দেশীয় রাজ্য গুলির মধ্যে কাশ্মীরের ভারত ভুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বেশি জটিল পরিস্থিতির জন্ম হয়, যার আজও নিষ্পত্তি ঘটে নি। কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তিকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ত হয়ে ওঠে এবং দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার যুদ্ধও সংঘটিত হয়।
কাশ্মীর রাজ্যের ভারতভুক্তি |
(১.) কাশ্মীরের ভৌগলিক অবস্থান ও রাজ্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় :-
দেশীয় রাজ্য গুলির মধ্যে কাশ্মীরের ভৌগোলিক অবস্থান ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রেরই একেবারে সীমান্তে অবস্থিত ছিলো। প্রায় চারদিক থেকে আন্তর্জাতিক সীমানা থাকায় জন্মু - কাশ্মীর রাজ্যটির অবস্থানগত গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম।
কাশ্মীরের পশ্চিমদিকে ছিলো পাকিস্তান। দক্ষিণ দিকে ছিলো ভারত। উত্তর পূর্ব দিকে ছিলো চিন এবং উত্তর পশ্চিম দিকে ছিলো আফগানিস্তান। এককথায় বলতে গেলে এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির ভৌগোলিক মধ্যস্থলে অবস্থিত ছিলো কাশ্মীর রাজ্যটি।
ভারতের দেশীয় রাজ্য গুলির মধ্যে আয়তনের দিক থেকে কাশ্মীরই ছিলো সবচেয়ে বড়ো দেশীয় রাজ্য। এর আয়োতন ছিলো ৮৪,৪৭১ বর্গমাইল, যা হায়দ্রাবাদের থেকেও বেশি। কাশ্মীরের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগনই ছিলেন মুসলমান, কিন্তু রাজা ছিলেন হিন্দু।
ডোগরা রাজপুতদের একটি শাখা দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীরে রাজত্ব চালিয়ে আসছিলো। এই রাজবংশেরই লোক ছিলেন হরি সিং। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভের সময় কাশ্মীরের রাজা ছিলেন হরি সিং। হরি সিং কেমন লোক ছিলেন, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে একদা তাঁর চতুর্থ ও সর্বকনিষ্ঠা রানী অভিযোগের সুরে বলেছিলেন -
"ওই তো ওঁর দোষ - উনি দেশের লোকের সঙ্গে কখনও মেলামেশা করেন না। চারপাশে কতকগুলো মোসায়েব আর পেটোয়া লোকেদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে বসে থাকেন। বাইরের জগতে যে কী ঘটছে তা কখনও ঠিক করে জানতেই পারেন না।"
বস্তুতপক্ষে অন্যান্য দেশীয় রাজাদের মতোই কাশ্মীরের মহারাজাও ছিলেন জনবিচ্ছিন্ন। নিজামের শাসনে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের যে বৈশিষ্ট্য গুলো দেখা গিয়েছিলো, তার হুবহু প্রতিচ্ছবি কাশ্মীরেও দেখা যায়। হিন্দু শাসিত হওয়ায় কাশ্মীরের সরকারি চাকুরিতে ও প্রশাসনে হিন্দুদেরই প্রাধান্য ছিলো। রাজ্যের সংখ্যা গরিষ্ঠ প্রজা মুসলমান হলেও, শুধুমাত্র ধর্মীয় কারনে তারা বিদ্বেষের শিকার হয় এবং চাকুরি ও সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই, কাশ্মীরের মহারাজার বিরুদ্ধে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠদের মনে ক্রমাগত ক্ষোভ জমতে থাকে। সেই ক্ষোভকে সংগঠিত করার জন্য কাশ্মীরেরই এক যুবক, শেখ আবদুল্লা কাশ্মীরে "ন্যাশনাল কনফারেন্স" নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। কাশ্মীরে রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ আবদুল্লা ও তার "ন্যাশনাল কনফারেন্স" পার্টি ধারাবাহিক ভাবে কাশ্মীরে আন্দোলন চালিয়ে যান। এর ফলে ১৯৪০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে শেখ আবদুল্লা কাশ্মীরের একজন প্রধান ও সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিনত হন।
শেখ আবদুল্লা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও, চিন্তাধারার দিক থেকে অত্যন্ত উদার ছিলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেখ আবদুল্লার সঙ্গে জওহরলাল নেহেরুর বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। শেখ আবদুল্লা ও নেহেরু দুজনেই রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতার বিরোধী ছিলেন।
(২.) হরি সিং এর স্বাধীন থাকবার সিদ্ধান্ত :-
কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং এর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রামচন্দ্র কাক। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন যখন পাশ হলো, তখনই মহারাজের কানে স্বাধীনতার ফুসমন্ত্ররটি কাক গুঁজে দেন। মূলত তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েই হরি সিং কাশ্মীরকে স্বাধীন রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
১৫ ই আগস্টের আগে লর্ড মাউন্টব্যাটন যখন হরি সিংকে ভারত অথবা পাকিস্তান, কোন একটি যোগ দিতে অনুরোধ করেন, তখন সেই অনুরোধ হরি সিং পত্রপাঠ খারিজ করে দেন। এমনিতেই সব দেশীয় রাজাদের মতো হরি সিংও কংগ্রেসকে ভীষণ ভাবে ঘৃনা করতেন।
হরি সিং মাউন্টব্যাটনকে পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেন, কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় তা কোন রাষ্ট্রেরই ভৌগলিক সংহতি বিপন্ন করে না। তাই কাশ্মীর স্বাধীনই থাকবে। বারংবার অনুরোধ করিয়েও কাশ্মীরের মহারাজাকে রাজী করানো গেলো না।
আসলে হরি সিং খুব ভালো করেই জানতেন, কাশ্মীর যদি ভারতে যোগ দেন, তাহলে সেখানকার গনতান্ত্রিক শাসন কাঠামোতে তিনি আর রাজা থাকতে পারবেন না। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ঘোষিত অবস্থান ছিলো প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা ও গনতন্ত্র। সুতরাং স্বাধীন ভারতবর্ষে কংগ্রেস কখনই হরি সিংকে মেনে নেবে নেবে না।
আবার অন্যদিকে হরি সিং যদি পাকিস্তানে যোগ দেন, তবে পাকিস্তানের মতো একটি মুসলিম রাষ্ট্র কখনই একজন হিন্দু রাজাকে মেনে নেবে না। ভারত ও পাকিস্তান দুই দিকেই নিজ রাজবংশের অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখে হরি সিং স্বাধীন থাকাই শ্রেয় বলে মনে করলেন।
তিনি ভেবে ছিলেন, কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় তা কোন রাষ্ট্রেরই ভৌগলিক সংহতি বা জাতীয়তাবাদী আদর্শকে খন্ডিত করবে না। ফলে কাশ্মীর স্বাধীন অবস্থান নিলে তা ভারত ও পাকিস্তান কারো কাছেই বিশেষ মাথাব্যাথার কারন হবে না।
বলা বাহুল্য, কাশ্মীর প্রশ্নে মহারাজা হরি সিংয়ের একেবারে বিপরীত অবস্থান নিয়েছিলেন শেখ আবদুল্লা ও ন্যাশনাল কনফারেন্স। তারা কাশ্মীরের ভারতভুক্তিকে সমর্থন করে ও তার স্বপক্ষে জোরালো বক্তব্য পেশ করে।
(৩.) কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান ও মত :-
বলা বাহুল্য, কাশ্মীরের স্বাধীন থাকাটা ভারত বা পাকিস্তান কাউকেই বিশেষ খুশি করতে পারলো না। আন্তর্জাতিক মানচিত্রে কাশ্মীরের ভৌগলিক অবস্থানের একটি গুরুত্ব ছিলো, যা আগেই আমরা বলেছি। এই ভৌগোলিক গুরুত্বের কারনে ভারত ও পাকিস্তান দুটো দেশই চাইছিলো কাশ্মীর তাদের দেশের সঙ্গে মিশে যাক।
(ক.) ভারতের অবস্থান :-
কাশ্মীর প্রশ্নে প্রথমদিকে ভারতের অবস্থান ছিলো ভিন্ন। দেশীয় রাজ্য গুলিকে ভারতভুক্ত করার কারিগর সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল প্রথম দিকে কাশ্মীরকে ভারতে অন্তর্ভূক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে তার মত ছিলো কাশ্মীর একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ এবং এটি পাকিস্তানের সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় কাশ্মীর হাতছাড়া হলে ভারতের ভৌগোলিক সংহতি বিপন্ন হওয়ারও কোন সম্ভাবনা ছিলো না। তাই কাশ্মীর প্রশ্নে প্যাটেল প্রথম দিকে কিছুটা নরম মনোভাব নিয়েছিলেন।
যদিও কাশ্মীর অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে প্রথমদিকে জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মতান্তর ঘটে। নেহেরু কোন মতেই কাশ্মীরকে পাকিস্তানের হাতে ছেড়ে দেবার পক্ষপাতী ছিলেন না। নেহেরু নিজে ছিলেন একজন কাশ্মীরী পন্ডিত। সুতরাং তাঁর জন্মভূমি অঞ্চল পাকিস্তানের অন্তভূক্ত হোক বা স্বাধীন থাক এটা কখনই তিনি চান নি।
তাছাড়া নেহেরুর কাছে কাশ্মীর ছিলো ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক। কাশ্মীরের মতো একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ যদি ভারতে যোগ দেয়, তাহলে এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের ভ্রান্তিকে ভারতীয় উপমহাদেশ ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে, তেমনি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের বলিষ্ঠতা ও গ্রহনযোগ্যতাকেও আরোও দৃঢ়তর ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে।
কাশ্মীর প্রশ্নে প্যাটেল যে মনোভাব নিয়েছিলেন, তা অবশ্য অল্প কিছুকালের মধ্যেই ভেঙ্গে যায়। পাকিস্তান হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ জুনাগড়কে পাকভুক্ত করবার চেষ্টা করলে, পাকিস্তান সম্পর্কে প্যাটেলের সব ধারনা ভেঙে যায়। এর ফলে কাশ্মীর সম্পর্কে প্যাটেল তার মত পাল্টান এবং কাশ্মীরকে ভারতে যুক্ত করতে রাজি হয়ে যান।
(খ.) পাকিস্তানের অবস্থান :-
কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের অবস্থান প্রথম থেকেই ছিলো অত্যন্ত স্পষ্ট। কাশ্মীর ছিলো একটি মুসলিম প্রধান অঞ্চল। এটি পাকিস্তানের সীমান্তেই অবস্থিত। সুতরাং দ্বিজাতি তত্ত্ব অনুসারে কাশ্মীরের পাকিস্তানে যোগ দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত বলে পাকিস্তানীরা মনে করতো।
তাছাড়া, পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গেও কাশ্মীরের একটি যোগ ছিলো বলে পাকিস্তানীরা বিশ্বাস করতো। ১৯৩০ খ্রিঃ চৌধুরী রহমত আলি নামে এক ব্যক্তি "নাও অর নেভার" পুস্তিকায় সর্বপ্রথম ভারতের ৫ টি মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশকে নিয়ে পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানান। বস্তুতপক্ষে ৫ টি মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলির আদ্যাক্ষর নিয়েই পাকিস্তান নামটির সৃষ্টি হয়েছিলো। এই প্রদেশ গুলি ছিলো - পাঞ্জাব (P), আফগান প্রদেশ বা উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ(A), কাশ্মীর (K), সিন্ধু(S), বালুচিস্তান(TAN)।
বলা বাহুল্য, নবগঠিত পাকিস্তানে পাঞ্জাব, আফগান প্রদেশ, সিন্ধু ও বালুচিস্তান যুক্ত হলেও, কাশ্মীর অধরা থেকে গিয়েছিলো। তাই পাকিস্তানীরা মনে করতো পাক জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তান রাষ্ট্র কোনটিই পূর্নতা লাভ করে নি। একমাত্র কাশ্মীর ভারতভুক্ত হলেই এটি সম্ভব হবে। তাই পাকিস্তান নামের ও আন্দোলনের স্বার্থকতা প্রদানের জন্য কাশ্মীরকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি বলে পাকিস্তান মনে করতো।
(৪.) কাশ্মীরের স্থিতাবস্থা চুক্তি :-
১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের পরিস্থিতি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো। রাজদ্রোহের অপরাধে কাশ্মীরে ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা শেখ আবদুল্লাকে হরি সিং গ্রেপ্তার করেন এবং তিন বছর কারাদন্ড দেন। আবদুল্লার মুক্তির অনুরোধ জওহরলাল নেহেরু, মহাত্মা গান্ধী করলেও মহারাজা তা প্রত্যাখান করেন।
১৯৪৭ সালে ১৫ ই আগস্টের মধ্যেই হরি সিং ভারত ও পাকিস্তানের কাছে কাশ্মীরের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট করে তুলে ধরেন। তিনি ঘোষনা করেন, কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক নিয়ে চলবার নীতিতে বিশ্বাসী। কাশ্মীর ভারত বা পাকিস্তান কোনপক্ষেই যোগ দেবে না। একমাত্র একটি ক্ষেত্রেই এই সিদ্ধান্ত বদল হতে পারে, যদি ভারত বা পাকিস্তানের কোন একটি কাশ্মীর আক্রমণ করে।
কাশ্মীর প্রশ্নে এইভাবে সুকৌশলে ভারত - পাকিস্তানের কোর্টে বল ঠেলে দিয়ে দুই রাষ্ট্রকেই হরি সিং কাশ্মীরের স্বাধীনতার স্বপক্ষে চাপে রাখার নীতি নিলেন। তিনি দুই রাষ্ট্রের কাছেই অনুরোধ করলেন, কাশ্মীর ভারত ভুক্ত বা পাক ভুক্ত কোন দলিলেই বা চুক্তিতে সই করবে না। এর বদলে উভয় রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি স্থিতাবস্থা চুক্তি করতে আগ্রহী। এই চুক্তি অনুযায়ী সীমান্তের দুই পাড়ের লোকজন মালপত্র নিয়ে অবাধে যাতায়াত করতে পারবে।
পাকিস্তান স্থিতাবস্থা চুক্তি করলেও, ভারত কোন চুক্তি না করেই ধৈর্য ধরে অবস্থাটা বুঝে নিতে চাইলো।
(৫.) পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীরের সম্পর্কের অবনতি :-
পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীরের স্থিতাবস্থা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, একমাসের মধ্যেই পাকিস্তান তা অস্বীকার করতে শুরু করে। ১৯৪৭ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান জন্মুর সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। পশ্চিম পাঞ্জাবের সিয়ালকোট আর জন্মুর মধ্যে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কাশ্মীর রাজ্যের জন্য মালপত্র নিয়ে যাওয়া লরিগুলোকে সীমান্তেই পাকিস্তান আটকে দিলো। এর ফলে সারা রাজ্যে খাদ্য সংকট দেখা দিলো। এর পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীরের সম্পর্কেরও অবনতি ঘটতে শুরু করলো।
এই সমস্যার সমাধানের জন্য হরি সিং পর পর বেশ কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীকে পরপর নিয়োগ ও বরখাস্ত করেন। রামচন্দ্র কাক এই সমস্যার কোন সমাধান করতে না পারায় কাককে বিদায় করে জনক সিংহ নামে এক সেনাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। কিছুদিন পরে তাকেও বিদায় করে পাঞ্জাব হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারক মেহেরচাঁদ মহাজনকে কাশ্মীরের নতুন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়।
বলা বাহুল্য, এরা কেউই সমস্যার কোন সমাধান করতে পারলো না। আসলে কাশ্মীরের প্রতি পাকিস্তান প্রথমে ভাতে মেরে হাতে মারার নীতি নিয়েছিলো। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকেই সেটা খুব ভালো ভাবে টের পাওয়া গেলো। কাশ্মীরের ওপারে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় মুসলিম মৌলবাদীদের চিৎকার আর গলার আওয়াজ বড়ো বেশি করে এইসময় শোনা যেতে লাগলো। মুসলিম মোল্লা ও ইমামরা একের পর এক জলশা আর সভা সমাবেশে পাকিস্তানি মুসলিমদের তাতিয়ে তুলতে লাগলো।
১৯৪৭ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসে কাশ্মীরের পুঞ্চ অঞ্চলের মুসলমান প্রজারা হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে জঙ্গি বিদ্রোহে সামিল হয়। ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৪ ই আগস্ট এখানকার মুসলমানরা তাদের এলাকায় পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে "পাকিস্তান জিন্দাবাদ" শ্লোগান দিয়েছিলো। পুঞ্চ অঞ্চলটিতে ডোগরা রাজবংশেরই একটি শাখা শাসন করতো। ১৯৩৬ খিঃ এই অঞ্চলটি হরি সিং দখল করে নেন এবং এখানে নতুন নতুন কর বসান। এর ফলে হরি সিং এর বিরুদ্ধে এখানকার মুসলিমদের ক্ষোভ ১৯৩৬ সাল থেকেই একটু একটু করে বাড়ছিলো। পুঞ্চ অঞ্চলের মুসলমানরা মনে করতো হরি সিং তাদের স্বশাসনের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক পরিবেশে সেই ক্ষোভ স্বাধীনতার দাবিতে পরিনত হতে বেশি সময় লাগে নি।
এদিকে ভারতের গোয়েন্দা দফতরে খবর এলো পাকিস্তান গোপনে কয়েকহাজার জেহাদিকে কাশ্মীরে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। ১৯৪৭ খ্রিঃ নেহেরু প্যাটেলকে কাশ্মীরের এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির কথা জানিয়ে এক লম্বা চিঠি লেখেন। কাশ্মীরের মহারাজার কাছে যখন হানাদারদের খবর এসে পৌঁছালো তখন অবশ্য অনেক দেরি হয়ে গেছে।
হরি সিং এই সময় বুঝতে পারলেন এই অবস্থায় ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটা প্রয়োজন। এই সময় কেউ একজন হরি সিংকে সুবুদ্ধি দিয়ে বলেছিলেন, মহারাজার একার পক্ষে কখনই পাক হানাদারদের আক্রমণ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এর পাশাপাশি ভারতের সাহায্যও দরকার। ভারতকে বার্তা দেওয়ার জন্য শেখ আবদুল্লাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়াটা দরকার। শেখ আবদুল্লা জেল থেকে ছাড়া পেলে ভারতকে বার্তা দিয়ে তার সাহায্য লাভও সহজ হবে।
১৯৪৭ খ্রিঃ ২২ শে সেপ্টেম্বর, শেখ আবদুল্লাকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই সময় আবদুল্লা এক বিশাল জনসভায় দাবি করেন, কাশ্মীরের জনগনের হাতে সমস্ত ক্ষমতা তুলে দেওয়া হোক। গনতান্ত্রিক কাশ্মীরের জনগনই তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন কাশ্মীর ভারত না পাকিস্তান কোন পক্ষে যোগ দেবে।
(৬.) পাক হানাদার বাহিনীর কাশ্মীর আক্রমণ :-
১৯৪৭ খ্রিঃ ২২ শে অক্টোবর, পাক মদতপুষ্ট পাঠান ও অন্যান্য উপজাতিদের নিয়ে গঠিত পাকিস্তানের কয়েকহাজার দলের এক হানাদার বাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে এর বেশ কিছুটা অংশ দখল করে নেয়। হানাদাররা বিদ্যুৎবেগে ধাবিত হয়ে ঝিলম উপত্যকা পর্যন্ত ও শ্রীনগরের কাছাকাছি এলাকায় পৌঁছে যায়। এই সময় অবস্থা বেগতিক দেখে হরি সিং ভারতের মুখাপেক্ষি হন।
(৭.) হরি সিং এর ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর :-
১৯৪৭ সালের ২৪ শে অক্টোবর, মহারাজা হরি সিং ভারত সরকারের কাছে সামরিক সাহায্য চেয়ে একটি তারবার্তা পাঠান। পরদিন সকালে অর্থাৎ ২৫ শে অক্টোবর, নয়াদিল্লিতে ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা কমিটির অধিবেশন বসে। ঠিক হয় ভি পি মেনন কাশ্মীরে গিয়ে পুরো অবস্থাটা সরেজমিনে দেখার পরই ভারত সিদ্ধান্ত নেবে।
ভি পি মেনন কাশ্মীরে গিয়ে হরি সিং এর সঙ্গে দেখা করে তাকে ভারত ভুক্তি দলিলে সই করার অনুরোধ করেন। মহারাজা রাজি হয়ে গেলে তাকে বিমানে করে নিরাপদে রাখার জন্য দিল্লিতে আনা হয়। ২৬ তারিখে (১৯৪৭ খ্রিঃ ২৬ শে অক্টোবর) মহারাজা হরি সিং ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করেন। ঐ দিনই ভারতের প্রতিরক্ষা দপ্তর হরি সিং ও শেখ আবদুল্লার সঙ্গে বৈঠকে বসে। শেখ আবদুল্লা ও তার পার্টি ন্যাশনাল কনফারেন্স কাশ্মীরের ভারত ভুক্তিকে সমর্থন করে দ্রুত কাশ্মীর পুনরুদ্ধারের জন্য ভারত সরকারকে সেনা পাঠাতে অনুরোধ করে।
(৮.) ভারতের কাশ্মীর পুনরুদ্ধার :-
১৯৪৭ খ্রিঃ ২৭ শে অক্টোবর, কয়েকশ ভারতীয় বিমান বাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে। সেনাদের একটি অংশ কাশ্মীরে হানাদারদের হটানোর জন্য যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অপর অংশ আহত শরনার্থীদের ভারতে নিয়ে আসতে থাকে।
এদিকে কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্য ঢুকে পড়ার সংবাদে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ আলি জিন্না রেগে বোম অথবা আগুন হয়ে গেলেন। তিনি পাক সেনাবাহিনীকে কাশ্মীরে ঢুকে যেতে বললেন। কিন্তু পাক বাহিনীর ব্রিটিশ সেনা প্রধান এই সময় জিন্নার নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করেন। কিন্তু অফিসাররা তলে তলে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে থাকলেন এবং সবরকম সাহায্য করতে লাগলেন।
কাশ্মীরে যখন যুদ্ধ চলছিলো, তখন লর্ড মাউন্টব্যাটন পাকিস্তানে গিয়ে জিন্নার সঙ্গে এক বৈঠক করেন। এই বৈঠকে জিন্না স্পষ্টতই জানিয়ে দেন, ভারত যদি জুনাগড়ের ওপর তার দাবি ছেড়ে দেয়, তাহলে তিনি কাশ্মীরের দাবির বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখবেন। ভারতের পক্ষে এই সমঝোতা করা কখনই সম্ভব ছিলো না। এদিকে জওহরলাল নেহেরুর নির্দেশে এই সময় শেখ আবদুল্লার নেতৃত্বে দিল্লিতে কাশ্মীর সরকার গঠনের তোড়জোড়ও শুরু হয়ে যায়। ১৯৪৭ খ্রিঃ ১১ ই নভেম্বর, জওহরলাল নেহেরু কাশ্মীরের প্রাক্তন মহারাজা হরি সিং কে এক চিঠি লিখে শেখ আবদুল্লার প্রতি পূর্ন আস্থা জ্ঞাপন করতে বলেন।
(৯.) সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে কাশ্মীর সমস্যা উত্থাপন :-
এই সময় পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াবার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটনের পরামর্শে জওহরলাল নেহেরু কাশ্মীরে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ বন্ধের দাবি জিনিয়ে বিষয়টি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করেন। ১৯৪৭ খ্রিঃ ৩১ শে ডিসেম্বর কাশ্মীর সমস্যার বিষয়টি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে তোলা হয়।
ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে হানাদারদের বিতাড়িত করে যখন দখলীকৃত কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশ পুনরুদ্ধার করে ঠিক তখনই জওহরলাল নেহেরু কাশ্মীর সমস্যার বিষয়টি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে উত্থাপন করে। ভুল সময়ে কাশ্মীর সমস্যার বিষয়টি জাতিপুঞ্জে তোলায় কাশ্মীর নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়, আজও তার সমাধান সম্ভব হয় নি।
নেহেরুর মধ্যে ধৈর্যের বড়োই অভাব ছিলো। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরেকটু সময় দিলে অথবা বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করলে ভারতীয় বাহিনী সমগ্র কাশ্মীর ভূখন্ডই পুনরুদ্ধার করতে পারতো। কিন্তু নেহেরুর অদূরদর্শিতার জন্য পরবর্তীকালে কাশ্মীর নিয়ে বিরাট জটিলতা সৃষ্টি হয়, যার সমাধান আজও সম্ভব হয় নি।
(১০.) কাশ্মীর সমস্যায় জাতিপুঞ্জের ভূমিকা :-
কাশ্মীর সমস্যা জাতিপুঞ্জে উত্থাপিত হলে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ -
(ক.) ১৯৪৮ খ্রিঃ ৩১ শে ডিসেম্বর, কাশ্মীরে যুদ্ধ বিরতি ঘোষনা করে এবং যুদ্ধ বিরতি সীমারেখা বরাবর অর্থাৎ ভারত ও পাকিস্তানের দখলিকৃত অংশের মাঝে নিয়ন্ত্রনরেখা টেনে দেয়। একে বলে L. O. C বা "Line of Control"। বলা হলো ভারত ও পাকিস্তান কেউই LOC অতিক্রম করে কাউকে আক্রমণ করবে না বা আগ্রাসন চালাবে না।
(খ.) কাশ্মীরের দখলীকৃত অংশে নিয়ন্ত্রনরেখা টানার ফলে পাকিস্তানের দখলে কাশ্মীরের বেশ কিছুটা ভূখন্ড থেকে গেলো। পাকিস্তানে থাকা কাশ্মীরের ঐ ভূখন্ডের নাম পাকিস্তান দিল - "আজাদ কাশ্মীর"। অন্যদিকে ভারত এর নামকরন করে - "পাক অধিকৃত কাশ্মীর"। পাকিস্তান পাক অধিকৃত কাশ্মীরে একটি সমান্তরাল সরকার গঠন করে ভারত ভুক্ত কাশ্মীরের ওপর কয়েক দশক ধরে আক্রমণ ও আগ্রাসন চালাতে থাকে।
(গ.) ভারতের দখলে থাকা সমগ্র কাশ্মীরের জন্য পরবর্তীকালে শেখ আবদুল্লার নেতৃত্বে একটি জরুরি সরকার গঠিত হয়। এই সরকার কাশ্মীরের ভারত ভুক্তিকে সমর্থন করে।
(ঘ.) জাতিপুঞ্জ কাশ্মীর সমস্যার নিরসনের জন্য গনভোটের প্রস্তাব দেয়। ঠিক হয়, গনভোটেই সিদ্ধান্ত হবে, কাশ্মীর ভারত না পাকিস্তানে যোগ দেবে না স্বাধীন থাকবে।
(ঙ.) গনভোটের পূর্ব শর্ত হিসাবে পাকিস্তানকে তার দখলিকৃত অংশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে বলা হয়। ভারতকেও কাশ্মীরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সেনা রাখতে নিষেধ করা হয়। পাকিস্তান কাশ্মীর থেকে সেনা প্রত্যাহার না করায় কাশ্মীরে কখনই গনভোটের আয়োজন করা সম্ভব হয় নি।
(চ.) ১৯৫৪ খ্রিঃ জন্মু - কাশ্মীরের নির্বাচিত গনপরিষদ কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে ঘোষনা করায় ভারত গনভোটের প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। এর ফলে কাশ্মীর সমস্যার আজও কোন সমাধান হয় নি। ১৯৪৭ সালে পাক হানাদারদের দখলীকৃত কাশ্মীরের একটা অংশ পাকিস্তানের দখলে রয়ে যায়।
কাশ্মীর রাজ্যের বর্ধমান চিত্র |
(১১.) কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি :-
কাশ্মীরকে ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত করতে ভারত সরকার ১৯৪৯ খ্রিঃ ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে। ৩৭০ হলো ভারতীয় সংবিধানের একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা বা টেম্পুরারি প্রভিশন। এই ধারায় জন্মু কাশ্মীরকে ভারতে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিলো।
সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, অর্থ এবং যোগাযোগ ব্যতিত অন্য কোন বিষয়ে ভারত সরকার জন্মু কাশ্মীরে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী, কাশ্মীর রাজ্য পৃথক পতাকা, সংবিধান, আইন রচনা ও স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার লাভ করে।
এই অনুচ্ছেদের ৩৫ নং ধারাতে কাশ্মীরের নাগরিকরাও বিশেষ সুবিধা লাভ করেন। এই ধারায় বলা হয় ভারতের অন্য রাজ্যের বাসিন্দারা কাশ্মীরে জমি ক্রয় করতে পারবেন না। অবশিষ্ট ভারতের কোন নাগরিকরাই কাশ্মীরে চাকুরির আবেদন করতে বা চাকরি করতে পারবেন না। এমনকি কাশ্মীরের কোন মহিলা যদি ভারতের কোন পুরুষকে বিবাহ করেন, তাহলে ঐ নারীও কাশ্মীরের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। এই ভাবে ৩৭০ ধারার মধ্য দিয়ে কাশ্মীরকে অবশিষ্ট ভারত থেকে অবরুদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হয়েছিলো।
১৯৪৭ সালে জন্মু কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন অবস্থাতেই ৩৭০ ধারার খসড়া তৈরি করে রেখেছিলেন শেখ আবদুল্লা। তাকে কাশ্মীরে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ করেছিলেন মহারাজা হরি সিং ও জওহরলাল নেহেরু। আবদুল্লা স্থায়ী ভাবে ৩৭০ ধারা মেনে নেওয়ার শর্তে কাশ্মীরের ভারত ভুক্তিকে সমর্থন করেন। অবশেষে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর নেহেরু আবদুল্লার ৩৭০ নং দাবিপত্রকে অস্থায়ী ভাবে মেনে নেন ও তাকে ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন।
কাশ্মীরের ৩৭০ নং ধারার তীব্র বিরোধিতা করেন নেহেরু মন্ত্রীসভারই অন্যতম সদস্য ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি হুংকার দিয়ে বলে ওঠেন - "এক দেশমে দো বিধান, (দুটি সংবিধান) দো প্রধান (দু জন প্রধানমন্ত্রী) অউর দু নিশান (দুই পৃথক পতাকা) নেহি চলেগা।"
পরবর্তীকালে ৩৭০ ধারার প্রতিবাদে ৩৭০ ধারাকে অস্বীকার করে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কাশ্মীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে আবদুল্লা প্রশাসন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে গ্রেপ্তার করে। এর কিছুদিন পরে কাশ্মীরেই রহস্যজনক ভাবে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় নেহেরু সরকার মুখে কুলুপ এঁটে থাকে।
যাইহোক, পরবর্তীকালে কাশ্মীর দখলকে কেন্দ্র করে ভারত - পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৪৭ খ্রিঃ, ১৯৬৫ খ্রিঃ, ১৯৭১ খ্রিঃ ও ১৯৯৯ খ্রিঃ পর পর যুদ্ধ হয়। প্রত্যেকটি যুদ্ধেই পাকিস্তান শোচনীয় ভাবে পরাস্ত হয়। দীর্ঘ কয়েক দশক পর ২০১৯ খ্রিঃ ৫ ই আগস্ট ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দল ("জনসংঘ" যার নাম পরবর্তীকালে হয় ভারতীয় জনতা পার্টি বা বি জে পি) এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়। ঐ দিন ভারতের বিজেপি শাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি জন্মু কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরকে দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে ভাগ করেন।
এক ঝলকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-
- দেশীয় রাজ্য গুলির মধ্যে আয়তনে সবথেকে বড়ো রাজ্য ছিলো - কাশ্মীর।
- কাশ্মীরের রাজা ছিলেন - হরি সিং।
- কাশ্মীর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য হলেও এর রাজা ছিলেন হিন্দু।
- ন্যাশনাল কনফারেন্স ছিলো - কাশ্মীরের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল।
- ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ছিলেন - শেখ আবদুল্লা।
- ১৯৪৭ খ্রিঃ ২৬ শে অক্টোবর, কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ভারত ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করেন।
- ১৯৪৭ খ্রিঃ ৩১ সে ডিসেম্বর, ভারত কাশ্মীর সমস্যার বিষয়টি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে উত্থাপন করে।
- ১৯৪৭ সালে পাক হানাদার বাহিনী কাশ্মীরের একাংশ দখল করে নেয়।
- পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ভূখন্ডকে পাকিস্তান "আজাদ কাশ্মীর" এবং ভারত "পাক অধিকৃত কাশ্মীর" নামে অভিহিত করে।
- কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত - পাকিস্তান যুদ্ধ হয় - ১৯৪৭ খ্রিঃ, ১৯৬৫ খ্রিঃ, ১৯৭১ খ্রিঃ ও ১৯৯৯ খ্রিঃ। প্রত্যেকটি যুদ্ধেই পাকিস্তান ভারতের কাছে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়
- L. O. C হল - "Line of Control" বা যুদ্ধ বিরতি সীমারেখা বা নিয়ন্ত্রণ রেখা।
- ১৯৪৮ খ্রিঃ ৩১ সে ডিসেম্বর, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি ঘোষনা করে যুদ্ধ বিরোধী যে ভৌগলিক সীমারেখা নির্দেশ করে, তাকেই LOC বা লাইন অফ কন্ট্রোল বলে।