স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ভারত যেসব জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলো, তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো দেশীয় রাজ্য গুলির ভারত ভুক্তি সংক্রান্ত সমস্যা।
ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের যে সমস্ত রাজ্য ব্রিটিশ সরকারের সার্বভৌমত্বকে মেনে নিয়ে "স্ব - শাসনের" অধিকার লাভ করেছিলো সেই সমস্ত রাজ্য গুলিই "দেশীয় রাজ্য" নামে পরিচিত ছিলো। এই সমস্ত দেশীয় রাজ্য গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল - কুচবিহার,হায়দ্রাবাদ,জুনাগড়, কাশ্মীর, পাতিয়ালা, ত্রিবাঙ্কুর, ভোপাল, যোধপুর, উদয়পুর, বিকানির, বেওয়া, মহীশূর, বরোদা ইত্যাদি।
স্বাধীনতার পর দেশীয় রাজ্যের ভারতভুক্তি |
(১.) স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশীয় রাজ্য গুলির অবস্থা :-
১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ ই আগস্ট, স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ভারতে দেশীয় রাজ্যের সংখ্যা এত বেশি ছিলো যে তার প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, এই সময় মোট দেশীয় রাজ্য ছিলো - ৬০১ টি। আবার কারো মতে এই সংখ্যাটি ছিলো ৫৬৫, অন্যমতে ৫২১টি। দেশীয় রাজ্যের সংখ্যা নিয়ে তর্ক বিতর্ক থাকলেও, তাদের মোট সংখ্যাটি যে ৫০০ এর অধিক ছিলো এই নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন মতান্তর ছিলো না।
দেশীয় রাজ্য গুলি সমগ্র ভারত ভূখন্ডের প্রায় ৪৮ ভাগ জায়গা জুড়ে অবস্থিত ছিলো। এই রাজ্য গুলির ভৌগলিক আয়তন ও মর্যাদাতেও বিরাট পার্থক্য ছিলো। একদিকে ছিলো কাশ্মীর ও হায়দ্রাবাদের মতো বিরাট আয়তনের রাজ্য, অন্যদিকে দশ বারোটি গ্রাম নিয়ে গঠিত অতি ক্ষুদ্র জমিদারী রাজ্যও ছিলো। ভারতের স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ভারতের মোট জনসংখ্যা ছিল ৩৯ কোটি। এর মধ্যে দেশীয় রাজ্যের জনসংখ্যাই ছিলো প্রায় ৯ কোটি।
দেশীয় রাজ্য গুলি ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বকে মেনে নিয়ে স্ব শাসনের অধিকার লাভ করেছিলো। ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসাবে দেশীয় রাজ্য গুলিতে একজন করে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট বা প্রতিনিধি থাকতেন। মন্ত্রী নিয়োগ থেকে শুরু করে, রাজার সিংহাসন নিয়ন্ত্রন এমনকি মাঝে মধ্যে রাজাদের শাসনকাজে বাগড়া দিয়ে তিনি ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বকে ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিতেন।
বড়ো বড়ো দেশীয় রাজ্যের নিজস্ব রেলওয়ে, মুদ্রা ও ডাকটিকিট থাকতো। তবে অধিকাংশ দেশীয় রাজ্যে আধুনিক ধাঁচের কোন শিল্প বা শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো না। গনতান্ত্রিক ধ্যান ধারনা থেকেও রাজ্য গুলি বহু দূরে ছিলো। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হলে, সেই আন্দোলনের ঢেউ যাতে দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের মনে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেই জন্য দেশীয় রাজারা অত্যন্ত সতর্ক থাকতেন। কোন প্রজা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যুক্ত থাকলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো।
দেশীয় রাজাদের নির্লজ্জ ইংরেজ প্রীতির কারনে ব্রিটিশ সরকারও সবসময় আপদে বিপদে দেশীয় রাজাদের রক্ষা করতেন। এইভাবে ইংরেজদের মদতপুষ্ট হয়ে দেশীয় রাজ্য গুলি বহুদিন ধরেই অপ্রতিহত স্বৈরতন্ত্রের আঁতুরঘরে পরিনত হয়েছিলো। ঐ সমস্ত রাজ্যে জাতীয় কংগ্রেসের প্রবেশের, সংগঠন প্রতিষ্ঠার বা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠনের কোন অধিকার ছিলো না। এইভাবে দেশীয় রাজারা অবশিষ্ট ভারত থেকে দেশীয় রাজ্য গুলিকে বিচ্ছিন্ন রাখার নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেশীয় রাজ্য গুলিতে প্রজাদের অবস্থা ছিলো খুবই খারাপ। তারা সমস্ত রকম প্রগতিশীল সংস্কার, চিন্তাভাবনা ও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। দেশীয় রাজাদের স্বৈর শাসনে তারা জর্জরিত ছিলেন। দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের কোন নাগরিক বা গনতান্ত্রিক অধিকারও ছিলো না। আধুনিক সংস্কার বা শিল্প না থাকায় এবং ব্রিটিশ অধিকৃত এলাকা থেকে করভার বেশি থাকায় অর্থনৈতিক দিক থেকেও দেশীয় রাজ্যের প্রজারা সবথেকে বেশি শোষিত ও নির্যাতিত ছিলেন।
দেশীয় রাজাদের অধিকাংশই ছিলেন অপদার্থ ও লম্পট। রেসের ঘোড়া, অন্য লোকের বউ নিয়ে ফুর্তি করা, ইওরোপ ভ্রমন এবং আমোদ প্রমোদ নিয়েই তারা বেশি ব্যস্ত থাকতেন। নিজের রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা পরিচলনা বা প্রজাকল্যানের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র নজর ছিলো না। এই সব কারনে দেশীয় রাজাদের বিরুদ্ধে তাদের প্রজাদের মনে প্রবল জনরোষ ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিলো।
বলা বাহুল্য, দেশীয় রাজ্য গুলির প্রজাদের দুরাবস্থা জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে বেশিদিন মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলো না। তাই জাতীয় কংগ্রেসের প্রচেষ্টায় এবং মদতে দেশীয় রাজ্য গুলিতে "প্রজামন্ডল" নামে একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিলো। দেশীয় রাজ্য গুলিতে প্রজাদের গনতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এই সংগঠনটির জন্ম হলেও, পরবর্তীকালে জাতীয় কংগ্রেস ও অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে দেশীয় রাজ্যের একাত্মতা প্রতিষ্ঠায় এই সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।
১৯২০ দশক থেকে দেশীয় রাজ্যে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় কংগ্রেস সোচ্চার হয়। এই সময় দেশীয় রাজাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য দেশীয় রাজ্যের "প্রজামন্ডল" গুলি নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় গঠন করা হয় "অল ইন্ডিয়া স্টেটস পিপলস ইউনিয়ন কনফারেন্স"।
(২.) ভারতীয় স্বাধীনতা আইন ও দেশীয় রাজ্য :-
১৯৪৭ খ্রিঃ ১৮ ই জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয় "ভারতীয় স্বাধীনতা আইন" (The Indian Independence Act, 1947)। এই আইনে -
(১.) ভারতে ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলকে "ভারত" ও" পাকিস্তান" এই দুটি ডোমিনিয়নে ভাগ করা হয়।
(২.) দেশীয় রাজ্য গুলির ওপর ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের অবসান ঘোষনা করা হয়, এবং বলা হয়
(৩.) ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর দেশীয় রাজ্য গুলির সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের সমস্ত রকম চুক্তির অবসান ঘটবে।
(৪.) এরপর তারা চাইলে স্বাধীন রাজ্য হিসাবে টিকে থাকতে পারে অথবা "ভারত" বা "পাকিস্তান" যেকোন ডোমিনিয়নে যোগ দিতে পারে।
ভারতের স্বাধীনতা বিল নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি বলেন, "ব্রিটিশ সরকার এই আশাই পোষন করে যে সব কটি দেশীয় রাজ্যই ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অন্তর্গত ভারত বা পাকিস্তান কোন না কোন ডোমিনিয়নে তাদের যথাযোগ্য স্থান খুঁজে নেবে"।
অর্থাৎ ১৯৪৭ খ্রিঃ ভারতীয় স্বাধীনতা বিলে একদিকে দেশীয় রাজ্য গুলিকে স্বাধীনতা দেওয়ার আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিলো। অন্যদিকে সরকারি ঘোষনায় দেশীয় রাজ্য গুলির স্বাধীন অস্তিত্বের বিরুদ্ধ কথা বলে নব উদীয়মান "ভারত" ও "পাকিস্তান" দুটি রাষ্ট্রকেই আশস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। দেশীয় রাজ্য গুলির প্রতি ব্রিটিশ সরকারের এই অস্পষ্ট, দ্বিচারী নীতিতে পরবর্তীকালে সমস্যা ও জটিলতা বহুগুন বৃদ্ধি পায়।
(৩.) সমস্যা, জটিলতা ও বিতর্ক :-
১৯৪৭ খ্রিঃ ভারতীয় স্বাধীনতা আইনে দেশীয় রাজ্য গুলির প্রতি যে নীতি গ্রহণ করা হয়, তা তৎকালীন ভারতবর্ষে বেশ কিছু সমস্যা, জটিলতা ও বিতর্কের জন্ম দেয়। যেমন -
(১.) ভারতীয় স্বাধীনতা আইনে দেশীয় রাজ্য গুলির স্বাধীন ও পৃথক সত্ত্বা বজায় রাখার যে নীতি গৃহীত হয় তা ভারতীয় উপমহাদেশের ভৌগলিক অখন্ডতার পক্ষে যথেষ্ট অন্তরায় ছিলো।
(৩.) অধিকাংশ দেশীয় রাজ্য ভারত ও পাকিস্তানের মূল ভূখন্ডের অভ্যন্তরে অবস্থিত ছিলো। এর ফলে স্বাধীন দুই ভূখন্ডের অভ্যন্তরে স্বাধীন বেশ কিছু দেশীয় রাজ্যের অবস্থানে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেরই ভৌগোলিক সংহতি বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
(৪.) তাছাড়া, দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় দেশীয় রাজ্য গুলির স্বাধীন অস্তিত্ব সর্বদাই বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা যায়। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে অশান্তি ও সশস্ত্র সংঘাতের সম্ভাবনা বৃদ্ধির আশঙ্কা ছিলো।
(৫.) সবচেয়ে বড় কথা, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে দেশীয় রাজ্য গুলির স্বাধীন ও সার্বভৌম অবস্থান মেনে নেওয়া কখনই সম্ভব ছিলো না। কারন বড়ো দেশীয় রাজ্য গুলির স্বাধীনতার স্পৃহা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ও অখন্ডতার পক্ষে বিপজ্জনক ছিলো।
(৬.) দেশীয় রাজ্য গুলির অবস্থান ছিলো বিক্ষিপ্ত ও ইতস্তত। ফলে তা রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও অখন্ড জাতীয়তাবাদেরও অন্তরায় ছিলো।
(৭.) স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্বপক্ষে দেশীয় রাজ্য গুলির প্রজাদের বিদ্রোহ ও আন্দোলন তীব্র এবং জটিল আকার ধারন করেছিলো। ফলে সংখ্যা গরিষ্ঠ প্রজাদের জনমতকে উপেক্ষা করে দেশীয় রাজাদের স্বাধীন অস্তিত্বের দাবিকে কখনই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলো না।
দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের গনবিক্ষোভকে উপেক্ষা করার সাহস গনতান্ত্রিক ব্রিটেনের পক্ষেও সম্ভব ছিলো না। ভারতের স্বাধীনতা আইন পাশের সময়েই তাই ইংল্যান্ডের অ্যাটর্নী জেনারেল স্যার হার্টলে শক্রুস এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি ঘোষনা করেছিলেন, ব্রিটিশ সরকার দেশীয় রাজ্য গুলির স্বাধীন অস্তিত্বকে কোন রকম স্বীকৃতি দেবে না, এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঐ রাজ্য গুলির স্বাধীন স্বীকৃতির দাবিকে সমর্থনও করবে না। কিন্তু ভারতে লর্ড মাউন্টব্যাটনের রাজনৈতিক উপদেষ্টা স্যার কনরাড কর্নফিল্ডের উস্কানিমূলক আচরন তৎকালীন ভারতবর্ষের অবস্থাকে অত্যন্ত জটিল ও সমস্যা বহুল করে তোলে।
কনরাডের উস্কানি পেয়ে এইসময় ভারতের বেশ কিছু রাজ্য অতি উৎসাহী হয়ে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণায় উদ্যোত হয়। এই সব রাজ্য গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল - ভূপাল, ত্রিবাঙ্কুর, হায়দ্রাবাদ, কাশ্মীর এবং আরোও বেশ কিছু রাজ্য। ভারতের পরম শত্রু মহম্মদ আলি জিন্না ভারতের মূল ভূখন্ডের অভ্যন্তরে অবস্থিত ঐ সমস্ত দেশীয় রাজ্যের স্বাধীনতার ইচ্ছাতে বিভিন্ন রকম উস্কানির ধুঁয়া দিলে পরিস্থিতি আরোও ঘোরালো ও জটিল আকার ধারন করে।
(৩.) দেশীয় রাজ্য গুলির প্রতি জাতীয় কংগ্রেস (ভারত) এবং জিন্নার (পাকিস্তানের) নীতি :-
দেশীয় রাজ্য গুলির প্রতি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং মহম্মদ আলি জিন্নার নীতি ও অবস্থান ছিলো বিপরীতধর্মী এবং পরস্পরবিরোধী।
(ক) কংগ্রেসের অবস্থান ও নীতি :-
দেশীয় রাজ্য গুলির বিষয়ে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসর অবস্থান ও নীতি ছিলো অত্যন্ত স্পষ্ট।
(১.) কংগ্রেস কোন দেশীয় রাজ্যের স্বাধীনতাকেই সমর্থন করতো না।
(২.) কংগ্রেস ঘোষনা করে দেশীয় রাজ্যের ভবিষ্যত নির্ধারন করার ক্ষমতা বা স্বাধীন থাকবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাজার একা নয়, ঐ রাজ্যের জনগনেরও আছে।
(৩.) কংগ্রেস দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষনা করেছিলো - ভারতের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে কোন স্বাধীন দেশীয় রাজ্যের অস্তিত্বকেই স্বীকার করা হবে না।
১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ ই জুন নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে দেশীয় রাজ্য গুলির প্রতি জাতীয় কংগ্রেসের নীতিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জওহরলাল নেহেরু দৃপ্তকন্ঠে ঘোষনা করেন - "দেশীয় রাজ্য গুলির ওপর ভারত সরকারের কিছুটা হলেও সার্বভৌমত্ব বর্তায়। এই সার্বভৌম কর্তৃত্বকে দেশীয় রাজ্য গুলি কখনই অস্বীকার করতে পারে না। ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে দেশীয় রাজ্যের স্বাধীন অস্তিত্বকে ভারত কখনই স্বীকার করে না। দেশীয় রাজ্য গুলির স্বাধীনতাকে অন্য কোন বিদেশী রাষ্ট্র যেমন পাকিস্তান বা ইংল্যান্ড যদি স্বীকৃতি দেয়, তাহলে ভারত তাকে অবন্ধুচিত আচরন বলেই মনে করবে।"
দেশীয় রাজ্য গুলির বিষয়ে গান্ধীজির অবস্থান ছিলো নেহেরুর মতোই কঠোর। তিনি ঘোষনা করেন কোন দেশীয় রাজ্য স্বাধীনতা ঘোষনা করলে তা স্বাধীন ভারতের পক্ষে যুদ্ধ ঘোষনা বলে বিবেচিত হবে।
অর্থাৎ একথা বলা যায়, একেবারে গোড়া থেকেই জাতীয় কংগ্রেস দেশীয় রাজ্য গুলির বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলো এবং তাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলো।
(খ.) জিন্নার অবস্থান ও নীতি :-
দেশীয় রাজ্য গুলির প্রতি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ আলি জিন্নার নীতি ও অবস্থান ছিলো জাতীয় কংগ্রেস ও ভারত বিরোধী।
জিন্না মনে প্রানে ভারতকে তার শত্রু ভাবতেন। স্বাধীনতা লাভের আগে যেমন তার অবস্থান ও নীতি ছিলো ভারত বিরোধিতা করা, স্বাধীনতা লাভের পরেও তার ঘোষিত অবস্থান ও নীতি ছিলো ভারত বিরোধিতা করা। দেশীয় রাজ্য গুলির প্রতি জিন্নার মনোভাব ও আচরনেই তা প্রতিফলিত হয়।
(১.) জিন্না দেশীয় রাজ্য গুলির স্বাধীনতাকে নানা ভাবে ইন্ধন ও উস্কানি দেন।
(২.) তার উদ্দেশ্য ছিলো দেশীয় রাজ্য গুলিকে প্ররোচিত করে ঐ রাজ্য গুলিকে পরবর্তীকালে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা।
(৩.) জিন্না কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার দরাদরির জন্য বেশ কিছু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সীমান্তবর্তী দেশীয় রাজ্যকে পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন।
(৪.) এছাড়া, ভারতকে দুর্বল ও অস্থির করার জন্য দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত হায়দ্রাবাদ রাজ্যের স্বাধীনতাকে সমর্থন জানান ও নানাভাবে সাহায্য করেন।
(৫.) কাশ্মীর রাজ্যকে বলপূর্বক ভাবে দখল করার নীতিও জিন্না ও পাকিস্তানের ছিলো।
(৪.) কংগ্রেস (ভারত) কেন দেশীয় রাজ্য গুলি ভারতভুক্ত করতে চেয়েছিলো?
আগেই বলেছি, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দেশীয় রাজ্য গুলির স্বাধীন অস্তিত্বকে স্বীকার করতো না। দেশীয় রাজ্য গুলির বিষয়ে কংগ্রেসের অবস্থান ও ঐক্যমত ছিলো খুবই স্পষ্ট। কতকগুলি উল্লেখযোগ্য কারনে কংগ্রেস দেশীয় রাজ্য গুলিকে ভারতে অন্তর্ভূক্ত করতে চেয়েছিলো। যেমন -
(১.) কংগ্রেস দেশীয় রাজ্য গুলিকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন কোন অংশ হিসাবে মনে করতো না। কারন ভারতের ধর্ম, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সঙ্গে দেশীয় রাজ্য গুলির কোন পার্থক্য ছিলো না।
(২.) কংগ্রেস অখন্ড জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলো। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশীয় রাজ্যের প্রজারাও অংশগ্রহণ করেছিলো। সুতরাং স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে ঐ সমস্ত রাজ্যের প্রজাদের স্বাধীনতার দাবিকে কখনই কংগ্রেসের পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিলো না।
(৩.) ভারতের মূল ভূখন্ডে স্বাধীন দেশীয় রাজ্যের উপস্থিতি ভৌগলিক সংহতির অন্তরায় ছিলো। কংগ্রেসের মতো সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষে কোন ভাবেই তাকে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলো না।
(৪.) দেশীয় রাজ্য গুলির শাসন ব্যবস্থা ছিলো মধ্যযুগীয় ও স্বৈরাচারী। এই স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই দেশীয় রাজ্য গুলিতে জনগন বিদ্রোহ করে আসছিলো।
(৫.) বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যে গনতন্ত্র ও স্বাধীনতার দাবিতে "প্রজামন্ডল" গুলির আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারন করেছিলো। কংগ্রেসের পক্ষে তাকেও উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করা সম্ভব ছিলো না।
(৫.) দেশীয় রাজ্য গুলিকে ভারত ভুক্ত করার উদ্যোগ :-
১৯৪৭ খ্রিঃ ১৮ ই জুলাই ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাশ করার পরেই জাতীয় কংগ্রেসের কাছে অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাড়ালো ভারতের ভৌগলিক সীমায় অবস্থিত দেশীয় রাজ্য গুলিকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করা। অত্যন্ত সুকৌশলে এবং সুনিপুন দক্ষতায় ভারত সরকার এই সমস্যার সমাধান করে।
(ক.) নেতৃত্ব নির্বাচন : প্যাটেলের ভূমিকা :-
দেশীয় রাজাদের স্বৈরাচারীতা, অপদার্থতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, এবং লাম্পট্যের কারনে নেহেরু দেশীয় রাজাদের একদমই পছন্দ করতেন না। অন্যদিকে দেশীয় রাজারাও নেহেরুকে পছন্দ করতো না। এমনকি তারা নেহেরুকে ভয়ও করতেন।
নেহেরু ভালো বক্তা হলেও, তার মধ্যে যথেষ্ট ধৈর্য্য ও কূটনৈতিক জ্ঞানের অভাব ছিলো। এছাড়া তার চারিত্রিক আরেকটি ত্রুটির জায়গা ছিলো, তিনি মাঝে মধ্যেই অসম্ভব রেগে যেতেন। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তির দায়িত্ব দেওয়া হয় সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের হাতে। বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম উপপ্রধানমন্ত্রী ও প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি ছিলেন একজন কেজো বা দক্ষ প্রশাসক, কূটনীতিবিদ এবং খুবই ঠান্ডা মাথার একজন মানুষ। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষিপ্রতা ও অসাধারণ কূটনৈতিক দক্ষতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য তাকে - "ভারতের লৌহমানব" এবং "ভারতের বিসমার্ক" নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। বিসমার্ক যেমন অসাধারণ কূটনৈতিক দক্ষতায় জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, ঠিক তেমনি সর্দার প্যাটেলও তাঁর সুনিপুন কূটনীতির তুলিতে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করেন। যে কাজ ইংরেজরা প্রায় ২০০ বছরেও করতে পারেন নি, সেই দেশীয় রাজ্য গুলিতেকে ভারতভুক্ত করার অসাধারণ কাজটি করেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তাঁর কূটনীতির তুলিতেই শেষপর্যন্ত স্বাধীন ভারতের নতুন মানচিত্র অঙ্কিত হয়েছিলো। এদিকথেকে তাকে "নব ভারতের রূপকার" বললেও অত্যুক্তি হয় না।
যার পরামর্শে ও চেষ্টায় প্রায় বিনা রক্তপাতে দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতে অন্তর্ভূক্ত করার এই দুঃসাহসিক কাজটি প্যাটেল সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন, তিনি হলেন ভি পি মেনন। ভারতের মালাবার অঞ্চলের এই ছোট্ট খাট্টো মানুষটির মন ছিলো সজাগ আর কূটনৈতিক বুদ্ধি ছিলো সাংঘাতিক। প্যাটেল ও মেননের সম্মিলিত উদ্যোগের ফলেই দেশীয় রাজ্য গুলি ভারত ভুক্ত হয়।
(খ.) দেশীয় রাজ্য দপ্তর গঠন :-
দেশীয় রাজ্য গুলির ভবিষ্যৎ নির্ধারন ও দেশীয় রাজ্য সমস্যার নিরসনের জন্য ১৯৪৭ খ্রিঃ ২৭ শে জুন ভারত সরকার "দেশীয় রাজ্য দপ্তর" নামে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করে।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে দেশীয় রাজ্য দপ্তরের প্রধান নিযুক্ত করা হয়। তাঁর সচিব নিযুক্ত হন ভি পি মেনন। পরবর্তীকালে দেশীয় রাজ্য দপ্তরের নেতৃত্বেই ভারতে দেশীয় রাজ্য গুলির অন্তর্ভুক্তকরনের কাজ পরিচালনা করা হয়।
(গ.) ৩ টি প্রধান রনকৌশল অবলম্বন :-
দেশীয় রাজ্য গুলি ভারত ভুক্তির জন্য সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ৩ টি প্রধান রনকৌশল অবলম্বন করেন। এগুলি হল -
(i.) দেশীয় রাজাদের সুযোগ সুবিধা ও বিভিন্ন প্রলভন দেখিয়ে তাদের ভারত ইউনিয়নে অন্তর্ভূক্ত করা। দুর্বল ও ছোট দেশীয় রাজ্য গুলির প্রতি এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছিলো।
(ii.) কূটনৈতিক চাপ দিয়ে দেশীয় রাজ্যের একাংশকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া। মাঝারি আয়তনের দেশীয় রাজ্য গুলির প্রতি এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছিলো।
(iii.) সরাসরি বল প্রয়োগ বা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাজ্য গুলিকে ভারত ভুক্ত করা। বৃহৎ ও অনমনীয় দেশীয় রাজ্য গুলির প্রতি এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছিলো।
(i) সুযোগ সুবিধা প্রদান :-
দেশীয় রাজাদের বশে আনার জন্য সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ১৯৪৭ খ্রিঃ গোটা বসন্তকাল জুড়ে একের পর এক ভোজসভার আয়োজন করে ছোট বড়ো সব দেশীয় রাজাদের আমন্ত্রন জানান। সেখানে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের স্বার্থে দেশীয় রাজাদের ভারত ইউনিয়নে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেন। দেশীয় রাজাদের কাছে আহ্বান জানানো হয় তারা যেন গনপরিষদে তাদের প্রতিনিধিদের পাঠিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নতুন ভারতের সংবিধান রচনায় সাহায্য করেন।
বলা বাহুল্য, স্বাধীন ভারতের নতুন সংবিধান রচনার জন্য ইতিপূর্বেই ১৯৪৬ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাস থেকে গনপরিষদের অধিবেশন শুরু হয়ে গিয়েছিলো। প্যাটেল দেশীয় রাজাদের কাছে প্রতিশ্রুতি দেন, দেশীয় রাজারা শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতি ও যোগাযোগ সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রন - এই ৩ টি ক্ষমতা ভারতকে ছেড়ে দেবে। বাদবাকি যা কিছু ক্ষমতা, যা এতদিন ধরে দেশীয় রাজারা ভোগ করে আসছিলেন, সেসবই তারা পূর্বের ন্যায় ভোগ করতে পারবেন। ভারতে যোগদানের বিনিময়ে দেশীয় রাজাদের বিশাল ভাতা, খেতাব ও নানা সুযোগ সুবিধার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
(ii.) কূটনৈতিক চাপ :-
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল জানতেন, শুধু সুযোগ সুবিধা প্রদান করে আত্ম - অহংকারী সব দেশীয় রাজাদের তিনি বাগে আনতে পারবেন না। এই কারনে তিনি ঝাঁনু কূটনীতির অবলম্বন করেন। কংগ্রেস ভালো করেই জানতো ব্রিটিশ সরকার যদি দেশীয় রাজাদের স্বাধীনতার খোয়াবে ইন্ধন দেয়, তাহলে অচিরেই ভারতের পরিস্থিতি বল্কান অঞ্চলের মতো হয়ে উঠবে।
লর্ড মাউন্টব্যাটনের রাজনৈতিক উপদেষ্টা স্যার কনরাড কর্নফিল্ড বেশ কিছু দেশীয় রাজ্যকে স্বাধীন থাকবার উস্কানি দিলে কংগ্রেস এর তীব্র সমালোচনা ও বিরোধিতা করে। এই সময় জাতীয় কংগ্রেসের তরফ থেকে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহেরু এবং মহাত্মা গান্ধী বারংবার লর্ড মাউন্টব্যাটনের সঙ্গে বৈঠক করে মাউন্টব্যাটনকে অনুরোধ করেন, ব্রিটিশ সরকার যেন কোন ভাবেই দেশীয় রাজাদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে মদত না দেয়।
দেশীয় রাজাদের ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য এই সময় তিনটি পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় -
(১.) এক, মাউন্টব্যাটনকে দিয়ে দেশীয় রাজাদের ভারতে যোগাদানের স্বপক্ষে প্রবল কূটনৈতিক চাপ দেওয়া হয়।
(২.) দুই, দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের গন আন্দোলনকে নানা ভাবে উস্কানি দিয়ে রাজাদের চাপে রাখা হয়।
(৩.) তিন, প্যাটেল ও ভি পি মেনন একের পর এক দেশীয় রাজ্যে ভ্রমন করে ঐসব রাজ্যের দেওয়ানদের সঙ্গে বৈঠক করে ভারতে যোগদানের জন্য সরাসরি নানা চাপ তৈরি করেন।
সর্দার প্যাটেল মাউন্টব্যাটনকে অনুরোধ করেছিলেন, দেশীয় রাজ্য গুলিকে ভারতভুক্তির প্রশ্নে মাউন্টব্যাটন যেন ভারতের হয়ে ব্যাট ধরেন। মাউন্টব্যাটন কংগ্রেসের প্রস্তাবে সম্মত হন। ১৯৪৭ খ্রিঃ ২৫ শে জুলাই দেশীয় রাজন্যসভার সম্মেলনে লর্ড মাউন্টব্যাটন তার প্রদত্ত ভাষনে বলেন -
"
।"ভারতীয় স্বাধীনতা আইন চালু হওয়ায় দেশীয় রাজ্য গুলি এখন ব্রিটেনের রাজার প্রতি যাবতীয় দায় দায়িত্ব থেকে মুক্ত। আইনি অর্থে তারা স্বাধীন হলেও, একলা পথ চলার প্রশ্নে তারা দিশাহীন ও কর্নধারহীন। পুরোনো বন্ধন গুলো ছিঁড়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু অন্য কিছু যদি তার জায়গা না নেয়, তাহলে অবধারিত ভাবেই দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা। সেই বিশৃঙ্খলা সবার আগে আঘাত করবে দেশীয় রাজ্য গুলিকেই
মাউন্টব্যাটন দেশীয় রাজাদের পরামর্শ দেন, যে ইউনিয়ন দেশীয় রাজ্য গুলির কাছাকাছি অবস্থিত তারা যেন সেখানেই যোগ দেন। এই সুপরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি অত্যন্ত ঝাঁঝালো আর চাঁচাছোলা ভাষায় মাউন্টব্যাটন দেশীয় রাজাদের স্মরন করিয়ে দেন -" আপনারা আপনাদের প্রতিবেশি ডোমিনিয়ন (ভারত ও পাকিস্তান) সরকারের কাছ থেকেও যেমন পালাতে পারবেন না। তেমনি আপনাদের বিক্ষুদ্ধ প্রজাদের কাছ থেকেও পালিয়ে বাঁচতে পারবেন না।"
মাউন্টব্যাটনের তিক্ত ভাষন শোনার পরে দেশীয় রাজাদের স্বাধীনতার খোয়াব তাদের ঘরের মতোই ভেঙ্গে পড়তে থাকে। অবশেষে তাদের বোধদয় হয় "ব্রিটিশরা আর তাদের পিঠ বাঁচাবে না, পিঠ চাবড়াবেও না। স্বাধীনতার খোয়াব একটা মরীচিকা মাত্র।"
(iii.) বলপ্রয়োগের হুমকি :-
প্রলভন ও কূটনৈতিক চাপকে উপেক্ষা করার পরেও বেশ কিছু বড়ো দেশীয় রাজ্য স্বাধীনতার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। অনমনীয় সেইসব দেশীয় রাজাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের হুমকি দেওয়া হয় বা সরাসরি বলপ্রয়োগ করা হয়। হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় রাজ্যের ক্ষেত্রে এই নীতি গ্রহণ করে ঐ সমস্ত রাজ্যকে ভারত ইউনিয়নে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়।
(ঘ.) "Instrument of Accession" বা "ভারত - ভুক্তির দলিলে" দেশীয় রাজাদের স্বাক্ষর ও যোগদান :-
দেশীয় রাজাদের ভারত ইউনিয়নে যোগদান করানোর জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে "Instrument of Accession" বা "ভারত - ভুক্তির দলিল" আনা হয়। এই দলিলে বলা হয় -
(১.) দেশীয় রাজ্য গুলি ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করবে।
(২.) এই যোগদানের বিনিময়ে দেশীয় রাজ্যের রাজারা তাদের ভৌগলিক আয়তন ও প্রাপ্ত রাজস্বের অনুপাতে বিপুল পরিমান "রাজন্য ভাতা" সহ বিশেষ সুযোগ সুবিধা পাবেন।
(৩.) ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষরকারী রাজ্য গুলি একমাত্র প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতি ও যোগাযোগ সংক্রান্ত ৩ টি ক্ষমতা ভারতকে ছেড়ে দেবে। বাকি ক্ষেত্র গুলিতে দেশীয় রাজারা যেমন ক্ষমত ভোগ করছিলেন, তেমনই করবেন।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের অসাধারণ কূটনীতির ফলে মাত্র ৩ সপ্তাহের মধ্যে অধিকাংশ দেশীয় রাজ্য ভারতে যোগদান করে এবং ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করে। এক্ষেত্রে (ক.) সবার প্রথমে দেশীয় রাজ্য "বরোদা" ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করে এবং গনপরিষদে যোগ দেয়। (খ.) এরপর একে একে রাজস্থানের দেশীয় রাজ্য গুলি ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়। (গ.) পাকিস্তান সীমান্তে অবস্থিত দেশীয় হিন্দু রাজ্য গুলি মুসলিম অত্যাচার ও আক্রমনের অতীত অভিজ্ঞতাকে স্মরন করে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়াই শ্রেয় বলে মনে করে। (ঘ.) অন্যদিকে ভারতের মূল ভূখন্ডে অবস্থিত ছোট ও মাঝারি মাপের রাজ্য গুলি ভারতের সঙ্গে সংঘাত নির্থক মনে করে ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করে।
এই ভাবে ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ ই আগস্ট স্বাধীনতা লাভের আগে প্রায় সমস্ত দেশীয় রাজ্যই ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তবে ১৫ ই আগস্টের আগে ভারতে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে ৩ টি দেশীয় রাজ্য - ত্রিবাঙ্কুর, ভোপাল এবং যোধপুর ঝামেলা পাকায় এবং স্বাধীনতা ঘোষনা করে। ১৫ ই আগস্টের পরে আরোও ৩ টি দেশীয় রাজ্য জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ এবং কাশ্মীর ভারতে অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করে এবং স্বাধীন থাকার নীতি গ্রহণ করে। এই প্রত্যেকটি রাজ্যের ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের ইন্ধন ও উস্কানি ছিলো।
(i.) ত্রিবাঙ্কুরের স্বাধীনতার প্রয়াস :-
ত্রিবাঙ্কুর দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত সবচেয়ে শিক্ষিত রাজ্য ছিলো। এই রাজ্যের যেমন সমৃদ্ধ নৌ বানিজ্য ছিলো, তেমনি মোনাজইটের খনি ছিলো, যা থেকে থোরিয়াম নিষ্কাশন হয়। এই থোরিয়াম পারমানবিক বোমা তৈরিতে কাজে লাগে। ত্রিবাঙ্কুরের দেওয়ান ছিলেন - সি পি রামস্বামী আয়ার। তিনি ছিলেন অত্যন্ত তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন ও উচ্চাভিলাষী। ত্রিবাঙ্কুরের জনগন মনে করতেন, এই দুষ্টু দেওয়ানটিই তাদের রাজ্যের সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বসে আসে। ত্রিবাঙ্কুরের রাজা ও রানী দেওয়ানের হাতের কাদার তাল মাত্র।
সি পি রামস্বামী ত্রিবাঙ্কুরের স্বাধীনতার জন্য গোপনে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি চুক্তি করতে চান। এরপর একের পর এক সাংবাদিক সম্মেলন করে তিনি ত্রিবাঙ্কুরের অতীত ঐতিহ্য, দেশপ্রেম এসব ফিরিস্তি দিয়ে ঘোষনা করেন, ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ ই আগস্ট ত্রিবাঙ্কুর একটি স্বাধীন দেশ হিসাবেই আত্মপ্রকাশ করবে। ত্রিবাঙ্কুরের স্বাধীনতা ঘোষনার সঙ্গে সঙ্গে ১৯৪৭ খ্রিঃ ২০ জুন মহম্মদ আলি জিন্না স্যার সি পি রামস্বামী আয়ারকে টেলিগ্রাম করে উৎসাহিত করেন এবং জানান - "পাকিস্তান ত্রিবাঙ্কুরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে প্রস্তুত, যা পরস্পরের সহায়ক হবে।"
ত্রিবাঙ্কুরের স্বাধীনতা প্রচেষ্টায় লাগাম টানতে জাতীয় কংগ্রেস মাউন্টব্যাটনকে ব্যবহার করেন। মাউন্টব্যাটনের সঙ্গে সি পি রামস্বামীর বৈঠকে মাউন্টব্যাটন ত্রিবাঙ্কুরকে ভারতে যোগদানের অনুরোধ করেন। এর দু একদিন পর ত্রিবাঙ্কুরে আসেন ভি পি মেনন। তিনি দেওয়ান সাহেবকে ক্ষমতা অঙ্গীকরন চুক্তিতে সই করতে বললে দেওয়ান সাহেব অস্বীকার করেন। এর বদলে তিনি ভারতের সঙ্গে বানিজ্যিক ও পারস্পরিক সাহায্যের চুক্তির কথা তুলে ধরেন।
এই দৌত্য ব্যর্থ হওয়ার কয়েকদিন পর এক আততায়ীর হাতে ত্রিবাঙ্কুরের দেওয়ান মারাত্মক আহত হন। অল্পের জন্য তিনি প্রানে বেঁচে যান। শেষপর্যন্ত হাসপাতালের শয্যা থেকে তিনি তাঁর মহারাজকে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা করার পরামর্শ দেন। এর ফলে ৩০ শে জুলাই ১৯৪৭ খ্রিঃ ত্রিবাঙ্কুর ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করে।
(ii.) ভোপালের স্বাধীনতার প্রয়াস :-
ভোপাল রাজ্যটি মধ্য ভারতে অবস্থিত ছিলো। এই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজা হিন্দু হলেও, রাজা ছিলেন মুসলমান। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভোপালের রাজা কংগ্রেসের ঘোর বিরোধী ছিলেন। জিন্না এবং মুসলিম লিগের সঙ্গে তার বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিলো। ১৯৪৭ খ্রিঃ জিন্না পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় এবং ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করায় এমনিতেই ভোপালের নবাব বেশ মুষড়ে পড়েছিলেন।
এই সময় মাউন্টব্যাটন বেশ কয়েকবার ভোপালের নবাবকে পত্র লেখে ভারতে যোগ দিতে অনুরোধ করলে ভোপালের নবাব জানিয়ে দেন, ২৫ শে জুলাইয়ের নির্ধারিত রাজন্য সভার সম্মেলনে তিনি যোগ দিচ্ছেন না এবং স্বাধীনতা ঘোষনা করছেন। এর পর মাউন্টব্যাটন বেশ কয়েকবার কড়া চিঠি লিখে ভোপালের নবাবের স্বাধীনতার খোয়াবটাকে ভেঙ্গে দেন।
দীর্ঘ নাটকবাজির পর ভোপালের নবাব শিশুসুলভ অহংপ্রীতির এক আবদার করে বললেন, তিনি ভারতীয় সংঘে যোগ দিতে রাজী আছেন ঠিকই। কিন্তু সেটা ১৫ ই আগস্টের আগে নয়, পরে। পটেল ভোপালের নবাবের এই অনুরোধ পত্রপাঠ খারিজ করে জানিয়ে দেন, তার পক্ষে কারো জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। অগত্যা ১৫ ই আগস্টের আগেই ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করা ছাড়া ভোপালের নবাবের কাছে দ্বিতীয় কোন বিকল্প থাকলো না।
(iii.) যোধপুরের স্বাধীনতার প্রয়াস :-
রাজস্থানের মধ্যে অবস্থিত যোধপুর ছিলো একটি পুরাতন ও বৃহৎ রাজ্য। এখানকার রাজা ও প্রজা দুজনেই হিন্দু ছিলেন। জুলাইমাসে মাউন্টব্যাটন আহুত এক ভোজসভায় যোধপুরের মহারাজা অন্যান্য রাজপুত রাজাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঘোষনা করেছিলেন, তিনিও ভারতে যোগ দেবেন। কিন্তু পরে তিনি সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন এবং যোগদানের প্রশ্নে যে দ্বিতীয় বিকল্পটি খোলা আছে অর্থাৎ পাকিস্তানে যোগাদানের বিষয়ে উৎসাহিত হন।
এই নিয়ে জিন্নার সঙ্গে যোধপুরের মহারাজার বৈঠক বসে। জিন্না নবাবকে প্রতিশ্রুতি দেন, নবাবকে তিনি করাচি বন্দরের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দেবেন। এরপর একটি ফাঁকা কাগজ আর ঝরনা কলম মহারাজার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, আপনার খুশিমতো শর্ত গুলো বসিয়ে নেবেন।
আসলে যোধপুরের মতো হিন্দু প্রধান একটি রাজ্যকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস চালিয়ে জিন্না কাশ্মীরকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির জন্য দরাদরি করতে চেয়েছিলেন। যদিও তার এই উদ্যোগ শেষপর্যন্ত সফল হয় নি। মহারাজার পাকিস্তানে যোগদানের প্রশ্নে যোধপুরের অভিজাতরা এবং গ্রামের মোড়লরা ভয়ঙ্কর খেপে গিয়ে বলেন, যোধপুরের মতো একটি হিন্দু রাজ্য পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার পর যদি মুসলিম আক্রমণের সম্মুখিন হয় এবং দাঙ্গা লাগে, তাহলে মহারাজা কার পক্ষ নেবেন?
যোধপুরের বিষয়টি জটিল আকার ধারন করলে পটেল যোধপুরের মহারাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ঘোষনা করেন, যোধপুরকে তিনি পাকিস্তানের থেকেও বেশি সুবিধা দেবেন। অনেক বেশি খাদ্যশস্য ও অস্ত্র যোধপুরকে দেওয়া হবে। দরাদরির পর অবশ্য যোধপুরের মহারাজা ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়ে যান।
এইভাবে ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ ই আগস্টের আগে হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় ও কাশ্মীর ছাড়া সব দেশীয় রাজ্যই "ভারত ভুক্তি দলিলে" স্বাক্ষর করে ভারতে যোগদান করে।
(৬.) ভারত ভুক্তির পরবর্তী অবস্থা : দেশীয় রাজ্য গুলিতে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন :-
দেশীয় রাজ্য গুলি ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশীয় রাজ্যের প্রজামন্ডল গুলি আবার সক্রিয় হয়ে উঠে এবং ঐ সমস্ত রাজ্যে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জোরদার আন্দোলন শুরু করে। কংগ্রেস তলে তলে এই আন্দোলন গুলিকে উস্কানি দিয়ে তাতিয়ে তুলতে থাকে।
এই সময় মহীশূর রাজ্যে গনতান্ত্রিক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে প্রায় ৩ হাজার লোককে গ্রেপ্তার করা হয়। কাঠিয়াওয়াড় এবং ঊড়িষ্যার কোন কোন দেশীয় রাজ্যে গনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারীরা সরকারি অফিস, আদালত, থানা আক্রমন শুরু করে। ধীরে ধীরে প্রজামন্ডল গুলির আন্দোলন এক দেশীয় রাজ্য থেকে অপর দেশীয় রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এই সময় পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠলে বল্লভভাই প্যাটেল এবং কংগ্রেস খুব সুচতুর ভাবে জনগনের আন্দোলনকে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে কাজে লাগান এবং পূর্ব প্রতিশ্রুতির জায়গা থেকে সরে আসেন।
জনগণের আন্দোলনে দেশীয় রাজারা ভীত হয়ে পড়লে প্যাটেল দেশীয় রাজাদের স্বাধীন মর্যাদা ও অস্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে ভারতীয় সংঘে মিশে যেতে বলেন। রাজাদের স্মরন করিয়ে দেওয়া হলো এটি না করলে নিজ রাজ্যের প্রজাদেন গন আন্দোলনে দেশীয় রাজারা এমনিতেই উৎখাত হবেন।
বলা বাহুল্য, এই সমস্ত রাজারা ইতিপূর্বেই ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন। এখন প্রজাদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে ভারতীয় সংঘে মিশে যাওয়া ছাড়া, দেশীয় রাজ্য গুলির সামনে দ্বিতীয় কোন বিকল্প ছিলো না। ভারতীয় সংঘে মিশে যাওয়ার বিনিময়ে কংগ্রেসের তরফ থেকে দেশীয় রাজাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তাদের খেতাব অটুট থাকবে এবং তারা স্থায়ী বার্ষিক রাজন্য ভাতাও পাবেন।
(৭.) রাজ্য - সংযুক্তকরনের পদ্ধতি :-
দেশীয় রাজ্য গুলি সংযুক্তিকরনের জন্য ৩ টি পদ্ধতি নেওয়া হয়। যেমন -
(ক.) কিছু দেশীয় রাজ্যকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। যেমন - হিমাচল প্রদেশ, কচ্ছ, বিলাসপুর, ভূপাল, ত্রিপুরা, মনিপুর। এই নীতিতে ৬১ টি দেশীয় রাজ্যকে ৭ টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
(খ.) কিছু দেশীয় রাজ্যকে তার পাশের রাজ্য বা প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। যেমন - ঊড়িষ্যা ও মধ্য প্রদেশের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের দেশীয় রাজ্য গুলি, বোম্বাই রাজ্যের সঙ্গে দাক্ষিনাত্য ও গুজরাটের দেশীয় রাজ্য গুলি, উত্তর প্রদেশের সঙ্গে রামপুর ও বেনারস, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে দেশীয় রাজ্য কুচবিহারকে, আসামের সঙ্গে খাসি পার্বত্য অঞ্চলের দেশীয় রাজ্য গুলি এবং মাদ্রাজের সঙ্গে তার পার্শ্ববর্তী বা লাগোয়া দেশীয় রাজ্য গুলিকে জুড়ে দেওয়া হয়। ১৯৪৮ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসের মধ্যে এই নীতিতে ২১৬ টি দেশীয় রাজ্যকে তার পাশের প্রদেশ গুলির সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
(গ.) কিছু দেশীয় রাজ্যকে সংযুক্ত করে কয়েকটি বড়ো রাজ্য গঠন করা হয়। যেমন - রাজস্থান, পাঞ্জাব, বিন্ধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি। এই নীতিতে ২৭৫ টি দেশীয় রাজ্যকে মিশিয়ে ৫ টি বড়ো রাজ্যে পরিনত করা হয়।
(৮.) হাতে রইলো তিন : রাজা, বোড়ে ও রানী :-
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে সিংহভাগ দেশীয় রাজ্য গুলিকে সংযুক্তিকরনের প্রক্রিয়া সাফল্যের সঙ্গে কার্যকর করা গেলেও, ব্যতিক্রম থেকে যায় জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ ও কাশ্মীর।
১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ ই আগস্টের আগে এই ৩ টি বড়ো দেশীয় রাজ্য স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তারা ভারত বা পাকিস্তান কোন ইউনিয়নেই যোগ দেয় নি। এই ৩ টি রাজ্যকে বল্লভভাই প্যাটেল দাবার ভাষায় নামকরন করেন - রাজা ( হায়দ্রাবাদ), বোড়ে ( জুনাগড়) ও রানী (কাশ্মীর)।
(৯.) প্যাটেল - নেহেরু বিতর্ক :-
স্বাধীনতা লাভের পর হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় ও কাশ্মীর রাজ্যকে ভারতে অন্তর্ভুক্তকরনের প্রশ্নে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের কিছু মতান্তর ও বিরোধ দেখা যায়।
৩ টি রাজ্যের মধ্যে প্যাটেল হায়দ্রাবাদ ও জুনাগড়কে কখনই পাকিস্তানের হাতে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি স্পষ্টতই ভারত ভূখন্ডে স্বাধীন হায়দ্রাবাদের উপস্থিতিকে ভারতের পেটে ক্যানসারের সঙ্গে তুলনা করেন। স্বাধীন হায়দ্রাবাদকে মেনে নিলে যেকোন সময় উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা ছিলো। তাই ভারতের ভৌগলিক অখন্ডতা বজায় রাখার জন্য হায়দ্রাবাদকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয় ছিলো।
দীর্ঘ টালবাহানার পর সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে হায়দ্রাবাদকে দখল করে নেওয়া হয়। পরে ১৯৫০ খ্রিঃ ২৬ শে জানুয়ারী হায়দরাবাদ আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতভুক্ত হয়।
হায়দ্রাবাদের মতো জুনাগড়কেও প্যাটেল হাতছাড়া করার পক্ষপাতী ছিলেন না। জুনাগড় গুজরাত অঞ্চলে অবস্থিত ছিলো, যা প্যাটেলের নিজের এলাকা এবং জন্মভূমি অঞ্চল ছিলো। সুতরাং এই অঞ্চলটির প্রতি তার বিশেষ আবেগ ও দুর্বলতাও ছিলো। শেষপর্যন্ত ১৯৪৮ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি মাসে বিপুল গন ভোটের মাধ্যমে জুনাগড় ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৪৯ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে।
তৃতীয় রাজ্যটি ছিলো কাশ্মীর। কাশ্মীর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য হওয়ায় এবং পাকিস্তান সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় বল্লভভাই প্যাটেল কাশ্মীরকে পাকিস্তানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু নেহেরু কখনই প্যাটেলের সাথে একমত হতে পারেন নি। নেহেরু নিজে একজন কাশ্মীরী পন্ডিত ছিলেন। সুতরাং তার জন্মভূমি অঞ্চল পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত হোক এটা তিনি কখনই চান নি।
তাছাড়া নেহেরুর কাছে কাশ্মীর ছিলো ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক। কাশ্মীরের মতো একটি মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্য যদি ভারতে যোগ দেয়, তাহলে তা জিন্না ও পাকিস্তানের কাছে হবে সজোরে এক চপোটাঘাত। এর ফলে জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের অসাড়তার দিকটি যেমন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করা যাবে। তেমনি কংগ্রেস ও ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকেও বলিষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে।
কাশ্মীরের রাজা ছিলেন হিন্দু। দেশভাগের প্রাক্কালে কাশ্মীরের হিন্দু রাজা হরি সিং স্বাধীন থাকাই শ্রেয় মনে করেছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ খ্রিঃ অক্টোবর মাসে পাকিস্তান একদল সশস্ত্র হানাদার বাহিনী পাঠিয়ে কাশ্মীরের একাংশ দখল করে নিলে ১৯৪৭ খ্রিঃ ২৬ শে অক্টোবর কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করেন।
এইভাবে হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় ও কাশ্মীরকে ভারত ভুক্ত করার ফলে দেশীয় রাজ্য অন্তর্ভুক্তকরনের বৃত্তটি সম্পূর্নতা লাভ করে।
(১০.) ভারতীয় ফরাসি ও পর্তুগিজ উপনিবেশবাদের অবসান :-
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত দেশীয় রাজ্য গুলি ভারতে অন্তর্ভুক্ত হলেও, তখনও ভারতে অনেক ফরাসি ও পর্তুগিজ উপনিবেশ ছিলো। ঐ সমস্ত উপনিবেশ গুলির লোকজন ভারতে যোগদানের জন্য আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকে।
(ক.) ফরাসি উপনিবেশ :-
ভারতে ফরাসিদের উপনিবেশ ছিলো ৩ টি। যথা - বাংলার চন্দননগর, মাদ্রাজের পন্ডিচেরী এবং পশ্চিম উপকূলের মাহে।
ভারত স্বাধীনতা লাভের পর ঐ সমস্ত উপনিবেশগুলি ভারতের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে, ফরাসি সরকার শান্তিপূর্ণ ভাবে ১৯৫৬ খ্রিঃ এই উপনিবেশ গুলি ভারতকে ফিরিয়ে দেয়।
(খ.) পর্তুগিজ উপনিবেশ :-
ভারতে অবস্থিত পর্তুগিজ উপনিবেশ গুলি ছিলো - গোয়া, দমন, দিউ, দাদরা, নগর হাভেলী। ফরাসি সরকার ভারতীয় উপনিবেশ গুলি ভারতের হাতে ফিরিয়ে দিলেও, পর্তুগাল সরকার কখনই তাদের উপনিবেশ গুলি ছেড়ে দিতে রাজি ছিলো না। এর ফলে পর্তুগিজ উপনিবেশকে কেন্দ্র করে সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতপুষ্ট হয়ে পোর্তুগাল গোয়া, দমন, দিউ, নগর হাভেলী প্রভৃতি অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী শাসন চালিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলো।
ভারত শান্তিপূর্ন ভাবে ফরাসি উপনিবেশ গুলির মতোই পর্তুগিজ উপনিবেশ গুলি থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান চেয়েছিলো। কিন্তু পর্তুগিজ উপনিবেশ গুলিতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করলে ভারত সামরিক হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়।
১৯৫৪ খ্রিঃ দাদরা ও নগর হাভেলীর জাতীয়তাবাদীরা ঐ দুটি অঞ্চল থেকে পর্তুগিজ শাসনের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়। ক্রমে গোয়া, দমন ও দিউতে জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করে। ভারতের অহিংস সত্যাগ্রহীরা গোয়ার সাধারন মানুষদের সমর্থনে তাদের আন্দোলনে সামিল হবার জন্য গোয়ায় রওনা দেন।
এই সময় পোর্তুগিজরা সাধারন মানুষের এই গন আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য নৃশংস দমননীতির আশ্রয় নেয়। এই সময় ভারত কিছুটা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল, যাতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তি পোর্তুগালের ওপর চাপ দেয়।
অনেকদিন অপেক্ষা করার পর জওহরলাল নেহেরুর নির্দেশে ১৯৬১ খ্রিঃ ১৭ ই ডিসেম্বর, রাত্রে জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী গোয়া আক্রমণ করে। গোয়ার পোর্তুগিজ গভর্নর জেনারেল বিনা বাধায় আত্মসমর্পণ করেন। পরবর্তীকালে পর্তুগাল সকল ভারতীয় উপনিবেশ গুলিই ভারতের হাতে ফিরিয়ে দেয়। পরবর্তীকালে পর্তুগাল অঞ্চল গুলি ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করে।
(১১.) উপসংহার :-
দেশীয় রাজ্য গুলির ভারতভুক্তি নিঃসন্দেহে ভারতের এক উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সাফল্য ছিলো। জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ ও কাশ্মীরের ভারত ভুক্তি সমস্যা সৃষ্টি করলেও, বল্লভভাই প্যাটেল ও ভি পি মেনন তা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন।
দেশীয় রাজ্য গুলির ভারত ভুক্তি এবং রাজাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সমর্পনের বিনিময়ে ভারত সরকারকে রাজন্য ভাতা হিসাবে ১৯৪৯ খ্রিঃ ৪.৬৬ কোটি টাকা ব্যায় করতে হয়, যা পরে সংবিধানের দ্বারা সুরক্ষিত করা হয়েছিলো। দেশীয় রাজাদের রাজন্যভাতা খাতে এই বিপুল অর্থব্যায়কে অনেকেই সেই সময় সমালোচনা করেন। ভারতের মতো সদ্য স্বাধীন দেশে তা বিরাট আর্থিক বোঝা সৃষ্টি করে।
নব্য স্বাধীন এক গনতান্ত্রিক দেশে রাজন্যপোষন তথা রাজাদের বিপুল ঐশ্বর্য ও ভাতা বড়োই বেমানান ছিলো। এটি বিরোধীদের সমালোচনার একটি বড়ো হাতিয়ারও ছিলো। অবশেষে ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালে রাজন্য ভাতা বিলোপ করা হয়।
তবে মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা, দেশভাগ, ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং উদ্বাস্তুদের আগমনের যুগেই ভারতে দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তিকরনের কঠিন কাজটি সম্পন্ন হয়েছিলো। যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশীয় রাজ্য গুলিকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তার বিনিময় মূল্য হিসাবে রাজন্য ভাতা অতি নগন্যই ছিলো। বস্তুত পক্ষে দেশভাগের ফলে পাকিস্তান গঠনের ফলে ভারত হারায় ৩৬৪.৭৩৭ বর্গমাইল ভূখন্ড এবং প্রায় ৮২ মিলিয়ন জনসংখ্যা। সেখানে দেশীয় রাজ্য গুলির ভারত ভুক্তির ফলে ভারতের লাভ হয়েছিলো ৫ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা ও ৮৭ মিলিয়ন জনসংখ্যা। তাই দেশীয় রাজ্য গুলির অন্তর্ভুক্তি যে দেশভাগের ক্ষতে প্রলেপ দিয়েছিলো, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তির ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের অখন্ডতা যেমন বজায় থাকে। তেমনি দেশীয় রাজ্যের জনগনও দীর্ঘ স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ করেন। দেশীয় রাজ্যের ভারত ভুক্তিতে পাকিস্তানের শক্তি বৃদ্ধির যাবতীয় সম্ভবনারও অঙ্কুরে বিনাষ ঘটে।
বিনা রক্তপাতে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তিকরনের এই অসাধ্য কাজটি করেছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। বিসমার্ক ঠিক যতটা সময় নিয়ে জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন, তার থেকে অনেক কম সময়ে, মাত্র কয়েক মাসেই সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করেন। এদিক থেকে বিচার করে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে অটোভন বিসমার্কের চেয়ে অনেক বেশী সফল ও সর্বোত্তম ব্যক্তিত্ব বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
সবশেষে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সচিব ভি পি মেননের কৃতিত্বের কথাও স্মরন করতে হয়। তার মতো দক্ষ কূটনৈতিক ব্যক্তিত্বকে যদি প্যাটেল সঙ্গে না পেতেন, তবে তার একার পক্ষে কখনই এত অল্প সময়ে দেশীয় রাজ্য গুলিকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হতো না। মেনন একের পর এক দেশীয় রাজ্যে ভ্রমণ ও বারংবার তাদের সঙ্গে বৈঠক করে দেশীয় রাজাদের শক্তিহরন করেন এবং কূটকৌশল প্রয়োগ করে তাদের বশে নিয়ে আসেন। তার এই কাজের ফলে দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তিকরনের কাজটি অনেক সহজ হয়ে যায়।
একঝলকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-
১. ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাশ হয় - ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৮ ই জুলাই।
২. স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ভারতে দেশীয় রাজ্যের সংখ্যা ছিল - ৬০১ টি/ পাঁচ শতাধিক।
৩. দেশীয় রাজ্য গুলি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ভারতে দেশীয় রাজ্য দপ্তর গঠন করা হয় - ১৯৪৭ খ্রিঃ ২৭ শে জুন।
৪. দেশীয় রাজ্য দপ্তরের প্রধান ছিলেন - সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল।
৫. স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সচিব ছিলেন - ভি পি মেনন।
৬. স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন - সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল।
৭. "ভারতের লৌহমানব" ও "ভারতের বিসমার্ক" বলা হয় - সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে।
৮. লর্ড মাউন্টব্যাটনের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন - স্যার কনরাড কর্নফিল্ড।
৯. ভারত ভুক্তি দলিলের নাম হল - "ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকশেসন"।
১০. ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ ই আগস্টের আগে ভারত ভুক্ত হয় নি - জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ ও কাশ্মীর।
১১. কাশ্মীর রাজ্যকে ভারতে অন্তর্ভূক্ত করার প্রশ্নে নেহেরুর সঙ্গে বল্লভভাই প্যাটেলের মতান্তর সৃষ্টি হয়েছিলো।
১২. কাশ্মীরের রাজা ছিলেন - হরি সিং।
১৩. হরি সিং ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করেন - ১৯৪৭ খ্রিঃ ২৬ শে অক্টোবর।
১৪. জুনাগড় গন ভোটের মাধ্যমে (১৯৪৮) ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় - ১৯৪৯ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে।
১৫. জুনাগড় অবস্থিত ছিল - গুজরাটে।
১৬. হায়দ্রাবাদ রাজ্যটি অবস্থিত ছিল - দক্ষিণ ভারতে।
১৭. হায়দ্রাবাদের প্রধান শাসককে বলা হতো - নিজাম।
১৮. হায়দ্রাবাদের ভারত ভুক্তি ঘটানো হয় - সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে।
১৯. হায়দ্রাবাদ রাজ্যটি আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারত ভুক্ত হয় - ১৯৫০ খ্রিঃ ২৬ শে জানুয়ারি।
২০. দেশীয় রাজাদের রাজন্য ভাতার বিলোপ করেন - শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী।
মডেল প্রশ্ন :-
(১.) দেশীয় রাজ্য গুলির ভারত ভুক্তির প্রশ্নটি কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো? দেশীয় রাজ্য গুলির ভারতভুক্তি প্রক্রিয়াটি আলোচনা করো।
(২.) ভারত সরকার কিভাবে দেশীয় রাজ্য গুলিকে ভারতীয় ইউনিয়নে সংযুক্ত করার প্রশ্নটির সমাধান করেছিলো?
(৩.) স্বাধীন দেশীয় রাজ্য গুলিকে ভারত কিভাবে ভারত ভুক্ত করেছিলো?
(৪.) দেশীয় রাজ্য গুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ কিভাবে সফল হয়েছিলো?
(৫.) ভারতের সঙ্গে দেশীয় রাজ্য গুলির সংযুক্তকরনের ব্যাপারে বল্লভভাই প্যাটেলের ভূমিকা কি ছিলো?
(৬.) দেশীয় রাজ্য গুলির ভারত ভুক্তির মূলে কি সমস্যা ছিলো? কীভাবে এর সমাধান করা হয়?
গ্রন্থঋন :-
১. গাঁধী - উত্তর ভারতবর্ষ - রামচন্দ্র গুহ।
২. ভারত ইতিহাস পরিক্রমা - প্রভাতাংশু মাইতি ও অসিত কুমার মন্ডল।
৩. আধুনিক ভারতের ইতিহাস - ড. রতন কুমার বিশ্বাস।
৪. ভারতের ইতিহাস (আধুনিক যুগ ১৭০৭ - ১৯৬৪) - তেসলিম চৌধুরী।
৫. আধুনিক ভারত (পলাশি থেকে নেহরু) - সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়।
৬. আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৭০৭ - ১৯৬৪) - সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়।
৭. আধুনিক ভারতের রূপান্তর - সমর কুমার মল্লিক।
৮. ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দশক - দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়।
৯. ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান, প্রস্তুতি ও পরিনতি - সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়।
১০. জওহরলাল নেহেরু, স্বাধীনতার আগে এবং পরে - শ্যামাপ্রসাদ বসু।