বিপ্লবের পথে চট্টগ্রাম
১৯৩০ এর দশকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের কয়েক বছর আগে ভারতীয় রাজনীতিতে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের পুনরুজ্জীবিত করে তোলে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ১৯২৬ থেকে ১৯২৯ খ্রিঃ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মোটামুটি শান্তই ছিলো।
এই সময় অধিকাংশ বিপ্লবীরা জেলে থাকায় চট্টগ্রামে সেই অর্থে কোন বিপ্লবী কার্যকলাপ সংগঠিত হয় নি। ১৯২৮ খ্রিঃ নাগাদ বেশ কয়েকজন বিপ্লবী জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। ১৯২৮ এর পর ভারতীয় রাজনীতির বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনায় চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করেন এবং সংঘবদ্ধ হন। ইতিহাস বিশ্লেষনের তাগিদে অবশ্যই এই ঘটনা গুলিকে উল্লেখ করতে হয়।
(১.) কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা ও বৈপ্লবিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তার প্রভাব :-
১৯২৫ খ্রিঃ ভারতের কানপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় "ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি"। সত্যভক্ত, সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার, মিরাজকর, এস এ ডাঙ্গে প্রমুখ ব্যক্তিরা এই কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন।
কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন পত্র পত্রিকার মধ্য দিয়ে বামপন্থী ভাবধারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের বিপ্লবীদের মধ্যেও সাম্যবাদের প্রসার ঘটে। অন্যভাবে বলা যায়, কমিউনিস্ট মতবাদ বিপ্লবীদের নতুন করে উজ্জীবিত করে। কমিউনিস্ট মতবাদে স্পষ্টতই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কথা বলা ছিলো। ভারতে ব্রিটিশ শাসন যে একটি সাম্রাজ্যবাদ - এই বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিলো না।
ভারতে এই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবসানের পর ভারতের ভবিষ্যৎ সমাজ ব্যবস্থা কেমন হবে, সে সম্পর্কেও কমিউনিস্ট মতবাদ একটি সুনির্দিষ্ট দিশা দেখায়। এইজন্য ভারতের বহু তরুন ও শিক্ষিত যুবক সমাজতান্ত্রিক মতবাদে আকৃষ্ট হন এবং বিপ্লবী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেন।
এ প্রসঙ্গে আরোও একটি তথ্যের উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতের প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের বাইরে ১৯২০ খ্রিঃ রাশিয়ার তাসখন্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। মানবেন্দ্রনাথ রায় বাংলার অনুশীলন সমিতি এবং যুগান্তর দলের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখে সাম্যবাদী ভাবধারা ভারতে প্রসার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
মোটকথা, মানবেন্দ্রনাথ রায় যে কাজটির সূচনা করেছিলেন, ১৯২৫ খ্রিঃ কানপুরে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা সেই প্রচেষ্টাটিকেই শক্তিশালী করে তুলেছিলো। আসলে কমিউনিস্ট মতবাদ ভারতীয় বিপ্লববাদকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার একটি সুনির্দিষ্ট দিশা দেখিয়েছিলো এবং শ্রেনী শোষনহীন এক নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলো।
যাইহোক, ১৯২৫ খ্রিঃ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ভারতের বিপ্লবীদের কাছে শক্তি সঞ্চয়ের একটি উপাদান ছিলো এটি বলাই যায়।
(২.)"হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন" প্রতিষ্ঠা :-
১৯২৩ খ্রিঃ ভারতে বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য যোগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামপ্রসাদ বিসমিল, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল প্রমুখের নেতৃত্বে যুক্তপ্রদেশে (এখানকার উত্তর প্রদেশে) প্রতিষ্ঠিত হয় - "হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন" ( হিন্দুস্থান সাধারনতন্ত্রী সংঘ)।
সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতকে মুক্ত করার জন্য এই সংগঠনটি গড়ে তোলা হয়েছিলো। ১৯২৫ খ্রিঃ মধ্যে যুক্তপ্রদেশ ছাড়াও পাঞ্জাব, বিহার, মাদ্রাজ ও মধ্যপ্রদেশে এই সংগঠনটির শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কিন্তু ১৯২৫ খ্রিঃ বিখ্যাত "কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায়" এই সংগঠনের প্রায় সব নেতা গ্রেফতার হওয়ায় সংগঠনটি ভেঙ্গে পড়ে।
পরবর্তীকালে কাকোরী মামলায় অভিযুক্ত আত্মগোপনকারী বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজাদ নব্য যুবকদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং ১৯২৬ খ্রিঃ গোড়ার দিকে তরুন যুবকদের নিয়ে নতুন করে সংগঠিত করেন - "হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন"। এই সমস্ত তরুন বিপ্লবীদের মধ্যে ছিলেন ভগৎ সিং, মহাবীর সিং, কিশোরীলাল, রাজগুরু, শুকদেব, বটুকেশ্বর দত্ত এবং আরোও অনেকে।
ঠিক হয়, হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি থাকবে। কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনে প্রত্যেক প্রদেশে থাকবে একটি করে প্রাদেশিক কমিটি। প্রাদেশিক কমিটির অধীনে থাকবে জেলা কমিটি। জেলা কমিটির অধীনে আবার থাকবে কিছু স্বতন্ত্র সমিতি। যেমন পাঞ্জাবে প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক ছিলেন ভগৎ সিং। তিনি "হিন্দ নওজোয়ান সভা" নামে একটি সমিতি তৈরি করেছিলো, যেটি স্বতন্ত্রভাবে স্কুল কলেজের ছাত্রদের বিপ্লববাদে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিলো।
আসলে ব্রিটিশ পুলিশের চোখকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য বিপ্লবীরা মূল সংগঠনের ছত্রছায়ায়, স্থানীয় ভাবে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সংগঠন ও সমিতি খুলে বিপ্লবী কার্যকলাপ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিতেন, যাতে মূল সংগঠনটি কখনো ভেঙ্গে না পড়ে এবং অক্ষত থাকে।
যেমনটা আমরা লক্ষ্য করেছিলাম সূর্যসেনের সময়। সূর্যসেন যুগান্তর দলের সদস্য হয়েও, স্থানীয় ভাবে একটি স্বতন্ত্র বিপ্লবী দল তৈরি করেছিলেন, যে দলটি যুগান্তর দলের হয়ে বিপ্লবী কাজকর্ম চালাতো। আসলে গেরিলা ঢঙের সংগঠন যেকোন সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনেরই একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো। ভারতীয় বিপ্লবী সংগঠন গুলিও এই বৈশিষ্ট্যের বাইরে ছিলো না।
(৩.) চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়, সর্বভারতীয় বিপ্লবী আন্দোলনের একটি পরিকল্পনার পার্ট বা অংশ :-
যাইহোক, ১৯২৮ খ্রিঃ ভারতের বিপ্লববাদের ইতিহাসে একটি স্মরনীয় বছর ছিলো। এই বছরটিতে অনেক গুলি ঘটনা ঘটে, যা ভারতীয় বিপ্লববাদকে অনেকাংশে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। এখানে মনে রাখতে হবে, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন নিছক বিক্ষিপ্ত একটি বিপ্লবী ঘটনামাত্র ছিলো না। মূল বিপ্লববাদী আন্দোলনের একটি পরিকল্পনারই পার্ট বা অংশ ছিলো চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন। সুতরাং বিষয়টির প্রেক্ষাপট বুঝতে গেলে কেন্দ্রীয় ঘটনার মূল দিক গুলি সম্পর্কে অবশ্যই জানা প্রয়োজন।
(ক.) বিপ্লববাদের ওপর কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রভাব :-
১৯২৫ খ্রিঃ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা এবং সাম্যবাদী ভাবধারা ভারতের বিপ্লবীদের অনেকখানি প্রভাবিত করেছিলো, এটা আমরা আগেই বলেছি। পূর্বে বিপ্লবীরা ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবী কার্যকলাপে অংশ নিতো। কিন্তু এই সশস্ত্র আন্দোলন সফল হলে ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারতের শাসন ব্যবস্থার রূপটি কেমন হবে, সমাজ ব্যবস্থার চরিত্রই বা কেমন হবে, সে সম্পর্কে বিপ্লবীরা অনেকটাই দিশাহীন ও নিরব ছিলেন।
কিন্তু কমিউনিস্ট মতবাদের সাম্যবাদী চেতনা ও আদর্শ বিপ্লবীদের নতুন ভারত নির্মানের একটি স্বপ্ন দেখায়। এমন এক ভারতের স্বপ্ন তারা দেখে, যেখানে ধনী দরিদ্রের কোন বৈষম্য থাকবে না। জাতপাতের লড়াই থাকবে না। শোষন, বঞ্চনা ও বেকারত্ব থাকবে না। সকলের থাকবে সম অধিকার, সম মর্যাদা ও সুযোগ।
সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করা। ভারতে ব্রিটিশ শাসন সাম্রাজ্যবাদ ছাড়া কিছুই নয়। একমাত্র আপোসহীন সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটানো সম্ভব। অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব।
এককথায় "কমিউনিস্ট মতবাদ" ভারতের সশস্ত্র আন্দোলনকে একটি দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করেছিলো। তার লক্ষ্য নির্ধারনে সুনির্দিষ্ট দিশাও দেখিয়েছিলো। এইজন্য ভগৎ সিং, রাজগুরু, শুকদেব, চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখ বিপ্লবীরা ১৯২৮ খ্রিঃ নাগাদ "হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের" নাম পরিবর্তন করে রাখেন "হিন্দুস্থান সোসালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন"। ঠিক হয়, প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি "সমাজতন্ত্র" প্রতিষ্ঠা করাও হবে ভারতীয় বিপ্লবী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
(খ.) ১৯২৮ খ্রিঃ, ভারতীয় বিপ্লববাদের একটি স্মরনীয় বছর : -
ঘটনাক্রম :- ১."বিপ্লবীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, ২.বিপ্লবীদের জেল থেকে মুক্তি,৩.কলকাতা অধিবেশনের গোপন বৈঠক, ৪.কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন,
১৯২৮ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এই বছরটিতেই আবার বহু বিপ্লবী জেল থেকে মুক্তিলাভ করে। চট্টগ্রামের যে সমস্ত বিপ্লবীরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তারাও এই সময় মুক্তিলাভ করেন। জেল থেকে মুক্তিলাভের পর বহু দেশপ্রেমিক জনতা তাদের ফুলের মালা ও পুষ্পস্তবক দিয়ে অভূতপূর্ব অভিনন্দন জানায়। বিপ্লবীদের প্রতি দেশবাসীর এই উচ্ছাস তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আরোও অনেকে বেশি উজ্জীবিত করে তোলে। দেশবাসীকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করার জন্য তারা দৃঢ় সংকল্প নেয়।
১৯২৮ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসে কলকাতায়। এই অধিবেশনে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন মতিলাল নেহেরু। মতিলাল নেহেরুকে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানানোর জন্য সুভাষচন্দ্র বসুর নির্দেশে এই সময় এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়, যারা সৈনিকের কায়দায় কুচকাওয়াজ ও অন্যান্য সামরিক রীতিতে মতিলাল নেহেরুকে অভিবাদন জানিয়েছিল। পরবর্তীকালে এই বাহিনীই "বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স" নামে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিলো।
১৯২৮ খ্রিঃ আবার ভগৎ সিং ও অন্যান্য প্রদেশের বিপ্লবীরা কলকাতায় এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়। এখানে বিপ্লবীরা সারা দেশব্যাপী সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে। প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়, কংগ্রেসের মধ্যে মিশে গিয়ে বিপ্লবী সংগঠন ও আদর্শকে নিরাপদে ছড়িয়ে দিতে হবে।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিপ্লবী যুবরা এই সময় কংগ্রেসে ভিড় জমায়। এই বিপ্লবীদের উৎসাহে ১৯২৮ খ্রিঃ কলকাতা অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু পূর্ন স্বাধীনতার প্রস্তাব তোলেন। জওহরলাল নেহেরু প্রস্তাবটিকে সমর্থন করেন। কিন্তু গান্ধীজির তীব্র বিরোধিতায় অল্পসংখ্যক ভোটে প্রস্তাবটি খারিজ হয়ে যায়। আসলে গান্ধীজি স্বাধীনতার লক্ষ্যে এখনই এতদূর অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।
যাইহোক, ১৯২৮ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে যে বহু সংখ্যক বিপ্লবী যোগ দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন - অনন্ত সিংহ, গনেশ ঘোষ, লোকনাথ বল। এরা সবাই চট্টগ্রামের বিপ্লবী ছিলেন। আবার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীরও অন্যতম নেতা ছিলেন। ১৯২৮ খ্রিঃ সুভাষচন্দ্রের অনুপ্রেরনায় গড়ে ওঠা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সামরিক কারসাজি প্রদর্শন মাস্টারদা সূর্য সেনের খুব ভালো লাগে। তিনি চট্টগ্রামেও এইরকম একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলার পরিকল্পনা করেন, যেটির সাহায্যে সারা দেশেই স্বাধীনতার জন্য সামরিক অভিযান চালানো যাবে।
(৪.) ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি গঠন ও রনকৌশল :-
পরিকল্পনা মাফিক কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হবার পর সূর্যসেন চট্টগ্রামে তরুন যুবকদের নিয়ে এরকম একটি বাহিনী গঠন করলেন। নাম দিলেন "ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি"। এর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন সূর্য সেন। এই বাহিনীর জন্য একটি "ওয়ার কাউন্সিল" বা যুদ্ধ পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়। এর সদস্য নির্বাচিত হন - নির্মল সেন, লোকনাথ বল, অনন্ত সিংহ, গনেশ ঘোষ, অম্বিকা চক্রবর্তী এবং উপেন ভট্টাচার্য। বাহিনীর জন্য অতি গোপনে অস্ত্রশস্ত্র, গুলি, বারুদ ও বোমা সংগ্রহ করা হয়। অস্ত্র চালনাও শেখানো হয়।
সবটাই হয়েছিলো কংগ্রেসের ছত্রছায়ায়। এই সময় চট্টগ্রাম কংগ্রেস সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ ছিলো এই বিপ্লবীদের হাতেই। অর্থাৎ পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য তারা দিনের বেলা কংগ্রেস করতেন আর রাতের অন্ধকারে গোপনে তারা চালাতেন বিপ্লবী কাজকর্ম। এই সময় তারা চট্টগ্রামে অনেক ব্যায়াম সমিতি ও শরীর চর্চার নানা ছোট খাটো কর্মশালা, সমিতি ও সংঘ গঠন করে যুব সদস্য সংগ্রহ করতে থাকেন। এইভাবে জাতীয় কংগ্রেসের কাজের মধ্য দিয়ে বহু যুবককে বিপ্লবী দলের সদস্য করা হয়। এই যুবকদের রিভালবার চালানো, মোটরগাড়ি চালানো ইত্যাদি নানাবিধ শিক্ষায় পারদর্শী করে একটি সৈন্য বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলা হয়।
বলা বাহুল্য, এই সকল কাজ হয়েছিলো খুবই গোপনে এবং সন্দর্পনে। ১৯২৮ থেকে ১৯৩০ খ্রিঃ মধ্যে ধীরে ধীরে অভ্যুত্থানের সমস্ত আয়োজন করা হয়। এ প্রসঙ্গে আরোও একটি তথ্যের উল্লেখ করতে হয়।
(৫.) রংপুরের গুপ্ত সম্মেলন ও অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা :-
১৯২৯ খ্রিঃ বাংলাদেশের রংপুরে বিপ্লবীদের একটি সম্মেলন বসে। এই সম্মেলনে অম্বিকা চক্রবর্তী, সতীশ পাকড়াশী, যতীন দাস, বিনয় রায়, নিরঞ্জন সেন সহ অন্যান্য বিপ্লবীরা একত্রে বসে বিপ্লবী কর্মপন্থা ঠিক করেন।
এই সময় ঠিক করা হয়, গুপ্ত হত্যার বদলে সারা দেশব্যাপী ছোট বড়ো বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটানো হবে। বাংলায় ব্রিটিশ সরকারের অস্ত্রাগার গুলি লুন্ঠন ও আক্রমন করা হবে। একই দিনে ও একই সময়ে এই অভ্যুত্থান ঘটানো হবে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন এই পরিকল্পনারই একটি অংশ ছিলো।
স্থির হয়েছিলো বাংলার তিন জেলায় চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশালে এবং কলকাতায় অস্ত্রাগার আক্রমণ করা হবে। তবে পুলিশ এই পরিকল্পনার কথা জেনে যাওয়ার কারনে বাকি পরিকল্পনা গুলি বাস্তবায়িত করা যায় নি। একমাত্র "চট্টগ্রামে অভ্যুত্থান ঘটানো" সম্ভব হয়েছিলো। মাস্টারদা সূর্য সেনের অভূতপূর্ব কর্মদক্ষতায় পুলিশ বিপ্লবী কার্যকলাপ সম্পর্কে কিছুই আঁচ করতে পারে নি।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই, অন্যান্য জায়গা থেকে বিপ্লবীরা গ্রেপ্তার হলেও চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা নিরাপদেই ছিলেন। তারা কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে অত্যন্ত গোপনে বিপ্লবী আন্দোলনের যাবতীয় আয়োজন সম্পূর্ণ করেন।
ইতিমধ্যে দেশীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব ও সংগ্রামী চেতনাকে তীব্র করে তোলে। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো ১৯২৯ খ্রিঃ ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত কর্তৃক দিল্লির কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভায় বোমা নিক্ষেপ, জেলের ভিতরে ৬৩ দিন অনশনের পর বিপ্লবী যতীন দাসের প্রানত্যাগ এবং এর প্রতিবাদে কলকাতায় বিপুল জনসমাগম ও শোকসভা। সর্বোপরি, ১৯৩০ খ্রিঃ মার্চ মাসে গান্ধিজীর আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক, - দেশীয় রাজনীতির এই সকল ঘটনা চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের প্রবলভাবে উজ্জিবীত করে তোলে।
এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৩০ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে এক গোপন বৈঠকে মাস্টারদা সূর্য সেন সহ অন্যান্য বিপ্লবীরা চট্টগ্রামে এক দুঃসাহসিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন। ঠিক হয়, ১৮ ই এপ্রিল সারা চট্টগ্রাম জুড়ে এই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হবে।
কি ছিলো এই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা? কেমন ভাবে এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা হয়েছিলো, সেই দুঃসাহসিক রোমাঞ্চকর ইতিহাসটি আমরা আগামী পর্বে আলোচনা করবো।
চলবে...
পরবর্তী অংশ - চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের ইতিহাস, পর্ব ৩ পড়ুন।