স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যা

স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের প্রথম ও প্রধান সমস্যা ছিলো "উদ্বাস্তু সমস্যা"। নিজের বাসভূমি ত্যাগ করে প্রান বাঁচাতে নিরাপত্তার খোঁজে ভিনদেশে চলে আসা ছিন্নমূল বাস্তুহারা মানুষেরাই ইতিহাসে "উদ্বাস্তু" বা "Refugee" নামে পরিচিত

স্বাধীনতা লাভের পর কয়েক লক্ষ হিন্দুশিখ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান পরিত্যাগ করে ভারতে চলে আসে। নবগঠিত পাকিস্তান থেকে এই বিরাট সংখ্যক মানুষের আগমনের ফলে স্বাধীন ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়।

স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যা
স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যা 


(ক.) ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভবের কারন :-

ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভবের পিছনে কতকগুলি কারন ছিলো। এগুলি হল -

  1. ধর্ম ও দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ, 
  2. পাকিস্তানে নিরাপত্তার অভাব, 
  3. হিন্দু ও মুসলিম দুই ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে বহুযোজন দূরত্ব
  4. পাকিস্তানে দাঙ্গা প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয়তা ও সংখ্যালঘু নিধন, 
  5. পাকিস্তানে দাঙ্গায় বিতাড়িত হিন্দুদের পাকিস্তানে ফিরে না যাওয়া, 
  6. পাক প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব না থাকা এবং
  7. ত্রুটিপূর্ন দেশভাগ। 
সৈয়দ আহমেদ খানের "আলিগড় আন্দোলন" ভারতে দ্বিজাতি তত্ত্বের যে বীজ বপন করেছিলো, মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে স্বাধীনতার ঊষালগ্নে তা বিষবৃক্ষে পরিনত হয়। ১৯২০ র দশকের শেষদিক থেকেই জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ প্রথমে মুসলমানদের পৃথক প্রতিনিধিত্ব ও পরে পৃথক বাসস্থানের দাবি তোলে। ১৯৪০ এর দশকে মুসলিমদের পৃথক বাসস্থান দাবি পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে রূপলাভ করে। ব্রিটিশ সরকার ও জাতীয় কংগ্রেসের কাছ থেকে বলপূর্বক পাকিস্তান দাবির জন্য জিন্না ভারতের সম্প্রীতির পরিবেশকে সাম্প্রদায়িক পরিবেশে পরিনত করেন।

এরই অঙ্গ হিসাবে বিভিন্ন জন সমাবেশে মুসলিমদের তাতিয়ে তোলা হয়। জিন্না মুসলিমদের তাতিয়ে তোলার জন্য শ্লোগান দেন - "মু মে বিড়ি, গাল মে পান, লেড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান"। ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য মুসলিম লিগ "নিষ্কৃতি দিবস", "প্রত্যক্ষ সংগ্রাম" ও "দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং" এর আয়োজন করে হিন্দু নিধন শুরু করে। বিপরীত দিক থেকে এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধের সাম্যতা তৈরির চেষ্টা শুরু হলে জাতি আক্রমন দাঙ্গার রূপ ধারন করে।

মুসলিম লিগের দ্বিজাতি তত্ত্বের মূল মর্মকথা ছিলো, ভারতে হিন্দু - মুসলমান দুটি পরস্পর বিরোধী যুদ্ধরত জাতি। তারা কখনই একসঙ্গে বাস করতে পারে না। বিভিন্ন জনসমাবেশ, সরকার, কংগ্রেস সকলের কাছেই সুপারিশ করে  লিগ যখন পৃথক দ্বিজাতি তত্ত্বের গ্রহনযোগ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হলো, তখন তাকে প্র্যাকটিক্যাল ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আমদানি করে ও ভারতকে দাঙ্গার মুখে ঠেলে দেয়।

স্বাধীনতার আগেই মহম্মদ আলি জিন্না যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন জ্বালিয়ে দেন, তা থেকে বাঁচবার এবং বাঁচানোর জন্য কংগ্রেস এবং ব্রিটিশ সরকার উভয়েরই ধর্ম ও দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকলো না। 

শেষপর্যন্ত ভারত ভাগ হলো। এর ফলে পাকিস্তানের মধ্যে থেকে যাওয়া হিন্দু ও শিখরা ভয়ঙ্কর ভাবে নিরাপত্তা হীনতায় ভুগতে থাকলেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিন্দু - মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ঘৃনার জন্ম দিয়েছিলো, তা মানুষের সব সরলতা ও বিশ্বাসকে নষ্ট করে দিয়েছিলো। মুসলমান রাষ্ট্রে বা সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চলে কোন অমুসলিম নিরাপদে থাকতে পারেন না, এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা বহু হিন্দুকে আতঙ্কিত করে তোলে। অমুসলিমদের এই অভিজ্ঞতাকে আরোও পাকাপোক্ত করে দিয়েছিলো স্বাধীনতার সময়কালের দাঙ্গা এবং পরবর্তীতে নব গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে সংখ্যা লঘু হিন্দুদের ওপর মুসলিমদের একতরফা আক্রমণ ও সন্ত্রাস। 

স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তান তৈরি হলো বটে। কিন্তু সেই রাষ্ট্রে কয়েক লক্ষ হিন্দু থেকে গিয়েছিলো। স্বাধীনতার আগে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ঘৃনা সৃষ্টি হয়েছিলো, পাকিস্তান রাষ্ট্রে তার এক নগ্ন বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা গেলো। দ্বিজাতি তত্ত্বের থিওরিকে রাষ্ট্রীয় মদতে খুব ভালো ভাবে পাকিস্তানে প্রয়োগ করা হতে থাকলো। পাকিস্তানিরা তাদের রাষ্ট্র থেকে হিন্দুদের মেরে জমি জায়গা, ঘর বাড়ী সব দখল করে নিতে শুরু করলো। হিন্দু ও শিখ নারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম ভাবে গন ধর্ষন করা হয়। এছাড়া নারকীয় হত্যালীলা তো ছিলোই। 

সব মিলিয়ে নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে থাকা হিন্দু ও শিখদের পক্ষে একেবারেই অসহনীয় হয়ে পড়লো। সেখানে জীবনের কোন নিরাপত্তা ছিলো না। অমুসলিমদের বেঁচে থাকারও কোন অধিকার ছিলো না। হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে মুসলিম ধর্ম, সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের বিস্তর ফারাক ছিলো। এইসব কারনে দেশভাগের পর কয়েক লক্ষ হিন্দু পাকিস্তান ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ভারতে চলে আসেন। 

ভারতে উদ্বাস্তুদের আগমনের আরেকটি বড়ো কারন ছিলো, দাঙ্গা দমনে পাকিস্তান প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা। পাকিস্তানে যখন একতরফা ভাবে এবং দফায় দফার সংখ্যা লঘু হিন্দু ও শিখদের ওপর আক্রমণ ঘটতে থাকে, তখন তাকে থামানোর কোন চেষ্টাই পাক প্রশাসন করে নি। উল্টে নিরব ও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা নিয়ে পাক প্রশাসন দাঙ্গাবাজদেরই সঙ্গ দেয়। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রশাসন ও লিগের লোকজন দাঙ্গাবাজদের প্রচন্ড উস্কানি দেয়। পাক প্রশাসনের সেনাবাহিনী ও পুলিশ জোর করে হিন্দুদের সম্পত্তির জবরদখল ও লুটপাটের কাজে মদত দেয়। হিন্দুদের অভিযোগের কোন প্রতিকার না করে উল্টে তাদেরই বিনা বিচারে আটকে রাখে। 

ভারতের ক্ষেত্রে অবশ্য চিত্রটি বিপরীত ছিলো। ভারতে নেহেরু সরকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে কঠোর অবস্থান ও ব্যবস্থা নেয়। কংগ্রেস প্রথম থেকেই একটি কথা খুব পরিষ্কার করে বলে দিয়েছিলো, তারা দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাস করে না। ভারতবর্ষ সকলের এবং সকলেই ভারতে নিরাপদে বসবাস করার অধিকারী। এখানে বলে রাখা দরকার, দাঙ্গার আগুন যে শুধু পাকিস্তানে জ্বলছিলো এমনটা নয়। সেই আগুন ভারতেও দাউ দাউ করে জ্বলছিলো। 

যেখানে যাদের পাল্লা ভারি সেখানে তারা একত্রিত হয়ে সংখ্যা লঘুদের ওপর প্রতিশোধ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো। সাম্প্রদায়িক দলগুলো বিভিন্ন রকম উস্কানি দিয়ে তাদের এই সমস্ত কাজকর্মকে সমানে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছিলো। ভারতে নেহেরু সরকার এইসব সাম্প্রদায়িক দল গুলোর ওপর কঠোর মনোভাব নেন। ভারত দাঙ্গা থামানোর জন্য সেনা ও পুলিশদের কঠোর ও খোলা নির্দেশ দেয়। 

খুনখারাপি করতে দেখা মাত্রই সাম্প্রদায়িক দলকে গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই কঠোর অবস্থানের ফলে ভারতে সাম্প্রদায়িক হিংসার শিরদাঁড়া ভেঙ্গে যায়। মহাত্মা গান্ধী স্বয়ং দাঙ্গার প্রতিবাদে অনশন করেন এবং মুসলমানদের পক্ষ নেন। গান্ধীজির অসামান্য প্রচেষ্টায় ভারতে দাঙ্গার আগুন অনেকটাই প্রশমিত হয়। এর ফলে শেষ পর্যন্ত সাড়ে চার কোটি মুসলমান এদেশে থেকে যাওয়ার মনস্থ করেন। সংখ্যা লঘুদের প্রতি ভারত সরকারের দরদি নীতির ফলে ভারত ত্যাগ করে যাওয়া অনেক মুসলমানও পরে ভারতে ফিরে এসেছিলো। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের ক্ষেত্রে এটি লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। 

খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেশভাগের ফলে পাকিস্তান থেকে যে পরিমান জলের স্রোতের মতো অমুসলিমদের নির্গমন ঘটে তা ভারতে প্রবেশ করেছিলো, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সেটি কখনই দেখা যায় নি। মনে রাখতে হবে, পাকিস্তান থেকে বিরাট পরিমাণ হিন্দু বিতাড়নের ফলে ভারত থেকে যে পরিমাণ মুসলিম পাকিস্তানে গিয়েছিলেন, তাদের তেমন সমস্যায় পড়তে হয় নি। কারন হিন্দুদের ছেড়ে আসা জমি, বাড়িঘর তারা পেয়েছিলেন। ভারতে পাকিস্তানের মতো সমানুপাতে মুসলিম নির্গমন না হওয়ায় পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা অমুসলিমদের প্রভূত সমস্যায় পড়তে হয়। 

এককথায় বলতে গেলে পাকিস্তানে হিন্দুদের ফাঁকা শূন্যস্থান মুসলমানরা পূরন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ভারতের ক্ষেত্রে কিন্তু সেই সুযোগ হিন্দুরা পান নি। এর প্রধান কারন হলো, দেশভাগের পরও প্রায় ৬০ % মুসলিম ভারতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভারত সরকারের উদার সংখ্যা লঘু নীতির কারনে দাঙ্গার ফলে বিতাড়িত বহু মুসলিম ভারতে ফিরে এসে তাদের সম্পত্তি ও জমি ফিরে পেয়েছিলেন। 

এর ফলে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেশভাগের পর ভারতেই উদ্বাস্তু সমস্যা সবথেকে বেশি ও তীব্র ভাবে দেখা যায়। মাথায় রাখতে হবে, দাঙ্গার আগুন নিভে গেলে পাকিস্তান ছেড়ে আসা কোন মানুষই আর সেখানে ফিরতে চায় নি। এর সবথেকে বড়ো কারন ছিলো পাক প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশে সংখ্যা লঘুদের আস্থা অর্জনের মতো যথেষ্ট সংখ্যক সংখ্যালঘু প্রতিনিধি ছিলো না। বলা ভালো একেবারেই ছিলো না। সংখ্যালঘুদের পাকিস্তান ত্যাগের এবং পুনরায় সেখানে ফিরে না যাবার এটি একটি বড়ো কারন ছিলো। 

ফলে স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীনতার পর উদ্বাস্তু নিয়ে ভারতকেই সবথেকে বেশি লড়াই চালিয়ে যেতে হয় এবং সমস্যায় পড়তে হয়

তবে স্বাধীনতার পর ভারতের উদ্বাস্তু সমস্যার সবথেকে বড়ো কারন ছিলো ত্রুটিপূর্ন দেশভাগ১৫ ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে, এর একদিন পর ১৭ ই আগস্ট ভারত বিভাজনের মানচিত্র প্রকাশিত হয়। স্বাধীনতার আগেই দেশভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইংল্যান্ড একজন প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার সিরিল রেডক্লিফকেরেডক্লিফ ১৯৪৭ খ্রিঃ জুন মাসে ভারতে আসেন। ভারত বিভাজনের জন্য তাকে মাত্র ৫ মাস সময় দেওয়া হয়। 

রেডক্লিফ ইতিপূর্বে কখনোই ভারতে আসেন নি। ভারতে তার জানা শোনা কেউই ছিলেন না। জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লিগ অথবা ব্রিটিশ প্রশাসন কারো কাছেই তিনি পরিচিত ছিলেন না। ফলে দেশ ভাগ সম্পর্কে তার নির্বাচন ও সিদ্ধান্ত ভয়ঙ্কর ভাবে নিরপেক্ষ হবে ভাবা হয়েছিলো। 

রেডক্লিফ ভুলে ভরা পুরাতন ছেঁড়াকাটা মানচিত্র ও জনগননা রিপোর্ট নিয়ে তার কাজ শুরু করেন। মাত্র ৫ সপ্তাহ সময়ের মধ্যে তিনি বাংলা ও পাঞ্জাবের বেশ কয়েকটি অঞ্চল পরিদর্শন করেন। শেষপর্যন্ত বাংলা ও পাঞ্জাব নামক সীমান্তবর্তী দুই প্রদেশের বুকে ছুরি কেটেই ভারত বিভাজন করেন।

অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে দেশবিভাজনের ফলে বহু হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল যেমন পাকিস্তানে থেকে যায়, তেমনই বহু মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা বা জেলা ভারতে থেকে যায়। এর ফলে দেশভাগ এক বিরাট সংখ্যক মানুষের জীবনে চরম বিপর্যয় নিয়ে আসে। রেডক্লিফ জানতেন, তিনি যে কাজ করেছেন, তা কখনই নিঃখুত হবে না। তার মধ্যে এক বিরাট ফাঁক ও গলদ থেকে যাবে। অবধারিত ভাবেই তিনি এক বিরাট সংখ্যক মানুষের প্রতিহিংসার শিকার হবেন। তাই তিনি শর্ত দিয়েছিলেন, তার ভারত ত্যাগের পরই যেন দেশভাগের মানচিত্র প্রকাশ করা হয়। 

দেশে তখন ভয়াবহ দাঙ্গা চলছিলো। ১৭ আগস্ট কোন ক্রমে দেশভাগের মানচিত্র ব্রিটিশ সরকারের হাতে তুলে দিয়েই রেডক্লিফ কোন পারিশ্রমিক না নিয়েই বিমানে ভারত ত্যাগ করেন। ব্রিটিশ সরকার অবশ্য রেডক্লিফের এই অবদানের জন্য পরবর্তীকালে তাকে "নাইট" উপাধিতে ভূষিত করেছিলো। নাইট উপাধি দেওয়ার জন্যই রেডক্লিফকে "স্যার" নামে অভিহিত করা হয়। 

রেডক্লিফ লাইন যে ক্রুটিপূর্ন দেশভাগ করে তা কোন রকম আপত্তি ছাড়াই কংগ্রেস ও লিগ মেনে নেয়। আসলে ক্ষমতার লোভে তারা এতটাই ক্ষুধার্ত নেকরে হয়ে উঠেছিলো যে, ছোটো খাটো ভুল ক্রুটিকে মেনে নেওয়া ছাড়া তাদের সামনে দ্বিতীয় কোন বিকল্প ছিলো না। ক্রুটিপূর্ন দেশভাগের ফলে চট্টগ্রামের মতো হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চল যেমন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়, তেমনই মুর্শিদাবাদের মতো মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। 

ক্রুটিপূর্ন দেশভাগ এক বিরাট সংখ্যক মানুষের জীবনকে যে অনিশ্চিত আশঙ্কার মধ্যে ফেলেছিলো, উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টির সেটি একটি বড়ো কারন ছিলো। 

(খ.) ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের সংখ্যা ও পরিমান :- 

দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক হিংসার বলি হয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রায় এক কোটি হিন্দু ও শিখ শরনার্থী ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে প্রবেশ করেছিলো। এখানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুদের ভারতে প্রবেশের ক্ষেত্রে একটি বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। 

দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানে হিংসার প্রকোপ ও নৃশংসতা ছিলো সবথেকে বেশি। তাই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দেশভাগের পরই এক ধাক্কায় সব উদ্বাস্তুরা ভারতে চলে এসেছিলেন। 

কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এরকম ঘটে নি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ খ্রিঃ পর্যন্ত অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) স্বাধীনতা লাভের আগে পর্যন্ত সেখানে দফায় দফায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে এবং ভারতে হিন্দুদের প্রবেশ ঘটতে থাকে। 

১৯৫১ সালের জনগননা অনুযায়ী প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে এসেছিলো। এদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৫০ লক্ষ। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৩৫ লক্ষ১৯৭১ সালের আগে পর্যন্ত আরোও কয়েক লক্ষ উদ্বাস্তু দলে দলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিলো। 

তবে স্বাধীনতার পরের দিন গুলিতে উদ্বাস্তুদের স্রোত ভারত সরকারের ওপর প্রভূত চাপ সৃষ্টি করে। এই সময় দৈনিক প্রায় ২০,০০০ করে উদ্বাস্তু ভারতে প্রবেশ করতে থাকে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ধনবানরা অবশ্য দেশভাগের আগেই পাকিস্তান ত্যাগ করে এদেশে এসেগিয়েছিলেন। 

তবে উদ্বাস্তুদের সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশই এসেছিলেন ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ ই আগস্টের পর। এই সময় সাধারন, দরিদ্র কৃষিজীবী, শ্রমজীবী এবং নিন্ম মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষেরা পাকিস্তানি মুসলমানদের মার খেয়ে, সর্বস্ব হারিয়ে, ভিটেমাটি ত্যাগ করে একবস্ত্রে প্রান বাঁচানোর তাগিদে এদেশে এসে হাজির হয়। এদের কেউ এসেছিলেন ট্রেনে করে, কেউ গরুর গাড়ি করে, তবে বেশির ভাগই এসেছিলেন পায়ে হেঁটে। ভারতে আসার পথেও অনেকে সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হন। অনেকে কঠিন পথশ্রম সহ্য করতে না পেরে পথেই মৃত্যু বরন করেন। 

ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের ভাষ্য অনুযায়ী, দেশভাগের ফলে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ মারা যানদেড় কোটি মানুষ গৃহচ্যুত হন এবং এক লক্ষ নারী অপহরন হন। বলা বাহুল্য এটি শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানের পরিসংখ্যান ছিলো। বাস্তবে এই বিপর্যয়ের সংখ্যাটি ছিলো অনেক বেশি। 

(গ.) উদ্বাস্তুদের আগমনে ভারতে সমস্যা :- 

উদ্বাস্তুদের আগমনের ফলে ভারতে বেশ কিছু সমস্যা দেখা যায়। যেমন - 

(১.) জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্য সংকট :- 

উদ্বাস্তুদের আগমনের ফলে ভারতে জনসংখ্যা একধাক্কায় অনেকটাই বেড়ে যায়। মাথায় রাখতে হবে, জনসংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়া এক ব্যাপার। আর একধাক্কায় হঠাৎ করে বৃদ্ধি পাওয়া আরেক ব্যাপার। হঠাৎ ও দ্রুত জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে একদিকে যেমন বাসস্থানের সমস্যা দেখা যায়, তেমনি খাদ্যেরও সংকট দেখা যায়। খাদ্য সংকট থেকে ১৯৫৯ খ্রিঃ খাদ্য আন্দোলনের জন্ম হয়েছিলো। 

(২.) পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি :- 

ভারতে জলের স্রোতের মতো দৈনিক উদ্বাস্তুদের আগমনের ফলে নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। ভারত বারংবার দাঙ্গা প্রতিরোধে পাকিস্তানকে অনুরোধ করলেও, পাক প্রশাসন ভারতের কথায় কোন কর্নপাত করে নি। বিরক্ত হয়ে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল তাই ভারতীয় আইনসভায় চাঁচাছোলা ভাষায় বলেন, পাকিস্তান এভাবে লক্ষ লক্ষ শরনার্থী ভারতে পাঠাতে থাকলে ভারতেরও উচিত তাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ভূখন্ড দাবি করা। 

(৩.) সামাজিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা বৃদ্ধি :- 

লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের আগমনের ফলে ভারতে সামাজিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা দেখা যায়। উদ্বাস্তুদের অনেকেই ফাঁকা জমি বা ভাঙ্গা অব্যবহৃত বাড়ি দেখলেই রাতের অন্ধকারে তা দখল করে নিতো। এই নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের বিরোধ বাঁধতো। লোকাল লোকেরা বহিরাগত উদ্বাস্তুদের সব সময়ই বক্র দৃষ্টিতে দেখতো। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত রেল প্ল্যাটফর্ম গুলি দখল করে নিয়েছিলো। তারা থাকতো খোলা আকাশের নীচে। আকাশের নীচে উন্মুক্ত, অস্বাস্থ্যকর স্থানেই তারা খেতো, পায়খানা করতো, সঙ্গম করতো, সন্তান জন্ম দিতো। 

(৪.) অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি :- 

লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের আগমনের ফলে তাদের খাবারের ব্যবস্থা, অস্থায়ী তাবু ও বাড়িঘর তৈরি, তাদের নতুন করে পুনর্বাসন দেওয়া ইত্যাদি খাতে ভারতকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। ফলে উদ্বাস্তু সমস্যা স্বাধীন ভারতের ওপর মারাত্মক অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। 

(৫.) সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিমান বৃদ্ধি :- 

এছাড়া, উদ্বাস্তুদের উস্কানিতে ভারতে একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটতে থাকে। মাথায় রাখতে হবে, উদ্বাস্তুরা পাকিস্তানি মুসলমানদের মার খেয়ে এদেশে এসেছিলো। জীবনের সবকিছু ছেড়ে একেবারে নিঃশ্ব হয়েই তারা এদেশে এসেছিলো। আহত বেদনাময় জীবন ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তারা বহন করে এনেছিলো মুসলমানদের প্রতি একরাশ ক্ষোভ আর ক্রোধ। ভারতে আসবার পর মুসলমানদের প্রতি প্রতিশোধ নিয়ে তারা নিজেদের রাগের ঝালটা মিটিয়ে নিতে চেয়েছিলো। পাক - মুসলমানদের নৃশংসতা এবং প্রিয়জন ও জন্মস্থানকে হারানোর বেদনা তাদের মনের সব সুকুমার প্রবৃত্তি গুলিকে নষ্ট করে দিয়েছিলো। উদ্বাস্তুদের আগমনের ফলে ভারতে তাই এখানে সেখানে দাঙ্গা ঘটতেই থাকে। এর মধ্যে দিল্লির দাঙ্গা ভয়াবহ আকার ধারন করেছিলো। একদিকে উদ্বাস্তুদের আশ্রয়দান, অন্যদিকে দাঙ্গায় উদ্বাস্তুদের উস্কানি বন্ধ করা ভারত সরকারের কাছে কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। 

(৬.) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা বৃদ্ধি :- 

উদ্বাস্তুদের আগমনের ফলে ভারতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানা অস্থিরতা দেখা যায়। উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ও ভারত - পাক নীতি নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে কংগ্রেস সরকারের বিরোধ দেখা যায়। উদ্বাস্তুরাও সরকারের প্রতি ক্ষোভ জানায়। উদ্বাস্তুদের একরাশ ক্ষোভ আর চিৎকারকে অতিক্রম করেই নেহেরুকে প্রত্যেকদিন তার দপ্তরে প্রবেশ করতে হতো। উদ্বাস্তুরা প্রায়ই চিৎকার করে বলতো, পন্ডিত নেহেরু কতকগুলো ধান্দাবাজ আর দুর্নীতিগ্রস্থ লোককে নিয়ে সরকার চালাচ্ছেন। তাদের ক্ষোভকে মাঝে মধ্যেই উস্কে দিতো ভারতের সাম্প্রদায়িক দলগুলো। বিশেষত, সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি কংগ্রেস সরকারের একচোখা নীতিতে তারা রাগে ফুঁসতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ও তাদের সমস্যার সমাধানের জন্য গলা উঁচিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে কমিউনিস্টরা নিজেদের জনভিত্তিকে আরোও শক্তিশালী করে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। 

(৭.) মহাত্মা গান্ধীর হত্যা :- 

উদ্বাস্তু সমস্যা ভারতে যে জটিলতা তৈরি করে তার শিকার হন মহাত্মা গান্ধী। এই সময়ের সাম্প্রদায়িক হিংসা তাঁরও জীবনাবসান ঘটায়। আগেই বলেছি, দাঙ্গা প্রতিরোধে মহাত্মা গান্ধী এবং নেহেরু সরকার সংখ্যালঘু দরদি নীতি নিয়েছিলো। এর লক্ষ্য ছিলো সংখ্যা লঘুদের বৃহওম সম্প্রদায় হিন্দুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা, তাদের আস্থা অর্জন করা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এক্ষেত্রে অদূর পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের প্রতি কি নীতি নেওয়া হচ্ছে তা তারা ধর্তব্যের মধ্যে কখনোই আনেন নি। 

দিল্লি মুসলিম প্রধান এলাকা হলেও, দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বহু সংখ্যক শিখ ও হিন্দু শরনার্থী দিল্লিতে এসে ভিড় জমান। এর ফলে দিল্লিতে জনবিন্যাসের বদল ঘটে। এতদিনকার সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুতে পরিনত হয়। দিল্লিতে উদ্বাস্তুদের আগমনে হিন্দুদের সংখ্যা বাড়লে দাঙ্গা বাড়ে। সেই দাঙ্গা ভয়াবহ আকার ধারন করলে গান্ধীজি দাঙ্গা থামাতে আমরন অনশন শুরু করেন। 

এই সময় গান্ধীজি মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বেশ কিছু শর্ত দেন এবং বলেন এই শর্তগুলি পালন করলে তবেই তিনি আমরন অনশন থেকে সরে আসবেন। এই শর্তগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল - দিল্লিতে মুসলমানদের জীবনের নিরাপত্তা প্রদান, দিল্লির ১০০ টা মসজিদ থেকে হিন্দু উদ্বাস্তু শরনার্থীদের সরিয়ে মসজিদ গুলির পবিত্রতা ফেরানো। কারন প্রচলিত মুসলিম নিয়ম অনুযায়ী মুসলিম ধর্মস্থানে কোন অমুসলিমরা প্রবেশ করতে পারে না। মুসলমানরা যাতে অবাধে দিল্লিতে ঘুরে বেড়াতে পারে তার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি সরকার, হিন্দু সহ সব ধর্মের লোকেদের দিতে হবে। 

হিন্দুরা গান্ধীকে ভালোবাসতেন। তাঁর আমরন অনশন তাই তাদেরও ব্যথিত করলো। সব ধর্মের লোকেরা গান্ধীর কাছে গিয়ে দাঙ্গা থামানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর গান্ধী অনশন প্রত্যাহার করেন। 

গান্ধী অনশনে দিল্লির দাঙ্গা প্রশমিত হলেও, দাঙ্গা প্রতিরোধে গান্ধীজির একচোখা ও একরেখা নীতিকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল গুলো কখনই সু নজরে দেখলো না। তাঁদের অভিযোগ ছিলো গান্ধী ভারতে মুসলিমদের পক্ষ নিচ্ছেন, কিন্তু পাকিস্তানে বা ভারতে হিন্দু সংখ্যালঘু অঞ্চলে যখন হিন্দুরা মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন তখন হিন্দুদের পাশেও দাড়াচ্ছেন না, পক্ষও অবলম্বন করছেন না। গান্ধী এর সাফাই দিয়ে বলেছিলেন, হিন্দুরা যেহেতু বড়ো ভাই, তাই তাদের ছোট ভাইদের প্রতি উদারতা দেখিয়ে একটু সহ্য করে নেওয়া উচিতনোয়াখালী দাঙ্গার ক্ষেত্রে এইরকম ভাষ্যই অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে তিনি বলেছিলেন। 

১৯৪৭ খ্রিঃ ভারত বিভাগের ফলে ব্রিটিশ ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কে থাকা ৩৭৫ কোটি টাকা আনুপাতিক হারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। পাকিস্তানের প্রাপ্য ছিলো ৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ কোটি টাকা আগেই দেওয়া হয়েছিলো। বাকি ৫৫ কোটি টাকা পাকিস্তান দাবি করলে ভারত তা দিতে অস্বীকার করে। এই সময় পাকিস্তান কাশ্মীর আক্রমণ করেছিলো। তাই সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল পাকিস্তানের প্রাপ্য টাকাটি সেদেশ থেকে আগত ও বিতাড়িত শরনার্থীদের কল্যাণে ব্যায় করার কথা ঘোষনা করেন। 

প্যাটেলের এই বক্তব্য শুনে গান্ধীজি এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং পাকিস্তানের প্রাপ্য মিটিয়ে দেওয়ার জন্য অনশন শুরু করেন। এমনকি গান্ধী এটিও বলেন, নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে মুসলমানদের সম্মতি নিয়েই হিন্দুদের বসবাস করতে হবে। বলা বাহুল্য, গান্ধীজির মুসলিম পক্ষপাতদুষ্ট এই নীতিকে হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক দলের মতো হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল গুলো কখনই মেনে নিতে পারে নি। তাদের দৃষ্টিতে গান্ধী বারেবারেই অন্যায়কারী মুসলমানদেরই পক্ষ অবলম্বন করছিলেন 

আমাদের মনে রাখতে হবে, দ্বিধাবিভক্ত শিবির ও সাম্প্রদায়িক পরিবেশে কেউই নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। ভারত, পাকিস্তান, জিন্না, নেহেরু বা সেসময়ের মানুষরাও কেউই নিরপেক্ষ ছিলেন না। থাকা সম্ভবও ছিলো না। গান্ধীজির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। আত্মত্যাগ, আত্ম - আঘাত, আত্মসংযম এবং আত্ম বিসর্জন গান্ধী নীতির সার কথা ছিলো। তাই গান্ধীজি তার সময়ে মুসলিমদের কোন দোষ দেখতে পান নি বা চান নি। তার নিজের নীতির দ্বারাই তিনি ভারতে দাঙ্গা থামাতে ও সাম্প্রদায়িক বিরোধকে নির্মূল করতে চেয়েছিলেন। তার দীক্ষিত শিষ্যরাও তাই করতে চেয়েছিলেন। 

গান্ধীজি ও তার মত পথকে বোঝা বা অনুসরন করা অত্যন্ত কঠিন ছিলো। নাথুরাম গডসেও বুঝতে পারেন নি। গান্ধীজির আচরনকে খোলা মনে তার মুসলিম তোষন বলেই মনে হয়েছিলো। শেষপর্যন্ত ১৯৪৮ খ্রিঃ ৩০ শে জুন নাথুরাম গডসের গুলিতেই মরতে হয় গান্ধীকে। মৃত্যুর আগে মুসলিম তোষনে অভিযুক্ত গান্ধীর শেষ দুটি শব্দ ছিলো - "হে রাম...।" 

(ঘ.) উদ্বাস্তু আগমনের প্রকৃতি ও ধরন : পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান 

১৯৪৭ সালে পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশের মধ্য দিয়ে ভারত ভাগ করা হয়। ফলে ভৌগোলিক দিক থেকে পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকেই দু টুকরো ছিলো। বিশাল ভারত ভূখন্ডকে মাঝে রেখে এর পূর্বে দিকে ছিলো পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম দিকে ছিলো পশ্চিম পাকিস্তান। 

দেশভাগের পর এই পাকিস্তানি দুই ভূখন্ড থেকে উদ্বাস্তুদের আগমনের চরিত্র ও ধরন এক ছিলো না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হিন্দু ও শিখরা একবারেই এদেশে চলে আসেন। ভাষার নৈকট্য থাকায় অর্থাৎ স্বাচ্ছন্দ্যে হিন্দি বলতে পারার কারনে তারা উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্য গুলিতে ছড়িয়ে পড়েন। 

কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের চিত্রটি ভিন্ন ছিলো। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান ভাষা ছিলো বাংলা। এখানকার লোকেরা বাঙালি সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলো, যা হিন্দু - মুসলিম সমন্বয়ের ধারায় বিশ্বাসী ছিলো। সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমরা কিছুটা হলেও উদার ও সহনশীল ছিলেন। তাছাড়া দীর্ঘদিন হিন্দু - মুসলিম একসঙ্গে থাকার অভ্যাস ও ঐতিহ্য সেখানকার ছিলো। এর ফলে দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানে যে বিভৎস নারকীয় নৃশংসতা দেখা গিয়েছিলো পূর্ব পাকিস্তানে হিংসা ততখানি নারকীয় ছিলো না।

তবে দেশভাগের পর বিভিন্ন মৌলবি, মোল্লা ও উলেমাদের উস্কানিতে সেখানে দাঙ্গা চলতে থাকে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দফায় দফায় বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু নিধন ও দাঙ্গা চলে। ফলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একধাক্কায় সব উদ্বাস্তুরা চলে এলেও, পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুদের আগমনের স্রোত বন্ধ হয় নি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের আগে পর্যন্ত ভারতে উদ্বাস্তুদের আগমন দফায় দফায় ঘটতেই থাকে। 

পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুরা যেহুতু বাংলাভাষী ছিলেন, তাই ভাষাগত কারনে তারা ভারতের অন্য কোথাও চলে যেতে রাজি ছিলেন না। ভাষা, খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতিগত কারনে তারা পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরাতে ভিড় বাড়ান। ফলে ভারতের দুই প্রান্তে উদ্বাস্তুদের আগমনের ধরন, চরিত্র ও সমাধানের উপায় এক ছিলো নাপশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান যতটা সহজ সরল ভাবে করা গিয়েছিলো, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে সেটা কখনই করা সম্ভব হয় নি। 

(ঙ.) ভারতে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন : - 

স্বাধীনতা লাভের প্রথম ৫ বছর নেহেরু সরকার ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে। তাই ভারতের স্বাধীনতা লাভের প্রথম ৫ বছরকে (১৯৪৭ - ১৯৫২) ঐতিহাসিকরা "পুনর্বাসনের যুগ" নামে অভিহিত করেন। 

ভারতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে পৃথক নীতি নেওয়া হয়। নেহেরু সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে যতটা যত্নশীল ও কর্মতৎপর ছিলো, পূর্ব পাকিস্তানের থেকে আগত উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে ততটা ছিলো না।

(অ.) পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন :- 


পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত শিখ ও হিন্দু শরনার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য ভারত সরকার নিন্মলিখিত ব্যবস্থা গুলি গ্রহন করেছিলো। 

(১.) উদ্বাস্তু শিবিরের আয়োজন :- 

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের আশ্রয়দানের জন্য ভারতে প্রায় ২০০ টি উদ্বাস্তু শিবির খোলা হয়। অস্থায়ী ভাবে তাবু তৈরি করে বিরাট বিরাট ছাউনি করে তাদের অস্থায়ী ভাবে থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। সবথেকে বড়ো উদ্বাস্তু শিবির বানানো হয় দিল্লির নিকটবর্তী কুরুক্ষেত্রের ময়দানে। মহাভারতের কৌরব ও পান্ডবদের ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গায় রক্তাক্ত হয়েছিলো যে ভূমি, সেই ভূমিটিই আরেক যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ লোকেদের সাময়িক আবাস হয়ে উঠলো। 

প্রাথমিক ভাবে মনে করা হয়েছিলো, কুরুক্ষেত্র শিবিরে এক লক্ষ শরনার্থীদের আশ্রয় দেওয়া যাবে। কিন্তু দৈনিক গড়ে প্রায় ২০,০০০ করে উদ্বাস্তু ভারতে প্রবেশ করায় কুরুক্ষেত্র উদ্বাস্তুদের সংখ্যাটা প্রায় তিন গুনে পৌঁছে যায়। জনৈক আমেরিকান রিপোর্টারের মতে, সেনাবাহিনী একটা বিরাট মাপের তাবু খাটানো শেষ হতে না হতে, কয়েক হাজার নতুন উদ্বাস্তু এসে পড়তে থাকে। যত দিন যেতে থাকে উদ্বাস্তুদের আগমন বাড়তেই থাকে। 

কুরুক্ষেত্র ছাড়াও বোম্বাই শহরে পাঁচটি বড়ো উদ্বাস্তু শিবির খোলা হয়। অন্যান্য শিবির গুলো পূর্ব পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতের অন্যান্য রাজ্যে খোলা হয়েছিলো। 

(২.) উদ্বাস্তুদের খাবার ও বিনোদনের ব্যবস্থা :- 

উদ্বাস্তু শিবির গুলিতে শরনার্থীদের থাকা, খাওয়া, বিনোদন সব কিছুরই ব্যবস্থা করা হয়। শুধু কুরুক্ষেত্রের ত্রান শিবিরেই দৈনিক প্রায় একশো টন আটা, ময়দা আর সেই সঙ্গে পরিমাণ মতো নুন, তেল, ডাল, চাল লাগতো। এর সমস্তটাই ভারত সরকার বিনামূল্যে দিতো। ভারতকে সাহায্য করতো দেশ বিদেশের নানা এন জি ও এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এইসব এনজিও ও সমাজকর্মীদের নিয়ে "সংযুক্ত ত্রান ও কল্যান পরিষদ" (ইউনাইটেড ফর রিলিফ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার) নামে একটি সমন্বয় সংস্থা গঠন করা হয়েছিলো। 

উদ্বাস্তুরা পাকিস্তানে ভিটেমাটি, জমিজায়গা, প্রিয়জন সকলকে হারিয়ে এসেছিলেন। ভারতে এসে সর্বস্ব হারানোর বেদনা আর জাতিগত ঘৃনা তাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসে প্রচন্ড ঠান্ডায় অস্থায়ী শিবিরে থাকা যে কত কঠিন সেটি ভারত সরকার বুঝতে পারলো। তাই শীতের দীর্ঘ রাতকে পার করা এবং উদ্বাস্তুদের বেদনাহত মনে একটু আনন্দের জাগানোর জন্য বিদেশী এন জিও দের সাহায্যে উদ্বাস্তু শিবিরে বড়ো বড়ো প্রজেক্টার লাগানো হয়। সেখানে মিকি মাউস আর ডোনাল্ড ডাক প্রমুখ ডিজনি প্রযোজনার কার্টুন লাগিয়ে উদ্বাস্তুদের সাময়িক আনন্দদানের ব্যবস্থা করা হয়। 

যারা পাকিস্তানি মুসলমানদের কাছ থেকে বেদম মার খেয়ে এসেছে, যারা গৃহ হারিয়েছে, যে মা তার কন্যা সন্তানকে গনধর্ষনে মরে যেতে দেখেছিলো, তাদের সেই ভয়াবহ স্মৃতিকে কিছুক্ষনের জন্য হলেও ভুলিয়ে দিতে পেরেছিলো মিকি মাউসরা। 

(৩.) উদ্বাস্তুদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে সরকারি উদ্যোগ ও সাহায্য :- 

ভারত সরকার বুঝতে পারলো কয়েক লক্ষ উদ্বাস্তুকে চিরদিনই অস্থায়ী শিবিরে রাখা যাবে না। ভারত সরকারের পক্ষে সেটা সম্ভবও ছিলো না। তাই সরকারি উদ্যোগে উদ্বাস্তুদের কৃষিজমি দান, কৃষিঋন প্রদান, স্থায়ী বাসস্থানের জন্য বিভিন্ন উপনগরী নির্মান, বাড়ি নির্মানে ঋন বা ভর্তুকি প্রদান এবং কুটির শিল্প ও ছোট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খোলায় নানারকম সাহায্য করা হয়। 

উদ্বাস্তুদের স্বাভাবিক কর্মচঞ্চল জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য নেহেরু সরকার তার সকল অফিসারদের নিয়োগ করেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তারলোক সিংহলন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের এই স্মাতক তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে সুন্দর ভাবে কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠ ভাবে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কাজটি সম্পন্ন করেন। এক্ষেত্রে যে কাজ গুলি করা হয় তা হলো -

(i.) কৃষকদের মধ্যে জমি বন্টন :- 

ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের সিংহভাগই ছিলেন হতদরিদ্র কৃষক। ভারতে এসে কিছুদিন উদ্বাস্তু শিবিরে কাটানোর পর পাগলের মতো তারা একখন্ড জমি চাইছিলো। সে জমি উর্বর হোক, অনুর্বর হোক, যেমনই হোক, কঠিন মাটির বুকে কোপ মেরে তারা তাকে শস্যশ্যমলা করে তোলার কথা বলেছিলো। ভারত সরকারও বুঝেছিলো, একখন্ড বা একফালি জমি পেলেই সর্বহারা লোকগুলো নতুন স্বপ্ন নিয়ে আবার তাদের জীবন শুরু করতে পারবে। 

কয়েক লক্ষ উদ্বাস্তুদের জমি বন্টনের এই কঠিন কাজটির দায়িত্ব দেওয়া হয় তারলোক সিংহকে, যিনি একজন দক্ষ আই. সি এস ছিলেন। তারলোক সিংহ তার দক্ষ সহযোগী অফিসারদের নিয়ে জমি বন্টনের কাজটি শুরু করেন। প্রায় ৭,০০০ দক্ষ সরকারি কর্মচারী নিয়ে জমি বন্টনের কাজটি সম্পন্ন করা হয়। 

পাকিস্তানের অধিনে থাকা পশ্চিম পাঞ্জাবে হিন্দু ও শিখরা ২৭০ হেক্টর জমি ফেলে ভারতে চলে এসেছিলো। অন্যদিকে ভারতের মধ্যে থাকা পূর্ব পাঞ্জাব থেকে মুসলমানরা মাত্র ১৯০ হেক্টর জমি ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলো। ফলে পাঞ্জাবের দুই পাড়ের জমির মধ্যে বিরাট অসামঞ্জস্য ছিলো। দেশভাগ পাঞ্জাবের মধ্য দিয়েই হয়েছিলো। ফলে মুসলমানদের ছেড়ে যাওয়া জমি গুলো হিন্দু ও শিখ কৃষকদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করা হয়। 

জমি বন্টনের ক্ষেত্রে - 

(১.) প্রতিটি কৃষক পরিবারকে চার একর করে অস্থায়ী জমির জোত দেওয়া হয়। 
(২.) বীজ, সার ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার জন্য কৃষকদের অগ্রীম কৃষিঋন দেওয়া হয়। 
(৩.) অস্থায়ী জোত বিলির পর স্থায়ী জোতের জন্য প্রত্যেক কৃষককে আবেদন করে জানাতে বলা হলো, কে কতটা জমি পাকিস্তানে ফেলে এসেছে। 
(৪.) প্রতিবেশিদের বা একই গ্রামের লোকেদের কাছে সাক্ষ্য গ্রহন করে জমির পরিমানের সত্যতা যাচাই করা হয়। 
(৫.) যারা অসত্য তথ্য পেশ করেন, তাদের জেলে পাঠিয়ে অথবা স্থায়ী জোতের জমির পরিমান কমিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়। 

পুরো কর্মকান্ডটি পরিচালনা করার জন্য পাঞ্জাবের জলন্ধরে একটি "পুনর্বাসন সচিবালয়" খোলা হয়। সেখানে স্থায়ী জোতের জন্য একমাসের মধ্যে দশ লক্ষ আবেদন জমা পড়ে। ১৯৪৯ খ্রিঃ নভেম্বর মাসের মধ্যে তারলোক সিংহ ও তার সহযোগীরা প্রায় আড়াই লক্ষ জোতের জমি বিলি করেন। 

পূর্ব পাঞ্জাবের বিভিন্ন জেলায় সমভাবে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়। পরে যেসব উদ্বাস্তুরা ভারতে প্রবেশ করেছিলো, তাদের প্রতিবেশীদের কাছেই পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিলো। 

(ii.) বিভিন্ন উপনগরী স্থাপন :- 

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কৃষকরা ছাড়াও এসেছিলো কারিগর, ব্যাপারী, শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেনী। এদের পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য ভারত সরকার প্রায় ১৯ টি উপনগরী গড়ে তোলে। সাধারনত বড়ো নগরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেই এই উপনগরী গুলো গড়ে তোলা হয়। মূল নগরী থেকে প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করে যাতে নিজেদের কাজটা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, সেই দিকটিকে খেয়াল রেখেই শ্রমিক, ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্তদের জন্য এই ব্যবস্থাটা করা হয়। 

এই সময়ের উল্লেখযোগ্য উপনগরী গুলির মধ্যে একটি ছিলো ফরিদাবাদ। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রায় ৩০ মাইল পশ্চিমে এটি অবস্থিত ছিলো। পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে যারা এসেছিলো তাদের এখানে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিলো। সরকার এখানে ৬০:৪০ আর্থিক সাহায্যের অনুপাতে বাড়ি তৈরি করে দেয়। 

নানা আত্মসহায়ক দল এই সব উপনগরী গুলিতে উদ্বাস্তুদের দোকানপাট ও ছোট শিল্প কারখানা খুলতে সাহায্য করে। 

(iii.) উত্তর ও পশ্চিম ভারতের নানা শহর গুলিতে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা :- 

বিভিন্ন উপনগরী গূলি ছাড়াও,পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের একটি বড়ো অংশ উত্তর ও পশ্চিম ভারতের নানা শহর গুলিতেও আশ্রয় নিয়েছিলো। এর ফলে বিভিন্ন শহরের জনবিন্যাস ও চরিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। যেমন - 

(A.) দিল্লি :-  (১.) দেশভাগের পর প্রায় ৫ লক্ষ উদ্বাস্তু দিল্লিতে আসে। (২.) তারা দিল্লিতে এসে ভিড় জমান স্কুল, কলেজ, ধর্মশালা, সামরিক ছাউনি, রেলের প্লাটফর্ম এবং ফুটপাতে। (৩.) বিপুল পরিমান উদ্বাস্তু আসার ফলে দিল্লি নগরীর চরিত্র বদলে গেলো। দেশভাগের আগে দিল্লিতে উর্দুভাষী মুসলমানরা সংখ্যা গরিষ্ঠ ছিলো। দেশভাগের পর তাদের সিংহভাগ পাকিস্তানে চলে যায় এবং সেখান থেকে পাঞ্জাবি ভাষী হিন্দু ও শিখরা এসে দিল্লিতে ভিড় জমায়। (৪.) দিল্লির পশ্চিম ও দক্ষিণে উদ্বাস্তুদের জমি দিয়ে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। 

(B.) বোম্বাই :- (১.) দিল্লির মতোই প্রায় ৫ লক্ষ উদ্বাস্তু বোম্বাই শহরে আসে। (২.) বোম্বাই শহরে এজন্য ৫ টি উদ্বাস্তু শিবির খোলা হয়। (৩.) বোম্বাই শহরের উদ্বাস্তুরা এসেছিলেন মূলত পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশ থেকে। (৪.) বিপুল পরিমানে উদ্বাস্তু আগমনের ফলে বোম্বাই শহরের চেহারা বদলে গেলো। এখানে থাকার জায়গার বড়োই অভাব ছিলো। ফলে বস্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেলো। 

(C.) অন্যান্য শহর :- দিল্লি, বোম্বাই ছাড়াও উদ্বাস্তুদের একটি বড়ো অংশ পশ্চিম ভারতের নানা শহর গুলিতে আশ্রয় নিয়েছিলো। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো পুনে, আমেদাবাদ ইত্যাদি শহর। 

(৪.) স্থানীয় নাগরিকদের সঙ্গে বিবাদ - বিসম্বাদ :- 

ভারত সরকার তার সাধ্য মতো উদ্বাস্তুদের সাহায্য সহযোগিতা করলেও, অনেকের মতে তা যথেষ্ট ছিলো না। আমেদাবাদের এক উদ্বাস্তু একজন সাংবাদিককে বলেন, "এখানে যা খাচ্ছি পাকিস্তানে থাকাকালীন এগুলো আমরা পাখিকে ছুঁড়ে খেতে দিতাম"। অনেক উদ্বাস্তু শিবিরেই পর্যাপ্ত জল, রেশন, বিদ্যুৎ এবং ডাক্তার ছিলো না। অনেক অব্যবস্থাও ছিলো। পুনর্বাসন নিয়েও নানা অভিযোগ, অনুযোগ ছিলো। এই নিয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে নানা ঝগড়া, ঝামেলা লেগেই থাকতো। 

উদ্বাস্তুদের অনেকেই এজন্য ভারত সরকারের বিরুদ্ধে রাগে ফুঁসতে থাকে। তারা বলে,"আমাদের এই সরকার অপদার্থ। কতকগুলো চোর এসে একজায়গায় জুটেছে। একমাত্র পন্ডিত নেহেরু ভালো লোক। বাকিরা অকর্মন্য আর ধান্দাবাজ। পন্ডিত যা বলেন, তা করেন। যন্ত্রের বাকি অংশ গুলো একেবারে অকেজো" (রামচন্দ্র গুহ - গান্ধী উত্তর ভারতবর্ষ)। 

শহরাঞ্চলের লোকাল লোকেরা উদ্বাস্তুদের একেবারেই দেখতে পারতো না। তাদের দৃষ্টিতে ওরা ছিলো "উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো"। জমি জায়গা বা ভাঙ্গা বাড়ি দখল করে নেওয়া নিয়ে প্রায়ই লোকাল লোকেদের সাথে উদ্বাস্তুদের ঝামেলা হতো। অনেক উদ্বাস্তু শহরে ভাড়া বাড়ি নিয়ে উঠতে চাইতো না। এই নিয়ে থানা, পুলিশ, ঝুট ঝামেলা লেগেই থাকতো। 

এইভাবেই কয়েক দশক পার করার পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত নিরন্ন, অসহায় মানুষগুলো ধীরে ধীরে দেশভাগের ক্ষতকে সারিয়ে তুলেছিলো। ছোটো বড়ো শহর গুলিতে ছড়িয়ে পড়ে তারা একদিকে যেমন ভারতের সঙ্গে মিশে যেতে পেরেছিল, তেমনই নানা শহরে কাজ কর্ম ও ব্যবসা করে অর্থনৈতিক ক্ষতটাও মেরামতি করে নিতে পেরেছিলো

(আ.) পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন :- 


দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানের মতো পূর্ব পাকিস্তান থেকেও দলে দলে হিন্দুরা এসে ভীড় জমায় সীমান্তবর্তী রাজ্য গুলিতে। যার মধ্যে অন্যতম ছিলো - পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম। তবে এই তিনটি রাজ্যের মধ্যে উদ্বাস্তু সমস্যা সবথেকে বেশি প্রভাব ফেলেছিলো পশ্চিমবঙ্গে। 

(ক.) পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের আগমন :- 

দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। প্রফুল্ল ঘোষের মুখ্যমন্ত্রীত্বের প্রথমদিকে উদ্বাস্তু সমস্যা খুব একটা বড়ো আকার ধারন করে নি। কিন্তু পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে এই সমস্যা তীব্র আকার ধারন করে। 

১৯৪৬ খ্রিঃ পূর্ব পাকিস্তানে নোয়াখালী দাঙ্গার সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের আগমন ঘটতে শুরু করে। ১৯৪৭ খ্রিঃ দেশভাগ এবং ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পূর্ববঙ্গে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা শুরু হলে ব্যাপক পরিমাণে উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করতে থাকে। 

প্রফুল্ল চক্রবর্তীর "প্রান্তিক মানব" গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালের ১৫ ই অক্টোবর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পাসপোর্ট ও ভিসা চালু হয়ে যায়। এর আগে পর্যন্ত প্রায় ৩৫ লক্ষ উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলো। এর পরেও অন্তত আরোও কয়েক লক্ষ উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে আসে। ১৯৫১ সালে জনগননার তথ্য থেকে এই পরিসংখ্যান জানা যায়। 

(খ.) পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু শিবির :- 

১৯৫০ সাল থেকে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের আগমন বন্যার মতো রূপ নেয়। এইসময় জলপথে, রেলপথে, গরুরগাড়ী করে, পায়ে হেঁটে যে যেভাবে পেরেছিলো, সেইভাবেই দলে দলে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছিলো। পশ্চিমবঙ্গে আসা উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ তাদের আত্মীয় স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলো। যাদের সে সুযোগ ছিলো না, সেই সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ আশ্রয় নেয় রেল স্টেশন গুলিতে এবং বড়ো বড়ো ফাঁকা মাঠে বা রাস্তার দু পাশে। 

১৯৪৮ খ্রিঃ এক বিশাল সংখ্যক উদ্বাস্তু শিয়ালদহ স্টেশন ছেড়ে স্থানীয় সামরিক ব্যারাক, মহীশূর ভবন, স্থানীয় ফাঁকা, পরিত্যাক্ত ও ভাঙ্গা বাড়ি গুলি দখল করে নেয়। ফাঁকা বাড়ি দেখলেই তারা রাতের অন্ধকারে সেগুলি দখলে নিয়ে নিতো। অনেকসময় ফাঁকা জায়গার দখল নিয়ে রাতের মধ্যেই বাঁশ ও মাটি দিয়ে নিজেদের একখানা বাড়িও তারা বানিয়ে ফেলতো। এই নিয়ে জমির মালিকের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলে, তারা কিছুতেই জমি ছাড়তে চাইতো না। তবে এর ব্যতিক্রমও ছিলো। অনেকেই জমির মালিককে নেয্য টাকা দিয়ে জমি কিনে নিতেন। 

পূর্ববঙ্গ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুরা শিয়ালদহ, শাপুর, কলকাতা, দুর্গাপুর, বালিগঞ্জ সার্কুলার, ধর্মতলার সামরিক ব্যারাক, ধুবুলিয়া, বাঁশবেড়িয়া, রানাঘাট, বনগাঁ, বারাসাত প্রভৃতি অঞ্চলে ভিড় জমায়। এদের সাহায্যের জন্য কাশী বিশ্বনাথ সমিতি, রামকৃষ্ণ মিশন, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্তমঠ, ভারত সেবাশ্রম সংঘের পাশাপাশি অনেক গুলি উদ্বাস্তু কল্যাণ সমিতি গড়ে উঠেছিলো। সরকারের আর্থিক সহায়তায় এই উদ্বাস্তু কল্যাণ সমিতি গুলি উদ্বাস্তুদের মধ্যে খাদ্য বিতরন করতো। ইন্ডিয়ান রেডক্রসের মতো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান শিশু ও অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য দুধ সরবরাহ করতো। 

(গ.) পূর্ববঙ্গীয়দের পুনর্বাসনের নানা ক্ষেত্রে সমস্যা :- 

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের মতো খুব সহজেই পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব হয় নি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা ও সমস্যা ছিলো। এর থেকেও বড়ো ছিলো সরকারি উদাসীনতা। যেমন - 

(১.) জনবিনিময় না হওয়া ও জায়গার অভাব :- 

ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ যেমন পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষেত্রে তেমন ঘটে নি। ফলে এখানে ফাঁকা খেত খামার ও থাকার জায়গার অভাব ছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানে দাঙ্গার প্রকোপ অনেক বেশি ছিলো বলে, দেশভাগের সময়ে সেখানে এমনিই জনবিনময় হয়ে গিয়েছিলো, যেটা পশ্চিমবঙ্গে ঘটে নি। তাছাড়া উর্বর নদীকেন্দ্রীক অঞ্চল হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গে এমনিতেই জনঘনত্ব ছিলো বেশি। ফলে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য এখানে ফাঁকা জায়গা ও পরিত্যক্ত ভূমির যথেষ্টই অভাব ছিলো। 

(২.) সরকারি উদাসীনতা :- 

তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার উদ্বাস্তু সমস্যার গভীরতাকে অনুধাবন করতে পারেন নি। বলা বাহুল্য, তৎকালীন রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার - এদের কেউই এটা উপলব্ধি করতে পারে নি বা চায় নি। বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশী মুসলিমদের পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে অনেক বেশি উদার ও কম সাম্প্রদায়িক বলে মনে করতেন। বাঙালি মুসলমানরা বাঙালি ভাষা ও সংস্কৃতির দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত ছিলেন। হিন্দু ও মুসলিম বাঙালির পোশাক, ভাষা, খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে বিশেষ তেমন পার্থক্য বা সাম্প্রদায়িকতা ছিলো না। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি ছিলো। এইসব কারনে হিন্দু - মুসলিম বিরোধ ও দাঙ্গাকে পশ্চিম পাকিস্তানের মতো এত গুরুত্ব দিয়ে কোন সরকারই উপলব্ধি করে নি বা করতে চায় নি। কেন্দ্র, রাজ্য উভয় সরকারই মনে করতো দাঙ্গা থামলে পূর্ববঙ্গীয়রা পুনরায় তাদের দেশে ফিরে যাবেন। 

(৩.) ভাষাগত সমস্যা :- 

ভাষাগত সাদৃশ্যের কারনে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের উত্তর ও পশ্চিম ভারতের নানা শহর গুলিতে পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব হলেও, ঐ একই কারণে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী উদ্বাস্তুদের অন্য কোথাও পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব হয় নি। বাংলা ভাষার কারনে বাঙালি উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা বা আসামের বাইরে যেতে প্রস্তুত ছিলো না। এক্ষেত্রে তাদের সবথেকে পছন্দের জায়গা ছিলো পশ্চিমবঙ্গ

(৪.) পুনর্বাসিত স্থান থেকে উদ্বাস্তুদের ফিরে আসা :- 

পশ্চিমবঙ্গে আগত উদ্বাস্তুদের একাংশকে পুনর্বাসনের জন্য ঊড়িষ্যার দন্ডকারন্য ও আন্দামানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলির সঙ্গে তৎকালীন সরকারের তীব্র মতপার্থক্য ও বাদানুবাদ দেখা যায়। ঊড়িষ্যার দন্ডকারন্য ছিলো জল বিহীন,লোকবিহীন, অনুর্বর শিলাখন্ডে জর্জরিত অঞ্চল। তাই উদ্বাস্তুরা সেখানে থাকতে চায় নি। কমিউনিস্ট পার্টি একসময় উদ্বাস্তুদের দন্ডকারন্য থেকে পুনরায় পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীর ক্ষমতায় এলে ১৯৭৮ খ্রিঃ প্রায় দেড় লক্ষ উদ্বাস্তু ঊড়িষ্যার দন্ডকারন্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মরিচঝাঁপিতে আশ্রয় নেয়। 

(৫.) পুলিশ - উদ্বাস্তু সংঘাত : মরিচঝাপি :- 

মরিচঝাঁপি ছিলো সংরক্ষিত বনাঞ্চল। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন কমিউনিস্ট সরকার বলপূর্বক ভাবে মরিচঝাঁপি থেকে উদ্বাস্তুদের পুনরায় দন্ডকারন্যে পাঠাবার চেষ্টা করলে পুলিশ ও উদ্বাস্তুদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে বেশ কয়েকজন আহত ও নিহত হন। শেষপর্যন্ত উদ্বাস্তুদের একটা অংশকে বলপূর্বক দন্ডকারন্যে পাঠানো সম্ভব হলেও, উদ্বাস্তুদের সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ শিয়ালদহ, বারাসাতের মধ্যবর্তী অঞ্চল এবং দক্ষিণ কলকাতায় আশ্রয় নেয়। 

(ঘ.) উদ্বাস্তুদের জবরদখল কলোনি স্থাপন :- 

দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুরা প্রথম দিকে বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকলেও, পরে তারা বিভিন্ন জেলায়, শহরে ও কলকাতা মহানগরীর বিভিন্ন প্রান্তে জমি জবরদখল করে কলোনি গড়ে তোলে। সাধারনত এলাকার জলা জমি, পতিত জমি, রেললাইনের ফাঁকা জমিতে তারা বসতি গড়ে তুলেছিলো। 

কলকাতায় জবরদখল করে গড়ে ওঠা উদ্বাস্তু কলোনি গুলি ছিলো - টালীগঞ্জ, যাদবপুর, কসবা, দমদম, সন্তোষপুর, সোদপুর প্রভৃতি স্থান। শুধু কলকাতাতেই উদ্বাস্তুদের ১৩৩ টি কলোনী গড়ে উঠেছিলো। এইভাবে পশ্চিমবঙ্গে আগত উদ্বাস্তুদের জবরদখলে পশ্চিমবঙ্গে ৫৯ হাজার একর জমি চলে যায়। 

(গ.) পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের নিয়ে অবজ্ঞা ও রাজনৈতিক আন্দোলন :- 

পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের সাহায্য ও পুনর্বাসন চেয়ে বারংবার ডঃ বিধানচন্দ্র রায় জওহরলাল নেহেরুকে চিঠি লিখলেও, নেহেরু সরকার পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের প্রতি বিরক্তি ও অবজ্ঞা দেখান। ডঃ বিধানচন্দ্র রায়কে এক চিঠিতে নেহেরু জানান, হিন্দুদের পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে আসাটা অন্যায়। তাদের পুনর্বাসন দিলেও এই সমস্যার কোন সমাধান হবে না। 

একাধিক ভাষনে নেহেরু পূর্ববঙ্গীয়দের বলেন, "এদেশে এসো না। এলে বিপর্যয় হবে এবং আমার কিছু করার থাকবে না। জোর করে এলে এদেশের মানুষ উদ্বাস্তুদের বিদেশী অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করবে। তাই পূর্ববঙ্গে আরোও বহু হিন্দুর সঙ্গে থেকে যাওয়াই ভালো হবে।" 

পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের অধিকার ও কল্যাণের জন্য সবচেয়ে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিলো বামপন্থী দল গুলো। সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় তারা উদ্বাস্তুদের সংগঠিত করে গন আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা করে। উদ্বাস্তুদের ক্ষতিপূরন, নাগরিকতা প্রদান, পুনর্বাসন ইত্যাদি ইস্যু গুলো নিয়ে তারা আন্দোলন চালিয়ে যান। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত হয় - "সারা বাংলা উদ্বাস্তু আন্দোলন পরিষদ"

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি উদ্বাস্তুদের মধ্যে বামপন্থীরা ছাড়াও হিন্দু মহাসভা ও আর এস এস এর মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গুলি প্রভাব বিস্তার করে। এরা উদ্বাস্তুদের তাতিয়ে তোলার জন্য শ্লোগান দেয় - "ভারতের স্বাধীনতা যজ্ঞে বাঙালি হিন্দুদেরই বলির পাঠা করা হয়েছে।" যে সরকার এই উদ্বাস্তুদের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে বলে, তারা তোষনপন্থার দোষে দোষী, তারা গনহত্যাকে মদত দিচ্ছে। 

সুতরাং বাংলায় উদ্বাস্তুদের নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গুলির আন্দোলন ও আওয়াজ ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিলো। কমিউনিস্টরা উদ্বাস্তুদের নিয়ে আন্দোলন করে তাদের শক্ত জনভিত্তি তৈরি করে। 

(ঘ.) উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে বাংলা থেকে চাপ :- 

বাংলায় উদ্বাস্তুদের নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সোচ্চার হলে তা নেহেরু সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে। মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় বারবার সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হয়ে একসময় ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন - এই চরম দুর্ভোগের শেষ করতে হলে এখন চাই একটা যুদ্ধ। উদ্বাস্তুদের দাবি, পুনর্বাসন ও অধিকার নিয়ে সোচ্চার হন ড. মেঘনাদ সাহা, আচার্য যদুনাথ সরকার, ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার এবং ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট জনেরা। 

"উদ্বাস্তুদের দরদি বন্ধু" বলে খ্যাত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলার নানা উদ্বাস্তু শিবির ঘুরে উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের জন্য নেহেরু সরকারের ওপর চাপ দেন। বাংলার উদ্বাস্তুদের স্বপক্ষে আইনসভায় তীব্র ঝড় তোলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও শ্রী ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী (১৯৫০ খ্রিঃ ২২ ফেব্রুয়ারি)। এরা দুজনেই নেহেরু মন্ত্রীসভার দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। 

বাংলার উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের জন্য ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নেহেরুকে প্রস্তাব দেন, হয় পূর্ব পাকিস্তান বাতিল করতে হবে, নয়তো পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যা লঘু হিন্দুদের জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে তার কিছু জমি ছেড়ে দিতে হবে। সুষ্ঠ উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের জন্য শ্যামাপ্রসাদ দুই পাড়ের মধ্যে "মানুষ ও সম্পত্তি বিনিময়ের" প্রস্তাব দিলে নেহেরু উচ্চ রাজনৈতিক আদর্শের দোহাই দিয়ে এর প্রতিবাদ জানান। এই সময় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নেহেরুকে স্মরন করিয়ে দেন, "পাঞ্জাবের বেলায় নেহেরুর এই উচ্চ রাজনৈতিক আদর্শ কোথায় ছিলো?"

বলা বাহুল্য, দেশভাগের পর তীব্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পাঞ্জাবে যখন জন বিনিময় হয়, তখন নেহেরু তার কোন প্রতিবাদ করেন নি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা শিখ ও হিন্দু শরনার্থীদের কখনই তিনি পাকিস্তানে ফিরে যাবার কথা বলেন নি। কিন্তু বাংলার বেলায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি উদ্বাস্তুদের দেশ ছেড়ে আসাটা অন্যায় বলছেন। তাদের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে বলছেন। এ কেমন দ্বিচারিতা? একের পর এক প্রশ্নবানে বিদ্ধ নেহেরু শেষপর্যন্ত উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি খানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন এবং এই সমস্যার সমাধানের জন্য একটা কাগুজে বন্দোবস্ত করে ফেলেন। এরই পরিনতি ছিলো নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তি

(ঙ.) উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের চেষ্টা : নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি :- 

প্রবল চাপের মুখে উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের জন্য জওহরলাল নেহেরু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে ১৯৫০ খ্রিঃ ১৭ ই এপ্রিল "নেহেরু - লিয়াকৎ চুক্তি" স্বাক্ষর করেন। দিল্লিতে বসে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো বলে একে "দিল্লি চুক্তিও" বলা হয়।

এই চুক্তিতে উদ্বাস্তুরা তাদের সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি সঙ্গে নিয়ে যাবার অধিকার লাভ করে এবং স্থাবর ও অন্যান্য সম্পত্তি বিক্রি করে তা থেকে প্রাপ্ত অর্থও সঙ্গে করে নিয়ে যাবার অধিকার লাভ করে। তাছাড়া, এই চুক্তি অনুযায়ী দেশত্যাগী উদ্বাস্তুরা বিনা বাধায় তাদের পুরাতন দেশে ফিরে আসারও অধিকার লাভ করে। এছাড়া এই চুক্তিতে আরোও বলা হয় - 
  1. সংখ্যালঘুরা যে যার রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে এবং তার কাছেই প্রতিকার চাইবে। 
  2. পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে কেউ অন্য দেশে শরনার্থী হতে চাইলে তাকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করা হবে। 
  3. ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই উদ্বাস্তু সমস্যার কারন ও উদ্বাস্তুদের সংখ্যা নির্ধারনের জন্য অনুসন্ধান কমিটি ও সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করবে। 
  4. পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রীসভায় সংখ্যা লঘু প্রতিনিধি থাকবে। 

(চ.) বিতর্ক, হতাশা ও অধরা সমাধান :- 

নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তি পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু সমস্যার কোন সমাধান করতে পারে নি। এই চুক্তি অনেককেই হতাশ করে। হিন্দুত্ববাদী দল ও সংগঠন গুলি এই চুক্তির তীব্র সমালোচনা করে। 

নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তির পর হিন্দু উদ্বাস্তুদের পাকিস্তান থেকে চলে আসবার প্রবনতা একচুলও কমে নি বরং বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছিলো। নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তির পর ১৯৬০ - ৬১ খ্রিঃ প্রায় ১০ লক্ষ উদ্বাস্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে বাধ্য হন। এই চুক্তির ফল কার্যক্ষেত্রে উল্টো হয়। 

এই চুক্তির সুযোগ নিয়ে যেসব মুসলিম পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলো, তারা আবার এদেশে ফিরে আসে। তাদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের বহু মুসলমানও চলে এসেছিলো। নেহেরু - লিয়াকৎ চুক্তি অনুযায়ী এইসব মুসলিমদের ফেলে আসা স্থাবর - অস্থাবর সম্পত্তি ফেরাবার দায়িত্ব নেন স্বয়ং নেহেরু। কারন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের ওপর তার আস্থা ছিলো না। 

কিন্তু বিতর্কের শুরু তখনই হয়, যখন হিন্দু উদ্বাস্তুদের পূর্ববঙ্গে ফেলে আসা স্থাবর - অস্থাবর সম্পত্তি ফেরানোর প্রস্তাবটি নেহেরু নাকচ করেন এবং স্বতঃপ্রনোদিত হয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহন না করেন। শুরু থেকেই ভারতে শান্তি ফেরানোর জন্য নেহেরু সরকার মুসলিম তোষন নীতি নিয়ে চলেছিলো১৯৪৭ খ্রিঃ থেকে কাশ্মীর সমস্যা নেহেরু সরকারের ওপর রক্তচাপ বাড়িয়েছিলো। হরি সিংকে ভারত ভুক্তি দলিলে সই করানোর পর বেশ কিছু শর্ত স্বাপেক্ষে শেখ আবদুল্লাকে রাজি করানো হয়েছিলো। এমতাবস্থায় ভারতের নেহেরু সরকার যে মুসলমানদের প্রতি অত্যন্ত দরদি তা বোঝানোর জন্য নেহেরু উঠে পড়ে লাগেন। মুসলিম উদ্বাস্তুদের প্রতি যাতে কোন অন্যায় না হয়, সে বিষয়ে নেহেরুর সজাগ থাকার প্রধান কারন ছিলো তাঁর কাশ্মীর নীতি। 

যাইহোক, নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তি পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু সমস্যার কোন স্থায়ী সমাধান করতে পারে নি। এই চুক্তির হাত ধরে দেশত্যাগী বহু মুসলমান ফিরে এসে সমস্যা আরোও বৃদ্ধি পায়। আসলে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু স্রোত বন্ধ করবার জন্য আরোও কঠোর চুক্তির প্রয়োজন ছিলো। দূরদর্শী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাই এই চুক্তির তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন, পাকিস্তান এই চুক্তির শর্তাদি পালন করবে না। বাস্তবে করেও নি তা। 

১৯৫০ খ্রিঃ আগস্ট মাসে ভারতীয় পার্লামেন্টে এই মর্মে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয় যে, এই চুক্তির শর্ত একতরফা ভাবে ভারত অনুসরন করছে। শেষপর্যন্ত এই চুক্তিতে হতাশ হয়ে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ক্ষিতিশচন্দ্র নিয়োগী নেহেরু মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর শ্যামাপ্রসাদ "জনসংঘ" নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে লোকসভায় নেহেরুর তীব্র সমালোচনা করতে থাকেন। 

 মূল্যায়ন :- 

নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তি পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের স্রোতকে বন্ধ করতে পারে নি। পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু হিন্দুদেরও এই চুক্তি কোন উপকার সাধন করতে পারে নি। এর পরিনামে দেশভাগের সবচেয়ে কুফল একা ভোগ করে পশ্চিমবঙ্গ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গে এসেই ভিড় বাড়ায়। এর ফলে বর্ধিত জনসংখ্যা সহ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সবদিক থেকেই স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হয়। 

বস্তুত পক্ষে উদ্বাস্তু সমস্যার আংশিক সাফল্য এসেছিলো। দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিমরা পশ্চিম পাকিস্তানে একবারেই চলে এসেছিলো। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হিন্দু ও শিখরাও একবারেই চলে আসেন। ফলে দাঙ্গা পাঞ্জাবে এমনিতেই জন বিনিময় ঘটিয়ে দিয়েছিলো। 

পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমানদের ছেড়ে যাওয়া জমি গুলো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত শিখ ও হিন্দুদের মধ্যে খুব সহজেই বন্টন করা সম্ভব হয়েছিলো। তাছাড়া, ভাষার নৈকট্য থাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের খুব সহজেই পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, দিল্লি, গুজরাত,হিমাচল প্রদেশ প্রভৃতি রাজ্য গুলিতে পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব হয়েছিলো। নেহেরু সরকারও অত্যন্ত তৎপরতা ও দক্ষতার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দিকটি সম্পন্ন করেছিলো

 কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের চিত্রটি অবশ্য ভিন্ন ছিলো। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাঙালি উদ্বাস্তুরা পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যা লঘুদের মতো একবারেই চলে আসে নি। তারা বারে বারে হওয়া দাঙ্গার সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখে দফায় দফায় ভারতে আসছিলেন। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের মতো পূর্ব পাকিস্তানে কোন জনবিনিময় ঘটে নি। পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ থেকে আগত বাংলাভাষী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই, আর কিছু পরিমানে আসাম ও ত্রিপুরায় করা সম্ভব ছিলো, অন্যত্র নয়। ঊড়িষ্যার দন্ডকারন্য বা আন্দামানে বহু সংখ্যক উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য পাঠানো হলেও, তারা সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। 

এসবের ফলে পশ্চিমবঙ্গে সব দিক থেকেই মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়। এখানে পতিত জমির অভাব ছিলো। জনবিনিময় না হওয়ায়, এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলমানদের দেশত্যাগ না ঘটায় আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব হয় নি। মাত্র যে কয়জন মুসলমান পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলেন, নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তির পর তারাও ফিরে এসেছিলেন। এমনকি তাদের সঙ্গে পূর্বপাকিস্তানের বহু মুলমানও পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। একসময় তাদের ফেলা যাওয়া সম্পত্তি গুলো ফেরানোর দায়িত্ব নেহেরু নিজের হাতে নিয়ে মুসলমানদের কাছে ফেরিস্তা হয়ে উঠতে চান। এসবের কারনে তীব্র বঞ্চনার শিকার হন পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু উদ্বাস্তুরা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের একটা বড়ো অংশ বিভিন্ন জেলায় জমি জবরদখল করে বসবাস করতে থাকেন। 

উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে নেহেরু সরকার বৈষম্যমূলক আচরন করেছিলো। যেমন - 

(১.) পশ্চিম পাকিস্তানের সব উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব হলেও, বাংলার ক্ষেত্রে সবাইকে পুনর্বাসন দেওয়া যায় নি। 

(২.) নেহেরু সরকার অত্যন্ত দরদি ভাবে ও তৎপরতার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কাজ করলেও, পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য টাকা দিতে কার্পণ্য বোধ করেন। এমনকি তাদের পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করাটিকে অন্যায় কাজ বলে অভিহিত করেন। 
(৩.) পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য পাকা বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হলেও, বাংলার ক্ষেত্রে যে সামান্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তা দিয়ে তাদের জন্য অত্যন্ত নিন্মমানের উপকরন খড়, টিন, টালি ও মাটি দিয়ে ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়
 
(৪.) পশ্চিম পাকিস্তানের সব উদ্বাস্তুরা পুনর্বাসন ও জমি লাভ করলেও, বাংলার উদ্বাস্তুরা তা পায় নি। 

পরিনামে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত অগনিত বাঙালি উদ্বাস্তুদের এদেশে দীর্ঘ বঞ্চনা ও অব্যবস্থার শিকার হতে হয়। 

একঝলকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :- 

  1. ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হয়েছিলো - রেডক্লিফ লাইন অনুসারে।
  2. নিজের বাসভূমি ত্যাগ করে প্রান বাঁচাতে নিরাপত্তার খোঁজে ভিনদেশে চলে আসা ছিন্নমূল বাস্তুহারা মানুষেরাই ইতিহাসে "উদ্বাস্তু" বা "Refugee" নামে পরিচিত
  3. ভারত বিভক্ত হবার পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বলি হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পাকিস্তান থেকে আগত লক্ষ লক্ষ হিন্দু ও শিখ শরনার্থীদেরকেই উদ্বাস্তু বলা হয়। 
  4. স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম ও প্রধান গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিলো - উদ্বাস্তু সমস্যা।
  5. স্বাধীনতার প্রথম ৫ বছর ভারত সরকার উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান ও উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করেছিলো বলে, এই সময়কালকে "পুনর্বাসনের যুগ" বলা হয়।
  6. ভারত ভাগ হয়েছিলো - বাংলা ও পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে। তাই উদ্বাস্তু সমস্যা সবথেকে বেশি তীব্র আকার ধারন করেছিলো পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাবে। 
  7. স্বাধীন ভারতের প্রথম উদ্বাস্তু কমিশনার ছিলেন - হিরন্ময় বন্দোপাধ্যায়। 
  8. পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন - প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ।
  9. পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু সমস্যা তীব্র আকার ধারন করেছিলো। 
  10. ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভিসা ও পাসপোর্ট চালু হয় - ১৯৫২ খ্রিঃ। 
  11. পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি উদ্বাস্তু শিবির হলো - ধুবুলিয়া, বাঁশবেড়িয়া, রানাঘাট, বনগাঁ, বারাসাত।
  12. পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু ত্রান ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন - ড. বিধানচন্দ্র রায়। 
  13. কেন্দ্রীয় উদ্বাস্তু ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন - শ্রী মেহেরচাঁদ খান্না। 
  14. বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন - কৈলাশনাথ কাটজু। 
  15. পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের - ঊড়িষ্যার দন্ডকারন্য ও আন্দামানে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিলো। 
  16. ঊড়িষ্যার দন্ডকারন্য থেকে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুরা সংরক্ষিত বনাঞ্চল মরিচঝাঁপিতে চলে এসেছিলো। 
  17. সারা ভারত উদ্বাস্তু আন্দোলন পরিষদ গঠিত হয় - ১৯৪৮ খ্রিঃ। 
  18. নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় - ১৯৫০ খ্রিঃ ১৭ ই এপ্রিল।
  19. নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো - ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলির মধ্যে। 
  20. নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তির প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন - ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ক্ষিতিশচন্দ্র নিয়োগী। 
  21. পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব হলেও, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের একটি বড়ো অংশকে পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব হয় নি। 
  22. ১৯৪৮ খ্রিঃ ৩০ শে জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেন - নাথুরাম গডসে। 
  23. পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ আলি জিন্নার মৃত্যু হয় - ১৯৪৮ খ্রিঃ। 
  24. পূর্ব পাঞ্জাবে উদ্বাস্তুদের মধ্যে জমি বন্টনের কাজ করেন - তারলোক সিংহ। 
  25. উদ্বাস্তুদের দরদি বন্ধু নামে পরিচিত ছিলেন - ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। 
  26. উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের জন্য "মানুষ ও সম্পত্তি বিনিময় নীতির" প্রস্তাব দিয়েছিলেন - ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। 
  27. জনসংঘ নামে নতুন রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন - ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। 
  28. জনসংঘই পরবর্তীকালে ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP) তে পরিনত হয়। 
  29. দেশভাগের পরবর্তী সময়কালকে ঐতিহাসিক সর্বপল্লি গোপাল" বিষন্ন প্রভাত" বা Sad Morning বলে অভিহিত করেছিলেন।
  30. খাদ্য সংকট থেকে খাদ্য আন্দোলনের জন্ম হয় - ১৯৫৯ খ্রিঃ। 

মডেল প্রশ্নপত্র :- 

  1. উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে ভারত সরকার কি কি উদ্যোগ গ্রহণ করে? অথবা, ১৯৪৭ পরবর্তী উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান কীভাবে করা হয়েছিলো? 
  2. সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো - দেশভাগ জনিত উদ্বাস্তু সমস্যা। 
  3. পাঞ্জাব এবং বাংলার উদ্বাস্তু সমস্যার তারতম্য ও সমাধানের পথ কী ছিলো? 
  4. বাংলার উদ্বাস্তু সমস্যা কেন জটিল ছিলো? এক্ষেত্রে উদ্বাস্তুদের প্রতিক্রিয়া কি ছিলো? 
  5. স্বাধীনতা উত্তর পর্বে কীভাবে উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিলো? ভারত সরকার কিভাবে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সমস্যার সমাধান করেছিলো? অথবা স্বাধীনতার পর উদ্বাস্তু সমস্যা ও তার সমাধানের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো। 

গ্রন্থঋন :- 

(১.) গাঁধী - উত্তর ভারতবর্ষ - রামচন্দ্র গুহ।
(২.) ভারত ইতিহাস পরিক্রমা - প্রভাতাংশু মাইতি ও অসিত কুমার মন্ডল। 
(৩.) আধুনিক ভারতের ইতিহাস - ড. রতন কুমার বিশ্বাস। 
(৪.) ভারতের ইতিহাস (আধুনিক যুগ ১৭০৭ - ১৯৬৪) - তেসলিম চৌধুরী। 
(৫.) আধুনিক ভারত (পলাশি থেকে নেহরু) - সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়। 
(৬.) আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৭০৭ - ১৯৬৪) - সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। 
(৭.) আধুনিক ভারতের রূপান্তর - সমর কুমার মল্লিক। 
(৮.) ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দশক - দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়। 
(৯.) ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান, প্রস্তুতি ও পরিনতি - সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। 
(১০.) জওহরলাল নেহেরু, স্বাধীনতার আগে এবং পরে - শ্যামাপ্রসাদ বসু। 
(১১.) ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট - ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক লাপিয়ের। 
(১২.) ভারতের ইতিহাস ও পরিবেশচর্চা (দশম শ্রেণি) - শচীন্দ্রনাথ মন্ডল।
(১৩.) মাধ্যমিক ইতিহাস ও পরিবেশ - ড. কল্যাণ চৌধুরি ও আজিজুল বিশ্বাস। 
(১৪.) দেশ বিভাগ এবং বাংলায় উদ্বাস্তু সমস্যা - মিঠুন দাস।
(১৫.) স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনোত্তর ভারত - সুভাষচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। 
(১৬.) ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম - সম্পাদনা রাখালচন্দ্র নাথ। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post