ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি

ভারতে কৃষক - শ্রমিক আন্দোলন ও বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিলো "ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির" প্রতিষ্ঠা।

ওয়ার্কাস অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি
ওয়ার্কাস অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি 

(ক.) প্রেক্ষাপট :- 

১৯১৭ খ্রিঃ সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট চিন্তা ধারার প্রসার ঘটেছিলো। ভারতও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। ১৯২০ দশকের প্রথম দিক থেকেই ভারতে কমিউনিস্ট চিন্তা ধারার প্রসার ঘটে।

১৯১৭ খ্রিঃ রাশিয়ায় সাম্যবাদী বিপ্লব সফল হবার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট চিন্তাধারার প্রসার করা হবে। এজন্য ১৯১৯ খ্রিঃ "কমিন্টার্ন" বা "কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল" নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। 

১৯২০ খ্রিঃ কমিন্টার্নের দ্বিতীয় কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, উপনিবেশ গুলিতে বুর্জোয়া শ্রেনীর নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা আন্দোলন গুলি যদি তাদের বিপ্লবী চরিত্র বজায় রাখে তবে কমিউনিস্টরা সেই আন্দোলন গুলিতে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু পরিস্থিতি যদি উল্টো হয় তাহলে কমিউনিস্টরা বুর্জোয়া শ্রেনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হবে।

ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মঞ্চ ছিলো ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। কমিন্টার্নের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ভারতের কমিউনিস্টরা জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য হয়ে জাতীয় সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই তারা উপলব্ধি করেন, জাতীয় কংগ্রেস সম্পূর্ন ভাবে বুর্জোয়া বা পুঁজিপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। 

আমরা জানি, জাতীয় কংগ্রেসের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকদের সবচেয়ে বড়ো অংশিদার ছিলো ছোট বড়ো জমিদার, ব্যবসায়ী ও দেশীয় শিল্পপতিগন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকে তারাই নিয়ন্ত্রন করতেন। তাদের নিয়ন্ত্রনের জন্য জাতীয় কংগ্রেস অসহযোগ আন্দোলনের সময় আপোসহীন ভাবে শ্রমিক বা কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করতে পারে নি। তাছাড়া, গান্ধীজির নেতৃত্বাধীন জাতীয় কংগ্রেস শ্রেনী সংগ্রামের তত্ত্বেও বিশ্বাসী ছিলো না। 

 ১৯২০ খ্রিঃ ভারতে "অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস" প্রতিষ্ঠিত হলেও, এই প্রতিষ্ঠানটিকে গোড়া থেকেই মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেনী নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রেখেছিলো। এই প্রতিষ্ঠানটির ওপর জাতীয় কংগ্রেসের অনেক প্রথম শ্রেণীর নেতাদের প্রভাব ছিলো অনেক বেশি। এমতাবস্থায়, ১৯২২ খ্রিঃ গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন হঠাৎ করে প্রত্যাহার করে নেওয়া কংগ্রেসের অভ্যন্তরে থাকা কমিউনিস্টদের প্রচন্ড হতাশ করে তোলে। এমতাবস্থায়, মানবেন্দ্রনাথ রায় ও অন্যান্য কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন বিকল্প আন্দোলনের পথের অনুসন্ধান করেন।

এই সময় কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের ভেতরে ও বাইরে দল গঠন করে কংগ্রেসকে সাঁড়াশি চাপের মধ্যে রেখে কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনার অংশ স্বরূপ - 
(১.) কমিউনিস্টরা দলে দলে জাতীয় কংগ্রেসের সভ্য পদ গ্রহণ করে কংগ্রেসকে বামপন্থীদের নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা চালান, 
(২.) অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস নামক সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠনে বুর্জোয়া নেতৃত্বকে সরিয়ে কমিউনিস্টদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যান এবং 
(৩.) কংগ্রেসকে বাইরে থেকে চাপ দেওয়ার জন্য ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি নামক শ্রমিক কৃষকদের পৃথক সংগঠন বা দল তৈরির চেষ্টা করেন।

১৯২৪ খ্রিঃ জুন মাসে কমিন্টার্নের পঞ্চম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ডি ম্যানুইলিস্কি "Report on the National - Colonial Question" নামক এক প্রতিবেদনে ঔপনিবেশিক দেশ গুলিতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলার কথা বলেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক দেশ গুলির সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি গুলি ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলবে। মানবেন্দ্রনাথ রায় এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে ভারতীয় কমিউনিস্টদের সহযোগিতার জন্য গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টিকে আবেদন জানান।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় কমিউনিস্টদের সহযোগিতা করার জন্য এবং ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন সংগঠিত করবার জন্য ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির দুই সদস্য ফিলিপ স্প্র্যাট  ও বেঞ্জামিন ব্রাডলি ভারতে আসেন। পরবর্তীকালে ফিলিপ স্প্র্যাট ভারতীয় কমিউনিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে "ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি" গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।

(খ.) প্রাদেশিক স্তরে ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি প্রতিষ্ঠা :-

১৯২৫ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে কানপুরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের কমিউনিস্ট সদস্যরা একটি প্রকাশ্য সম্মেলনে মিলিত হন। ঐ সম্মেলনে ভারতে বিক্ষিপ্ত কমিউনিস্ট কার্যকলাপকে একটি কেন্দ্রীয় ও সংঘবদ্ধ রূপ দেবার লক্ষ্যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বা CPI দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

এই সময় CPI দল "দলীয়" ভাবে ভারতে বামপন্থার বিস্তারের বদলে গোপনে ও "ভিন্ন" সংগঠনের মধ্য দিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে।কেননা ভারতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টি যদি তখনই প্রকাশ্যে ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতায় নামতো, তাহলে অচিরেই তাদের ওপর তীব্র সরকারি দমন নীতি নেমে আসতো। ফলে ভারতে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানের সমস্ত পরিকল্পনাই ভেস্তে যেতো।

এই অবস্থায় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ছোট ছোট কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গুলি তাদের নিজস্ব এলাকায় কতক গুলি কৃষক - শ্রমিক পার্টি গড়ে তুলে কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রসার করতে থাকেন। এই পার্টি গুলিতে ভারতে সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী বহু যুবক যোগ দিতে শুরু করেন। এই পার্টি গুলি প্রায় সব কটিই জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই তার শাখা হিসাবে গড়ে ওঠে।

(১.) ১৯২৩ খ্রিঃ সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার ও আরও বেশ কিছু কমিউনিস্ট মাদ্রাজে "Labour kisan party of Hindustan" গঠন করেন। এই দল কংগ্রেসের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে কংগ্রেসের শ্রমিক - কৃষক শাখা হিসাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
(২.) পাঞ্জাবেও কীর্তি কিষান পার্টি নামে একই ধরনের একটি প্রাদেশিক কৃষক - শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলা হয়।
(৩.) বোম্বেতে ১৯২৬ সালে "কংগ্রেস লেবার পার্টি" গঠিত হয়।
(৪.) ১৯২৫ খ্রিঃ নভেম্বর মাসে বাংলায় মুজফ্ফর আহমেদ ও হেমন্তকুমার সরকারের নেতৃত্বে "লেবার স্বরাজ পার্টি অব দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস" নামে একটি দল গঠিত হয়। ১৯২৬ খ্রিঃ কৃষ্ণনগরে আয়োজিত এক সম্মেলনে এই দলের নতুন নামকরন করেন" ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি অব বেঙ্গল"। এই পার্টিকেই ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির পূর্বসূরী বলে অনেকে অভিহিত করে থাকেন।

(গ.) সর্বভারতীয় ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির প্রতিষ্ঠা:- 


১৯২৮ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে কমিউনিস্টদের সমস্ত প্রাদেশিক শাখা সংগঠন গুলি কলকাতায় এক সর্বভারতীয় সম্মেলনে মিলিত হয়। এই সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো ভারতে কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য একটি সর্বভারতীয় দল গঠন করা। এই সম্মেলনেই বিভিন্ন প্রাদেশিক কৃষক ও শ্রমিক দল গুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে ১৯২৮ খ্রিঃ সর্বভারতীয় ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির প্রতিষ্ঠা করা হয়।

(ঘ.) "Workers and peasants party" বা WPP দলের সদস্য :-

(১.) ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির আদি রূপ লেবার স্বরাজ পার্টি অব দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা ছিলেন - কবি কাজি নজরুল ইসলাম, হেমন্তকুমার সরকার, কুতুবউদ্দিন আহমদ, সামসুদ্দিন হুসেন প্রমুখ।
(২.) লেবার পার্টির পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় - "ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি অব বেঙ্গল"। এর অন্যতম সদস্যদের মধ্যে ছিলেন - এস এ ডাঙ্গে, মুজাফফর আহমেদ, পি সি যোশী ও মোহন সিং যশ। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ছিলেন এর প্রেসিডেন্ট এবং যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন হেমন্ত সরকার। কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পর এই দলে যোগ দেন মুজাফফর আহমেদ ও নলিনী গুপ্ত। পরে মুজাফফর আহমেদের আহ্বানে অনুশীলন সমিতির দুই সদস্য গোপেন চক্রবর্তী ও ধরনী গোস্বামীও এই দলে যোগ দেন।
(৩.) ১৯২৮ খ্রিঃ গঠিত সর্বভারতীয় ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন আর এস নিম্বকার। এছাড়া অন্যান্য সর্বভারতীয় নেতৃত্বের মধ্যে ছিলেন - সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার, এস এস মিরাজকর, পি সি যোশি।

(ঙ.) WPP র শাখা সংগঠন ও মুখপত্র :- 

ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি খুব অল্প দিনের মধ্যেই ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও তার শাখা সংগঠনের বিস্তর করে। যেমন - 
(১.) এই দলের মাদ্রাজ শাখার সম্পাদক ছিলেন সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার। এখানকার মুখপত্রের নাম ছিলো "লেবার কিষান গেজেট" ও "ওয়ার্কাশ"।
(২.) পাঞ্জাব শাখার সম্পাদক ছিলেন মোহন সিং জোশি। এখানকার মুখপত্র ছিলো "কীর্তি"। কীর্তির সম্পাদক ছিলেন গদর দলের নেতা সন্তোষ সিং।
(৩.) বোম্বে শাখার সম্পাদক ছিলেন এস এস মিরাজকর। এখানকার মুখপত্রটির নাম ছিলো "ক্রান্তি"।
(৪.) উত্তর প্রদেশে ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির সম্পাদক ছিলেন পি সি যোশি। এখানকার মুখপত্রটির নাম ছিলো "অসন্তিকারী"।
(৫.) এই দলের লাহোর শাখার মুখপত্রের নাম ছিলো যথাক্রমে "কীর্তি কিষান" ও "ইনকিলাব" (উর্দু মাসিক পত্রিকা)। এর সম্পাদক ছিলেন গোলাম হোসেন।
(৬.) বাংলায় ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির মুখপত্র গুলি ছিলো - কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত "লাঙ্গল", মুজাফফর আহমেদ সম্পাদিত গনবানী।

(চ.) WPP র মূল উদ্দেশ্য :-

ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত "ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির" মূল উদ্দেশ্য গুলি ছিলো -
(১.) ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির মাধ্যমে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে কমিউনিস্টদের প্রভাব বৃদ্ধি করা। 
(২.) কংগ্রেসের সংস্কার সাধন করে বুর্জোয়া নেতৃত্বকে সরিয়ে জাতীয় কংগ্রেসকে নিয়ন্ত্রিত করা। 
(৩.) কংগ্রেসকে আরোও রেডিক্যাল ও গনমুখি করে তোলা, অর্থাৎ জনগনের পার্টি গড়ে তোলা। 
(৪.) ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির মাধ্যমে ভারতে ব্যাপক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সূচনা করা। 
(৫.) শ্রমিক ও কৃষকদের সংগঠিত করে প্রথমে স্বাধীনতা অর্জন ও শেষে সমাজতন্ত্র অর্জন করা।
(৬.) শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে ঐক্যবোধ ও শ্রেনী চেতনা জাগ্রত করা। 
(৭.) শ্রমিক ও কৃষকদের নানাবিধ সমস্যার সমাধান ও অর্থনৈতিক দাবি দাওয়ার ভিত্তিতে শ্রমিক - কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করা। 

(ছ.) WPP দলের কর্মসূচি :-

ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি শ্রমিক ও কৃষকদের স্বার্থে একাধিক কর্মসূচি গ্রহণ করে। যেমন - শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা হ্রাস, শ্রমিক শ্রেণীকে সংগঠিত করা, শ্রমিক ও কৃষক শ্রেনীর সর্বনিন্ম মজুরির হার নির্ধারন, জমিদারি প্রথার বিলোপ করা ইত্যাদি।

নদিয়াতে অনুষ্ঠিত সারা বাংলা কৃষক সম্মেলনে এই পার্টি কৃষকদের হয়ে বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করে। যেমন - কৃষকদের প্রজাসত্বের স্থায়িত্ব, জমি হস্তান্তরের অধিকার, মহাজন আরোপিত সুদের হার হ্রাস, পাট চাষীদের পাটের ন্যায্য দাম প্রদান ইত্যাদি।

জাতীয় কংগ্রেসে পূর্ন স্বাধীনতার দাবিও এই দল উত্থাপন করে। 

(জ.) WPP র কার্যাবলী :- 

ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি -

 (১.) বিভিন্ন সভা সমাবেশ, শ্রমিক সংগঠন ও পত্র পত্রিকার মাধ্যমে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবি দাওয়া ও ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে থাকেন। 

(২.) অর্থনৈতিক দাবি দাওয়ার পাশাপাশি তারা শ্রমিকদের রাজনৈতিক আন্দোলন ও শ্রেনী সংগ্রাম সম্পর্কেও সচেতন করেন। তাঁরা প্রচার চালান যে, শ্রমিকরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না পেলে তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতারও কোন মূল্য থাকবে না।

(৩.) লিলুয়া ও খড়্গপুরে শ্রমিক ধর্মঘট, বোম্বের সুতোকলে ও গিরনি কামগার ইউনিয়নের ধর্মঘটে, মাদ্রাজে বার্মা ওয়েল কোম্পানির ধর্মঘটে এবং বাংলার চটকল ও কাগজকলের শ্রমিক ধর্মঘটে ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।

(৪.) ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। (ক.) ১৯২৮ খ্রিঃ সাইমন কমিশনের ভারতে আসার প্রতিবাদে ওয়ার্কাশ পার্টির নেতৃত্বে বোম্বের প্রায় ৩০,০০০ শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে। কলকাতার ট্রাম ও চটকল শ্রমিকরাও এই ধর্মঘটে সামিল হয়। এছাড়া, (খ.) ১৯২৮ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে কয়েক হাজার শ্রমিক কংগ্রেসের প্যান্ডেল দখল করে পূর্ন স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করে এবং শ্রমিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রস্তাব কংগ্রেসের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানায়।

(৫.) ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির মধ্য দিয়ে AITUC র ক্ষেত্রেও এই সময় কমিউনিস্টরা ব্যাপক প্রভাব বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। তাঁরা ক্রমশ নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় চলে আসেন।

(ঝ.) মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ও WPP র নিষেধাজ্ঞা :-

কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে ১৯২৭ খ্রিঃ থেকে ভারতে ব্যাপক ও জঙ্গী শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হলে তা ব্রিটিশ সরকারের কাছে বিশেষ মাথাব্যথার কারন হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় ভারতে কমিউনিস্টদের দমন করার জন্য ১৯২৯ খ্রিঃ সরকার মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেপ্তার করে এই মামলা দায়ের করা হয়েছিলো। এই মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - মুজাফফর আহমেদ, মিরাজকর, পি সি যোশি, ধরনী গোস্বামী, বেঞ্জামিন ব্রাডলি, ফিলিপ স্প্র্যাট প্রমুখ

বলা বাহুল্য, মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের প্রত্যেকেই ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন। তাই কমিউনিস্ট নেতাদের এই ব্যাপক গ্রেপ্তারের পাশাপাশি ১৯২৯ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টিকেও নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। এই ব্যাপক দমন নীতি ও সরকারি নিষেধাজ্ঞার ফলে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দেই ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির যাবতীয় কর্মকান্ডের পরিসমাপ্তি ঘটে

(ঞ.) ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা :-

ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির ব্যর্থতার পিছুনে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার দিক ছিলো। যেমন -

(১.) এই দলের কার্যকলাপ মূলত শহরাঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।

(২.) গ্রামাঞ্চলে এই দল তার প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হয়।

(৩.) ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনে যতটা উৎসাহ দেখিয়েছিলো, কৃষক আন্দোলন সংগঠনের ব্যাপারে তেমন দৃষ্টি না দেওয়ায় তাদের জনভিত্তি যথেষ্ট দুর্বল ছিলো

প্রথম দিকের কমিউনিস্ট নেতারা বই ও পত্র পত্রিকা পাঠের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তাই তারা বাস্তব বোধের থেকেও অনেক বেশি তাত্ত্বিক ছিলেন। কৃষকদের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলো জমি বা সম্পদ। অন্যদিকে শ্রমিকরা একান্তভাবেই ছিলেন সর্বহারা। তাই শুরুর দিকে তাত্ত্বিক কমিউনিস্ট নেতাদের মনে হয়েছিলো কৃষকদের সংগঠিত করে ভারতে বিপ্লব সফল হবে না। কারন তারা প্রকৃত অর্থে সর্বহারা শ্রেনী নয়। তাদের জমির লোভ আছে।

ভারতের মোট জনসংখ্যার ৮০ % ছিলো কৃষক। তারা গ্রামে থাকতেন। ভারতে রাশিয়ায় মতো কোন ভূমিদাস ব্যবস্থাও ছিলো না। শিল্পায়নও ব্যাপক ভাবে ঘটে নি। ফলে শ্রমিকের সংখ্যা ছিলো যথেষ্ট কম। আবার ভারতীয় শ্রমিকরা রাশিয়া বা ইওরোপের শ্রমিকদের মতো সর্বহারাও ছিলেন না। তারা একদিকে ছিলেন শ্রমিক, অন্যদিকে কৃষক। ভারতের সামাজিক ব্যবস্থা যৌথ পরিবার ভিত্তিক হওয়ায় শহরাঞ্চলে কাজের সন্ধানে আসা শ্রমিকরা একেবারই বাড়ি ঘর ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে শ্রমিক হয়ে যান নি। গ্রাম সমাজের প্রতি তাদের আত্মিক টান ও সম্পর্ক ছিলো প্রবল।

আসলে গোড়া থেকেই ভারতীয় শ্রমিকদের শ্রেনী সচেতনাও ছিলো অস্পষ্ট। অন্যদিকে ভারতের তাত্ত্বিক কমিউনিস্ট নেতারা ভারতের আর্থ সামাজিক অবস্থা বা বাস্তব পরিস্থিতিকে বুঝে রনকৌশল ঠিক করতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। ভারতে কৃষক আন্দোলনের দিকে বেশি গুরুত্ব আরোপ না করাই ছিলো তাদের ব্যর্থতার অন্যতম একটি প্রধান কারন।

(ট.) WPP র গুরুত্ব :-

তবে উপরোক্ত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভারতে - (১.) শ্রমিক আন্দোলন, (২.) কমিউনিস্ট আন্দোলন ও (৩.) স্বাধীনতা আন্দোলন, এই ৩ টি ক্ষেত্রেই ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।

(১.) ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির নেতৃত্বে ১৯২৭ খ্রিঃ থেকে ভারতে শ্রমিক আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ব্যপক আকার ধারন করেছিলো।

(২.) জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, শ্রমিকদের কাজের সময় হ্রাস, নুন্যতম মজুরি প্রভৃতি দাবি দাওয়া উত্থাপন করে ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি শ্রমিক ও কৃষকদের অধিকারবোধ ও শ্রেনী সচেতনতা সৃষ্টি করতে যথেষ্ট সক্ষম হয়।

(৩.) ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক - কৃষকদের সংযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিকরা ১৯২৮ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসে প্রথম পূর্ন স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করে এবং ভারতে সাইমন কমিশনের আগমনের প্রতিবাদে তীব্র প্রতিবাদ ও ধর্মঘট সংগঠিত করে।

(৪.) ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির মূল উদ্দেশ্য ছিলো জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের অপসারিত করে সেখানে বামপন্থীদের নিয়ন্ত্রন স্থাপন। এই কাজে ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি যে ব্যর্থ হয়েছিলো, তা কখনই বলা যায় না।

ওয়ার্কাস ও প্রেজেন্ট পার্টির উদ্যোগে ধীরে ধীরে জাতীয় কংগ্রেসে বামপন্থীদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এই বামপন্থীরাই পরবর্তীকালে ১৯৩৪ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল প্রতিষ্ঠা করে কংগ্রেসকে পুনরায় নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করে। এছাড়া, AITUC র ওপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তারা যথেষ্ট সফল হন। 

এককথায়, ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রথম পর্বে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্য দিয়ে ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি কমিউনিস্টদের জনভিত্তি প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post