বিশ শতকে কৃষক আন্দোলন:পর্ব - ২

বিশ শতকে কৃষক আন্দোলন : পার্ট - ০২
বিশ শতকে কৃষক আন্দোলন : পার্ট - ০২

(১.) বিশ শতকের কৃষক আন্দোলনের পরিচয় :- 

(i.) বিশ শতক বলতে ১৯০১ থেকে ২০০০ খ্রিঃ পর্যন্ত সময়কালকে বোঝায়। 

(ii.) এই সময়কালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাবে বা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সাযুর্জ্য রেখে ভারতে বেশ কিছু কৃষক আন্দোলন সংঘঠিত হয়। এই আন্দোলন গুলিকেই এককথায় "বিশ শতকের কৃষক আন্দোলন" বলে।

(iii.) বিশ শতকের কৃষক আন্দোলনের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন - 

  • (ক.) এই সময়ের কৃষক আন্দোলন গুলি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়। 
  • (খ.) কৃষক সমাজের বাইরের নেতারাই এই সময় কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ও কৃষকদের সংগঠিত করেন। 
  • (গ.) এই পর্বের কৃষক আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় জাতীয় কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা। 
  • (ঘ.) নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে এই সময়ের কৃষক আন্দোলন গুলি হয়েছিলো।
  • (ঙ.) জাতীয় কংগ্রেসের প্রভাবে এই সময়ের কৃষক আন্দোলন গুলি যথার্থ শ্রেনী সংগ্রামের রূপ লাভ করতে পারে নি। 
  • (চ.) "কৃষক সভা" গঠন এই সময়কালের কৃষক আন্দোলনের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো। 
*******************************************

(২.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে (১৯০৫ - ১৯১১) কৃষক আন্দোলন :- 

(ক.) বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন 

(i.) লর্ড কার্জন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করার জন্য বঙ্গভঙ্গের বা বাংলাকে প্রশাসনিক ভাবে দ্বিখন্ডিত করার কথা ঘোষনা করেন - ১৯০৫ খ্রিঃ ১৯ শে জুলাই

(ii.) লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন - ১৯০৫ খ্রিঃ ১৬ ই অক্টোবর

(iii.) লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বাংলাতে শুরু হয়েছিলো - স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৫ - ১৯১১)

(iv.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের দুটি ধারা ছিলো - বয়কট ও স্বদেশী।  

(v.) বয়কট বলতে বিলাতি বা বিদেশী জিনিসপত্র বর্জন করা, এবং স্বদেশী বলতে দেশে তৈরি জিনিসের ব্যবহারকে বোঝায়।

(খ.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী পর্বে কৃষক আন্দোলন :- 

(i.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণী অংশগ্রহণ করলেও, কৃষকরা অংশগ্রহণ করে নি। 

(ii.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অনেক জায়গায় কৃষকদের জোর করে উচ্চমূল্যের স্বদেশী জিনিসপত্র কেনার জন্য স্বদেশী আন্দোলনকারীরা চাপ দিলে বহু কৃষক অর্থনৈতিক দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন এবং ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। 

(iii.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের অংশগ্রহণ না করার কারন গুলি ছিলো -

  • (ক.) এই আন্দোলনের সঙ্গে কৃষকদের শ্রেনী স্বার্থের কোন যোগ ছিলো না। 
  • (খ.) কৃষকদের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ছিলো না। 
  • (গ.) আন্দোলনকারী নেতারা কৃষকদের সামিল করতে চান নি। 
  • (ঘ.) কৃষক সমাজের পক্ষে এই আন্দোলনে কোন নেতা ছিলো না। 
  • (ঙ.) পূর্ব বঙ্গের মুসলিম কৃষকরা স্বদেশী আন্দোলনকে হিন্দু স্বার্থ রক্ষার আন্দোলন হিসাবে মনে করেছিলেন। 
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী পর্বে কৃষক আন্দোলনের তালিকা
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী পর্বে কৃষক আন্দোলনের তালিকা


(iv.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় কৃষক আন্দোলনের মধ্যে একটি সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য ছিলো। 

(v.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাবে বাংলাতে কোন কৃষক আন্দোলন সংগঠিত না হলেও, ১৯০৬ - ০৭ খ্রিঃ পূর্ব বঙ্গের কুমিল্লা ও ময়মনসিংহতে হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের ক্ষোভ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ নিয়েছিলো। 

(vi.) ১৯০৫ - ১৯১১ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন পর্বে ভারতের উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলন গুলি ছিলো - 
  • (ক.) বিহারের চম্পারন জেলার মতিহারি বেতিয়া অঞ্চলের নীলচাষিদের আন্দোলন (১৯০৫ - ১৯০৮)। 
  • (খ.) পাঞ্জাবে চিনাব নদী সংলগ্ন এলাকায় বাড়তি জলকরের বিরুদ্ধে স্থানীয় কৃষকদের আন্দোলন (১৯০৭)। 
  • (গ.) রাজস্থানের মেবার অঞ্চলের বিজলিয়াতে ৮৬ ধরনের সামন্ততান্ত্রিক উপকারের বিরুদ্ধে কৃষকদের  আন্দোলন (১৯০৫ - ১৯১৩)। 
(vii.) স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কিত - "দ্য স্বদেশী মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল" - গ্রন্থটি লিখেছিলেন - ড. সুমিত সরকার। 

(viii.) ১৯০৬ খ্রিঃ "স্বদেশ বান্ধব সমিতি" গঠন করেছিলেন - অশ্বিনী কুমার দত্ত। 

(ix.) স্বদেশী আন্দোলনের সময় অশ্বিনী কুমার দত্তের স্বদেশ বান্ধব সমিতি ৫২৩ টি গ্রাম্য বিবাদের মীমাংসা করেছিলো। 

*******************************************

(৩.) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কৃষক আন্দোলন :-

(i.) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ খ্রিঃ, ২৮ শে জুলাই এবং শেষ হয় ১৯১৮ খ্রিঃ ১১ নভেম্বর। 

(ii.) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সরকার ভূমি রাজস্বের হার অত্যধিক বৃদ্ধি করলে কৃষক অসন্তোষের জন্ম হয়। 

(iii.) এই পর্বের উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলন ছিলো দুটি - 
  • বিহারের চম্পারন সত্যাগ্রহ (১৯১৭)
  • গুজরাটের খেদা / খেড়া সত্যাগ্রহ (১৯১৮)
(iv.) দুটি সত্যাগ্রহ আন্দোলনই পরিচালিত হয় মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে। 

(ক.) চম্পারন সত্যাগ্রহ (১৯১৭) :- 

(i.) বিহারের চম্পারনে নীলচাষীদের প্রতি বিঘার ৩ কাঠা জমিতে বাধ্যতামূলক ভাবে নীলচাষ করতে হতো। একে বলা হতো - "তিনকাঠিয়া ব্যবস্থা"। 

(ii.) গান্ধীজির নেতৃত্বে চম্পারন সত্যাগ্রহের ফলে সরকার ১৯১৭ খ্রিঃ "চম্পারন কৃষি বিল" পাস করে। 

(iii.) চম্পারন কৃষিবিল দ্বারা তিন কাঠিয়া প্রথার অবসান ঘটানো হয়। 

(খ.) খেদা সত্যাগ্রহ (১৯১৮) :- 

(i.) গুজরাটের কৈরা বা খেদা জেলা ছিলো একটি রায়তওয়ারি অঞ্চল, অর্থাৎ এটি জমিদারি এলাকা ছিলো না। এখানে কৃষকরা সরাসরি সরকারকে খাজনা দিতো। 

(ii.) সরকার বাড়তি রাজস্ব চাপালে গান্ধীজির নেতৃত্বে এখানকার কৃষকরা সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করে। 

(iii.) গান্ধীজি বল্লভভাই প্যাটেল ও ইন্দুলাল যাজ্ঞিকের সহায়তায় এখানে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেন। 

(iv.) গান্ধীজির নেতৃত্বে চম্পারন ও খেদা সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়ে বিশ শতকে জাতীয় কংগ্রেস সর্বপ্রথম সক্রিয় ভাবে কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post