জুনাগড় রাজ্যের ভারত ভুক্তি

১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্টের মধ্যে যেসব দেশীয় রাজ্য ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করেনি তার মধ্যে অন্যতম ছিলো জুনাগড় রাজ্য

জুনাগড় রাজ্যের ভারতভুক্তি
জুনাগড় রাজ্যের ভারতভুক্তি 


(১.) ভৌগোলিক অবস্থান ও রাজ্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় :-

জুনাগড় রাজ্যটি পশ্চিম ভারতের কাথিয়াবাড় অঞ্চলে অবস্থিত ছিলো। এখানকার নবাব ছিলেন মুসলমান, কিন্তু রাজ্যের ৮২ % জনগনই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীজুনাগড়ের প্রধান বন্দর ভেরাভল থেকে পাকিস্তানের করাচি বন্দর প্রায় ৩২৫  নৌ - মাইল দূরে অবস্থিত ছিলো। হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থান সোমনাথ মন্দির জুনাগড় রাজ্যেই অবস্থিত ছিলো। এছাড়া জৈনদের বহু মনোরম মন্দিরও এখানে ছিলো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই মুসলমান শাসিত হলেও, সাংস্কৃতিক দিক থেকে বৃহত্তর ভারতের সঙ্গে জুনাগড়ের কোন পার্থক্য ছিলো না। 

১৯৪৭ খ্রিঃ জুনাগড়ের নবাব ছিলেন মহাবৎ খান। শাসক অপেক্ষা পশুপ্রেমী হিসাবেই তার সুখ্যাতি ছিলো সবচেয়ে বেশি। নবাবের সংগ্রহে ছিলো দুই হাজার সদ্বংশজাত কুকুর। এর মধ্যে বেশ কিছু কুকুরকে নবাবের প্রাসাদ পাহারা দেওয়ার জন্য মোতায়েন করা হয়েছিলো। নবাবের প্রিয় কুকুর ও কুক্কুরীর মধ্যে যেদিন মিলন হতো, সেদিন সরকারি ছুটি দিয়ে দেওয়া হতো। কুকুরের বিবাহ উপলক্ষে সেই সময় নবাব প্রায় তিন লক্ষ টাকা খরচ করতেন।

জুনাগড়ের জঙ্গলে এশিয় প্রজাতির সিংহদের সযত্নে রক্ষা করার ক্ষেত্রেও মহাবৎ খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি জীবনে কোনদিনই অন্যান্য দেশীয় রাজাদের মতো শিকার করেন নি, এমনকি উচ্চমার্গের কোন ব্রিটিশ অফিসারকেও জুনাগড়ের জঙ্গলে প্রবেশ করতে দেন নি। 

দেশীয় রাজ্য গুলিতে শাসন সংক্রান্ত সব দিক গুলি তাদের দেওয়ানরাই পরিচালনা করতেন। জুনাগড়ও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। রাজারা শাসন সংক্রান্ত বিষয়কে "মেঠো ও তুচ্ছ" মনে করে তার দায়িত্ব দেওয়ানদের হাতে দিয়ে নিশ্চিতে শখ আহ্লাদে মেতে থাকতেন। 

জুনাগড় রাজ্যের অবস্থান
জুনাগড় রাজ্যের অবস্থান 


(২.) পাকিস্তানে যোগদানের সিদ্ধান্ত :-

১৯৪৭ সালে গরমের ছুটিতে জুনাগড়ের নবাব ইওরোপে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতির কালেই বর্তমান দেওয়ানের বদলে দেওয়ান হন স্যার শাহনওয়াজ ভুট্টো। ভুট্টো ছিলেন একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং মহম্মদ আলি জিন্নার খুব কাছের লোক।

নবাব ইওরোপ ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার পর শাহনওয়াজ ভুট্টো নবাবকে ভারতীয় সংঘে যোগ দিতে নিষেধ করেন। তিনি নবাবকে বোঝান, নবাব যেহেতু একজন মুসলিম, তাই তার পক্ষে পাকিস্তানে যোগ দেওয়াই ঠিক হবে। তাছাড়া, বিশাল হিন্দু প্রজা নিয়ে পাকিস্তানে যোগ দিলে নবাব বিশেষ সুবিধাও পাবেন।

দেওয়ানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মহাবৎ খান পাকিস্তানে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৪ ই আগস্ট যেদিন ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করে, সেই দিনই মহাবৎ খান নিজের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য পাকিস্তানে যোগদানের ঘোষনা করেন।

(৩.) জিন্না ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া :-

জিন্না কোনদিন স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি জুনাগড়ের মতো একটি হিন্দু রাজ্য পাকিস্তানে যোগ দিতে পারে। কারন পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিলো টু নেশন থিওরির ওপর ভিত্তি করে, যেখানে বলা হয়েছিলো হিন্দু ও মুসলমান দুটি  বিবাদমান আলাদা জাতি এবং তারা কখনই একসঙ্গে থাকতে পারে না। সুতরাং জুনাগড়ের পাকিস্তানে যোগদানের সিদ্ধান্ত ছিলো জিন্নার টু নেশন থিওরির গালে একটা জোর চপটাঘাত।

জুনাগড়ের পাকিস্তানে যোগদানের ঘোষনায় তাই বেশ কয়েক সপ্তাহ জিন্না কোন উচ্চবাচ্য করেন নি। পরে ১৯৪৭ খ্রিঃ ১০ ই সেপ্টেম্বর, জিন্না জুনাগড়ের পাকিস্তানে যোগদানের প্রস্তাবকে স্বাগত জানান এবং নবাবকে তার সিদ্ধান্তের জন্য অভিনন্দিত করেন। আসলে জুনাগড়কে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করানোর পিছনে জিন্নার এক গোপন অভিসন্ধি ছিলো, সেটি হলো জুনাগড়কে তুরুপের তাস করে কাশ্মীর আদায় করা। জুনাগড়ের মতো একটি হিন্দু রাজ্য পাকিস্তানে যোগ দিলে খুব সহজেই কাশ্মীরের হিন্দু রাজাকে পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত করানোর জন্য রাজি করানো যাবে।

(৪.) কংগ্রেস ও ভারতের প্রতিক্রিয়া :-

জুনাগড়ের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্তকে কংগ্রেস কোন ভাবেই মেনে নিতে রাজি ছিলো না। জুনাগড় গুজরাতে অবস্থিত ছিলো। কংগ্রেসের প্রথম শ্রেণীর দুই নেতা মহাত্মা গান্ধী এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের জন্মভূমিও ছিলো গুজরাত। খুব স্বাভাবিক ভাবেই জুনাগড়ের প্রতি ভারতের এবং কংগ্রেসের নেতাদের একটা আলাদা আবেগের জায়গা ছিলো। প্যাটেল সরাসরি জুনাগড়ের পাকিস্তানে যোগদানের বিরোধিতা করেন।

১৯৪৭ খ্রিঃ ১৮ ই জুলাই ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী, অবশ্য জুনাগড়ের পাকিস্তানে যোগদানের ক্ষেত্রে কোন আইনি বাধা ছিলো না। কিন্তু প্যাটেল সব দেশীয় রাজাদেরই দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, দেশীয় রাজ্যের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত কোন রাজা একা নির্ধারন করতে পারেন না। তা নির্ধারনের ক্ষমতা ঐ রাজ্যের জনগনেরও আছে। 

তাছাড়া, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় দিক থেকে জুনাগড়ের সঙ্গে ভারতের কোন পার্থক্যই নেই। হিন্দুদের অন্যতম তীর্থস্থান সোমনাথ মন্দির জুনাগড় রাজ্যেই অবস্থিত ছিলো। সুতরাং কংগ্রেস ও ভারত সরকার উভয়েরই মত ছিলো জুনাগড় ভারতে অন্তর্ভুক্ত হোক। 

(৫.) জুনাগড়ের জনগনের প্রতিক্রিয়া ও গন আন্দোলন :- 

জুনাগড়ের নবাবের পাকিস্তানে যোগদানের সিদ্ধান্তকে সেই রাজ্যের জনগন মেনে নিতে পারেন নি। এর বিরুদ্ধে তারা রাজ্যের সর্বত্র তীব্র গন আন্দোলন শুরু করে। মহাত্মা গান্ধীর ভাইপো সামালদাস গান্ধীর নেতৃত্বে বোম্বাইতে প্রতিষ্ঠিত হয় "জুনাগড় সাময়িক সরকার"। 

জুনাগড়ে গন আন্দোলন শুরু হলে তাকে সুকৌশলে কংগ্রেস ব্যবহার করে কংগ্রেস জুনাগড়কে ভারতে অন্তর্ভূক্ত করার পরিকল্পনা তৈরি করে।  

(৬.) ভারতের হস্তক্ষেপ ও দখল :- 

জুনাগড়ে গন আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারন করলে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল জুনাগড়ের আশ্রিত দুই হিন্দু রাজার রাজ্য "মাংগ্রোল" ও "বাবড়িওয়াড়" কে ভারতভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করান। 

এই সময় জুনাগড়ের নবাব আশ্রিত রাজ্যের ভারত ভুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে জানায়, ঐ দুটি আশ্রিত রাজ্য যেহেতু জুনাগড়ের নবাবের আশ্রিত, তাই নবাবের অনুমতি ব্যতিত তারা কখনই ভারতে যোগদান করতে পারে না। জুনাগড়ের নবাব মাংগ্রোল ও বাবড়িওয়াড়ের ভারত ভুক্তির বিরোধিতা করলে ভারত ঐ দুটি রাজ্যের সহায়তায় একটি সেনাদল পাঠিয়ে দেয়। এর ফলে আশ্রিত রাজ্যকে কেন্দ্র করে জুনাগড়ের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা যায়। 

১৯৪৭ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসে জুনাগড় সমস্যার সমাধানের জন্য ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সচিব ভি পি মেনন জুনাগড়ের নবাবের সঙ্গে দেখা করতে এলে, নবাব অসুস্থতার ছুতো দেখিয়ে বৈঠক এড়িয়ে যান। এমতাবস্থায় মেনন জুনাগড়ের দেওয়ান স্যার শাহনওয়াজ ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বলেন ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে জুনাগড়ের উচিত ভারতে যোগদান করা। ভুট্টো এর বিপরীতে বলেন, বিষয়টির নিস্পত্তি গনভোটের মাধ্যমেই হওয়া উচিত। 

(৭.) নবাবের পলায়ন :- 

ইতিমধ্যে জুনাগড়ে গন আন্দোলন ভয়াবহ ও হিংসাত্মক হয়ে উঠলে জুনাগড়ের নবাব ভয় পেয়ে করাচিতে পলায়ন করেন। পাকিস্তানে পালিয়ে যাবার সময় তিনি সঙ্গে নেন তাঁর অতি প্রিয় এক ডজন কুকুরকে। বাদবাকি প্রায় দু হাজার কুকুর এবং কোলের সদ্যজাত সন্তান দুটিকেই ছেড়ে যান দেওয়ানের জিম্মায়। 

নবাবের পলায়নের প্রায় দশ দিন পর জুনাগড়ের দেওয়ান শাহনওয়াজ ভুট্টো ভারত সরকারকে চিঠি লিখে জানান জুনাগড়ের প্রশাসনের ভার তিনি ভারত সরকারের হাতে তুলে দিতে রাজি আছেন। এর ফলে ১৯৪৭ খ্রিঃ ৯ ই নভেম্বর, আনুষ্ঠানিকভাবে জুনাগড়ের ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। 

(৮.) গনভোট ও ভারতভুক্তি :- 

জুনাগড়ের ভারত ভুক্তির বিষয়ে মাউন্টব্যাটনের কোন পরামর্শ নেওয়া হয়নি। তাই তার মান ভাঙ্গানোর জন্য এবং জনমতকে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়ার জন্য ১৯৪৮ খ্রিঃ ২০ ফেব্রুয়ারি, ভারত সরকার এক গনভোটের আয়োজন করে। এই গনভোটে ৯৯ % জনতা জুনাগড়ের ভারত ভুক্তির স্বপক্ষে মত প্রকাশ করে ও ভোট দেয়। 

এই গনভোটের ফলে ১৯৪৯ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে জুনাগড় ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীকালে স্বাধীন গুজরাট রাজ্যের সঙ্গে জুনাগড়কে মিশিয়ে দেওয়া হয়। 


একঝলকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-

  1. জুনাগড় রাজ্য অবস্থিত ছিলো - বর্তমানে গুজরাত রাজ্যে। 
  2. ভারত ভুক্তির সময় জুনাগড়ের নবাব ছিলেন - মহাবৎ খান। 
  3. জুনাগড়ের দেওয়ান ছিলেন - শাহনওয়াজ ভুট্টো। 
  4. জুনাগড়ের নবাব মুসলিম হলেও জুনাগড়ের সংখ্যা গরিষ্ঠ প্রজা ছিলো - হিন্দু।
  5. মাংগ্রোল ও বাবরিওয়ার ছিলো - জুনাগড়ের আশ্রিত দুই হিন্দু রাজ্য। 
  6. জুনাগড়ের ভারত ভুক্তি হয়েছিলো - গনভোটের ভিত্তিতে। 
  7. জুনাগড়ে গনভোট অনুষ্ঠিত হয় - ১৯৪৮ খ্রিঃ ২০ ফেব্রুয়ারি। 
  8. ১৯৪৯ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে আনুষ্ঠানিক ভাবে জুনাগড় ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। 

গ্রন্থঋন :- 

১. গাঁধী - উত্তর ভারতবর্ষ - রামচন্দ্র গুহ।
২. ভারত ইতিহাস পরিক্রমা - প্রভাতাংশু মাইতি ও অসিত কুমার মন্ডল। 
৩. আধুনিক ভারতের ইতিহাস - ড. রতন কুমার বিশ্বাস। 
৪. ভারতের ইতিহাস (আধুনিক যুগ ১৭০৭ - ১৯৬৪) - তেসলিম চৌধুরী। 
৫. আধুনিক ভারত (পলাশি থেকে নেহরু) - সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়। 
৬. আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৭০৭ - ১৯৬৪) - সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। 
৭. আধুনিক ভারতের রূপান্তর - সমর কুমার মল্লিক। 
৮. ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দশক - দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়। 
৯. ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান, প্রস্তুতি ও পরিনতি - সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। 
১০. জওহরলাল নেহেরু, স্বাধীনতার আগে এবং পরে - শ্যামাপ্রসাদ বসু। 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post