বিশ শতকে কৃষক আন্দোলন : পর্ব - ৬ |
(ক.) বারদৌলি সত্যাগ্রহ (১৯২৮) সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-
(১.) বারদৌলি ছিলো গুজরাটের সুরাট জেলার একটি তালুক বা অঞ্চল। এর অধীনে ছিলো ১৩৭ টি গ্রাম।
(২.) এখানে রায়তওয়ারি ভূমি ব্যবস্থা চালু ছিলো। অর্থাৎ এখানে জমিদার জমির মালিক ছিলো না। সরাসরি রায়ত বা কৃষকরা সরকারকে খাজনা দিতো।
(৩.) বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ১৮২০ খ্রিঃ আলেকজান্ডার রিড ও টমাস মনরো "রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত" প্রবর্তন করেছিলেন।
(৫.) ১৯২৮ খ্রিঃ গুজরাটের সুরাট জেলার বারদৌলিতে বর্ধিত খাজনা বন্ধের জন্য যে কৃষক আন্দোলন হয়েছিলো, তাকেই "বারদৌলি সত্যাগ্রহ" বলা হয়।
(৬.) ১৯২৭ খ্রিঃ বোম্বাই প্রেসিডেন্সির প্রশাসন কৃষকদের খাজনার পরিমান এক ধাক্কায় ২২% বাড়িয়ে দিলে, এরই প্রতিবাদে বারদৌলি সত্যাগ্রহ কৃষক আন্দোলন শুরু হয়।
(৭.) বারদৌলি সত্যাগ্রহের প্রধান নেতৃত্ব ও পরিচালক ছিলেন বল্লভভাই প্যাটেল।
(৮.) বোম্বাই প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের কৃষকদের একমঞ্চে আনার জন্য বল্লভভাই প্যাটেল "বোম্বাই প্রেসিডেন্সি ল্যান্ড সংঘ" গঠন করেছিলেন। এর মাধ্যমে কৃষক আন্দোলন সারা বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
(৯.) ১৯২৮ খ্রিঃ গান্ধীজি বারদৌলিতে এসে আন্দোলন পরিচালনা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
(১০.) শেষপর্যন্ত আন্দোলনের চাপে সরকার খাজনার হার কমাতে বাধ্য হয়।
(১১.) ব্রুমফিল্ড ম্যাক্সওয়েল তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় বারদৌলি তালুকে খাজনা বৃদ্ধির তদন্ত করার জন্য।
(১২.) এই তদন্ত কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে শেষপর্যন্ত খাজনার হার ৬.০৩% বৃদ্ধি করা হয়।
(১৩.) বারদৌলি সত্যাগ্রহে সফল নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বারদৌলির মহিলারা বল্লভভাই প্যাটেলকে "সর্দার" উপাধিতে ভূষিত করে।
(১৪.) বারদৌলি সত্যাগ্রহ পরিচালনার জন্য বারদৌলি থেকে প্রকাশিত হয় - "সত্যাগ্রহ পত্রিকা"।
(১৫.) বারদৌলি সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণকারী স্থানীয় কয়েকজন নেতা ছিলেন -
- কল্যানজি মেহতা
- কুনবেরজি মেহতা
- দয়ালজি দেশাই
- সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের কন্যা - মনিবেন প্যাটেল
- মিঠুবেন পেটিট
- সারদা মেহতা
- সারদাবেন শাহ।
(খ.) বারদৌলিতে কৃষকদের শ্রেনী কাঠামো কেমন ছিলো?
(১.) বারদৌলিতে উচ্চবর্নের কৃষকরা "উজলিপরাজ" (সাদা মানুষ) নামে পরিচিত ছিলো।
(২.) উজলিপরাজরা ছিলেন পাতিল সম্প্রদায়ের। এদের পদবি ছিলো প্যাটেল। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলও ছিলেন উজলিপরাজ সম্প্রদায়ের।
(৩.) অন্যদিকে বারদৌলিতে ৬০% ভূমিহীন, ভাগচাষী বা ক্ষেতমজুররা ছিলো নিন্মবর্নের গোষ্ঠীভুক্ত। এদেরকে গুজরাটী ভাষায় বলা হতো "কপিলরাজ" (কালো মানুষ)।
(৪.) কপিলরাজরা "হালিপ্রথায়" উজলিপরাজদের জমি চাষ করতো।
বারদৌলিতে কৃষকদের শ্রেনি কাঠামো |
(৫.) বংশানুক্রমিক ভাবে বাধ্যতামূলক শ্রমদানের প্রথাকেই বলা হতো "হালিপ্রথা"। কপিলরাজরা উজলিপরাজদের ঋনদাসে পরিনত হয়ে নানা অত্যাচার ও শোষনের শিকার হয়ে হালিপ্রথায় চাষাবাদ করতে বাধ্য ছিলো।
(৬.) মহাত্মা গান্ধী কালিপরাজদের নতুন নামকরন করেছিলেন, "রানিপরাজ" অর্থাৎ অরন্যের অধিবাসী।
(গ.) বারদৌলি সত্যাগ্রহের প্রতি জাতীয় কংগ্রেসের মনোভাব, অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি :-
বারদৌলি সত্যাগ্রহের প্রতি জাতীয় কংগ্রেসের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানের মূল দিক গুলি হলো -
- (ক.) বারদৌলি তালুক যেহেতু একটি রায়তওয়ারি এলাকা অর্থাৎ জমিদার বিহীন এলাকা ছিলো, তাই জাতীয় কংগ্রেস বারদৌলির কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলো এবং
- (খ.) সক্রিয় ভাবে আন্দোলন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।
- (গ.) বারদৌলি সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান নেতা বল্লভভাই প্যাটেল। সরকার বর্ধিত রাজস্বের হার না কমালে গান্ধীজি নিজে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন বলেছিলেন।
- (ঘ.) বারদৌলি সত্যাগ্রহ ছিলো একটি পরিকল্পিত আন্দোলন। কংগ্রেস অসহযোগ আন্দোলনের সময়েই বারদৌলি সত্যাগ্রহের পরিকল্পনা করেছিলো। কিন্তু নানা কারনে তা করে ওঠা সম্ভব হয় নি।
- (ঙ.) অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষনা বারদৌলি তালুকে জাতীয় কংগ্রেসের বৈঠক থেকেই করা হয়েছিলো। গান্ধীজির আকস্মিক অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারে দেশব্যাপী যে হতাশা দেখা দিয়েছিলো, ১৯২৮ খ্রিঃ বারদৌলি সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়ে কংগ্রেস সেই হতাশাকে দূর করতে চেয়েছিলো।
- (চ.) অসহযোগ পরবর্তী পর্বে বারদৌলি সত্যাগ্রহ গান্ধী প্রদর্শিত মত ও পথের গ্রহনযোগ্যতাকে দেশব্যাপী সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলো।