বিশ শতকে কৃষক আন্দোলন :পর্ব - ০৪ (আইন অমান্য)

বিশ শতকে কৃষক আন্দোলন : পর্ব - ০৪
বিশ শতকে কৃষক আন্দোলন : পর্ব - ০৪

(১.) আইন অমান্য আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় :-

(i.) ১৯৩০ খ্রিঃ গান্ধীজির ডাকে ভারতে শুরু হয় আইন অমান্য আন্দোলন। 

(ii.) ১৯৩০ থেকে ১৯৩৪ খ্রিঃ পর্যন্ত দুটি পর্বে ভারতে আইন অমান্য আন্দোলন চলেছিলো।

(iii.) ১৯৩০ খ্রিঃ ৬ ই এপ্রিল, গান্ধীজির ডান্ডি অভিযান ও লবন সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়ে ভারতে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা ঘটে। 

(২.) আইন অমান্য পর্বে কৃষক আন্দোলনের কারন :-

(i.) আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হওয়ার প্রধান কারন ছিল - 

  • ১৯২৯ খ্রিঃ বিশ্বব্যাপী আর্থিক মহামন্দার প্রভাব
  • দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি
  • কৃষিপন্যের দাম কমে যাওয়া, এবং 
  • জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাব। 
(ii.) গান্ধীজি আইন অমান্য আন্দোলনে কৃষকদের খাজনার পরিমান ৫০ % কমানোর দাবি উত্থাপন করলে তা আপামোর কৃষক সমাজকে আন্দোলনে উৎসাহিত করে তোলে। 

(৩.) আইন অমান্য পর্বে কৃষক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও আন্দোলনের স্থান/এলাকা :- 

(i.) আইন অমান্য পর্বে মূলত সরকারি কর বা খাজনা বর্জন বা কমানোর দাবিতে ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়।

(ii.) এই পর্বে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। 

(iii.) কৃষকরা দাঙ্গা হাঙ্গামার বদলে মিছিল ও সমাবেশের মাধ্যমে জমায়েত হয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে তাদের দাবি দাওয়া পেশ করে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল - খাজনা হ্রাস ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ। 

(iv.) এইসব রাজ্য গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল - উত্তরপ্রদেশ, বিহার, বাংলা, গুজরাট, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব, গুজরাট। 

আইন অমান্য পর্বে কৃষক আন্দোলনের স্থান ও নেতৃত্ব :- 



রাজ্যের নাম কৃষক আন্দোলনের স্থান ও নেতৃত্ব
উত্তরপ্রদেশ স্থান :- অযোধ্যা, আগ্রা ও রায়বেরিলিতে। নেতৃত্ব :- জওহরলাল নেহরু, কালিকাপ্রসাদ, রফি আহমেদ কিদোরাই, অঞ্জনিকুমার।
বিহার নেতৃত্ব :- স্বামী সহজানন্দ, যদুনন্দন শর্মা, পঞ্চানন বর্মা, রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন।
বাংলা স্থান :- আরামবাগ, মেদিনীপুর, শ্রীহট্ট, ত্রিপুরা, হুগলি, ঢাকা, দিনাজপুর। নেতৃত্ব :- কিষান সভা, শ্রমিক কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লিগ।
গুজরাত স্থান:- সুরাট ও বারদৌলি তালুক।
কেরালা নেতৃত্ব :- কেলাপ্পান, কমিউনিস্ট পার্টি ও সমাজতন্ত্রীরা।
অন্ধ্রপ্রদেশ নেতৃত্ব :- এন জি রঙ্গ, বেঙ্কটরামা নাইডু, বাল রামকৃষ্ণ।
পাঞ্জাব নেতৃত্ব :- সোহন সিং, হরি সিং, তেজা সিং, জাগীর সিং, ভগবান সিং।


(ক.) উত্তরপ্রদেশ :- (কংগ্রেসের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন হয়) 

(i.) ১৯৩১ খ্রিঃ উত্তরপ্রদেশে কৃষক আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করেছিলো। 

(ii.) উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা ও রায়বেরিলিতে কৃষকদের খাজনা বন্ধের আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করেছিলো। অনেক কৃষককে জমি থেকে উৎখাত করে দেওয়া হলে আন্দোলন হিংস্রাশ্রয়ী হয়ে উঠেছিলো। 

(iii.) কৃষকদের এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন - জওহরলাল নেহরু, কালিকাপ্রসাদ, রফি আহমেদ কিদোয়াই ও অঞ্জানিকুমার। 

(খ.) বিহার :- (বামপন্থীদের নেতৃত্বে আন্দোলন হয়) 

(i.) বিহারে আইন অমান্য আন্দোলনের আগেই স্বামী সহজানন্দ ১৯২৯ খ্রিঃ "বিহার প্রাদেশিক কিষান সভা" গঠন করে কৃষকদের সংগঠিত করেন। 

(ii.) পরবর্তীকালে কংগ্রেসের আপসমুখী মনোভাবে বিরক্ত  স্বামী সহজানন্দ কংগ্রেস ত্যাগ করে স্বাধীন ভাবে কৃষকদের সংগঠিত করেন এবং খাজনা বর্জন, কৃষক উচ্ছেদ ও জমিদারি প্রথা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। 

(iii.) মহামন্দার সময়ে খাজনা দিতে না পারায় বিহারে যেসব জমি জমিদাররা কেড়ে নেন, সেই জমিকে বলা হতো - " বকাস্ত জমি"। 

(iv.) বকাস্ত জমি ফিরে পাবার জন্য বিহারে ১৯৩৫ খ্রিঃ বকাস্ত আন্দোলন শুরু হয়। 

(v.) বিহারে কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন - স্বামী সহজানন্দ, যদুনন্দন শর্মা, পঞ্চানন বর্মা ও রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতো বামপন্থী নেতারা। 

(গ.) বাংলা :- (কিষান সভা, শ্রমিক কৃষক দল, কংগ্রেস ও বামপন্থীদের নেতৃত্বে হয়) 


(i.) মহামন্দার ফলে বাংলাতেও কৃষি পন্যের দাম অনেকখানি কমে গিয়েছিল। ফলে এখানকার কৃষকরাও জমিদারদের খাজনা বন্ধ করে দেওয়ার আন্দোলন শুরু করেছিলো। তারা 

(ii.) চৌকিদারি কর ও লবন কর দেওয়া বন্ধ করে। 

(iii.) গ্রামে পাহাড়া দেওয়ার জন্য সরকার চৌকিদার নিয়োগ করেছিলো, এর জন্য বাংলার গ্রাম গুলিতে যে কর আরোপ করা হয়েছিলো, তাই ছিলো চৌকিদারি কর। 

(iv.) বাংলাতে আরামবাগ, মেদিনীপুর, শ্রীহট্ট ও ত্রিপুরা,ঢাকা সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষকরা খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করেছিলো। 

(ii.) বাংলাতে খাজনা বন্ধ ছাড়াও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ও বর্গাদার ও ভাগচাষীরা জমির আধিকারের জন্য (কাঁথি ও মহিষাদলে ও পূর্ব বঙ্গে) আন্দোলন করেছিলো। 

(iii.) বাংলায় কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলো - কিষান সভা, শ্রমিক কৃষক দল, কৃষক প্রজা পার্টি, মুসলিম লিগ ও বামপন্থীরা। 

(ঘ.) গুজরাট :- (জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে) 

(i.) গুজরাটের খেদা, সুরাট ও বারদৌলিতে পতিদার সম্প্রদায়ের কৃষকরা ১৯৩৩ খ্রিঃ খাজনা বন্ধের আন্দোলন করে। 

(ঙ.) কেরালা :- (কংগ্রেস ও সমাজতন্ত্রীদের উদ্যোগে) 

(i.) কেরালায় কংগ্রেস নেতা কেলাপ্পান কৃষকদের নিয়ে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। 
(ii.) কেরালার গ্রামগুলিতে "কৃষক সঙ্গম" নামে কৃষক সমিতি গঠন করে কৃষকদের সংঘবদ্ধ করা হয়। 
(iii.) কৃষক উচ্ছেদ, আগাম খাজনা দানের রীতি ও বিভিন্ন সামন্ততান্ত্রিক উপকর বাতিলের দাবিতে সেখানে আন্দোলন হয়। 
(iv.) কেরালায় কৃষক সংগঠনে কংগ্রেস ছাড়াও কমিউনিস্টসোশ্যালিস্টরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। 

(চ.) অন্ধ্রপ্রদেশ :- (কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি) 

(i.) অন্ধ্রপ্রদেশে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন কংগ্রেস কর্মী এন জি রঙ্গ। এছাড়াও ছিলেন বেঙ্কাট রামা নাইডু, বাল রামকৃষ্ণ ও কমিউনিস্ট নেতা পি সুন্দরাইয়ার।

(ii.) আইন অমান্য আন্দোলন শুরুর আগে থেকেই অন্ধ্রপ্রদেশে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছিলো। ১৯২৮ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো "অন্ধ্র প্রাদেশিক রায়ত সংঘ"।

(iii.) আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে অন্ধ্রের কৃষকরা মিছিল করে জেলা ও সদর তালুকে মিলিত হয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে খাজনা কমানো ও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের দাবি উত্থাপন করেছিলো।

(ছ.) পাঞ্জাব :-

(i.) পাঞ্জাবে কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন - সোহন সিং, হরি সিং, তেজা সিং, জাগীর সিং, ভগবান সিং প্রমুখরা।

(ii.) পাঞ্জাবে জাঠ ও শিখ কৃষকরা খাজনা বন্ধের জন্য, এবং অমৃতসর ও লাহোরের কৃষকরা সেচকর বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলন করেন।

(৩.) সমাজতন্ত্রী দল ও সারা ভারত কিষান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা :- 

(i.) আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করার পরেও ধীর গতিতে কৃষক আন্দোলন চলতে থাকে। 

(ii.) আইন অমান্য আন্দোলন পরবর্তীকালে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল - কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল প্রতিষ্ঠা এবং সর্বভারতীয় কিষান সভা প্রতিষ্ঠা। 

(iii.) কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের উদ্যোগে কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই ১৯৩৪ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয় কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল। 

(iv.) সমাজতন্ত্রী দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - জয়প্রকাশ নারায়ন, আচার্য নরেন্দ্রদেব, রামমনোহর লোহিয়া, অচ্যুত পট্টবর্ধন প্রমুখ। 

(v.) কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল প্রতিষ্ঠার দু বছরের মাথায় এই দল ও কমিউনিস্টদের উদ্যোগে ১৯৩৬ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয় "সারা ভারত কিষান কংগ্রেস" বা "সর্বভারতীয় কিষান সভা"। 

(vi.) সর্বভারতীয় কিষান সভার সভাপতি ছিলেন স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী এবং প্রথম সম্পাদক ছিলেন এন জি রঙ্গ। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post