১৯০৫ খ্রিঃ বড়োলাট লর্ড কার্জন ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করার জন্য "বঙ্গভঙ্গ" করলে তার বিরুদ্ধে সারা দেশব্যাপী শুরু হয় "স্বদেশী আন্দোলন"। এই আন্দোলনে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর পাশাপাশি নারীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভাবে অংশগ্রহণ করে।
১৯০৫ খ্রিঃ থেকে ১৯১১ খ্রিঃ,বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার আগে পর্যন্ত সময়কাল জুড়ে চলেছিলো বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনে অংশ নেওয়া উল্লেখযোগ্য স্মরনীয়া নারীদের মধ্যে ছিলেন - কুমুদিনী মিত্র, লীলাবতী মিত্র, নির্মলা সরকার, হেমাঙ্গিনী দাস, আশালতা সেন, নবশশী সেন, মনোরমা বসু, ভগিনী নিবেদিতা, হেমপ্রভা মজুমদার, লাবন্যপ্রভা চন্দ প্রমুখ।
এইসব বাঙালি নারী ছাড়াও, মহারানী তেজস্বিনী, পন্ডিতা রমাবাই, রমাবাই রানাডে, তনুবাই তারখুদ, বীরুবাই লিমে প্রমুখ অনেক দক্ষিন ভারতীয় নারীও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন।
![]() |
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা |
(অ.) নারীদের অংশগ্রহণের ধরন ও প্রকৃতি
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের ধরন ও প্রকৃতির ক্ষেত্রে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
(১.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের পরিচালনা, নেতৃত্ব এবং সংগঠনের যাবতীয় কাজগুলিই করেছিলেন মধ্যবিত্ত হিন্দু সম্প্রদায়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দু মধ্যবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরাই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।
(২.) কোন শ্রেনী স্বার্থের যোগ না থাকায় নিন্মবর্নের হিন্দু বা মুসলিম পরিবারের মেয়েরা সেভাবে আন্দোলনে যোগ দেয় নি। অল্প, সামান্য কয়েকজন মুসলিম নারীই এই আন্দোলনের সঙ্গে সামিল হয়েছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খয়েরুন্নেসা খাতুন। ১৯০৫ খ্রিঃ নবনূর পত্রিকায় "স্বদেশানুরাগ" নামে এক প্রবন্ধে তিনি স্বদেশীর ব্যবহার এবং বিদেশী জিনিস বয়কটের জন্য নারীদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করেন।
(৩.) রাখীবন্ধন, অরন্ধন বা উপবাস, লক্ষ্মীর ব্রতকথা, লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রভৃতি কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনটিকে নারী মহলে গ্রহনযোগ্য করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ফলতঃ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের মূল দিকটি মধ্যবিত্ত হিন্দু নারীদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস ও গোন্ডীর মধ্যেই আবদ্ধ থেকে গিয়েছিলো।
(৪.) আর একটি ব্যাপার হলো, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মধ্যবিত্ত হিন্দু নারীদের ভূমিকা যত না সক্রিয় ছিলো, তার থেকেও বেশি ছিলো সহযোগীর। আন্দোলনে "বয়কট"(বিদেশী পন্য বর্জন) ও "স্বদেশী" (দেশীয় পন্য উৎপাদন ও ব্যবহার) কর্মসূচি দুটি সফল করে তুলতে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন এবং পুরুষের পাশে সহযোগীর ভূমিকা পালন করেন।
মনে রাখতে হবে, উনিশ শতকে নারী শিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটলেও, "মধ্যবিত্ত মানসিকতা" তখনও নারীকে মুক্ত, স্বতন্ত্র ও স্বকীয় ভূমিকায় দেখবার মতো উদার মানসিকতা অর্জন করতে পারে নি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় নারীরা সম্পূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশে অথবা নিজ পাড়া বা মহল্লায় সমবেত হয়েই স্বদেশী আন্দোলনের কর্মসূচি গুলিকে সফল করে তুলেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের চেহারা তাই ঘরোয়া পরিবেশের মধ্যেই অনেকাংশে আবদ্ধ ছিলো।
তবে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে নারী শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে হিন্দু ললনাদের মধ্যে রাজনৈতিক স্বাতন্ত্রবোধও বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিলো। মেয়েরা যে দুর্বল ও ভীরু নয়, তারাও যে পুরুষদের মতো যোগ্য ও উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে, সেই মানসিকতা এবং উদাহরনের একাধিক ছাপ এইসময় নারীরা রাখেন।
এই সব নারীদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন, কেউবা তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আবার এমন অনেক নারী ছিলেন যারা স্বদেশী আন্দোলনের শেষ পর্যায় বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী পর্বের নানা কাজকর্মেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এইসব নারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - সরলাদেবী চৌধুরানী, ভগিনী নিবেদিতা, ননীবালা দেবী প্রমুখ।
(আ.) নারীদের অংশগ্রহণের বৌদ্ধিক পটভূমি :-
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মধ্যবিত্ত নারী সমাজের ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানের কারন ছিলো দুটি - (১.) বঙ্গভঙ্গ জনিত ক্ষোভ এবং (২.) জাতীয়তাবাদ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরন ঘটতে শুরু করে। ইওরোপীয়রা তাদের স্বদেশভূমিকে "পিতৃভূমি" হিসাবে ডাকতো। কিন্তু উনিশ শতকে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী যে নতুন জাতীয়তাবাদের জন্ম দেন, সেখানে তারা স্বদেশভূমিকে "পিতৃভূমি" হিসাবে না ডেকে,তাকে "মাতৃভূমি" হিসাবে আখ্যায়িত করেন। দেশকে মা বা জননী রূপে তুলে ধরার বিষয়টি নারী পুরুষ উভয়ের মনেই এক প্রবল জাতীয়তাবাদী আবেগের সঞ্চার করে।
"পিতৃভূমির" বদলে দেশকে "মাতৃভূমি" হিসাবে দেখবার পিছনে অবশ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিলো দুটি। এক, জাতীয়তাদের সঙ্গে নারী মূর্তির সংমিশ্রন ঘটিয়ে ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজ জাতির নারীসূচক কাপুরুষচিত অপমান গুলির যোগ্য প্রত্যুত্তর দেওয়া এবং দুই, দেশকে জননী রূপে আখ্যায়িত করে ইওরোপীয় জাতীয়তাবাদের লিঙ্গ বৈষম্যের দিকটিকে জনমনে প্রতিষ্ঠিত করা।
মাথায় রাখতে হবে, ইংরেজরা এদেশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর ভারতীয়দের প্রতি বিজেতা সুলভ নীতি নিয়েছিলো। কথায় কথায় তারা ভারতীয়দের অকথ্য ভাষায় অপমান করতো। বিভিন্ন সময়ে তারা ভারতীয়দের প্রতি দুর্বল, ভীরু, কাপুরুষ প্রভৃতি নারীসূচক বিশেষন গুলি প্রয়োগ করতো।
ইংরেজদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পাল্টা প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ায় তাই হিন্দু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেনী তাদের নব্য জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে "পিতৃভূমি"র বদলে স্বদেশভূমিকে "মাতৃভূমি" হিসাবে আখ্যায়িত করে এবং এর মধ্য দিয়ে ইংরেজদের নারীসূচক অপমানের যোগ্য প্রত্যুত্তর দিতে চায়।
যাইহোক, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এই বৌদ্ধিক চিন্তা চেতনার প্রেক্ষিতেই দেশকে "মা" হিসাবে বন্দনা করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৫ খ্রিঃ রচনা করেন "বন্দেমাতারম" গান। যা পরে তিনি ১৮৮২ খ্রিঃ "আনন্দমঠ" উপন্যাসে সংযুক্ত করেন। দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বদেশী আন্দোলনের প্রাক্ মুহূর্তে আঁকেন "ভারতমাতার"(বঙ্গমাতা) ছবি। এককথায়, দেশের কল্পিত জননী রূপের প্রতিমূর্তি নারী পুরুষ উভয়ের মনেই এক প্রচন্ড জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের সঞ্চার করে।
১৯০৫ খ্রিঃ গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করলে শিক্ষিত হিন্দু বাঙালি তাই সেটিকে সঙ্গত কারনেই বিদেশী শত্রুর হাতে মায়ের লাঞ্ছনা হিসাবেই দেখে। দেশ যখন "মা", তখন তার লাঞ্ছনা মোচনের ও শৃঙ্খলা মোচনের ভার সকলের। এই কারনে স্বদেশী আন্দোলনে "বন্দেমাতারম" ধ্বনির মধ্য দিয়ে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরকেও দেশমাতৃকার মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
স্বদেশী যুগে কবিদের নানা রচনা, গানও নারীদের নানা ভাবে আন্দোলনে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। স্বদেশী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের প্রথম আহ্বান জানিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "ব্রত ধারন" নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন।
রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, চারন কবি মুকুন্দ দাস নানা ভাবে নারীদের স্বদেশী আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। এছাড়া, "বামাবোধিনী পত্রিকা", "অন্তঃপুর পত্রিকা" সহ একাধিক নারীকেন্দ্রীক পত্র পত্রিকা গুলিও স্বদেশী ভাবধারায় নারীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
(ই.) নারীদের ভূমিকা ও অংশগ্রহণের বহুমুখী দিক :-
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ও অংশগ্রহণের দিক গুলি ছিলো বহুমুখী। খুব সংক্ষেপে তাদের ভূমিকার বহুমুখী দিকগুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) রাখিবন্ধন এবং অরন্ধন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ :-
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সূচনাতেই নারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি নির্দিষ্ট করা হয়েছিলো।
বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন অর্থাৎ ১৯০৫ খ্রিঃ ১৬ ই অক্টোবর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাগের প্রতিবাদে রাখি বন্ধনের ডাক দেন।
রাখি ছিলো ঐক্যের প্রতীক,বন্ধনের প্রতীক, মিলনের প্রতীক, সর্বোপরি, দুই বাংলার সংহতির প্রতীক। রাখি বন্ধনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং দুই বাংলার মননের মধ্যে ইংরেজ সরকার যে বিভেদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে ছিলো, তাকে দূর করতে চেয়েছিলেন। তাই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সূচনাটিই হয়েছিলো রাখিবন্ধন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে।
এই রাখিবন্ধন কর্মসূচিকে সফল করে তোলার ক্ষেত্রে নারীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। ঐ দিন নারীরা রাখি তৈরি করে তা পরিয়ে দেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ভাগ্নি সাহানা দেবী এবং উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কন্যা পুন্যলতা চক্রবর্তীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, রাখি বন্ধন সেদিন সারা বাংলায় এক অদ্ভুদ উদ্মাদনা সৃষ্টি করে।
এই সময় "ভারতী" পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গিরিন্দ্র মোহিনী দাসীর কবিতা "বঙ্গনারীর রাখিবন্ধন"। "ভারত মহিলা" পত্রিকায় রাখির রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে তুলে ধরা হয়। এই সমস্ত তথ্য প্রমান থেকে সহজেই বুঝে নেওয়া যায়, রাখিবন্ধন কর্মসূচিকে সফল করে তুলতে বাংলার নারী সমাজ ঠিক কতখানি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
রাখিবন্ধন ছাড়াও, অরন্ধন কর্মসূচির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও একই ভাবে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গভঙ্গের কার্যকরের দিনটিকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী শোকের দিন হিসাবে ঘোষনা করে "অরন্ধন"কর্মসূচির ডাক দেন। ঐ দিন অর্থাৎ ১৬ অক্টোবর, কলকাতা ও সংলগ্ন গ্রামীন এলাকা গুলিতে মূলত নারীদের উদ্যোগেই অরন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। ঐ দিন বাংলার অনেক ঘরে উনুন জ্বলে নি। ঐ দিন উপবাসের মধ্য দিয়ে বাংলার আপামোর জনসাধারণ যে শোক জ্ঞাপন করেন এবং প্রতিবাদ জানান, তাকে সফল রূপদানের ক্ষেত্রে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
(২.) সভা সমাবেশে অংশগ্রহণ :-
বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে দুই বাংলার বিভিন্ন স্থানে যে সব সভা সমাবেশ গুলি হয়েছিলো, তাতে মেয়েরা অংশগ্রহণ করেন।
বঙ্গভঙ্গের কার্যকরের দিনেই কলকাতার আপার সার্কুলার রোডে দুই বাংলার মিলনের প্রতীক হিসাবে "মিলন মন্দির" বা "ফেডারেশন হলের" ভিত্তি স্থাপন করা হয়। এই উপলক্ষে কলকাতায় প্রায় ৫০,০০০ মানুষের এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভাতে প্রায় ৫০০ মহিলা অংশ নেয়। তাদের বসার জায়গা হয়েছিলো পার্শ্ববর্তী "ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে"।
এছাড়া, বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কালীপ্রসন্ন বিদ্যাবিনোদ, বিপিনচন্দ্র পাল, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সমস্ত সভা সমাবেশের আয়োজন করেন, তাতে বিপুল সংখ্যক নারী অংশগ্রহণ করেন। অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা নিজেরাই নেতৃত্ব দিয়ে সভা সমাবেশের আয়োজন করেন বলে "ঢাকা প্রকাশ" পত্রিকার সাক্ষ্য থেকে জানা যায়।
বরিশালের ১৩ বছরের গৃহবধু মনোরমা বসু এক নারী বাহিনী সংগঠিত করে সদর রাস্তায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। মানিকগঞ্জের বয়রাতে সুশীল সুন্দরী গুপ্তা একটি সভায় নেতৃত্ব দেন। খুলনায় স্নেহশীলা চৌধুরী নামে এক মহিলা অনুরূপ সভার আয়োজন করেন। স্থানীয় অনেক নারী এই সভা সমাবেশ গুলিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
(৩.) লক্ষ্মী প্রতিষ্ঠার কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ :-
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী "স্বদেশী আন্দোলনে" নারীদের সমর্থন লাভের জন্য সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এই সময় স্বদেশী আন্দোলনের নেতারা প্রচার চালান, বঙ্গভঙ্গের জন্য বঙ্গের "শ্রী" অর্থাৎ সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধি বা লক্ষ্মী নষ্ট হয়েছে। মা লক্ষ্মী দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। একমাত্র বঙ্গের লক্ষ্মীমন্ত মেয়েরাই পারে লক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনতে ও তাকে রক্ষা করতে।
বঙ্গলক্ষ্মীর পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য মুর্শিদাবাদের কান্দীতে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর বিষ্ণুপ্রাঙ্গনে সমবেত হয়ে প্রায় ৫০০ নারী বঙ্গ লক্ষ্মীর ব্রতকথা শোনেন এবং বিদেশী পন্য বর্জন ও স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার ও অরন্ধনের শপথ নেন। এই ব্রতকথা পাঠ করেন রামেন্দ্রসুন্দরের কন্যা গিরিজা সুন্দরী দেবী।
বঙ্গভঙ্গে গৃহচ্যুত লক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনবার জন্য বাংলার প্রায় প্রতিটি মেয়ের কাছে "মায়ের কৌটা" পৌঁছে দেওয়া হয়। যেখানে মেয়েরা প্রতিদিন জন্মভূমির উদ্দেশ্যে একমুঠো করে চাল ধরে রাখবে।
স্বদেশী আন্দোলনের একবছর আগে ১৯০৪ খ্রিঃ সরলাদেবী চৌধুরানী কলকাতার বৌ বাজারে "লক্ষ্মীর ভান্ডার" নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। স্বদেশী আন্দোলনের সময় "লক্ষ্মীর ভান্ডার" স্বদেশী দ্রব্য বিক্রির একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। বাংলার বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বদেশী দ্রব্য ও জিনিসপত্র সংগ্রহ করে এখানে বিক্রি করা হতো। উল্লেখ্য, এখানে শুধু মেয়েদেরই জিনিস পাওয়া যেতো।
এইসময় স্বদেশী আন্দোলনে কোন নারী প্রচুর অর্থ সাহায্য করলে বা অন্য কোন দুঃসাহসিক কাজ করলে "বঙ্গলক্ষ্মী" উপাধি দেওয়া হতো। স্বদেশী আন্দোলনে দীর্ঘদিন যাবত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার জন্য ১৯০৮ খ্রিঃ সরোজিনী বসুকে "বঙ্গলক্ষ্মী" উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিলো।
(৪.) স্বদেশী ও বয়কট কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ :-
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে "স্বদেশী" ও "বয়কট" কর্মসূচি পালনে মেয়েরা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিদেশী বর্জনে অনেক ক্ষেত্রে পুরুষদের থেকে মেয়েরাই ছিলেন বেশি সক্রিয়। মুকুন্দ দাসের ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে এইসময় বঙ্গ নারীরা রেশমি বা কাঁচের চুরি, বিলিতি লবন, সাদা চিনি এবং বিলিতি কাপড় বর্জন করেন। অনেক জায়গায় তারা একত্রিত হয়ে সমবেত ভাবে বিদেশী শাড়ি, ধুতি আগুনে নিক্ষেপ করেন।
তবে শুধু বয়কট নয়। স্বদেশীর ব্যবহারেও নারীরা গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করেন। এই সময় শহর ও গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা দিয়াশলাই, সাবান, কাগজ, কালি, চরকা ও তাঁত চালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
নারীদের মধ্যে স্বদেশীর প্রসারে এই সময় ব্রাহ্মনেতা কৃষ্ণকুমার মিত্রের কন্যা কুমুদিনী মিত্র, তার স্ত্রী লীলাবতী মিত্র, ড. নীলরতন সরকারের স্ত্রী নির্মলা সরকার, ডা. প্রানকৃষ্ণ আচার্যের স্ত্রী সুবালা আচার্য, হেমাঙ্গিনী দাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
(৫.) তহবিল গঠনে সাহায্য :-
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য যে জাতীয় তহবিল গঠন করা হয়, তাতে নারীরা নানাভাবে সাহায্য করে। এই সময় বহু নারী তাদের জমানো অর্থ ও অলংকার স্বদেশী তহবিলে দান করেন। বরিশালের স্বদেশবান্ধব সমিতিতে বহু নারী এই সময়ে অর্থ ও অলংকার প্রদান করেন।
বঙ্গভঙ্গের কার্যকরের দিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেয়েদের কাছে ভাইফোঁটার খরচ বাঁচিয়ে আন্দোলন পরিচালনার জন্য জাতীয় তহবিলে অর্থ দানের আহ্বান জানালে বহু নারী জাতীয় ভান্ডারে অর্থ প্রদান করেন।
(৬.) সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে সমর্থন :-
শুধু আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ নয়, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়েও অনেক নারী বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সমর্থন ও প্রচার করেছিলেন। যেমন -
(ক.) মুকুন্দ দাস স্বদেশী প্রচারের জন্য নারীদের নিয়ে একটি যাত্রাদল গঠন করে তা যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল প্রভৃতি জায়গায় ছড়িয়ে দেন।
(খ.) স্বদেশ বান্ধব সমিতিতে যুক্ত থেকে অনেক নারী স্বদেশী শিল্প, সাহিত্য ও কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে সক্রিয় থেকে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
(গ.) ১৯০৬ খ্রিঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের সম্পাদনায় "যুগান্তর" পত্রিকায় এবং "বন্দেমাতারম" পত্রিকায় কতিপয় নারী স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে নানা উৎসাহব্যাঞ্জক লেখা প্রকাশ করে।
(ঘ.) খয়েরুন্নেসা খাতুন নামে এক মুসলিম নারী ১৯০৫ খ্রিঃ "নবনূর" পত্রিকায় "স্বদেশানুরাগ" নামে এক প্রবন্ধ লিখে স্বদেশীর ব্যবহার এবং বিদেশী বয়কটের জন্য নারীদের উৎসাহিত করেন।
(ঙ.) বরিশালের মনোরমা বসু নামে এক গৃহবধূ হাতের কবজিতে হলুদ রং এর সুতার রাখি পড়ে প্রকাশ্যে স্বদেশী আন্দোলনের মিছিলে অংশগ্রহণ করেন।
(৭.) বিপ্লবী আন্দোলনে সাহায্য :-
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন চারটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে চলেছিলো। যথা - বয়কট, স্বদেশী, জাতীয় শিক্ষা এবং বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদ।
স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের ব্যর্থতার পর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন তার অন্তিম পর্যায় "চরমপন্থী পর্বে" প্রবেশ করে। এই পর্বে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রসার ঘটে। এই সময় বাংলায় বিপ্লববাদের সলতে পাকানোর ক্ষেত্রে সরলাদেবী চৌধুরানী এবং ভগিনী নিবেদিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলার প্রথম গুপ্ত সমিতি "অনুশীলন সমিতি" গঠনে ভগিনী নিবেদিতা এবং সরলাদেবী চৌধুরানী গোপনে নানা ভাবে সাহায্য করেন।
স্বদেশী আন্দোলন শুরুর অল্প কিছু দিন আগেই সরলাদেবী (১৯০২ - ০৪) বীরাষ্টমী ব্রত, প্রতাপাদিত্য উৎসব, উদয়াদিত্য উৎসব প্রচলন করে বঙ্গীয় যুবকদের দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জিবিত করেন। এই সময় "ভারতী" পত্রিকার নানা প্রবন্ধমালায় তিনি বাঙালি যুবাদের শৈর্য্য, বীর্য, দেশপ্রেম ও সাহসিকতার আদর্শ প্রচার করে লেখেন - "মৃত্যুকে যেচে বরন করে নিতে শেখো"।
১৯০৬ খ্রিঃ অনুশীলন সমিতি ভেঙ্গে যুগান্তর দলের প্রতিষ্ঠা হয়। যুগান্তর দল আয়ারল্যান্ডের ধাঁচে গেরিলা রননীতির মাধ্যমে নানা রকম নাশকতামূলক কাজের পরিকল্পনা করে। এক্ষেত্রে ভগিনী নিবেদিতা আয়ারল্যান্ডের বেশ কিছু বিপ্লবী বইপত্র দিয়ে যুগান্তর দলকে সাহায্য করেন।
স্বদেশী আন্দোলনের বিপ্লববাদ পর্বে বহু নারী নানা ভাবে বিপ্লবীদের সাহায্য করেন। ফরিদপুরের সৌদামিনী দেবী, বরিশালের সরোজিনী দেবী, ঢাকার ব্রহ্মময়ী সেন, বীরভূমের দুকড়িবালা দেবী বিভিন্ন সময়ে বিপ্লবীদের আশ্রয় দেন এবং বিপ্লব কর্মে নানা ভাবে সাহায্য করেন।
এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেজো পিসিমা ননীবালা দেবীর নাম বিশেষ ভাবে করতে হয়। স্বদেশী আন্দোলনের সময় দেশপ্রেম এবং সাহসিকতার এক অনন্য নজির তিনি সৃষ্টি করেন। বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে ব্রিটিশ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলেও ননীবালা দেবীর অনমনীয় মনোভাবের জন্য ব্রিটিশ পুলিশ কোন তথ্যই আদায় করতে পারে নি। ননীবালা দেবী ছিলেন ভারতের প্রথম এবং একমাত্র মহিলা, যাকে ১৯০৮ খ্রিঃ ৩নং ধারায় বিনা বিচারে ব্রিটিশ সরকার আটক করে।
(ঈ.) উপসংহার
এইভাবে দেখা যায়, স্বদেশী আন্দোলনে নারীরা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আন্দোলনকে সফল করে তুলবার জন্য পুরুষরা নারীকে তাদের সহায়ক শক্তি হিসাবে গ্রহন করে। তারা উপলব্ধি করেন, মেয়েরাই গৃহস্থলির বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করে। তাই বিদেশী পণ্য বর্জন ও দেশী পন্যের ব্যবহারে নারীরাই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাস্তবে ঘটেওছিলো তা। নারীরা স্বদেশী ও বয়কট কর্মসূচিকে শুধু সফল করে তোলেন নি। স্বদেশী আন্দোলনকে আরোও সংঘবদ্ধ ও সংগঠিত করে তুলতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। কেউ কেউ স্বদেশী ও বয়কটের গোন্ডী অতিক্রম করে সভা সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন। তাতে বক্তৃতা করেছিলেন। স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বদেশীর প্রচারে কলম ধরেছিলেন। এমনকি স্বদেশী আন্দোলনের অন্তীম পর্ব বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদেও নানা ভাবে সাহায্য করেছিলেন।
তাই স্বদেশী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা এককথায় ছিলো অনন্য ও অসাধারণ। আন্দোলনে তাদের ভূমিকা মূলত সহযোগীর হলেও, বেশ কিছু ক্ষেত্রে কয়েকজন নারী সক্রিয় ভাবে অংশ নিয়ে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত ও কৃতিত্বের সাক্ষ্য রাখেন। তাই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা, অংশগ্রহণ ও অবদানকে কখনোই উপেক্ষা বা অস্বীকার করা যাবে না।
স্বদেশী আন্দোলনে যোগদানের ফলে বাংলার মধ্যবিত্ত নারী সমাজ রাজনৈতিক দিকে সচেতন হয়ে ওঠেন। এই রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে পরবর্তীকালে তারা নিজেদের স্বতন্ত্র অধিকার গুলি আদায়ের জন্য আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের যোগদান তাই একদিকে যেমন আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করেছিলো, তেমনি অন্যদিকে নারী মুক্তির পথকে প্রশস্ত ও মসৃন করেছিলো।
(উ.) সীমাবদ্ধতা
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা এবং অংশগ্রহণের দিকগুলি বহুমুখী হলেও, তার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও চোখে পড়ে। যেমন -
(১.) সমাজের সর্ব স্তরের মেয়েরা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয় নি।
(২.) শ্রেনী স্বার্থের কোন যোগ না থাকায় নিন্মবর্গ ও কৃষক পরিবারের মেয়েরা এই আন্দোলন থেকে দূরে ছিলেন।
(৩.) মুসলিম পরিবারের মেয়েরাও আন্দোলন সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব ও নিস্প্রভ ছিলেন।
(৪.) এই আন্দোলন মূলত মধ্যবিত্ত হিন্দু নারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।
(৫.) ঘরোয়া পরিবেশের গোন্ডীর মধ্যে থেকেই নারী সমাজ এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলো।
(৬.) মূলত পুরুষের "সহযোগী" হিসাবেই তারা আন্দোলনে অংশ নেন এবং কর্মসূচি গুলি পালন করেন।
(৭.) কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সক্রিয় ভূমিকা নিলেও, নারীদের প্রকাশ্য সভা সমিতিতে যোগদান বা অংশগ্রহণের উদাহরন ছিলো অনেক কম।