চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের ইতিহাস, পর্ব - ০১

বিপ্লবের আঁতুরঘর চট্টগ্রাম 

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের ইতিহাস : পর্ব - ১
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের ইতিহাস : পর্ব - ১


(১.) সূর্য কুমার সেন থেকে "মাস্টারদা":- 

সূর্য কুমার সেন বিপ্লবী মহলে "মাস্টারদা" নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। শোনা যায়, মাস্টারদার বিপ্লবী কার্যকলাপ ব্রিটিশ সরকারের কাছে এতটাই ত্রাস সৃষ্টি করেছিলো যে, একজন জনৈক ম্যাজিস্ট্রেট একবার সূর্যসেনকে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন, সূর্য সেন যদি রাজনীতি থেকে সরে আসেন, তাহলে ব্রিটিশ সরকার সূর্য সেনের সমস্ত সাংসারিক খরচা বহন করবে।

কিন্তু সূর্য সেন ম্যাজিস্ট্রেটের সেই প্রস্তাবটি ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আসলে তিনি জানতেন, ব্যাক্তি স্বার্থ, তোষন আর সুবিধাবাদী নীতিই ভারতবর্ষকে প্রকৃত অর্থে পরাধীন করে রেখেছে। তিনি অনায়াসে এই সমস্ত প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছিলেন বলেই স্বাধীনতার জন্য নিজের প্রানকে তুচ্ছ জ্ঞান করে দেশের সেবায় আত্মবলিদান দিতে পেরেছিলেন।

১৮৯৪ খ্রিঃ ২২ শে মার্চ, চট্টগ্রাম জেলার নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সূর্য সেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিলো সূর্য কুমার সেন। অল্প বয়সে পিতার মৃত্যুর পর তিনি কাকা গৌরমনি সেনের কাছে প্রতিপালিত হন। ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯১৮ খ্রিঃ বহরমপুর কলেজ থেকে তিনি বি এ পাশ করেন

(২.) বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষা ও গুপ্ত সমিতি গঠন :- 

এখানে বলা প্রয়োজন, বহরমপুর কলেজের অন্যতম অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন যুগান্তর দলের একজন সক্রিয় সদস্য। তাঁরই প্রভাবে সূর্য সেন বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত হন এবং যুগান্তর দলে যোগ দেন। ১৯১৮ খ্রিঃ সের্য সেন চট্টগ্রামে ফিরে এসে তার অনুগামীদের নিয়ে একটি নতুন গুপ্ত সমিতি গঠন করেন। এই নব্য গুপ্ত সমিতি যুগান্তর সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে থাকে।

চট্টগ্রামের ওরিয়েন্টাল স্কুলে অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে সূর্য সেন তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরে অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্থানীয় জনগনের সাহায্যে তিনি একটি জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়টিই পরবর্তীকালে তাঁর বিপ্লবী কর্মকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সূর্যসেন এই বিদ্যালয়টির শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং এই সময় থেকেই তিনি সকলের কাছে "মাস্টারদা" নামে সুপরিচিত হয়ে উঠেন। 

(৩.) কিভাবে চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের মূল ঘাঁটিতে পরিনত হয়?

এ প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, ১৯৩০ এর দশকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের বহু আগে থেকেই চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের অন্যতম কর্মকেন্দ্র ও ঘাঁটি হিসাবে গড়ে উঠেছিলো। মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে এর ইতিহাসটিও সংক্ষেপে বলে নেওয়া প্রয়োজন।

অরবিন্দ ঘোষ ১৮৯৩ খ্রিঃ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে দেশে ফিরে বরোদা কলেজে সহকারী অধ্যক্ষের পদে যোগদান করেন। এই সময় তিনি মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির নেতা দামোদর হরি চাপেকার এবং রামকৃষ্ণ হরি চাপেকারের সংস্পর্শে এসে বিপ্লবী আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। পরে তার এবং ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রের তৎপরতায় ১৮৯৯ - ১৯০২ খ্রিঃ মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় "অনুশীলন সমিতি"। এই সমিতির সদস্যদের লাঠি খেলা, অসি চালনা, ছোরা চলনা এবং কুস্তি ও মুষ্ঠিযুদ্ধের শিক্ষা দেওয়া হতো।

কিন্তু শুধুমাত্র লাঠিখেলা বা অসি খেলায় তৃপ্ত থাকতে অস্বীকার করে অনুশীলন সমিতির বেশ কিছু সদস্য পরবর্তীকালে বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নেতৃত্বে অনুশীলন সমিতি থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ১৯০৬ খ্রিঃ নাগাদ গঠন করেন "যুগান্তর দল"। খুব অল্প সময়ের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে গড়ে উঠা "অনুশীলন সমিতি" এবং "যুগান্তর দল" - দুটিরই শাখা পূর্ব বাংলায় বিস্তার লাভ করে।

১৯০৮ খ্রিঃ যুগান্তর দল অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার দায়িত্ব দেয় ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকীকে৩০ শে এপ্রিল, ১৯০৮ খ্রিঃ বিহারের মুজাফফরপুরে ইওরোপীয়ান ক্লাবের সামনে কিংসফোর্ডকে বোমা ছুড়ে হত্যার প্রচেষ্টা করেন ক্ষুদিরাম বসু। যদিও তিনি এক্ষেত্রে ব্যর্থ হন।

যাইহোক, এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের সূত্র ধরে ব্রিটিশ পুলিশ কলকাতাতে মানিকতলায় বিপ্লবীদের একটি বোমা তৈরির কারখানা খুঁজে পায়। এরপর অরবিন্দ ঘোষ সহ বেশ কিছু বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ "আলিপুর বোমা মামলা" দায়ের করে। এই মামলা দায়ের হওয়ার সময় বেশ কিছু আসামী ও বিপ্লবী গোপনে আত্মরক্ষার জন্য চট্টগ্রামে চলে আসেন।

চট্টগ্রামে আসার পর তারা বেশ কিছু ছোট ছোট গুপ্ত সমিতি ও বিপ্লবী গোষ্ঠী গড়ে তোলে। এই বিপ্লবীরা কলকাতা থেকে গোপনে নানা পত্র পত্রিকা ও ইস্তেহারের মাধ্যমে চট্টগ্রামে বিপ্লবী কার্যকলাপ চালাতে থাকে। ১৯২০ র দশকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে বিপ্লবী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিলো।

প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন, ১৯২০ খ্রিঃ গান্ধীজি স্বরাজ অর্জনের জন্য অহিংসা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তিনি স্বরাজ এনে দেওয়ার জন্য বিপ্লবীদের কাছে একবছর সময় চেয়ে নেন। বলা বাহুল্য, বিপ্লবীরা অহিংসা নীতিতে বিশ্বাস না করলেও, গান্ধীজির কথায় অনেকেই সহযোগিতা করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন স্বরাজ আনতে ব্যর্থ হলে বিপ্লবীরা আবার সশস্ত্র বিপ্লবের পথে ফিরে যান।

গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন ১৯২২ খ্রিঃ। এর ঠিক পরের বছরটিতেই অর্থাৎ ১৯২৩ খ্রিঃ ১৪ ই ডিসেম্বর, চট্টগ্রামে একটি রেল ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এতে অংশ নেন অনন্ত সিং, দেবেন দে ও নির্মল সেন। এই ডাকাতিতে প্রায় ১৭ হাজার সরকারি অর্থ লুন্ঠন করা হয়। পরে এই টাকা নিয়ে কলকাতায় অস্ত্র কিনতে যাওয়ার সময় বিপ্লবীরা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান।

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই রেল ডাকাতির সঙ্গে মাস্টারদা সূর্য সেনও জড়িত ছিলেন। যাইহোক, রেল ডাকাতির পর ব্রিটিশ পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। মাস্টারদা সূর্য সেন এই সময় পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পটাশিয়াম সায়েনায়েট খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। যদিও, শেষপর্যন্ত তিনি বেঁচে যান। কারন তার কাছে থাকা পটাশিয়াম সায়ানায়েট ছিলো বহু পুরানো এবং সেটি ভালো থাকার অর্থাৎ কার্যকারিতার সীমা পেরিয়ে গিয়েছিলো।

যাইহোক, রেল ডাকাতির ঘটনায় সূর্য সেন সহ অনেক বিপ্লবীর ৯ মাস জেল হয়১৯২৪ খ্রিঃ ৫ ই সেপ্টেম্বর, চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় আবার একটি অস্ত্র লুন্ঠনের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাতেও সূর্যসেনের নাম উঠে আসে। এই ঘটনার পর ১ নং বেঙ্গল অর্ডিনেন্স দ্বারা পুলিশ সারা বাংলায় বিপ্লবীদের ব্যাপক ধরপাকড় ও গ্রেফতার করতে শুরু করে।

অদ্ভুত ভাবে এই সময় সূর্যসেন এক চা - ওয়ালার ছদ্মবেশে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তবে শেষপর্যন্ত ১৯২৬ খ্রিঃ অক্টোবর মাসে কলকাতার এক মেস থেকে পুলিশ সূর্যসেনকে গ্রেপ্তার করে। এই গ্রেফতারির পর প্রায় ২ বছর তিনি জেলে থাকেন।

১৯২৮ খ্রিঃ শেষের দিকে তার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলার অসুস্থতার জন্য তিনি জেল থেকে সাময়িক ছাড়া পান। যদিও এই সময় তিনি নজর বন্দী ছিলেন। এই সময় সূর্য সেন বাড়ি থেকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পুনরায় পালিয়ে যান এবং কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকেন।

প্রায় দুই বছর পর ১৯৩০ খ্রিঃ মাস্টারদা সূর্য সেন পুনরায় চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। পুলিশের চোখে তখনও তিনি ছিলেন একজন ফেরারী আসামী এবং সন্ত্রাসবাদী। এই পর্বেই সংগঠিত হয় ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের ঘটনা


চলবে... 
পরবর্তী অংশ দ্বিতীয় পর্বে... 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post