১৯২০ দশকে ভারতে বামপন্থী মতাদর্শ ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়লে ও জনপ্রিয়তা অর্জন করলে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দুটি বামপন্থী দলের উদ্ভব হয়। প্রথমটি ছিলো "ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি"। দ্বিতীয়টি ছিলো "কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল"।
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল |
মতাদর্শের দিক থেকে "ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি" ও "কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল" সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হলেও, দুই দলের মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিলো। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি "কমিন্টার্ন" বা "আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট" সংগঠনের নির্দেশ মেনে চলতো। অন্যদিকে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল কংগ্রেসের অভ্যন্তরের এক বামপন্থী গোষ্ঠী বা দল ছিলো। এরা কংগ্রেসের মধ্য থেকেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মতো বিদেশী রাষ্ট্রের অনুকরন করে (সোভিয়েত রাশিয়ার ধাঁচের) সমাজতন্ত্র ভারতে প্রতিষ্ঠিত হোক এটা কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীরা কখনোই চাইতেন না। এই বিষয়ে তাদের অভিমত ছিলো অত্যন্ত স্পষ্ট। তারা বলতেন, ভারত তার নিজস্ব প্রয়োজন ও উপযোগীতার ভিত্তিতে নিজস্ব পথেই সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
তবে কর্মপদ্ধতি নিয়ে দুই দলের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও, সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের আপোষহীন বিরোধিতা, কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করা, তাদের অধিকার, স্বার্থ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতি কর্মসূচির প্রশ্নে দুই দলের মধ্যে অনেক মিল ছিলো। এই কারনে কমিউনিস্ট পার্টির অনেক সদস্যই ভারতে বামপন্থার প্রসারে বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলে যোগ দিতেন বা নানা ভাবে সমাজতন্ত্রীদের কর্মসূচি গুলিকে রূপায়নের কাজে সহযোগীতা করতেন।
(ক.)কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য :-
(১.) কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল কংগ্রেস বিরোধী বা জাতীয় কংগ্রেসের বাইরের কোন পৃথক দল ছিলো না।
(২.) জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই কংগ্রেসের বামপন্থী সদস্যদের নিয়ে এই দল গঠিত হয়েছিলো।
(৩.) এই দলের সভ্য হতে গেলে জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য পদ গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক ছিলো।
(৪.) জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যরা আবেদনের ভিত্তিতে কংগ্রেসের সমাজতন্ত্রী দলের সদস্য হতে পারতেন।
(৫.) কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের সদস্যরা একদিকে যেমন মার্কসবাদ, শ্রেনী সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলেন, তেমনি মহাত্মা গান্ধীর জাতীয়তাবাদী ভাবধারাতেও বিশ্বাসী ছিলেন।
(৬.) জাতীয় কংগ্রেসকে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় পরিচালিত করার জন্যই কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের উদ্ভব ঘটেছিলো।
(খ.) প্রেক্ষাপট ও কারন :-
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চারটি বিশেষ ঘটনা কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের উদ্ভবের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলো। এগুলি হলো -
(১.) রুশ বিপ্লবের প্রভাব,
(২.) সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী জওহরলাল নেহেরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর প্রভাব,
(৩.) কৃষক - শ্রমিক সংগঠনে জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও উদাসীনতা, এবং
(৪.) আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যর্থতা।
১৯১৭ খ্রিঃ রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ভারতের রাজনীতিতে এক প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯২০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ভারতে সমাজতান্ত্রিক ও বামপন্থী চিন্তাধারার দ্রুত প্রসার ঘটতে শুরু করেছিলো। ক্রমে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার ঢেউ জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও এসে পৌঁছায়।
কংগ্রেসে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার আমদানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু ও সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯২৭ খ্রিঃ জওহরলাল নেহেরু সোভিয়েত রাশিয়া পরিভ্রমনকালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপায়ন দেখে অভিভূত হয়ে যান। ১৯২৮ খ্রিঃ পূর্ন স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে মিলিত ভাবে তিনি "Independence for India League"গঠন করেন। ১৯৩৩ খ্রিঃ "ভারত কোন পথে" প্রবন্ধে জওহরলাল নেহেরু সকল কায়েমি স্বার্থ ও শ্রেনীগত সুবিধা বিনষ্ট করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। নেহেরু কংগ্রেস দলকে প্রভাবিত করে সমাজতন্ত্রমুখী আন্দোলনকে জোরদার করতে চেয়েছিলেন। ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কংগ্রেস ত্যাগের কোন প্রয়োজন নেই বলেও তিনি মনে করতেন।
নেহেরু বিশ্বাস করতেন, কংগ্রেসের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আপাত কোন বিরোধ নেই। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার জন্য শ্রমিক ও কৃষকদের সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব নেহেরু বুঝেছিলেন। তাই তিনি কংগ্রেসের পতকাতলে শ্রমিক ও কৃষকদের আনতে চেয়েছিলেন।
নেহেরুর মতো সুভাষচন্দ্রও বিশ্বাস করতেন, ভারতের জাতীয় সংগ্রামের দুটি স্তর আছে। প্রথমটি হলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। দ্বিতীয়টি হলো সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। নেহেরুর মতো সুভাষ চন্দ্রও মনে করতেন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন।
আসলে ভারতে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দুজনের অভিমত ছিলো প্রায় একই ধরনের। নেহেরু বিশ্বাস করতেন, ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য হুবহু রাশিয়াকে অনুসরন করার কোন দরকার নেই। ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে ভারতীয়দের প্রয়োজন ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। সুভাষচন্দ্রও বিশ্বাস করতেন বিদেশী রাষ্ট্রের অনুকরনে ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে তা বিশেষ ফলপ্রসূ হবে না। ভারতের নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বজায় রেখেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে এগিয়ে যেতে হবে।
বলা বাহুল্য, সমাজতন্ত্র সম্পর্কে জওহরলাল নেহেরু ও সুভাষ চন্দ্র বসুর এইসকল চিন্তাধারাই কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের প্রেক্ষাপট ও মতাদর্শ রচনা করেছিলো। কংগ্রেসের অনেক তরুন প্রজন্মের নেতৃত্ব নেহেরু ও সুভাষের বামপন্থী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের দক্ষিনপন্থী নেতাদের চাপে তারা অনেকটাই কোনঠাসা ছিলেন।
কংগ্রেসের দক্ষিনপন্থীদের কর্মপন্থা নিয়ে কংগ্রেসের বামপন্থী গোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছিলো। বিশেষত গান্ধীজির দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হলেও, গান্ধীজির মতাদর্শকে তারা পুরোপুরি গ্রহন করতে পারেন নি। জাতীয় কংগ্রেস জমিদার, দেশীয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের আর্থিক অনুদানে চলতো। এই কারনে অনেক সময়েই কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনে কংগ্রেস অনীহা প্রকাশ করেছিলো এবং উদাসীনতা দেখিয়েছিলো। অনেক জায়গাতেই জমিদারদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে কংগ্রেস আপোষহীন কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছিলো। আবার শ্রেনী সংগ্রামের অজুহারে কংগ্রেসের দক্ষিনপন্থী গোষ্ঠী শ্রমিক আন্দোলন পরিচালনায় পুরোপুরি অনীহা দেখিয়েছিলো।
এই অবস্থায় গান্ধীজির আকস্মাৎ অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের মতো ১৯৩৩ খ্রিঃ জুলাই মাসে আইন অমান্য আন্দোলনকে হঠাৎ করে স্থগিত ঘোষনা করলে তা কংগ্রেসের নবীন বামপন্থী গোষ্ঠীকে চরম হতাশ করে তোলে। ১৯৩০ - ৩১ ও ১৯৩২ - ৩৪ খ্রিঃ জেলে বসেই তারা গান্ধীবাদী রননীতি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন এবং বিকল্প সমাজতান্ত্রিক পথে জাতীয় কংগ্রেসকে শক্তিশালী করার চিন্তা ভাবনা করেন। এই চিন্তা ভাবনার ফলশ্রুতিতেই জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে গড়ে উঠেছিলো কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল।
(গ.) প্রতিষ্ঠা :-
গান্ধিবাদী রননীতিতে বিরক্ত এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী তরুন কংগ্রেসিরা ১৯৩৩ সালে নাসিক জেলে বসেই জাতীয় কংগ্রেসকে প্রকৃত গন সংগঠনে পরিনত করার জন্য বিকল্প পথের চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। কংগ্রেসের এই নবীন বামপন্থী তরুনেরা মাক্সবাদ বা কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হলেও, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে একমত হতে পারেন নি। এমতাবস্থায় জাতীয় কংগ্রেসকেই সমাজতান্ত্রিক পথে পরিচালিত করবার জন্য তারা কংগ্রেসের অভ্যন্তরে একটি বামপন্থী দল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
জেল থেকে মুক্তি লাভের পর কংগ্রেসি বামপন্থীরা ১৯৩৪ খ্রিঃ ১৯ মে কাশী বিদ্যাপীঠের অধ্যক্ষ আচার্য নরেন্দ্র দেবের নেতৃত্বে ও সভাপতিত্বে পাটনায় "নিখিল ভারত সমাজতন্ত্রী" সম্মেলনে মিলিত হয়। এই সম্মেলনেই সভাপতির ভাষনে আচার্য নরেন্দ্রদেব পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য কংগ্রেসের ভিতরেই একটি সমাজতান্ত্রিক দল গঠনের কথা তুলে ধরেন।
পাটনার সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনের কয়েকমাস পরে ১৯৩৪ খ্রিঃ অক্টোবর মাসে বোম্বাইয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে "কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টি" বা "কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল" প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।
(ঘ.) সদস্য :-
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের মধ্যে ছিলেন - আচার্য নরেন্দ্রদেব, ড. রামমনোহর লোহিয়া, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, অচ্যুত পট্টবর্ধন, জয়প্রকাশ নারায়ন, এম আর মাসানি প্রমুখ।
জওহরলাল নেহেরু কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের সভ্য পদ না নিলেও, এই দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছিলেন।
(ঙ.) মূল নীতি :-
প্রতিষ্ঠার সময়কাল থেকেই কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ৪ টি মৌলিক নীতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলো।
এগুলি হল : -
(১.) স্বাধীনতা লাভের জন্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলনই হলো ভারতের প্রথম সংগ্রাম।
(২.) জাতীয়তাবাদ বা জাতীয় সংগ্রামকে উপেক্ষা করে কখনোই সমাজতন্ত্রের পথে পৌঁছানো যাবে না।
(৩.) ভারতে জাতীয় গন সংগ্রামের প্রাথমিক সংগঠন হলো কংগ্রেস। তাই সমাজতন্ত্রীদের জাতীয় কংগ্রেসের মধ্য থেকেই কাজ করতে হবে।
(৪.) কংগ্রেসকে সমাজতান্ত্রিক চরিত্র ও অভিমুখ প্রদানের জন্য শ্রমিক ও কৃষকদের সংগঠিত করে তাদের আর্থিক দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের মৌলিক নীতি গুলি পর্যালোচনা ও গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল কংগ্রেস বিরোধী কোন দল ছিলো না। জাতীয় কংগ্রেসের বাইরেরও কোন দল ছিলো না। জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই এই দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।
(চ.) উদ্দেশ্য :-
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের মূল উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি গুলি ছিলো -
(১.) কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী শক্তিকে সুসংহত করা,
(২.) কংগ্রেসের দক্ষিনপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে প্রতিহত করা,
(৩.) ভারতের পূর্ন স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইকে কৃষক - শ্রমিক প্রভৃতি প্রান্তিক শ্রেনী গুলির কাছে পৌঁছে দেওয়া,
(৪.) কংগ্রেসের মধ্য থেকে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা প্রসারের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা,
(৫.) কংগ্রেসের নেতা ও কর্মীদের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় উৎসাহিত করার চেষ্টা করা।
(৬.) কংগ্রেস ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সমাজতন্ত্রের পথে পরিচালিত করা,
(৭.) সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য শ্রমিক ও কৃষকদের সংগঠন গড়ে তোলা এবং তাদের সংগঠিত করা,
(৬.) কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থে ব্যপক সংস্কারের প্রস্তাব গ্রহণ করা।
(ছ.)কর্মসূচি ও দাবিসমূহ :-
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল তার মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলো। যেমন -
(i.) শিল্পের সমাজতন্ত্রীকরন, (ii.) বৈদেশিক বানিজ্যের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রন, (iii.) দেশীয় রাজা ও জমিদারদের বিলুপ্তি,(iv.) কৃষি ঋন মুকুব, (v.)কৃষকদের মধ্যে জমি বন্টন, (vi.) শ্রমিকদের সঠিক মজুরি প্রদান করা ইত্যাদি।
এই সমস্ত কর্মসূচি গুলি ছাড়াও কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল বিভিন্ন সময়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দাবিও উত্থাপন করেছিলো। এর মধ্যে অন্যতম হলো -
(১.) জাতীয় স্বার্থ ও শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী সমস্ত আইনকে বাতিল করতে হবে।
(২.) স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে যে সব কৃষকের জমি উচ্ছেদ করা হয়েছিলো তা তাদের ফেরত দিতে হবে।
(৩.) অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৪.) ধর্মঘট, পিকেটিং ও শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠনের অধিকার দিতে হবে।
(৫.) জমিদারি ও তালুকদারি প্রথার অবসান ঘটাতে হবে।
(৬.) বাক্ স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের অধিকার দিতে হবে।
(জ.) কংগ্রেসের অভ্যন্তরে প্রতিক্রিয়া :-
জয়প্রকাশ নারায়ন ঘোষনা করেছিলেন, কংগ্রেসের মধ্য থেকেই সমাজতন্ত্রী দল কংগ্রেসকে শক্তিশালী করবে এবং কংগ্রেসের সঠিক নীতি নির্ধারণে সাহায্য করবে। সমাজতন্ত্রীরা শ্রমিক ও কৃষকদের স্বার্থে কংগ্রেসের অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাবে। এটি চালাতে গিয়েই কংগ্রেসের সমাজতন্ত্রী গোষ্ঠী কংগ্রেসের অভ্যন্তরে এক বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেন।
কংগ্রেসের বামপন্থী অংশ সমাজতান্ত্রিক দলের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ হবার পরেই কংগ্রেসে দক্ষিনপন্থী ও বামপন্থীদের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্য রূপ পায়। ১৯৩৬ খ্রিঃ জয়প্রকাশ নারায়ণ কমিউনিস্টদের সমাজতান্ত্রিক দলে প্রবেশাধিকার দিলে কংগ্রেসে বামপন্থীদের সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। এই সংখ্যা গরিষ্ঠ বামপন্থীদের চাপেই গান্ধীজি ১৯৩৬ খ্রিঃ জওহরলাল নেহেরুকে লক্ষ্মৌ কংগ্রেস অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত করেন। এই সময় নেহেরু দ্বিধাহীন ভাষায় সমাজতন্ত্রের প্রশংসা করেন। এমনকি সভাপতির ভাষনে সমাজতন্ত্রকে তিনি বিশ্ব ও ভারতের সমস্ত সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ বলে উল্লেখ করেন।
জওহরলাল নেহেরুর বক্তৃতা এই সময় কংগ্রেসের বুর্জোয়া সমর্থকদের মনে প্রচন্ড ভীতির সঞ্চার করে। কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রের নিয়ম ছিলো প্রত্যেক বছর কংগ্রেসের একজন করে নতুন সভাপতি নির্বাচিত হবেন। ঐ নির্বাচিত সভাপতিই ওয়াকিং কমিটির সদস্যদের নির্বাচিত করে, তাদের সাহায্যে দল পরিচালনা করবেন। এই নিয়ম অনুযায়ী জওহরলাল ১৯৩৫ খ্রিঃ লক্ষৌ কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচিত হবার পর কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের ৩ জন সদস্যকে ওয়াকিং কমিটিতে স্থান দেন। এরা হলেন, আচার্য নরেন্দ্রদেব, জয়প্রকাশ নারায়ন এবং অচ্যুত পট্টবর্ধন।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনার সূত্র ধরে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়। জওহরলাল নেহেরুর অতি বামপন্থী কাজকে গান্ধী তীব্র সমালোচনা করেন। "জওহরের পথ আমার পথ নয়" বলে তিনি কংগ্রেসের দক্ষিনপন্থী গোষ্ঠী ও বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের সংযত ও আশস্ত করার চেষ্টা করেন।
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলকে কংগ্রেসের দক্ষিনপন্থী গোষ্ঠী পছন্দ করতো না। কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদের ওয়াকিং কমিটিতে স্থান দেওয়ায় ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ, চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করার হুমকি দেন। শেষপর্যন্ত গান্ধীজির অনুরোধে জওহরলাল উগ্র বামপন্থার পথ থেকে সরে আসেন।
মূলত ১৯৩৭ খ্রিঃ থেকেই কংগ্রেসের মধ্যে ক্ষমতাসীন দক্ষিনপন্থী নেতৃত্বের সঙ্গে বামপন্থী গোষ্ঠীর সংঘাত শুরু হয়। ১৯৩৫ খ্রিঃ ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ খ্রিঃ প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থীদের উপেক্ষা করে কংগ্রেসের দক্ষিনপন্থী অংশ স্থানীয় জমিদার ও বুর্জোয়া প্রতিনিধিদেরই প্রার্থী নির্বাচন করে। নির্বাচনে জেতার পর সর্দার প্যাটেল ও বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদের মতো দক্ষিনপন্থী অংশ মন্ত্রীসভায় যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দেন। অন্যদিকে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রী দল আইন সভা বর্জনের প্রস্তাব দেন। জয়প্রকাশের প্রস্তাবটি ১৩৫ - ৭৮ ভোটে খারিজ হয়ে যায়। আসলে এই সময় কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের মনে হয়েছিলো, কংগ্রেস এখনই প্রাদেশিক সরকারে যোগ দিলে কংগ্রেসের সংগ্রামী চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে।
১৯৩৮ খ্রিঃ হরিপুরা অধিবেশনে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হলে কংগ্রেসে বামপন্থীদের ক্ষমতা ও প্রভাব অনেক বেশি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পরবর্তীকালে ১৯৩৯ খ্রিঃ কংগ্রেসের ত্রিপুরি অধিবেশন সুভাষচন্দ্রের পুনঃনির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই গোষ্ঠীর বিরোধ কার্যত সংঘাতের রূপ নেয়। এই সময় কংগ্রেস দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল তার স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে সরে এসে গান্ধীজিকেই সমর্থন করে।
১৯৩৯ খ্রিঃ গান্ধীজি ও দক্ষিনপন্থীদের সঙ্গে সুভাষ বসুর বিরোধের সময় কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল সুভাষচন্দ্র বসুকে সমর্থন করে নি। ত্রিপুরি অধিবেশনে "পন্থ প্রস্তাব" প্রশ্নে তারা নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৯৩৯ খ্রিঃ তিরুপতি অধিবেশনের পর জয়প্রকাশ নারায়ন বলেন, তারা কংগ্রেসের মধ্যে কোন উপদল সৃষ্টি করতে অথবা কংগ্রেসের পুরনো নেতৃত্বকে সরিয়ে একটা বিকল্প নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান না। তারা শুধু কংগ্রেসের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে চান।
১৯৩৯ খ্রিঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল অন্যান্য বাম গোষ্ঠীর মতোই অবশ্য এই যুদ্ধকে "সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ" আখ্যা দিয়ে বিরোধিতা শুরু করে। এই যুদ্ধ বিরোধিতার জন্য এই সময় অনেক শীর্ষস্থানীয় সমাজতন্ত্রী নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪২ খ্রিঃ গান্ধীজি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলে ঐ আন্দোলনকে সফল করে তোলার জন্য কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।
এই সময় জয়প্রকাশ নারায়ণ, রামমনোহর লোহিয়া ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সহিংস আন্দোলনকে অনুমোদন করেছিলেন। আসলে সমাজতন্ত্রী দল কোন আপোষমুখী আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা চায় নি। তারা কংগ্রেসের আপোসমূলক মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করেন। কংগ্রেস মুসলিম লিগের পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণ করায় ও ভারত বিভাগে সম্মত হওয়ায় কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল তার তীব্র বিরোধিতা করে এবং প্রবল হতাশা ব্যক্ত করে।
(ঝ.) কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের ব্যর্থতা :-
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী মতাদর্শ স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছিলো। তাদের এই ব্যর্থতার পিছনে অনেক গুলি কারন ছিলো।
প্রথমত, কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের আদর্শ ও নীতির মধ্যে কোন সুস্পষ্ট অবস্থান ছিলো না। আদর্শগত দিক থেকে তারা ছিলেন চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী এবং ব্রিটিশের সঙ্গে যে কোন রকম আপোস নীতির বিরোধী। আবার একই সঙ্গে তারা বৈজ্ঞানিক মার্কসবাদেও বিশ্বাসী ছিলেন। তারা ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ ও শ্রেনী সংগ্রামের কথা বলতেন। আবার গান্ধীজির ভাবাদর্শও তাদের প্রভাবিত করতো।
এই পরস্পর বিরোধী ভাবধারার সংমিশ্রনের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের অবস্থান ছিলো দোদুল্যমান চরিত্রের। এর ফলে বামপন্থী অথবা জাতীয়তাবাদী কোন পক্ষেই তাদের অবস্থান দৃঢ় ছিলো না। ১৯৩৯ খ্রিঃ ত্রিপুরী অধিবেশনে এই দোদুল্যমান চরিত্রের জন্যই তারা সুভাষের পক্ষ ত্যাগ করে গান্ধীজিকে সমর্থন করেন। আবার পন্থ প্রস্তাবে নিরপেক্ষ অবস্থান নেন। এই দোদুল্যমান অবস্থানের জন্য সমাজতন্ত্রী দল তাদের গ্রহনযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারান।
দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের ব্যর্থতার দ্বিতীয় কারনটি ছিলো তাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব। সমাজতন্ত্রী নেতারা মার্কসবাদ, ফেবিয়ান ও গান্ধিজীর মতাদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় তাদের মধ্যে মতাদর্শগত বিরোধ ছিলো।ফলে তারা ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে পারেন নি।
তৃতীয়ত, প্রথম দিকে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে একযোগে কাজ করতে উদ্যোগী হলেও, পরে নানাবিধ কারনে সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের বিরোধ দেখা যায়।
জয়প্রকাশের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রী দলের সঙ্গে কমিউনিস্টরা সম্পর্ক রেখে চলতেন। জয়প্রকাশ নারায়ণও কমিউনিস্টদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু মিনু মাসানি কমিউনিস্টদের সঙ্গে মোটেই সম্পর্ক রাখার বিরোধী ছিলেন না। তিনি কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের সঙ্গে যেসব কমিউনিস্ট সদস্য যুক্ত ছিলেন, তাদের বহিষ্কার করার দাবি জানান। এর ফলে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সমাজতন্ত্রী দলের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। ১৯৪০ খ্রিঃ কমিউনিস্ট সদস্যগন কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল থেকে বহিষ্কৃত হন। কমিউনিস্টদের বিতাড়নের ফলে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল শক্তিশালী ভাবে কংগ্রেসে নিজেদের অস্তিত্ব ও অবস্থানকে তুলে ধরতে ব্যর্থ হন।
চতুর্থত, সমাজতন্ত্রীদের ব্যর্থতার জন্য জওহরলাল নেহেরুও কম দায়ী ছিলেন না। কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল নেহেরুর বামপন্থী চিন্তাধারায় ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিলো। অথচ আমন্ত্রন জানানো সত্ত্বেও, নেহেরু সমাজতন্ত্রী দলের সভ্য পদ গ্রহণ করেন নি। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার চিন্তাভাবনাও ছিলো ভাসা ভাসা। তিনি কংগ্রেসে বামপন্থী বনাম গান্ধিপন্থী বিতর্কে শেষপর্যন্ত গান্ধির দিকেই ঝুঁকে পড়েন। পরবর্তীকালে নেহেরুর অবস্থানকে অনুসরন করে ১৯৩৯ খ্রিঃ গান্ধিপন্থী বনাম সুভাষের নেতৃত্বাধীন বামপন্থী বিতর্কে সমাজতন্ত্রী দল গান্ধীজিকেই সমর্থন করেন। এর ফলে জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করার পূর্ন সুযোগ পেয়েও অবস্থানরত দুর্বলতার কারনে, সম্পূর্ণ ভাবে তা করতে ব্যর্থ হন।
পঞ্চমত, কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদের ব্যর্থতার পিছুনে কংগ্রেসের দক্ষিনপন্থী সদস্যদের বিরোধিতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। ত্রিশের দশকে কংগ্রেসের পুরাতনপন্থী সদস্যরা সমাজতন্ত্রকে মেনে নেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না। তখন তাদের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিলো ভারত থেকে ইংরেজদের বিতাড়ন করা। এই লক্ষ্য পূরনের জন্য কংগ্রেসের সকল শ্রেনীকে প্রয়োজন ছিলো অর্থাৎ পুঁজিপতি ও জমিদার দুজনকেই প্রয়োজন ছিলো। এমতাবস্থায়, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা ঐ সমস্ত শ্রেনী গুলির মনে যে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে, তা থেকে তারা কংগ্রেস বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করতে পারে। এর ফলে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা সংগ্রামে তার বিরাট প্রভাব পড়তে পারে। এই কারনেই কংগ্রেসের দক্ষিনপন্থী গোষ্ঠী কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের বিরোধিতা করেন।
(ঞ.) অবদান :-
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলেও, ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে কোন প্রভাব ফেলতে পারে নি একথা বলা যাবে না।
(১.) জওহরলাল নেহেরুর প্রভাবে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের তিন সদস্য আচার্য নরেন্দ্রদেব, জয়প্রকাশ নারায়ণ ও অচ্যুত পট্টবর্ধন কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটিতে স্থান লাভ করলে, কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটির অভ্যন্তরে বিরাট চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।
(২.) কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের প্রভাবে কংগ্রেসের বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে বিরোধ তীব্র আকার ধারন করে ও তা প্রকাশ্যে এসে পড়ে।
(৩.) এই বিরোধে কংগ্রেসের অন্যতম বামপন্থী নেতা জওহরলাল নেহেরু গান্ধীজির সঙ্গে আপোষ সমঝোতা করে কংগ্রেস থেকে গেলেও, সুভাষচন্দ্র বসু আপোষহীন মনোভাবের কারনে জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করেন।
(৪.) ১৯৩৭ খ্রিঃ প্রাদেশিক নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস যে বিপুল সাফল্য লাভ করেছিলো তার পিছুনে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিলো।
(৫.) এই দলের সমর্থনেই সুভাষচন্দ্র বসু জাতীয় কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশনে সভাপতি পদে নির্বাচিত হন।
(৬.) সমাজতন্ত্রী দলের প্রভাবেই কংগ্রেস কৃষি সংস্কার, ভূমি সংস্কার, শিল্প বিরোধের সমস্যা ও দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের সমস্যার দিকে নজর দিতে বাধ্য হয়েছিলো।
(৭.) সমাজতন্ত্রী দলের নিরন্তর চাপের ফলেই কংগ্রেস জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের মতো চরম কৃষি সংস্কার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলো।
(৮.) বিহার, কেরালা, যুক্ত প্রদেশ ও অন্ধ্রপ্রদেশ কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।
(৯.) এছাড়া, শ্রমিক শ্রেণীর স্বাধীন আন্দোলনকে জাতীয় কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রনে আনারও চেষ্টা করে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল।
(১০.) ১৯৪২ খ্রিঃ ভারতে ছাড়ো আন্দোলনে কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতাদের জেলবন্দী ও অনুপস্থিতির কালে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলই ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে যায়।
(১১.) কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে জয়প্রকাশ নারায়ণ, অরুনা আসফ আলি, রামমনোহর লোহিয়ার মতো কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের নেতারা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নেতৃত্বদান করেন।
(১২.) আজাদ হিন্দ বাহিনী নিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু অস্থায়ী ভারত সরকার গঠন করলে জয়প্রকাশ নারায়নের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রীরা সেই সরকারকে স্বীকৃতি জানান।
এইভাবে দেখা যায়, নানাবিধ সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে এবং সমাজতান্ত্রিক ভাবনার প্রসারের ক্ষেত্রে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলো।
গ্রন্থঋন
১. আধুনিক ভারত (পলাশি থেকে নেহরু) - সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়।
২. আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৭০৭ - ১৯৬৪) - সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়।
৩.আধুনিক ভারতের ইতিহাস (ব্রিটিশরাজ থেকে নেহেরু) - রতন কুমার বিশ্বাস।
৪. আধুনিক ভারতের রূপান্তর - রাজ থেকে স্বরাজ - সমর কুমার মল্লিক ।
৫. আধুনিক ভারত ও বিশ্বের ইতিহাস - জীবন মুখোপাধ্যায়।
৬. ভারত ইতিহাস পরিক্রমা - প্রভাতাংশু মাইতি ও অসিত কুমার মন্ডল।
৭. ভারতের ইতিহাস - আধুনিক যুগ ১৭০৭ - ১৯৬৪ - তেসলিম চৌধুরী ।
৮. পলাশী থেকে পার্টিশান - শেখর বন্দোপাধ্যায়।
৯. আধুনিক ভারতের ইতিহাস - বিপান চন্দ্র।
১০. আধুনিক ভারত (১৮৮৫ - ১৯৪৭) - সুমিত সরকার।
১১. জওহরলাল নেহেরু, স্বাধীনতার আগে ও পরে - শ্যামাপ্রসাদ বসু।