কৌশলকে ব্যবহার করেই নেহেরু সরকার ভাষা ভিত্তিক প্রদেশ গঠনের বিষয়টিকে হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। পাশাপাশি কমিশন ও কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে বিরোধীদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনেরও চেষ্টা করে।
(ক.) দার কমিশন গঠন (১৯৪৮) :-
গনপরিষদের উদ্যোগে সরকারি ভাবে বিচারপতি এস কে দারের নেতৃত্বে ১৯৪৮ খ্রিঃ "ভাষাভিত্তিক প্রদেশ কমিশন" গঠিত হয়। বিচারপতি এস কে দারের নেতৃত্বে এই কমিশন গঠিত হয়েছিলো বলে অনেকে একে "দার কমিশনও" বলে থাকেন।
দার কমিশন তার প্রতিবেদনে জানায় - "যতদিন না ভারত একটি জাতিতে পরিনত হচ্ছে, ততদিন ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গুলির সংকীর্ণ ইচ্ছাকে অবদমিত রাখতেই হবে।" কমিশন প্রস্তাব দেয়, এই মুহূর্তে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন করলে -
(১.) প্রশাসনিক দক্ষতার অবক্ষয় ঘটবে,
(২.) একটি বিক্ষুব্ধ ভাষাগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করবে, সর্বোপরি
(৩.) দেশের জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করবে।
দার কমিশনের প্রতিবেদনে দক্ষিণ ভারতের কংগ্রেসকর্মী ও ভাষাবিদরা খুবই হতাশ ও অসন্তুষ্ট হলেন। ভাষা ছিলো একটি সংবেদনশীল আবেগ ও স্পর্শকাতর বিষয়। এই বিষয়টিকে এত সহজে উপেক্ষা করা যে সহজ হবে না, সেটা অচিরেই কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব উপলব্ধি করে। ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের বিষয়টি আরোও একবার খতিয়ে দেখবার জন্য তাই কংগ্রেসের তরফে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই প্রতিশ্রুতির ফলস্বরূপ গঠন করা হয় "জে ভে পি কমিটি"।
(খ.) জেভিপি কমিটি (১৯৪৮) :-
দলিয় ভাবে কংগ্রেসের ভাষা ভিত্তিক প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব মুছে ফেলা এবং দক্ষিণ ভারতের কংগ্রেস কর্মীদের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য কংগ্রেসের উদ্যোগে ১৯৪৮ খ্রিঃ শেষের দিকে "জেভিপি কমিটি" গঠন করা হয়।
জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় তিনজন নেতা - জওহরলাল নেহেরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ও পট্টভি সীতারামাইয়াকে নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। এই তিনজন সদস্যদের নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে এই কমিটির নামকরন করা হয়েছিলো "জেভিপি কমিটি"।
এতদিন ধরে ভাষা ভিত্তিক প্রদেশ গঠনের বিপক্ষে কংগ্রেসের উচ্চমার্গের নেতারা যে যুক্তি, বক্তব্য ও আশঙ্কার কথা গুলি শুনিয়ে আসছিলেন, জেভিপি কমিটি তার প্রতিবেদনে সেই ভাষ্য গুলিকেই পুনরুল্লেখ করে। যাবতীয় পর্যালোচনার শেষে জেভিপি কমিটি তার প্রস্তাব বলে -
"ভাষার শুধু যে বাঁধবার শক্তি আছে তা নয়, ভাঙ্গবারও শক্তি আছে। ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের উপযুক্ত সময় এখন নয়। এখন বিভেদকামী প্রবনতাগুলি আমাদের ঠেকিয়ে রাখতে হবে। সবথেকে বেশি জোর দিতে হবে দেশের নিরাপত্তা, ঐক্য ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ওপর।
দেশের বর্তমান নিরাপত্তা ও ঐক্যের স্বার্থে স্বাধীনতার পূর্বে ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠন সম্পর্কে কংগ্রেসের যে বক্তব্য ছিলো তার এখন বাস্তব পরিস্থিতি নেই। যে কোনভাবে তাকে প্রশয় দেওয়া এখন কাম্য নয়।"
(৭.) সাময়িক ক্ষোভ প্রশমন ও পুনরায় আন্দোলন :-
" দার কমিশন" এবং" জেভিপি কমিটি" ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের বিষয়টিতে ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে মাত্র কয়েক মাসের জন্য পরিস্থিতিকে শান্ত রাখতে পারলেও, সেটা ছিলো নেহাতই তুষের আগুনকে ধামাচাপা দেওয়ার মতো। ১৯৪৮ - ১৯৪৯ খ্রিঃ মধ্যে পুনরায় জেগে ওঠে একের পর এক ভাষাভিত্তিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিতে বিক্ষোভ ও আন্দোলন। এইসময় -
(ক.) মাদ্রাজ, হায়দ্রাবাদ ও মহীশূরে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা তেলেগুভাষীরা পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের দাবিতে গন আন্দোলন শুরু করে।
(খ.) কন্নড়ভাষীরা শুরু করে "সংযুক্ত কর্নাটক আন্দোলন", যার উদ্দেশ্য ছিলো মাদ্রাজ, মহীশূর ও বোম্বাই প্রদেশে ছড়িয়ে থাকা কন্নড় ব্যক্তিদের একত্রিত করে ভাষাভিত্তিক স্বায়ত্ত্বশাসনের ব্যবস্থা করা।
(গ.) মারাঠিদের আলাদা রাজ্যের জন্য "সংযুক্ত মহারাষ্ট্র পরিষদ" আন্দোলন শুরু করে।
(ঘ.) বোম্বাই প্রদেশের অন্তর্গত গুজরাটিরা নিজস্ব রাজ্যের দাবিতে শুরু করে - "মহাগুজরাট আন্দোলন"।
(ঙ.) মলয়ভাষীরা দাবি তুললো মালাবারের সঙ্গে কোচিন ও ত্রিবাঙ্কুর এই দুই রাজন্যশাসিত রাজ্যের মিলনে মালয়ালামদের নিজস্ব রাজ্য "কেরালা"।
(চ.) পাঞ্জাবের শিখরা তাদের গুরুমুখী ভাষা ও স্বাতন্ত্র্যবোধের জন্য চাইলো পৃথক পাঞ্জাব রাজ্য।
(ছ.) ১৯৪৮ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারিতে অল ইন্ডিয়া আদিবাসী মহাসভার প্রেসিডেন্ট জয়পাল সিং প্রকাশ্য বক্তিতায় বিহার রাজ্য ভেঙ্গে ঝাড়খন্ড রাজ্য গঠনের দাবি জানান।
তবে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের জন্য প্রথম সর্বাত্মক গন আন্দোলন সংগঠিত হয় তেলেগুভাষী অন্ধ্রতে। তাদের জোরালো গনআন্দোলনের ফলেই ভারতে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের পথটি মসৃন, প্রশস্ত ও বিশেষ ভাবে ত্বরান্বিত হয়।
(৮.) অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য তেলেগুভাষীদের আন্দোলন :-
স্বাধীন ভারতে হিন্দির পরেই সংখ্যার দিক থেকে সবথেকে বেশি ছিলো তেলেগুভাষীরা। তারা মাদ্রাজ, হায়দ্রাবাদ ও মহীশূর রাজ্যে ইতস্তত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। তেলেগুভাষীদের সাহিত্য ও ইতিহাস দুটোই অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিলো। অতীতের বিজয়নগর সাম্রাজ্যের গৌরব অন্ধ্র অঞ্চলেই পরিব্যাপ্ত ছিলো। ভারত যখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিলো, তখনই তেলেগুভাষীদের মধ্যে আত্মপরিচয় জাগিয়ে তোলার জন্য মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীতে "অন্ধ্র মহাসভা" নামে একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিলো।
অন্ধ্র মহাসভা মাদ্রাজ, হায়দ্রাবাদ ও মহীশূরের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তেলেগুদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। পরাধীনতার কালেই অন্ধ্র মহাসভা তেলেগুভাষীদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের বোধ জাগিয়ে তোলার জন্য অভিযোগ তোলে তামিলরা তেলেগুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরন করে। পৃথক ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের আন্দোলনের সময় পুরাতন এই অভিযোগটিকেই প্রধান অস্ত্র হিসাবে তেলেগুরা ব্যবহার করে।
(ক.) আন্দোলনের পদ্ধতি :-
স্বাধীনতার পরেই তেলেগুভাষীরা পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের জন্য আন্দোলন শুরু করে। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা আবেদন, নিবেদন, পথসভা, মিছিল ও জনসভার মধ্য দিয়ে আন্দোলন শুরু করে। তেলেগুভাষী কংগ্রেস কর্মীরা কংগ্রেস হাইকমান্ডের কাছে আবেদন পাঠিয়ে বলেন, স্বাধীনতার আগে কংগ্রেস ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের যে অঙ্গীকার করেছিলো, সেই সময় এখন এসে গেছে। কংগ্রেস হাইকমান্ড কিন্তু গোড়া থেকেই তেলেগুদের আন্দোলনকে তেমন আমল না দিয়ে বলে দিলো, ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের উপযুক্ত সময় এখন নয়।
কংগ্রেস নেতৃত্বের এরকম গাছাড়া মনোভাব দেখে কংগ্রেসকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য এবং পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের দাবিতে মাদ্রাজের প্রাক্তন তেলেগুভাষী মুখ্যমন্ত্রী টি প্রকাসম কংগ্রেস দল থেকে ১৯৫০ সালে পদত্যাগ করেন।
(খ.) বিধান সভায় পৃথক রাজ্যের দাবি :-
পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের দাবিতে মাদ্রাজ বিধান সভায় একটি প্রস্তাব আনেন মাদ্রাজের সকল তেলেগুভাষী বিধায়করা। এইসময় সব পার্টির তেলেগুভাষী বিধায়করা প্রস্তাবটিকে সমর্থন করেন এবং একত্রিত হয়ে পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের দাবি তোলেন। এই সময় পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন তামিল বিধায়করা, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনায় পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের আন্দোলন পুরোপুরি রাজনৈতিক আন্দোলনের চেহারা লাভ করে। ১৯৫১ - ৫২ খ্রিঃ স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম নির্বাচনে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট একই সঙ্গে হয়েছিলো। এইসময় জওহরলাল নেহেরু তেলেগুভাষী জেলাগুলিতে ভোট প্রচারে গেলে তেলেগুরা নেহেরুকে কালো পতাকা দেখিয়ে মারাত্মক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং বলেন - "আমরা পৃথক অন্ধ্র চাই"।
নির্বাচনে তেলেগুভাষী অঞ্চল গুলিতে কংগ্রেস খুবই শোচনীয় ফল করে। এর ফলে সমগ্র মাদ্রাজ বিধানসভায় ১৪৫ টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস পায় মাত্র ৪৩ টি আসন। নির্বাচনের এই ফল অন্ধ আন্দোলনকারীদের পৃথক রাজ্যের জন্য আরোও উৎসাহিত করে তোলে।
(গ.) স্বামী সীতারামের আন্দোলন :-
১৯৫২ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে স্বামী সীতারাম নামে ধর্মগুরু এবং কংগ্রেস রাজনীতিবিদ অন্ধ্রপ্রদেশের সমর্থনে তেলেগু প্রধান জেলা গুলিতে পদযাত্রা করলে সাধারন মানুষের মধ্যে প্রচন্ড উৎসাহ, উদ্দীপনা ও আবেগ দেখা যায়। সীতারাম এইসময় সমস্ত তেলেগুভাষী বিধায়কদের পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের দাবিতে মাদ্রাজ বিধানসভা বয়কটের ডাক দেন। তিনি বলেন, আলাদা রাজ্য সৃষ্টির জন্য আর অপেক্ষা করা চলে না।
অন্ধ্রপ্রদেশে আলাদা রাজ্যের জন্য যখন আন্দোলন ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছিলো তখন ১৯৫২ খ্রিঃ ২২ মে নেহেরু সংসদে অত্যন্ত ভাসা ভাসা শব্দে একটা ভাষন দিলেন, তার সারাংশ ছিলো এরকম -
"কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠন যদি কাঙ্খিতও হয়, সে কাজটাও করার পক্ষে অনুকূল সময় এটা নয়। উপযুক্ত সময় যখন আসবে, তখন আমরা সকলেই তাকে সর্বপ্রযত্নে ঘটিয়ে তুলবো।"
(ঘ.) পট্টি শ্রীরামালুর অনশন ও অগ্নিগর্ভ অন্ধ্র :-
পৃথক অন্ধ্র রাজ্য গঠনের অনুকূল সময় কখন আসবে তা কেউ জানে না। কিন্তু সেই সময়কে অন্ধ্রদের অনুকূলে এনে দেওয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজটি করলেন পট্টি শ্রীরামালু নামে একজন কংগ্রেসকর্মী। পট্টি শ্রীরামালু একজন সমাজসংস্কারক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। ১৯৪৬ খ্রিঃ মাদ্রাজ রাজ্যের সব মন্দিরের দরজা অস্পৃশ্যদের জন্য খুলে দেওয়ার দাবিতে তিনি আন্দোলন ও আমরন অনশন করেছিলেন। গান্ধীজির লবন সত্যাগ্রহেও তিনি সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯৫২ সালের ১৯ শে অক্টোবর, পট্টি শ্রীরামালু অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের দাবিতে আমরন অনশনে বসেন এবং ৫৮ দিন অনশন করে মারা যান।
পট্টি শ্রীরামালুর মৃত্যুর পরেই অন্ধ্রপ্রদেশের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। সাধারন মানুষের ক্ষোভ ও যাবতীয় রাগ হিংসার রূপ ধারণ করে। বিক্ষুব্ধ জনতা সরকারি সম্পত্তি, যানবাহন আক্রমন করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। রাস্তায় রাস্তায় জনতা - পুলিশ খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
(ঙ.) পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠন (১৯৫৩) :-
পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় নেহেরু অন্ধ্রপ্রদেশের দাবি মেনে নেন। শ্রীরামালুর মৃত্যুর দুদিন পর জওহরলাল নেহেরু এক বিবৃতি জারি করে বলেন "পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের সময় এবার এসে গেছে"। এরপর কয়েকমাস ধরে মাদ্রাজ প্রদেশের তেলেগুভাষী জেলা গুলিকে চিহ্নিত করার কাজ চলে।
অবশেষে ১৯৫৩ খ্রিঃ ১ লা অক্টোবর, ভারতের প্রথম ভাষাভিত্তিক রাজ্য হিসাবে আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের। কুর্নুল নামক স্থানে নতুন রাজ্যের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অন্ধ্ররা যে দুজন ব্যক্তিকে তাদের সবথেকে বড়ো শত্রু মনে করতেন, সেই দুজন ব্যক্তির উপস্থিতিতেই সম্পন্ন হয় নতুন রাজ্যের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এদের একজন ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। অন্যজন ছিলেন মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী।
(৯.) অন্যান্য অঞ্চলে ভাষাভিত্তিক প্রদেশের দাবি :-
অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনকে নেহেরু সহজভাবে মেনে নেন নি। খুব ঘনিষ্ঠ একজন সহকর্মীকে তিনি খুব দুশ্চিন্তার সুরে বলেছিলেন -
"এই যে ভীমরুলের চাকে আমরা খোঁচা মারলাম, এর ফলে দেখবেন আমাদের কত ভুগতে হয়। আমার ধারনা, আমরা অধিকাংশই এর কামড়ে ক্ষত বিক্ষত হবো।"
নেহেরু যেটা আশঙ্কা করেছিলেন, সেটাই হলো। অন্ধ্রপ্রদেশ গঠিত হবার পর ভারতবর্ষের অন্যান্য ভাষাভাষীদের মধ্যে খুব শিঘ্রই ভাষাভিত্তিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি প্রবল আকার ধারন করলো। অন্ধ্ররা তাদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারলে আমরা কেন পারবো না, এইরকম একটি আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে ভারতের অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষরা পৃথক রাজ্যের দাবিতে গলা ফাটাতে আরম্ভ করলেন।
এরূপ অবস্থায় সকলের সম্মিলিত ক্ষোভের প্রশমন করার জন্য নেহেরু সরকার ব্রিটিশ সরকারের শেখানো কূটকৌশলকেই অবলম্বন করলেন। সকলের দাবির যথার্থতার বিচার করার জন্য তিনি একটি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন।
(১০.) রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন (১৯৫৩) :-
অন্ধ্রপ্রদেশের মতো অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি যাতে অন্য কোথাও সৃষ্টি না হয়, সেইজন্য কিছুটা অনিচ্ছাকৃত ভাবেই জওহরলাল নেহেরু গঠন করেন "রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন"। ১৯৫৩ খ্রিঃ আগস্ট মাসে গঠিত হয়েছিলো "States Re - Organization Commision"।
সদস্য ও সভাপতি :- রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের তিন জন সদস্য ছিলেন - সৈয়দ ফজল আলি, হৃদয়নাথ কুঞ্জুরু এবং কে এম পানিক্কর।
এদের প্রথমজন ছিলেন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও বিচারপতি, দ্বিতীয় জন ছিলেন স্বনামধন্য ঐতিহাসিক, আর তৃতীয় জন ছিলেন একজন সমাজকর্মী। এদের কারো সঙ্গেই কংগ্রেসের কোন আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের বন্ধন ছিলো না। রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের চেয়ারম্যান /সভাপতি ছিলেন - সৈয়দ ফজল আলি।
উদ্দেশ্য :- রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো ৩ টি। যথা -
(ক.) ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠন নিয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যে জনরোষ সৃষ্টি হয়েছে, তা হ্রাস করা,
(খ.) ভাষা ভিত্তিক প্রদেশ গঠনের বিষয়টি কিছুটা বিলম্বিত করা, এবং
(গ.) ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা।
কমিশনের কাজ :- (ক.) প্রায় আঠারো মাস ধরে কমিশন তার সমীক্ষা চালায়। (খ.) ১৯৫৪ - ১৯৫৫ প্রায় দুবছর ধরে কমিশনের সদস্যরা সারা ভারত পরিভ্রমন করে তথ্য সংগ্রহ করেন। (গ.) এই সময়কালে তারা ১০৪ টি শহরে যান, নয় হাজার লোকের সাক্ষাৎকার নেন এবং ১,৫২,২৫০ টি লিখিত আবেদনপত্র গ্রহন করেন। যারা পৃথক ভাষাভিত্তিক রাজ্যের দাবি তুলছিলেন তারা এই সময় তাদের ভাষার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানা দিককে তুলে ধরে ধরেন এইসব আবেদনপত্রে।
(১০.) ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের পক্ষে কমিশনের কাছে বৌদ্ধিক যুক্তি :-
এইসময় ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের স্বপক্ষে বিভিন্ন ভাষাভিত্তিক গন সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কাছে ৪ টি জোরালো যুক্তি তুলে ধরা হয়। এগুলি হলো -
(ক.) ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠিত হলে ভাষাভিত্তিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিও পূরন হয়ে যাবে। ফলে ভারতে ভাষাকেন্দ্রিক বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবনতা বা বিদ্বেষ হ্রাস পাবে।
(খ.) নিজেদের ভাষায় সরকারি কাজকর্ম হওয়ায় স্থানীয় মানুষ আরোও বেশি করে প্রশাসনে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। ফলে শাসক ও শাসিতের মধ্যে ব্যবধান অনেকখানি কমে যাবে।
(গ.) প্রাদেশিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে স্থানীয় ভাষা গুলিরও উন্নয়ন হবে, যা ব্রিটিশ আমলে উপেক্ষিত ছিলো।
(ঘ.) স্থানীয় ভাষায় শিক্ষার আরোও প্রসার ঘটবে। শিক্ষার প্রসার ঘটার ফলে ভারতে গনতন্ত্রের বুনিয়াদ আরোও শক্ত হবে।
(১১.) রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের প্রস্তাব পেশ :-
১৯৫৫ খ্রিঃ ৩০ শে সেপ্টেম্বর, রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন তার রিপোর্ট পেশ করে। কমিশন তার প্রতিবেদনে জানায় - "ভাষাগত সর্বসমতা থাকলে তা প্রশাসনিক সুবিধা ও কর্মদক্ষতার পক্ষে অনুকূল হয়। কিন্তু ভারতের ঐক্য ও অখন্ডতাকে ছাপিয়ে কখনই ভাষা একমাত্র বন্ধনসূত্র হতে পারে না। "এই ভাষ্য অনুযায়ী বিভিন্ন দিক বিচার বিশ্লেষণ করে কমিশন বেশ কিছু ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের সুপারিশকে যেমন মেনে নেয়, তেমনি কয়েকটি সুপারিশকে নাকচও করে দেয়।
কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী -
(ক.) দক্ষিণ ভারতে তামিল, তেলেগু, কন্নড় ও মালয়ালামদের জন্য ৪ টি পৃথক ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের কথা বলা হয়। রাজ্য পুনর্গঠনের সময় জেলা ও তালুক গুলিকে সংখ্যা গরিষ্ঠ ভাষার ভিত্তিতে পুনর্বিন্যস্ত করার কথা কমিশন তুলে ধরে।
(খ.) উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী বলয়টিকে কমিশন ৪ টি রাজ্যে ভাগ করে। যথা - বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান।
(গ.) পূর্ব ভারতে ছোটখাটো জেলা অদলবদল ছাড়া রাজ্য গুলি যেমন ছিলো তেমনই থাকবে বলা হলো। পূর্বভারতে প্রধান রাজ্য ছিলো ৩ টি। যথা - পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ঊড়িষ্যা।
(ঘ.) বিহারকে ভেঙ্গে ঝাড়খন্ড আর আসামের পৃথক উপজাতি রাজ্য গঠনের দাবি কমিশন প্রত্যাখ্যান করে।
(ঙ.) পাঞ্জাবকে টুকরো বা বিভক্ত করার বিরুদ্ধেই কমিশন তার মতপ্রকাশ করে।
(চ.) কমিশন ঐক্যবদ্ধ মহারাষ্ট্র গঠনের দাবিকেও প্রত্যাখ্যান করে। তবে মারাঠিভাষী কিছু জেলা নিয়ে পৃথক বিদর্ভ রাজ্য গঠনের একটি বিকল্প প্রস্তাব দেয়।
(ছ.) এছাড়া কমিশন বোম্বাইকে পৃথক দ্বিভাষিক (মারাঠি ও গুজরাটি) রাজ্য হিসাবেই রেখে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।
(১২.) রাজ্য পুনর্গঠন আইন (১৯৫৬) :-
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সুপারিশ গুলি কয়েকটি সংশোধনি সহযোগে গ্রহন করা হয়। সুপারিশ গুলি কার্যকর করবার জন্য ১৯৫৬ খ্রিঃ নভেম্বর মাসে "রাজ্য পুনর্গঠন আইন" ভারতীয় পার্লামেন্টে পাশ করা হয়। এই আইন অনুযায়ী তৎকালীন ভারতকে ১৪ টি রাজ্য ও ৬ টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে বিন্যস্ত করা হয়।
১৪ টি রাজ্য হলো যথাক্রমে -
- অন্ধ্রপ্রদেশ
- আসাম
- ঊড়িষ্যা
- উত্তরপ্রদেশ
- কেরালা
- জন্মু ও কাশ্মীর
- পশ্চিমবঙ্গ
- পাঞ্জাব
- বিহার
- বোম্বাই
- মধ্যপ্রদেশ
- মহীশূর
- মাদ্রাজ
- রাজস্থান।
- ত্রিপুরা,
- আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ
- দিল্লি
- লক্ষাদ্বীপ, মিনিকয় ও আমিনদিভি দ্বীপপুঞ্জ
- মনিপুর ও
- হিমাচল প্রদেশ।
(১৩.) ভারতের নতুন মানচিত্রের রূপ :-
১৯৫৬ খ্রিঃ ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠিত হবার ফলে ভারতে যেমন বেশ কিছু নতুন রাজ্যের জন্ম হয়, তেমনি পুরাতন রাজ্যের সঙ্গে বেশ কিছু ভাষাভাষী জেলাও সংযুক্ত হয়। এর ফলে তৎকালিন ভারতের মানচিত্রে ব্যাপক রদবদল ঘটে। যেমন -
(ক.) হায়দ্রাবাদ রাজ্যের তেলেঙ্গানা অঞ্চলকে প্রথম ভাষাভিত্তিক রাজ্য "অন্ধ্রপ্রদেশের" সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
(খ.) পুরানো মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীর মালাবার জেলাকে ত্রিবাঙ্কুর ও কোচিনের সঙ্গে যুক্ত করে তৈরি করা হয় নতুন "কেরালা রাজ্য"।
(গ.) বোম্বাই, মাদ্রাজ এবং হায়দ্রাবাদের কুর্গের কন্নড়ভাষী এলাকা গুলিকে মিশিয়ে তৈরি করা হয় নতুন রাজ্য - মহীশূর রাজ্য, পরে যার নাম হয় কর্নাটক।
(ঘ.) রাজ্য পুনর্গঠনের ফলে বোম্বাই রাজ্যের আয়োতন অনেকখানি বেড়ে যায়। কচ্ছ, সৌরাষ্ট্র এবং হায়দ্রাবাদের মারাঠিভাষী এলাকা গুলি দ্বিভাষিক বোম্বাই রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়।
(ঙ.) ১৯৫৬ খ্রিঃ পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয় বিহারের পুর্নিয়া জেলার কিছু অংশ এবং বিহারের মানভূম জেলার কিছু অংশ, পরে যার নাম হয় পুরুলিয়া।
(১৪.) রাজ্য পুনর্গঠনে দাবি উপেক্ষিত হওয়ায় বোম্বাই, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে তীব্র প্রতিবাদ ও গন আন্দোলন :-
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ও আইন দুটিতেই মারাঠিদের পৃথক রাজ্যের দাবি ও আশা পূরন না হওয়ায় মারাঠিরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এই সময় মারাঠিদের অনেকেই প্রশ্ন তুলতে থাকেন, কেন্দ্র অন্য সকলের ভাষাভিত্তিক প্রদেশের দাবি মেনে নিলেও, মারাঠিদের দাবি অন্যায় ভাবে প্রত্যাখান করেছে।
১৯৫৬ সাল থেকেই রাজ্য পুনর্গঠন আইনের বিরুদ্ধে বোম্বাই প্রদেশে ব্যাপক গোলমাল, দাঙ্গা ও প্রতিবাদ শুরু হলো। এই সময় জনতা - পুলিশ খন্ডযুদ্ধে প্রায় ৮০ জন মানুষ মারা যায়। সংযুক্ত মহারাষ্ট্রের এই আন্দোলনকে সমর্থন করে পাশে দাঁড়ায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এস এ ডাঙ্গে, দলিতদের নেতা বি আর আম্বেদকর এবং মহারাষ্ট্রের বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস কর্মীদের একটি বড়ো অংশ।
এইসময় গন আন্দোলনের চাপে পড়ে সরকার বোম্বাই প্রদেশকে ভাষার ভিত্তিতে "মহারাষ্ট্র", "গুজরাট" ও "বোম্বাই" - এই ৩ টি রাজ্যে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিলো। মারাঠিদের জন্য মহারাষ্ট্র, গুজরাটিদের জন্য গুজরাট, এবং বোম্বাই শহরকে একটি দ্বিভাষিক কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসাবে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
দ্বিভাষিক রাজ্য বা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসাবে বোম্বাইয়ের দাবিকে অবশ্য মারাঠি বা গুজরাটিদের কেউই সমর্থন করলো না। বোম্বাই শহরে বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ থাকলেও সেখানে মারাঠি ও গুজরাটি ভাষীদের সংখ্যা ছিলো সবচেয়ে বেশি। দুটি ভাবী রাজ্যের দাবিদাররাই এইসময় বোম্বাই শহরের দখল নিয়ে নতুন করে আন্দোলন শুরু করে। বোম্বাইকে অন্তভূক্ত করার জন্য একদিকে "সংযুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতি" অন্যদিকে "মহাগুজরাট জনতা পরিষদের" মধ্যে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। প্রায় ৫ বছর এই আন্দোলন চলেছিলো।
আন্দোলন চলাকালীন সময়ে দুই পক্ষই বোম্বাইয়ের অন্তর্ভূক্তির প্রশ্নে জোরালো ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক যুক্তি তুলে ধরেছিলো। গুজরাটিরা বললো, বোম্বাইয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষীর লোক বসবাস করে। মারাঠিরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, শতকরা ৪৩ ভাগ। অন্যদিকে মারাঠিরা বললো, যে দ্বীপের ওপর বোম্বাই তৈরি হয়েছে, সেখানে বহু প্রাচীন যুগ থেকেই মারাঠিভাষীরা বসবাস করে আসছে। বোম্বাইকে ভৌগলিক দিক থেকে মারাঠিভাষী জেলা গুলি ঘিরে আছে। তাই বোম্বাই শহরটি মহারাষ্ট্রের অন্তভূক্ত হওয়া উচিত।
মারাঠিরা নবগঠিত মহারাষ্ট্রের রাজধানী হিসাবে বোম্বাইকে দাবি করলো। এই সময় তারা শ্লোগান দেয় - "লাঠি গোলি খায়েঙ্গে, ফির ভি বোম্বাই লায়েঙ্গে।" এই সময় নেহেরু শান্তি বজায় রাখার প্রস্তাব দিলে মারাঠিরা বলে, বোম্বাইকে রাজধানী করে সংযুক্ত মহারাষ্ট্র গঠন করা ছাড়া অন্য কোন সমাধানই গ্রহনযোগ্য হবে না। বোম্বাই আদায় করার জন্য এইসময় মারাঠিরা রাজপথে নেমে প্রতিবাদ করলে, জনতা পুলিশ খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
বোম্বাইয়ের গুজরাটিদের মনে হলো তারা নবগঠিত মারাঠি রাজ্যে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন। তাই তারা বোম্বাইয়ের মহারাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করলো। তাদের সঙ্গে প্রতিবাদে সামিল হলো অন্যান্য গুজরাটিরা। এইভাবে প্রায় ৫ বছর ধরে প্রথমে তর্ক - বিতর্ক, পরে হিংসাত্মক গন আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ১৬ জন নিহত ও ২০০ জন আহত হয়। আন্দোলনের জেরে বোম্বাই প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মোরারজি দেশাই ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সি ডি দেশমুখ পদত্যাগ করেন।
(১৫.) মহারাষ্ট্র ও গুজরাট রাজ্য গঠন (১৯৬০) :-
দীর্ঘ সংঘাতের পর শেষপর্যন্ত ভারত সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে এবং ১৯৬০ খ্রিঃ মে মাসে সমগ্র বোম্বাই প্রদেশকেই ভাষার ভিত্তিতে দ্বিখন্ডিত করে মহারাষ্ট্র ও গুজরাট রাজ্য গঠন করে। নবগঠিত মহারাষ্ট্রের রাজধানী হয় বোম্বাই, আর গুজরাটের রাজধানী হয় আমেদাবাদ।
(১৬.) পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও হিমাচল প্রদেশ গঠন (১৯৬৬) :-
দেশভাগের পর পাঞ্জাবের যে অংশটি ভারতের দিকে পড়েছিলো, তাকে পাঞ্জাব নামেই অভিহিত করা হতো। যদিও এর সরকারি নাম ছিলো - পেপসু প্রদেশ (PEPSU = Patiala and East Punjab States Union) । পাঞ্জাবে তিনটি ভাষাভাষীর অস্তিত্ব ছিলো। যথা - পাঞ্জাবি বা গুরুমুখী, হিন্দি এবং পাহাড়ি ভাষা। পাঞ্জাবে পাঞ্জাবীরা গুরুমুখী ভাষাতে এবং হিন্দুরা হিন্দি ভাষায় কথা বলতো। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ ভাষাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে পৃথক রাজ্যের দাবি করেছিলো।
পাঞ্জাবে অকালি দলের নেতা মাস্টার তারা সিং পাঞ্জাবিদের জন্য পৃথক শিখ রাজ্য দাবি করেন। এইসময় জনসংঘের প্রভাবে পাঞ্জাবের হিন্দিভাষীরাও পৃথক রাজ্যের দাবি করে। নেহেরু এবং কংগ্রেস ধর্মের ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের বিরোধী ছিলেন। তাই নেহেরুর আমলে পাঞ্জাব বিভক্ত হয় নি।
পরে ১৯৬৬ খ্রিঃ ইন্দিরা গান্ধীর আমলে পাঞ্জাবকে পাঞ্জাবি, হিন্দি ও পাহাড়ি অঞ্চলে ভাগ করে যথাক্রমে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও হিমাচলপ্রদেশ নামে ৩ টি রাজ্য গঠন করা হয়। কাঙড়া ও হোসিয়ারপুর জেলার পাহাড়িভাষী অঞ্চল হিমাচল প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। নতুন শহর চন্ডীগড় পাঞ্জাব ও হরিয়ানা দুই রাজ্যেরই রাজধানী হয়।
(১৬.) অন্যান্য রাজ্য গঠন :-
স্বাধীনতার আগে থেকেই ভারতে ভাষা ও জাতিভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের যে দাবি উঠেছিলো, তা নেহেরু যুগ অতিক্রম করে, তার পরবর্তীকালেও অতি সক্রিয় থাকে। এর ফলে পরবর্তীকালেও ভারতে অনেকগুলি রাজ্য পুনর্গঠিত হয়। যেমন -
- ১৯৬৩ খ্রিঃ ১ ডিসেম্বর - পৃথক নাগল্যান্ড রাজ্য গঠিত হয়।
- ১৯৭১ খ্রিঃ - হিমাচল প্রদেশ পূর্ন রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে।
- ১৯৭২ খ্রিঃ - মনিপুর, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্য গঠিত হয়।
- ১৯৭৫ খ্রিঃ - সিকিম রাজ্য গঠিত হয়।
- ১৯৮৭ খ্রিঃ - অরুনাচল প্রদেশ, মিজোরাম ও গোয়াকে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়।
- ১৯৯৩ খ্রিঃ - রাজধানী দিল্লি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল রূপে পূর্নাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে।
- ২০০০ খ্রিঃ - বিহার ভেঙ্গে ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ ভেঙ্গে ছত্তিশগড় এবং উত্তরপ্রদেশ ভেঙ্গে উত্তরাখন্ড রাজ্য গঠিত হয়।
- ২০১৪ খ্রিঃ - অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙ্গে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠিত হয়।
- অন্ধ্রপ্রদেশ (রাজধানী - অমরাবতী),
- অরুনাচল প্রদেশ (রাজধানী - ইটানগর)
- আসাম (রাজধানী - দিসপুর)
- বিহার (রাজধানী - পাটনা)
- ছত্তিশগড় (রাজধানী - রায়পুর)
- গোয়া (রাজধানী - পানাজি)
- গুজরাট (রাজধানী - গান্ধীনগর)
- হরিয়ানা (রাজধানী - চন্ডীগড়)
- হিমাচলপ্রদেশ (রাজধানী - সিমলা)
- ঝাড়খণ্ড (রাজধানী - রাঁচি)
- কর্নাটক (রাজধানী - বেঙ্গালুরু)
- কেরালা (রাজধানী - তিরুবন্তপুরম)
- মধ্যপ্রদেশ (রাজধানী - ভোপাল)
- মহারাষ্ট্র (রাজধানী - মুম্বাই)
- মনিপুর (রাজধানী - ইম্ফল)
- মেঘালয় (রাজধানী - শিলং)
- মিজোরাম (রাজধানী - আইজল)
- নাগাল্যান্ড (রাজধানী - কোহিমা)
- ওড়িশা (রাজধানী - ভুবনেশ্বর)
- পাঞ্জাব (রাজধানী - চন্ডীগড়)
- রাজস্থান (রাজধানী - জয়পুর)
- সিকিম (রাজধানী - গ্যাংটক)
- তামিলনাড়ু (রাজধানী - চেন্নাই)
- তেলেঙ্গানা (রাজধানী - হায়দ্রাবাদ)
- ত্রিপুরা (রাজধানী - আগরতলা)
- উত্তরপ্রদেশ (রাজধানী - লখনউ)
- উত্তরাখন্ড (রাজধানী - দেরাদুন)
- পশ্চিমবঙ্গ (রাজধানী - কলকাতা)
- আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ,
- চন্ডীগড়,
- দাদরা, নগর হাভেলি, দমন ও দিউ,
- দিল্লি,
- লাদাখ,
- লাক্ষাদ্বীপ,
- জন্মু ও কাশ্মীর,
- পুদুচেরি।
(১৭.) ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব :-
একঝলকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-
- দার কমিশন ও জেভিপি কমিটি গঠন করা হয়েছিলো - ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের দিকটি অনুসন্ধান করবার জন্য।
- দার কমিশন ও জেভিপি কমিটি গঠন করা হয় - ১৯৪৮ খ্রিঃ।
- দার কমিশন গঠিত হয়েছিলো - বিচারপতি এস কে দারের নেতৃত্বে।
- জেভিপি কমিটির ৩ জন সদস্য ছিলেন - জওহরলাল নেহেরু, বল্লভভাই প্যাটেল ও পট্টভি সীতারামাইয়া।
- দার কমিশন ও জেভিপি কমিটি ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের বিপক্ষে মতপ্রকাশ করেছিলো।
- প্রথম ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের দাবি তোলে - তেলেগুভাষীরা।
- ভারতের প্রথম ভাষাভিত্তিক রাজ্য হলো - অন্ধ্রপ্রদেশ।
- অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠনের জন্য - পত্তি শ্রীরামালু ৫৮ দিন অনশন করে প্রানত্যাগ করেন।
- অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠিত হয় - ১৯৫৩ খ্রিঃ ।
- মাদ্রাজ রাজ্য ভেঙ্গে পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ু রাজ্য গঠিত হয় - ১৯৫৩ খ্রিঃ ।
- রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন করা হয় - ১৯৫৩ খ্রিঃ ।
- রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সদস্য ছিলেন - ফজল আলি, হৃদয়নাথ কঞ্জুরু ও কে এম পানিক্কর।
- রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সভাপতি ছিলেন - সৈয়দ ফজল আলি।
- রাজ্য পুনর্গঠন আইন পাশ হয় - ১৯৫৬ খ্রিঃ ১ নভেম্বর।
- ১৯৫৬ খ্রিঃ রাজ্য পুনর্গঠন আইন অনুযায়ী - ভারতকে ১৪ টি রাজ্য ও ৬ টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়।
- রাজ্য পুনর্গঠন আইন অনুযায়ী ১৯৫৬ খ্রিঃ গঠিত ভাষাভিত্তিক রাজ্য গুলি হল - কর্নাটক, কেরালা, ঊড়িষ্যা, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, পাঞ্জাব, মধ্য প্রদেশ, আসাম, জন্মু ও কাশ্মীর।
- পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পুরুলিয়া জেলাকে যুক্ত করা হয় - ১৯৫৬ খ্রিঃ।
- রাজ্য পুনর্গঠন আইন অনুযায়ী - হায়দ্রাবাদের তেলেঙ্গানাকে অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে এবং বিহারের পুরুলিয়া ও পুর্নিয়া জেলার একাংশকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
- বোম্বাই প্রদেশ ভেঙ্গে মহারাষ্ট্র ও গুজরাট রাজ্য গঠন করা হয় - ১৯৬০ খ্রিঃ।
- পাঞ্জাব রাজ্য ভেঙ্গে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও হিমাচলপ্রদেশ রাজ্য গঠন করা হয় - ১৯৬৬ খ্রিঃ।
- ১৯৬৩ খ্রিঃ ১ ডিসেম্বর - পৃথক নাগল্যান্ড রাজ্য গঠিত হয়।
- ১৯৭১ খ্রিঃ - হিমাচল প্রদেশ পূর্ন রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে।
- ১৯৭২ খ্রিঃ - মনিপুর, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্য গঠিত হয়।
- ১৯৭৫ খ্রিঃ - সিকিম রাজ্য গঠিত হয়।
- ১৯৮৭ খ্রিঃ - অরুনাচল প্রদেশ, মিজোরাম ও গোয়াকে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়।
- ১৯৯৩ খ্রিঃ - রাজধানী দিল্লি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল রূপে পূর্নাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে।
- ২০০০ খ্রিঃ - বিহার ভেঙ্গে ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ ভেঙ্গে ছত্তিশগড় এবং উত্তরপ্রদেশ ভেঙ্গে উত্তরাখন্ড রাজ্য গঠিত হয়।
- ২০১৪ খ্রিঃ - অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙ্গে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠিত হয়।