|
বিশ শতকে কৃষক আন্দোলন : পর্ব - ৫ |
(ক.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:-
(১.) গান্ধীজির ডাকা সর্বশেষ সর্বভারতীয় গন আন্দোলন ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা ১৯৪২ এর আগস্ট আন্দোলন।
(২.) ১৯৪২ খ্রিঃ ৮ ই আগস্ট গান্ধীজি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেন। এর ফলে পরের দিন ৯ ই আগস্ট থেকেই ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়ে যায়।
(৩.) ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই জাতীয় কংগ্রেসের সমস্ত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নেতৃত্বকে গ্রেফতার করে নেওয়ায়, এই আন্দোলন সম্পূর্ণ ভাবেই ছিলো নেতৃত্বহীন।
(৪.) গান্ধীজি ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে চূড়ান্ত বা শেষ আন্দোলন হিসাবে ঘোষনা করেন এবং এর শ্লোগান দেন - "করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে" অর্থাৎ করব না হয় মরবো।
(খ.) ভারত ছাড়ো পর্বে কৃষক আন্দোলনের কারন :-
(১.) ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিলো একটি স্বতঃস্ফূর্ত গন আন্দোলন। এই গন আন্দোলনে অন্যান্য শ্রেণি গুলির পাশাপাশি কৃষকরাও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলো।
(২.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কৃষকদের অংশগ্রহণের প্রধান কারন গুলি ছিল ৩ টি -
- (ক.) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯ - ১৯৪৫) জনিত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও কৃষকদের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ,
- (খ.) জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাব, এবং
- (গ.) ব্যাপক পুলিশী অত্যাচার ও নির্যাতন।
এই তিনটি কারনে কৃষকদের মনে যে বিশাল ক্ষোভের জন্ম হয়েছিলো, তার ফলেই দলে দলে কৃষক সম্প্রদায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল হয়।
(গ.) কৃষক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য :-
(১.) এম হারকোর্টের মতে "ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল মূলত কৃষক বিদ্রোহ, যার নেতৃত্বে ছিল শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণী ।
(২.) ভারত ছাড়ো পর্বে কৃষক আন্দোলন জাতীয়তাবাদী গন আন্দোলনের সাথে একসঙ্গে মিলেমিশে সংগঠিত হয়েছিলো।
(৩.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কৃষকরা কোথাও জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হয় নি অর্থাৎ ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন শ্রেনী সংগ্রামের রূপ লাভ করতে পারে নি।
(৪.) যেসব জমিদার ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলো, কৃষকরা কেবলমাত্র তাদের ওপরেই আক্রমণ করেছিলো।
(৫.) জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থক ধনী কৃষক ও জমিদাররা প্রথমে আন্দোলন শুরু করে। পরে দরিদ্র ও নিন্মবর্গের কৃষকরা আন্দোলনে সামিল হয়।
(গ.) কৃষক আন্দোলনের স্থান ও পরিচয় :-
(১.) শুরুর দিকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ভরকেন্দ্র ছিল শহরাঞ্চল।
(২.) পরে এই আন্দোলনের ভরকেন্দ্র গ্রামাঞ্চলে স্থানান্তরিত হলে, এই দ্বিতীয় পর্বেই কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়।
(৩.) ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয় - বিহার, ঊড়িষ্যা, বোম্বাই, গুজরাত ও বাংলাতে।
(৪.) রাহুল সাংস্কৃত্যায়নের রচনায় ও সতীনাথ ভাদুড়ীর রচিত "জাগরী" উপন্যাসে কৃষকদের সংগ্রামী ভূমিকার পরিচয় পাওয়া যায়।
রাজ্যের নাম |
কৃষক আন্দোলনের স্থান ও নেতৃত্ব |
বিহার |
নেতৃত্ব :- যদুবংশ সাহা, তালেবর সারা, রামকল ধনুক। স্থান :- হাজারিবাগ, ভাগলপুর, মজফফরপুর, মুঙ্গের, কাটিহার। |
ঊড়িষ্যা |
নেতৃত্ব :- লক্ষন নায়ক। স্থান :- তালচের, বালেশ্বর, কটক, কোরাপুট। |
মহারাষ্ট্র |
স্থান :- খান্দেশ, সাতারা |
উত্তরপ্রদেশ |
স্থান :- আজমগড়, বালিয়া, গোরক্ষপুর জেলা। |
গুজরাট |
স্থান :- ব্রোচ, আমেদাবাদ, সুরাট। |
পাঞ্জাব |
নেতৃত্ব :- ভগবান সিং লঙ্গয়ালের নওজোয়ান ভারতসভা, কীর্তিকিষান সভা। |
বাংলা |
স্থান:- মেদিনীপুর, বীরভূম, দিনাজপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া। নেতৃত্ব :- বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, কৃষক সভা। |
বিহার :-
(১.) বিহারে পালামৌ জেলার কৃষকরা যদুবংশ সাহারের নেতৃত্বে এবং কাটিহারে তালেবর সারার নেতৃত্বে কৃষিজীবী সাঁওতালরা বিদ্রোহ করে।
(২.) বিহারের হাজারিবাগ, ভাগলপুর ও ভোজপুরে ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহ দেখা যায়।
(৩.) বিহারে ৮০% থানা আন্দলনরত কৃষকদের দখলে চলে গিয়েছিলো।
ঊড়িষ্যা :-
(১.) ঊড়িষ্যার কোরাপুটে লক্ষন নায়েকের নেতৃত্বে উপজাতি কৃষকরা জয়পুরের রাজার সংরক্ষিত অরন্য ধ্বংস করে থানা আক্রমণ করে।
(২.) ঊড়িষ্যার তালচেরে পবিত্রমোহনের নেতৃত্বে "চাষি - মোল্লা" রাজ গঠিত হয়।
(৩.) বালেশ্বরে পাঁচ হাজার কৃষক থানা আক্রমণ করে।
মহারাষ্ট্র :-
(১.) মহারাষ্ট্রের খান্দেশ ও সাতারায় ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহ দেখা যায়।
(২.) মহারাষ্ট্রের দরিদ্র ও নীচু জাতির "কুনবি" কৃষকরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
(৩.) তারা গেরিলা রননীতির মাধ্যমে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস ও আক্রমণ করে।
(৪.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় সাতরায় কৃষকদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল "বহিয়া সমাজ"।
গুজরাট :-
(১.) গুজরাটের ব্রোচ জেলায় ব্যাপক কৃষক আন্দোলন দেখা যায়।
(২.) গুজরাটের বহু জায়গায় খাজনা বন্ধের আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিলো।
বাংলা :-
(১.) বাংলার মেদিনীপুরের কৃষকরা জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে।
(২.) মেদিনীপুরের তমলুক ও কাঁথিতে কৃষিজীবী মাহিষ্য সম্প্রদায় বিদ্রোহের পুরোভাগে এসেছিলো।
পাঞ্জাব :-
(১.) পাঞ্জাবে কমিউনিস্ট প্রভাবিত সংগঠন "নওজোয়ান ভারত সভা" ও "কীর্তি কিষান সভা" র উদ্যোগে কৃষকরা সংঘবদ্ধ হয়।
(২.) পাঞ্জাবের পাতিয়ালার ভগবান সিং লঙ্গয়ালের নেতৃত্বে কৃষকরা ফসলের ভাগ চাষকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে তোলে।
উত্তর প্রদেশ :-
(১.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে উত্তরপ্রদেশের গ্রামাঞ্চল গুলিতে তীব্র করে তুলেছিলো কৃষকরা।
(২.) অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে যোগ দিয়ে তারা বিভিন্ন থানা দখল করে ও সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করে।
(৩.) উত্তর প্রদেশের বালিয়া, গাজিপুর, আজমগর, বারানসী প্রভৃতি স্থানে কৃষকদের নেতৃত্বে আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো।