আগের পর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি, চট্টগ্রামে "অস্ত্রাগার লুন্ঠনের" পর সকল বিপ্লবীরা পুলিশ লাইনে এসে সমবেত হয় এবং একটি অস্থায়ী সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এই সরকার অবশিষ্ট ভারতের জন্য এবং নিজেদের সাফল্যকে ধরে রাখবার জন্য ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
অন্যদিকে ১৯৩০ খ্রিঃ ১৮ ই এপ্রিল ঐ রাতেই চট্টগ্রামের আতঙ্কিত ইংরেজ সাহেবরা চট্টগ্রাম বন্দরে আশ্রয় নেয়। চট্টগ্রাম বন্দর বিপ্লবীদের অবরোধ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলো। এটি বিপ্লবীদের রনকৌশলের একটি বিরাট বড় ভুল বা ফাঁক ছিলো, এটি আমরা আগেই বলেছি। অবশেষে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আক্রমণ নেমে এসেছিলো রাত্রি ১২ টায়।
কী হয়েছিলো সেই রাতে? কেমন ভাবে ইংরেজরা বিপ্লবীদের মোকাবিলা করেছিলেন? বিপ্লবীদের শেষ পরিনতিই বা কি হয়েছিলো? এসবকিছু নিয়েই সাজানো আমাদের আজকের অন্তীম পর্ব - "বিপ্লবের শেষ পরিনতি"।
বিপ্লবের শেষ পরিনতি
(১.) চট্টগ্রাম বন্দরের যুদ্ধ :-
চট্টগ্রামের বিরাট অভ্যুত্থানের সংবাদ যখন চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায় তখন অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। শেষে রাত্রি প্রায় ১২ টার সময় বাংলাদেশের পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টার জেনারেল ফারমার সাহেব, চট্টগ্রাম পুলিশের সুপারিনটেন্ডেন জনসন সাহেব এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন ও বারাক্লাফ্ নামে একজন সেনা অফিসার এই মোট চারজন একত্রিত হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটির অস্ত্রাগার থেকে একটি মেশিনগান জোগাড় করেন। এরপর একটি জলের ট্যাঙ্কের ওপর উঠে বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে মুহুরমুহু গুলি বর্ষন করেন।
বিপ্লবীরা মাস্কেট বন্দুকে করে পাল্টা গুলি বর্ষন করতে থাকে। তারা একটি বোমাও নিক্ষেপ করে, যদিও সেটি ফাটে নি। তবে শেষ পর্যন্ত মেশিনগানের গুলির সামনে দাঁড়াতে না পেরে বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকে পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। পিছু হটবার সময় তারা পুলিশ ব্যারাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন লাগাতে গিয়ে হিমাংশু সেন নামে একজন বিপ্লবী আগুনে পুড়ে মারাত্মকভাবে জখম হন, পরে তার মৃত্যু হয়।
ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম পোতাশ্রয়ের একটি জাহাজের বেতার মারফৎ এই অভ্যুত্থানের খবর কলকাতা এবং অন্যান্য স্থানে পাঠানো হয়। এই ভয়ঙ্কর সংবাদে আতঙ্কিত ব্রিটিশ সরকার দিশেহারা হয়ে "চট্টগ্রামের যুদ্ধক্ষেত্রে" দলে দলে সৈন্য পাঠাতে থাকে।
বলা বাহুল্য, ১৮ ই এপ্রিল রাতে ব্রিটিশ সেনা ও পুলিশ আধিকারিকদের তীব্র প্রতিরোধের জন্য বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম শহরটি দখলেও আনতে পারে নি। ব্রিটিশ সেনার সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য দেখে মাস্টারদা সূর্য সেন তার পরবর্তী পরিকল্পনা স্থির করেন। মাস্কেট্রি রাইফেল দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করা কঠিন ভেবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন পাহাড়ের উপর থেকে যুদ্ধ করা হবে।
পরিকল্পনা মাফিক সূর্য সেনের নেতৃত্বে ৫৭ জন বিপ্লবী ১৮ ই এপ্রিল শেষ রাতে এবং পরের দিন এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ঘুরে অবশেষে জালালাবাদ পাহাড়ে এসে উপস্থিত হন।
(২.) জালালাবাদের যুদ্ধ :-
জালালাবাদ পাহাড়টি উঁচু ও খাড়া, শত্রুপক্ষকে বাধা দেবার পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক ভেবে বিপ্লবীরা যুদ্ধের জন্য জালালাবাদ পাহাড়টিকেই বেছে নিলেন। প্রায় তিনদিন শত্রুপক্ষের অপেক্ষায় তারা পাহাড়ে কাটিয়ে দিলেন। তখন বৈশাখ মাসের প্রচন্ড গরম। জালালাবাদ পাহাড়ে বড়ো গাছও তেমন ছিলো না। তাই পাহাড়ের ওপরে পর্যাপ্ত ছায়াও ছিলো না। এছাড়া, জল, খাদ্য কোন কিছুই ছিলো না। কি প্রচন্ড ত্যাগ ও কষ্টের মধ্যে, শুধুমাত্র দেশকে স্বাধীন করার জন্য, তারা নিজের প্রানকে তুচ্ছ করে, এই কটা দিন কাটিয়েছিলেন, তা ভাবলেই আমাদের বুক বেদনায় ভরে ওঠে।
যাইহোক, এদিকে বিপ্লবীদের অনুসন্ধানে ব্রিটিশ পুলিশ এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে খোঁজ চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ২২ শে এপ্রিল দুপুরবেলা জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের সন্ধান পাওয়া গেলো। বিকেল ঠিক ৫ টার সময় পাহাড়ের নীচ থেকে আক্রমণ শুরু হয়। বিপ্লবীরাও পাল্টা আক্রমণ করতে থাকে। বিপ্লবীদের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন লোকনাথ বল। বিপ্লবীদের মরনপন প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ রাজের সুশিক্ষিত সেনাদল।
ব্রিটিশ অফিসাররা বুঝতে পারলেন, এইভাবে আক্রমণ চালিয়ে তরুন বিপ্লবীদের কাবু করা যাবে না। তাই নতুন রনকৌশল ঠিক হলো। একই সঙ্গে পাহাড়ের নীচ থেকে এবং পাশের পাহাড় থেকে মেশিনগান নিয়ে অবিরাম গুলিবর্ষন চলতে থাকলো। এমনকি উড়োজাহাজে করে পাহাড়ে বোমা নিক্ষেপ করা হলো। কিন্তু কিছুতেই বিপ্লবীদের দমন করা গেলো না। শেষপর্যন্ত রাত্রি ৮ টায় ব্রিটিশ বাহিনী পিছু হটে।
জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে বিপ্লবীদের ১০ জন নিহত এবং এবং কয়েকজন আহত হয়। অন্যদিকে ইংরেজদের ৭৪ জন নিহত এবং ১৫০ জন আহত হয়। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, কি বীর বিক্রমে বিপ্লবীরা যুদ্ধ করেছিলেন।
যাইহোক, জালালাবাদের যুদ্ধে জয়লাভ করে বিপ্লবীরা বুঝতে পারলো এই অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে বিরাট ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে বেশিদিন যুদ্ধ করা যাবে না।
(৩.) নতুন রনকৌশল ও গেরিলা যুদ্ধ :-
তাই নেতারা ঠিক করলেন, গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে হঠাৎ আক্রমণে সৈন্যদের বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত করে তুলতে হবে। এই উদ্দেশ্যে বেশিরভাগ লোককে শহরে পাঠিয়ে, অল্প কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে সূর্য সেন পাহাড় থেকে নেমে গ্রামাঞ্চলে আত্মগোপন করেন।
২৩ শে এপ্রিল অনন্ত সিং, গনেশ ঘোষ সহ মোট ৪ জন বিপ্লবী নোয়াখালি জেলার ফেনী রেলস্টেশনে গ্রেপ্তার হন। কয়েকদিনের মধ্যেই ধরা পড়া একজন বিপ্লবী ফকির সেন পুলিশের কাছে সমস্ত সংবাদ ফাঁস করে দেন।
ইতিমধ্যে বিপ্লবীদের খোঁজে ব্রিটিশ সেনা চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের উপর তল্লাশির নামে অত্যাচার শুরু করে। এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিপ্লবীরা কর্নফুলী নদীর তীরে ইংরেজ কর্মচারীদের কোয়াটারগুলি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
গভীর রাত্রিতে বিপ্লবীরা নদীর তীরে পৌঁছাবারমাত্র কয়েকজন স্থানীয় দেশীয় গুন্ডা তাদের চিনে নেয় এবং পুলিশে খবর দেয়। এরপর গুন্ডা আর পুলিশের ষাঁড়াশি আক্রমণে বিপ্লবীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এর একটি দল নৌকায় করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ধাওয়া করে। জলযুদ্ধে ৪ জন বিপ্লবী নিহত হন। বাকি দুজন বিপ্লবী যুদ্ধ করা নিরর্থক দেখে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন।
এদিকে কলকাতার গোয়েন্দা বিভাগ খবর দেয়, অস্ত্রাগার লুন্ঠনের কয়েকজন পলাতক বিপ্লবী চন্দননগরের একটি বাড়িতে লুকিয়ে আছে। এই খবর পেয়ে ব্রিটিশ পুলিশ ৩১ শে আগস্ট বাড়িটি ঘেরাও করে। পুলিশের সঙ্গে বিপ্লবীদের এই সময় একখন্ড যুদ্ধ চলে। শেষপর্যন্ত গনেশ ঘোষ ও লোকনাথ বল সহ অনেকে গ্রেপ্তার হন।
(৪.) বিপ্লবের শেষ প্রয়াস :-
চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা যখন একের পর এক ধরা পড়েছিলেন, তখন মাস্টারদা সূর্য সেন অবশিষ্ট বিপ্লবীদের পুনরায় সংগঠিত করে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের শেষ প্রয়াস চালান। এই সময় তিনি চট্টগ্রাম শহর থেকে দশ মাইল দূরে ধলঘাটে একটি বাড়িতে গোপনে আশ্রয় নেন। বাড়িটি ছিল সাবিত্রী দেবী নামে এক বয়স্ক বিধবার। সূর্যসেনর সঙ্গে এই বাড়িতেই থাকতেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সহ আরোও কিছু বিপ্লবী। এই বাড়িটিই এখন থেকে হয়ে উঠলো "ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির" সদর দপ্তর।
ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মূল নায়ক সূর্য সেনের নামে ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে গেছে। তাঁর নামে পুরস্কার ঘোষনা করে দেশের সর্বত্র দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার সাঁটানো হয়ে গেছে। যে ব্যক্তি সূর্য সেনকে ধরিয়ে দিতে পারবে, তাকে ব্রিটিশ সরকার ১০,০০০ টাকা পুরস্কার দেবে। টাকার লোভে একজন দেশদ্রোহী জমিদার ব্যক্তি শেষপর্যন্ত সূর্য সেনকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন, সে গল্পে অবশ্য একটু পরেই আমরা আসছি।
যাইহোক, গোয়েন্দা মারফৎ ব্রিটিশ পুলিশ শেষপর্যন্ত সাবিত্রী দেবীর বাড়িটির সন্ধান পায়। ১৯৩২ খ্রিঃ ১৩ ই জুন রাতে বাড়িটি ঘিরে ফেলে একদল ইংরেজ সিপাহী। এখানেও বিপ্লবীদের সঙ্গে ব্রিটিশ সেনার একপ্রস্ত যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধে বিপ্লবী নির্মল সেন শহীদ হন।
ব্রিটিশ সেনার তুমুল গুলিবর্ষনের মধ্যে মাস্টারদা প্রীতিলতাকে নিয়ে বাঁশের মই বেয়ে দোতলা থেকে রান্নাঘরের ছাদে নামেন। তারপর বাড়ির পিছন দিকের দুর্গম পথ দিয়ে পালিয়ে যান। সকালে পুলিশ বাড়ির দোতালার ছাদে নির্মল সেনের মৃতদেহ দেখতে পায়। ঐ দিন পুত্র কন্যা সহ সাবিত্রী দেবীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
(৫.) পাহাড়তলী ক্লাব আক্রমন :-
ধলঘাট থেকে পালিয়ে এসে মাস্টারদা এবং প্রীতিলতা আশ্রয় নেন চট্টগ্রাম শহরের কাট্টলীতে। সেখান থেকে মাস্টারদা পাহাড়তলী ইওরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। তিনি এর ভার দেন তার প্রিয় শিষ্যা প্রীতিলতার ওপর।
১৯৩২ খ্রিঃ ২৪ শে সেপ্টেম্বর, প্রীতিলতার নেতৃত্বে বিপ্লবীদের একটি দল পাহাড়তলী ইওরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করে।
বলা বাহুল্য, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মূল পরিকল্পনাতে এই ক্লাবটি আক্রমণের কথা ঠিক হয়েছিলো। কিন্তু ১৮ ই এপ্রিল গুডফ্রাইডে থাকায় ক্লাবে কেউ ছিলেন না। তাই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত করা যায় নি। ঠিক হয়েছিলো, ক্লাবটি আক্রমণ করে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেওয়া হবে।
এখন মাস্টারদা এই অসমাপ্ত কাজটি সম্পূর্ণ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর নামে ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিলো। দলের অবশিষ্ট যে কয়জন বেঁচে ছিলেন, তাদের মধ্যে প্রীতিলতাকেই তার সবথেকে যোগ্য এবং উপযুক্ত বলে মনে হয়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রীতিলতার হাতে অবশিষ্ট কাজের ভার দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন।
পাহাড়তলীর ইওরোপীয়ান ক্লাব শুধু যে ইংরেজ সাহেবদের আমোদ প্রমোদের জায়গা ছিলো এমন নয়, এটি বর্নবৈষম্যবাদের বহিঃপ্রকাশেরও একটি অন্যতম কেন্দ্র ছিলো। এই ক্লাবের বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা থাকতো - "কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।"
যাইহোক, ১৯৩২ খ্রিঃ ২৪ শে সেপ্টেম্বর, রাত দশটায় পুরুষের ছদ্মবেশে প্রীতিলতা ও তার সহযোগীরা ক্লাবে প্রবেশ করেন। তখন প্রায় ৪০ জন ইংরেজ পুরুষ ও নারী ক্লাবে আমোদ প্রমোদে লিপ্ত ছিলেন। প্রীতিলতা আচমকা ক্লাবের ভিতরে বোমা নিক্ষেপ করলে সমস্ত ক্লাবঘর ধোঁয়ায় ভরে যায়।
এই আক্রমণে মিসেস স্যালিভান নামে একজন জনৈক ইংরেজ মহিলা নিহত হন এবং ১২ জন ইংরেজ গুরুতর আহত হন। ৩ মিনিটের এই অভিযান সম্পূর্ন করে বিপ্লবীরা সকলেই ফিরে যান। শুধু যেতে পারলেন না একজনই, তিনি হলেন প্রীতিলতা। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার বদলে তিনি মৃত্যুকেই শ্রেয় বলে মনে করলেন। তাই জীবনের শেষ মুহূর্তে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে তিনি চরম সিদ্ধান্তটি নিলেন। তাঁর কাছে থাকা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।
প্রীতিলতার মৃত্যু সংবাদে মাস্টারদা গভীরভাবে মর্মাহত হন। কিন্তু তখনও তিনি ভেঙ্গে পড়লেন না। শরীরের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত দেশকে স্বাধীন করার কঠিন ব্রত যে তিনি নিয়েছিলেন।
যাইহোক, ইওরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের পর মাস্টারদা সূর্য সেন আশ্রয় নিলেন গৈরালা গ্রামে বিশ্বাসদের বাড়িতে। এই সময় ১০,০০০ টাকা পুরস্কারের লোভে নেত্ররঞ্জন সেন নামে একজন দেশদ্রোহী জমিদার পুলিশকে সূর্য সেনের খবর দেন। ১৯৩৩ খ্রিঃ ১৬ ই ফেব্রুয়ারি এই বাড়িটি থেকেই ব্রিটিশ পুলিশ ব্রজেন্দ্র সেন ও সূর্য সেনকে গ্রেপ্তার করে।
(৬.) কল্পনা দত্ত ও অন্যান্য বিপ্লবীদের প্রচেষ্টা :-
বলা বাহুল্য, গৈরালার বাড়ি থেকে সূর্য সেন গ্রেপ্তার হলেও, এই সময় কল্পনা দত্ত ও অন্যান্য বিপ্লবীরা পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। সূর্যসেনের গ্রেপ্তারের পর তাঁর অনুপস্থিতিতে বিপ্লবীদের নেতৃত্বদানের দায়িত্ব পান তারকেশ্বর দস্তিদার।
এই পর্বে বিপ্লবীরা একাধিক বিপ্লববাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সূর্যসেনকে গ্রেপ্তার করার কাজে সাহায্য করেছিলো পটিয়া থানার দারোগা মাখনলাল দীক্ষিত। মাত্র দেড় মাসের কিছু বেশি সময়ের পর ১৯৩৩ খ্রিঃ ২৮ শে মার্চ দুই বিপ্লবী তাকে হত্যা করে। এই পর্বে বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী জমিদার নেত্ররঞ্জন সেনকেও বিপ্লবীরা হত্যা করে। ১৯৩৪ খ্রিঃ ৮ ই জানুয়ারি গভীর রাতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তাকে হত্যা করা হয়।
"ভারত সম্রাট বনাম সূর্য কুমার সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার ও কল্পনা দত্ত" ঐতিহাসিক মামলার বিবরন থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম জেল থেকে সূর্য সেন সহ অন্যান্য বিপ্লবীদের বের করে নিয়ে আসার জন্য তারকেশ্বর দস্তিদাররা চেষ্টা করেন। এই সময় তারা জেল আক্রমণ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
কিন্তু এই পরিকল্পনাটি কার্যকর করার আগেই পুলিশের গোয়েন্দারা এর খবর পেয়ে যান। বিপ্লবীরা তখন গহিরার একটি বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত এই বাড়ি থেকেই তারকেশ্বর দস্তিদার, কল্পনা দত্ত ও অন্যান্য বিপ্লবীরা গ্রেপ্তার হন।
(৭.) মামলার বিচার :-
১৯৩৩ খ্রিঃ ১৫ ই জুন, সূর্য সেন এবং তাঁর দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলার বিচার চলে একটি স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনালের সভাপতি ছিলেন ডব্লিউ ম্যাকমা। অপর দুজন সদস্য ছিলেন মিঃ আর কে ঘোষ এবং খন্দকার আলী তৈয়ব। বিচারে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি হয় এবং কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
১৯৩৪ খ্রিঃ ১২ ই জানুয়ারি রাত আনুমানিক দেড়টা থেকে দুটোর মধ্যে সূর্য সেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসি দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মৃতদেহ তাদের আত্মীয় স্বজনদের ফেরত দেওয়া হয় নি। যতদূর জানা যায়, তাদের মৃতদেহ গভীর সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো। সূর্যসেনের মৃত্যুর সাথেই ভারতকে স্বাধীন করার দুর্দমনীয় একটি প্রয়াসের সলিল সমাধি ঘটে।
(৮.) চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের গুরুত্ব :-
মনে রাখতে হবে, মাস্টারদা সূর্য সেনের অক্লান্ত লড়াই আর চট্টগ্রামের এই অভ্যুত্থান নিছকই ব্যর্থ একটি সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হয়ে যায় নি। এই সংগ্রাম বাংলা তথা সারা দেশের বিপ্লববাদের ইতিহাসে এক নতুন অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছিলো।
(i.) চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানের সংবাদ সারা দেশে এক গভীর উদ্মাদনার সঞ্চার করে। সমস্ত গুপ্ত সমিতির তরুন বিপ্লবীরা অস্ত্রশক্তি দ্বারা ব্রিটিশ শাসনকে উচ্ছেদ করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি গুলিতে সদস্য সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
(ii.) চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের আগে দেশে একাধিক সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চলেছিলো। কিন্তু কোনটিই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত করা যায় নি। সবকটিই ফাঁস হয়ে গিয়েছিলো। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলো চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন। এটি নিঃসন্দেহে একটি সফল অভ্যুত্থান ছিলো।
(iii.) চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে প্রায় ৩ দিন চট্টগ্রাম ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত ছিলো। এই ঘটনা দেশে যুবশক্তির মধ্যে নতুন আত্মবিশ্বাস ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে।
(৯.) ব্যর্থতার গ্লানি ও কারন বিশ্লেষন :-
ভারতের আরসব স্বাধীনতা প্রচেষ্টার মতো, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই ব্যর্থতা কখনই বিপ্লবীদের পরাজয় ছিলো না। আসলে কতক গুলো ভুলের কারনে তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন, যা ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে নতুন শিক্ষার উপলব্ধি বহন করে এনেছিল।
(i.) মনে রাখতে হবে, চট্টগ্রামে মাস্টারদার অনুগামীরা কার্যত একা লড়াইটি চালিয়ে ছিলেন। কেউ তাদের পাশে ছিলেন না। অন্যান্য অনেক ছোটো খাটো বিপ্লবী গোষ্ঠী তখনও চট্টগ্রামে ছিলো। কিন্তু তারা বিপ্লবীদের পাশে এসে দাঁড়ায় নি। দাঁড়ালে অথবা প্রয়োজন মাফিক সাহায্য করলে হয়তো এতটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন তারা হতেন না।
(ii.) বিপ্লবীরা অভ্যুত্থান ঘটাতে গিয়ে চট্টগ্রামকে বাকি অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করার নীতি নিয়েছিলেন। এটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরকে অবরোধের কথা তারা ভাবেন নি। পরিনতিতে শত্রুপক্ষ ঐ একটি মাত্র খোলা পথে পালিয়ে যাবার যেমন সুযোগ পেয়েছিলো, তেমনই ঐ খোলা জায়গা থেকেই বিপ্লবীদের ওপর প্রত্যাঘাত নেমে এসেছিলো।
(iii.) বিপ্লবীদের তৃতীয় ভুলটি ছিলো, সামরিক ঘাঁটিতে অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সময় তারা গোলা বারুদের সন্ধান পান নি অথবা বেমালুম তা ভুলে গিয়েছিলেন। অস্ত্র আর গোলাবারুদ কখনোই একসাথে রাখা হয় না, এটি তারা হয়তো জানতেন না। তারাহুড়ো করতে গিয়ে তারা মারাত্মক ভুলটি করে বসেন। ফলে অস্ত্রাগার লুন্ঠন করে অনেক অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেগুলি গুলি বারুদের অভাবে আর ব্যবহার করা যায় নি। গেলে ইতিহাসের গতিপথ হয়তো অন্য রকম হতে পারতো।
(iv.) তবে, এটাও ঠিক বৃহৎ সর্বগ্রাসী ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে কতিপয় জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদ, সংগ্রাম এবং যুদ্ধ চিরকালই অবদমিত হয়ে এসেছে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। তাদের ব্যর্থতা নিয়তিরই এক নির্মম পরিহাসমাত্রই ছিলো।
সবশেষে তাদের ব্যর্থতার জন্য আমাদের নিজ দেশের দেশদ্রোহী ব্যক্তিদের কথাও বলতে হয়। কিছু টাকার লোভে দেশীয় গুটিকয়েক ব্যক্তি বারংবার বিপ্লবীদের পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আসলে বিপ্লবীদের লড়াইটা একমুখী ছিলো না। লড়াইটা ছিলো দ্বিমুখী। ইংরেজদের পাশাপাশি দেশদ্রোহী ব্যক্তিদের সাথেও তাদের লড়াই করতে হয়েছিলো।
সমাপ্ত।।