স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের প্রথম ও প্রধান সমস্যা ছিলো উদ্বাস্তু সমস্যা। উদ্বাস্তু সমস্যা সংক্রান্ত আলোচনার পরিধির মধ্যে থাকা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গুলিকে নিন্মলিখিত ভাবে সাজিয়ে তুলে ধরা হলো। তথ্য গুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কারনে যে, এই তথ্য গুলি থেকে পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে। আশা করছি, নিন্মলিখিত আলোচনাটি কিছুটা হলেও ছাত্র ছাত্রীদের কাজে লাগবে এবং তথ্য গুলিকে মনে রাখার কাজকে সহজ করে তুলবে।
![]() |
স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যা : সংক্ষিপ্ত তথ্য |
(ক.) একঝলকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-
- ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হয়েছিলো - রেডক্লিফ লাইন অনুসারে।
- নিজের বাসভূমি ত্যাগ করে প্রান বাঁচাতে নিরাপত্তার খোঁজে ভিনদেশে চলে আসা ছিন্নমূল বাস্তুহারা মানুষেরাই ইতিহাসে "উদ্বাস্তু" বা "Refugee" নামে পরিচিত।
- ভারত বিভক্ত হবার পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বলি হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পাকিস্তান থেকে আগত লক্ষ লক্ষ হিন্দু ও শিখ শরনার্থীদেরকেই "উদ্বাস্তু" বলা হয়।
- স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম ও প্রধান গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিলো উদ্বাস্তু সমস্যা।
- স্বাধীনতার প্রথম ৫ বছর ভারত সরকার উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান ও উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করেছিলো বলে, এই সময়কালকে "পুনর্বাসনের যুগ" বলা হয়।
- ভারত ভাগ হয়েছিলো বাংলা ও পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে। তাই উদ্বাস্তু সমস্যা সবথেকে বেশি তীব্র আকার ধারন করেছিলো পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাবে।
- স্বাধীন ভারতের প্রথম উদ্বাস্তু কমিশনার ছিলেন - হিরন্ময় বন্দোপাধ্যায়।
- পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন - প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ।
- পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু সমস্যা তীব্র আকার ধারন করেছিলো।
- ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভিসা ও পাসপোর্ট চালু হয় - ১৯৫২ খ্রিঃ।
- পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি উদ্বাস্তু শিবির হলো - ধুবুলিয়া, বাঁশবেড়িয়া, রানাঘাট, বনগাঁ, বারাসাত।
- পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য সবচেয়ে বড়ো উদ্বাস্তু শিবির খোলা হয়েছিলো - কুরুক্ষেত্রে।
- পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু ত্রান ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন - ড. বিধানচন্দ্র রায়।
- কেন্দ্রীয় উদ্বাস্তু ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন - শ্রী মেহেরচাঁদ খান্না।
- বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন - কৈলাশনাথ কাটজু।
- পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া হয় - উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন রাজ্য গুলিতে।
- পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের (পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত) ঊড়িষ্যার দন্ডকারন্য ও আন্দামানে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিলো।
- ঊড়িষ্যার দন্ডকারন্য থেকে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুরা সংরক্ষিত বনাঞ্চল মরিচঝাঁপিতে চলে এসেছিলো।
- সারা ভারত উদ্বাস্তু আন্দোলন পরিষদ গঠিত হয় - ১৯৪৮ খ্রিঃ।
- নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় - ১৯৫০ খ্রিঃ ১৭ ই এপ্রিল।
- নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো - ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলির মধ্যে।
- নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তির প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন - ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ক্ষিতিশচন্দ্র নিয়োগী।
- পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব হলেও, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের একটি বড়ো অংশকে পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব হয় নি।
- ১৯৪৮ খ্রিঃ ৩০ শে জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেন - নাথুরাম গডসে।
- পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ আলি জিন্নার মৃত্যু হয় - ১৯৪৮ খ্রিঃ।
- পূর্ব পাঞ্জাবে উদ্বাস্তুদের মধ্যে জমি বন্টনের কাজ করেন - তারলোক সিংহ।
- উদ্বাস্তুদের দরদি বন্ধু নামে পরিচিত ছিলেন - ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
- উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের জন্য "মানুষ ও সম্পত্তি বিনিময় নীতির" প্রস্তাব দিয়েছিলেন - ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
- "জনসংঘ" নামে নতুন রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন - ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
- জনসংঘই পরবর্তীকালে ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP) তে পরিনত হয়।
- দেশভাগের পরবর্তী সময়কালকে ঐতিহাসিক সর্বপল্লি গোপাল" বিষন্ন প্রভাত" বা "Sad Morning" বলে অভিহিত করেছিলেন।
- খাদ্য সংকট থেকে খাদ্য আন্দোলনের জন্ম হয় - ১৯৫৯ খ্রিঃ।
(খ.) বিভিন্ন ব্যক্তির পরিচয় :-
(১.) জওহরলাল নেহেরু - স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
(২.) সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল - স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।
(৩.) লিয়াকৎ আলি খাঁ - পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
(৪.) শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ক্ষিতিশচন্দ্র নিয়োগী - নেহেরু মন্ত্রীসভার দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন।
(৫.) প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ - পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
(৬.) ডঃ বিধানচন্দ্র রায় - স্বনামধন্য ডাক্তার, পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু ত্রান ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন।
(৭.) শ্রী মেহেরচাঁদ খান্না - কেন্দ্রীয় উদ্বাস্তু ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন।
(৮.) তারলোক সিংহ - পাঞ্জাবে উদ্বাস্তুদের মধ্যে জমি বন্টনের মুখ্য পরিচালক ও কারিগর ছিলেন।
(৯.) হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় - স্বাধীন ভারতের প্রথম উদ্বাস্তু কমিশনার ছিলেন।
(গ.) পাকিস্তান থেকে কেন সংখ্যালঘু হিন্দু ও শিখরা ভারতে চলে এসেছিলো?
পাকিস্তান থেকে একাধিক কারনে সংখ্যালঘু হিন্দু ও শিখরা ভারতে এসেছিল। যেমন -
- পাকিস্তানে সংখ্যা লঘুদের জীবন ও সম্পত্তির কোন নিরাপত্তা ছিলো না।
- পাক প্রশাসন পাকিস্তানে দাঙ্গা থামানোর ও সংখ্যালঘুদের রক্ষার কোন নীতি গ্রহণ করে নি।
- পাক প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশে আস্থা অর্জনের মতো সংখ্যা লঘু প্রতিনিধি ছিলো না।
- পাক প্রশাসন, পুলিশ ও সেনা দাঙ্গাকারীদের সঙ্গ দিয়ে সংখ্যা লঘুদের ওপর অত্যাচার, সম্পত্তি দখলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
- হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতি নীতি ও খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে মুসলিমদের ব্যাপক পার্থক্য থাকায় অমুসলিমরা ভারতে থাকাই শ্রেয় বলে মনে করেছিলো।
(ঘ.) উদ্বাস্তুদের আগমন ভারতে কি কি সমস্যা তৈরি করে?
উদ্বাস্তুদের আগমনের ফলে ভারতে -
- জনসংখ্যা উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পায়,
- বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য খাদ্য সংকট ও খাদ্য আন্দোলনের জন্ম হয়,
- সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিমান বৃদ্ধি পায়,
- ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা ও অব্যবস্থা দেখা যায়,
- উদ্বাস্তুদের খাদ্য, আশ্রয় ও পুনর্বাসনের জন্য ভারত সরকারের প্রভূত অর্থ খরচ হয়,
- উদ্বাস্তু আগমনের ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ত আকার ধারন করে।
(ঙ.) উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে বিতর্ক কেন দেখা যায়?
অনেক গুলি কারনে উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে ভারতে বিতর্ক দেখা যায়। যেমন -
- নেহেরু সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তু সমস্যায় যতটা আন্তরিক ছিলো, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তু সমাধানে ততটা আন্তরিক ছিলো না।
- পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের জন্য জমি বন্টন, উপনগরী স্থাপন করা হলেও, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের জন্য তা করা হয় নি।
- পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত শিখ ও হিন্দিভাষী উদ্বাস্তুদের জন্য প্রভূত অর্থ বরাদ্দ করা হলেও, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্য নামমাত্র অর্থ বরাদ্দ করা হয়।
- পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য পাকা বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হলেও, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের জন্য খড়, টালি ও বাঁশ দিয়ে নিন্মমানের ঘরবাড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়।
- পশ্চিম পাকিস্তানের সব উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দিলেও, নেহেরু সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সব উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে তাদের পাকিস্তানে ফিরে যেতে বলেছিলো।
- পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের জন্য নেহেরু "নেহেরু - লিয়াকৎ / দিল্লি চুক্তি" স্বাক্ষর করলেও, তা উদ্বাস্তু সমস্যার কোন সমাধান করতে পারে নি।
- শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে কঠোর চুক্তি এবং সম্পত্তি ও জনবিনিময়ের প্রস্তাব দিলে নেহেরু তা প্রত্যাখান করেন।
- নেহেরু পাকিস্তান থেকে ভারতে প্রত্যাপর্ন করা মুসলমানদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ফিরে পাবার ব্যাপারে উদ্যোগী হলেও, পাকিস্তানে হিন্দুদের বেদখল হয়ে যাওয়া সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে নিরব ও নিষ্ক্রিয় থাকেন।
(চ.) পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান কেন করা যায় নি? / পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু সমস্যার মধ্যে কি জটিলতা ছিলো?
- পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দেশভাগের সময় একবারেই সব উদ্বাস্তুরা চলে এসেছিলেন। ফলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে তাদের পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব হয়েছিলো।
- কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে দফায় দফায় উদ্বাস্তুদের আগমন ঘটেছিলো। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের মতো পরিকল্পনা করে এখানকার উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান করা যায় নি।
- পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্য কোথাও যেতে রাজি ছিলেন না।
- পূর্ব পাঞ্জাবের মতো পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা দেশত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান নি। ফলে পশ্চিমবঙ্গে জমির যথেষ্ট অভাব ছিলো।
- নেহেরু সরকার পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু সমস্যায় আন্তরিক ছিলেন না।