গান্ধীজির ডাকে ১৯৪২ খ্রিঃ ভারতে শুরু হয়েছিলো "ভারত ছাড়ো আন্দোলন"। গান্ধী পরিচালিত গন আন্দোলন গুলির মধ্যে এটি ছিলো সর্বশেষ গন আন্দোলন। গান্ধীজির আগের দুই গন আন্দোলন অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন থেকে ধারে,ভারে ও প্রকৃতিতে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিলো অনেক বেশি চরমপন্থী ও তীব্র।
![]() |
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা |
গান্ধীজি তার আগের দুই গন আন্দোলন - অসহযোগ এবং আইন অমান্য আন্দোলনে ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগে বাধ্য করার জন্য দুই ভিন্ন রনকৌশল অবলম্বন করার কথা বলেছিলেন। যেমন - অসহযোগ আন্দোলনে (১৯২১) তিনি দেশবাসীকে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সার্বিক অসহযোগীতার কথা বলেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন, দেশবাসী ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সার্বিক দিক থেকে অসহযোগীতা করলে এবং সরকার সহ সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গুলিকে বয়কট করলে ভারতে ইংরেজ শাসন এমনিতেই অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং ইংরেজরা ভারত ত্যাগে বাধ্য হবে।
কিন্তু অসহযোগ আন্দোলন মাঝপথে গান্ধীজি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় যা আশা করা হয়েছিলো, তা পূরন হয় নি। অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের (১৯২২) প্রায় ৮ বছর পর ১৯৩০ খ্রিঃ গান্ধীজি আরও একটি গন আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। এর নাম ছিলো আইন অমান্য আন্দোলন। এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ও কর্মসূচি ছিলো ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা সমস্ত আইন ও সরকারি নিষেধাজ্ঞা গুলিকে অমান্য করা বা লঙ্ঘন করা। গান্ধীজি জানতেন, সরকার একটি আইনি প্রতিষ্ঠান। তাই,আপামোর ভারতবাসী যদি ব্রিটিশ সরকারের যাবতীয় আইনের নির্দেশ গুলিকে লঙ্ঘন করে, তাহলে ভারতে ব্রিটিশ শাসন এমনিতেই অকার্যকর হয়ে পড়বে। একই সাথে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের উপস্থিতির অবৈধতার দিকটিকেও সুপ্রতিষ্ঠিত করা যাবে।
প্রায় ৪ বছর চলার পরেও আইন অমান্য আন্দোলনের কৌশল শেষপর্যন্ত সফলতা লাভ করতে পারে নি। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৪২ খ্রিঃ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গান্ধীজি অসহযোগ বা আইন অমান্যের মতো কোন পৃথক রনকৌশলের কথা না বলে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে ইংরেজদের ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বললেন এবং এই আন্দোলনের নাম দেন "ভারত ছাড়ো আন্দোলন" বা "Quit India Movement"।
১৯৪২ খ্রিঃ ৮ ই আগস্ট বোম্বাই শহরে সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির বৈঠকে "ভারত ছাড়ো আন্দোলনের" প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঐ সম্মেলনেই আন্দোলনের চরমপন্থী পথ ও লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে দিয়ে গান্ধীজি বলেছিলেন, "পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনকিছুতেই আমি সন্তুষ্ট হবো না। ভারতবর্ষের প্রত্যেক জনগনই স্বাধীন এবং স্বাধীন ভাবেই তারা আন্দোলনে অংশ নেবেন"। "Do or Die" এবং "করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে" আত্মপ্রত্যয়ের শ্লোগানের মধ্য দিয়ে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের চরমপন্থী বানীকে তিনি আপামোর ভারতবাসীর কাছে পৌঁছে দেন।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কংগ্রেসের গন আন্দোলনের বেয়াদপিকে ব্রিটিশ সরকার কোনমতেই সহ্য করতে প্রস্তুত ছিলো না। তাই ৮ ই আগস্টের গভীর রাতেই কংগ্রেসের সমস্ত প্রথম শ্রেণীর নেতাদের গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার চেষ্টা করে।
কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের সমস্ত দুশ্চিন্তাকে সত্য প্রমানিত করে পরদিনই অর্থাৎ ১৯৪২ খ্রিঃ ৯ ই আগস্ট ভারতের জনগন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আন্দোলন শুরু করে দেয়। কংগ্রেসের প্রধান নেতৃত্ববৃন্দ গ্রেফতার হওয়ার পর জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ভারতের বিভিন্ন স্থানের "উন্মুক্ত জনগন" যে যার মতো আন্দোলনে অংশ নিতে থাকে এবং আন্দোলনকে সংগঠিত করতে থাকেন।
শেষপর্যন্ত দেখা গেলো, ৮ ই আগস্টে গান্ধীজির বলে যাওয়া চরমপন্থী শেষ কথা কটি "ভারত ছাড়ো আন্দোলন"কে "আগস্ট বিপ্লবে" রূপান্তরিত করলো।
(অ.) নারীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা
ভারতের বিভিন্ন শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের মানুষ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। নারীরাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্যেই ছিলো নারীদের ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।
(আ.) নারীদের অংশগ্রহণের ধরন ও প্রকৃতি :-
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের ধরন ও প্রকৃতির মধ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
(১.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ বা যোগদানের সংখ্যা আগের গন আন্দোলন গুলি থেকে অনেক বেশি ছিলো।
(২.) এই আন্দোলনে বিভিন্ন বয়সের নারীরা আন্দোলনে অংশ নিলেও, স্কুল কলেজের ছাত্রীদের যোগদান ছিলো চোখে পড়ার মতো।
(৩.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণে যে ব্যপকতা, উৎসাহ এবং স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা গিয়েছিলো, তা অসহযোগ আন্দোলন বা আইন অমান্য আন্দোলন থেকেও অনেক বেশি ছিলো।
(৪.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীরা শুধু বিভিন্ন সভা সমিতি বা বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন নি। নেতৃত্বহীন আন্দোলনকে সংগঠিত করতে এমনকি নেতৃত্ব দিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং উজ্জ্বল কৃতিত্বের নিদর্শন রাখেন।
(৫.) সর্বোপরি, পূর্ববর্তী গন আন্দোলন গুলির চাইতে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের সক্রিয়তাও অনেক বেশি পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়। তারা শুধু বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেন নি। বিভিন্ন ক্যাম্প সংগঠিত করেছিলেন। রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য রিলিফ ফান্ড তৈরি করেছিলেন। আন্দোলনের জন্য তহবিলও তৈরি করেছিলেন।
(৬.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের মূল ধরন গুলি ছিলো - স্কুল, কলেজ বর্জন করা, বিদেশী কাপড়ের দোকানে পিকেটিং করা, ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করা, বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করা, চরখা, খাদি ও গ্রামোন্নয়নের কর্মসূচিকে প্রচার করা, সরকারি দপ্তরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা, আন্দোলন পরিচালনা ও প্রচারের জন্য গোপন কেন্দ্র গুলিতে কাজ করা, নাশকতামূলক কাজকর্ম পরিচালনা করা ইত্যাদি।
(ই.) নারীদের ভূমিকার বহুবিধ দিক :-
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকাকে আলোচনার সুবিধার্থে আমরা দুটি দিকে ভাগ করে বিশ্লেষন করবো। যথা -
এক, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কেন্দ্রীয় স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা, এবং
দুই, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে আঞ্চলিক স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা।
(A.) কেন্দ্রীয় স্তরে নারীদের ভূমিকা :-
ভারত ছাড়ো আন্দোলন পরিচালনা ও সংগঠনে কেন্দ্রীয় স্তরের বেশ কিছু নারী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - সরোজিনী নাইডু,অরুনা আসফ আলি, সুচেতা কৃপালনী, ঊষা মেহতা।
(ক.) সরোজিনী নাইডু :-
কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটির একমাত্র নারী সদস্যা ছিলেন সরোজিনী নাইডু। বোম্বাইয়ে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সভায় তিনি হিন্দু মুসলিম দুটি সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ১৯৪২ খ্রিঃ ৮ ই আগস্ট, আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই গান্ধীজির সঙ্গে তাকেও ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ১৯৪৩ খ্রিঃ মার্চ মাসে ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারনে ব্রিটিশ সরকার তাকে মুক্তি দেয়।
খুব শীঘ্রই শারীরিক অসুস্থতা কাটিয়ে ১৯৪৪ খ্রিঃ তিনি বোম্বাই, দিল্লি ও লাহোরে বিভিন্ন জনসভায় অংশগ্রহণ করলে ব্রিটিশ সরকার তার ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু সরকার জনসমক্ষে বক্তব্য রাখতে বা শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করলেও, সরোজিনী গোপনে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সমর্থন জুগিয়ে যান।
(খ.) মিসেস অরুনা আসফ আলি :-
১৯৩৪ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো কংগ্রেস সমাজতন্ত্র দল বা কংগ্রেস সোসালিষ্ট পার্টি। এরই অন্যতম সদস্য ছিলেন মিসেস অরুনা আসফ আলি। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
১৯৪২ খ্রিঃ ৮ ই আগস্ট জাতীয় কংগ্রেসের ভারত ছাড়ো প্রস্তাব পেশের সময় তিনি বোম্বাই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। ঐ দিন প্রধান নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ৯ ই আগষ্ট বোম্বের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দান এবং পরে শিবাজী পার্কে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় অরুনা আসফ আলি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং সভায় সভাপতিত্ব করেন। নারী ও ছাত্ররাই এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন।
পুলিশ আন্দোলন দমন করার জন্য গুলি চালালে অনেক মানুষ নিহত ও আহত হন। অরুনা আসফ আলি এরপর অন্তরীন হয়ে যান এবং গোপনে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজ চালিয়ে যান। তিনি গোপনে স্বেচ্ছাসেবীদের সংগঠিত করে গোটা ভারত জুড়ে ব্রিটিশ বিরোধী নাশকতামূলক কাজের পরিকল্পনা করেন।
এই জন্য তিনি ছদ্মবেশে বারংবার বাংলা ও আসাম পরিক্রমা করেন। এছাড়া, গোপনে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের মাসিক সংবাদপত্র "ইনকিলাব" সম্পাদনা করেন। এই পত্রিকার মধ্য দিয়ে তিনি ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে বৈপ্লবিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অরুনা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে হিংসাত্মক পথকেই আন্দোলনের একমাত্র উপযুক্ত পথ বলে মনে করতেন।
দিল্লিতে রাজনারায়ন নামে একজন কংগ্রেস কর্মীর জাবানিতে শোনা যায়, অরুনা আসফ আলি কৃষ্ণা নায়ার নামে একজনকে দায়িত্ব দেন, জনপিছু ১৫ টাকা মাইনেতে গ্রামবাসীদের নিয়ে যাতে "কংগ্রেস আর্মি" তৈরি করা হয়। এই আর্মিকে সঠিক সময়ে আন্দোলনে ব্যবহার করা হয়েছিলো।
(গ.) সুচেতা কৃপালনী :-
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কেন্দ্রীয় স্তরের আরেক নেতৃত্ব ছিলেন সুচেতা কৃপালনী। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কংগ্রেসের প্রধান নেতারা যখন কারারুদ্ধ ছিলেন তার কিছুদিন আগেই সুচেতা জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। আন্দোলন শুরুর পর তিনি কিছুদিন অন্তরীন হয়ে যান এবং গোপনে বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকে সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যান।
১৯৪৩ খ্রিঃ সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মহিলা শাখা খোলা হয়। শ্রীমতি কৃপালনী এর সভাপতি নিযুক্ত হন। সমাজের সর্বস্তরের নারীরা যাতে কংগ্রেসের গন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন সেইজন্য সুচেতা গোপনে কাজ করতে থাকেন এবং নিয়মিত মিটিংয়ের আয়োজন করেন। আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে ১৯৪৪ খ্রিঃ ব্রিটিশ পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
(ঘ.) ঊষা মেহতা :-
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কেন্দ্রীয় ভূমিকার ক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাম ছিলো ঊষা মেহতা। বোম্বাই অধিবেশনে ভারত ছাড়ো প্রস্তাবটি যখন পাশ হয় এবং আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গুলি যখন নেওয়া হয় তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঊষা মেহতা।
৮ ই আগস্ট প্রথম সারির বিখ্যাত কংগ্রেস নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ার পর আন্দোলনকে সর্বভারতীয় স্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ঊষা এবং তার কয়েকজন বান্ধবী একটি গোপন রেডিও খোলেন, যার নাম ছিলো "Voice of Freedom" । এই কংগ্রেস রেডিওর নিজস্ব ট্রান্সমিটার ছিলো। ১৯৪২ খ্রিঃ ৪ ঠা আগস্ট voice of Freedom সম্প্রচার শুরু করে এই বলে - "This is the Congress Radio calling in 42.84 metres somewhere in India..." ।
পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে এই রেডিও চালানো খুবই কঠিন ছিলো। তা সত্ত্বেও, এর মাধ্যমে ঊষা আন্দোলনের স্বপক্ষে জনমত সংগঠনের কাজটি চালিয়ে যান। শেষপর্যন্ত অবশ্য পুলিশ রেডিও স্টেশন বাজেয়াপ্ত করে এবং ঊষাকে গ্রেপ্তার করে। বিচারে ঊষার ৪ বছরের জেল হয়।
(ঙ) অন্যান্য নারী :-
সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে আরোও বেশ কিছু নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন -
কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় -
ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে নারীদের সংগঠিত করতে কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি অসংখ্য সভা সমিতি ও বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। এইজন্য ১৯৩৯ খ্রিঃ থেকে ১৯৪৪ খ্রিঃ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার ব্রিটিশ পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
মীরাবেন ও খুর্শিদবেন -
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি নাম ছিলো মীরাবেন ও খুর্শিদবেন। মীরাবেন সরাসরি আন্দোলনে অংশ না নিলেও সারা ভারতে গান্ধীর আদর্শ ও খাদির প্রচার করেন এবং নারীদের সংগঠিত করেন।
এই জন্য গান্ধীজির সঙ্গেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনে প্রচারাভিযানের সময় ১৯৪২ খ্রিঃ তিনি ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।
একই ভাবে খুর্শিদবেন গান্ধীজির আদর্শ ও আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। তিনি উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বোম্বাই প্রদেশে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার নেতৃত্বে বোম্বাই প্রেসিডেন্সির মহিলারা ব্যাপক ভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
এই দুইজন নারী ছাড়াও গান্ধীজির সর্বক্ষনের সঙ্গী কস্তুরবা গান্ধী, হংস মেহতাব, মৃদুলা সারাভাই এর মতো নারীরাও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মেয়েদের সংগঠিত করতে এবং নারীদের মধ্যে গান্ধীজির আদর্শ ও ভাবধারা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
এইভাবে দেখা যায়, সর্বভারতীয় স্তরে "কেন্দ্রীয় ভাবে" "নেতৃত্বহীন" ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ করতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
(B.) আঞ্চলিক স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা :-
তবে মনে রাখতে হবে, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা এইসব গুটিকয়েক নারীদের অবদানের মধ্যেই সীমায়িত ছিলো না। আঞ্চলিক স্তরে বিভিন্ন প্রদেশে গুলিতে আন্দোলনকে সংগঠিত করতেও বহু নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। যেমন -
(ক.) বাংলা :-
বাংলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সবথেকে তীব্র প্রভাব পড়েছিলো মেদিনীপুর জেলায়। সেখানে তমলুক মহকুমায় স্বাধীন "তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার" গড়ে উঠেছিলো। এই সরকারে মহিলা স্বেচ্ছাসেবিকাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিলো "ভগিনী সেনা"।
১৯৪৪ খ্রিঃ ৮ ই আগস্ট পর্যন্ত তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার টিকে ছিলো। এই সময় তাম্রলিপ্ত সরকারের নেতৃত্বে একাধিক মিটিং মিছিলে মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ অংশ নেন। এইসব অনামী মহিলাদের মধ্যে এক অনন্য দৃষ্টান্তের নজির সৃষ্টি করেন ৭৩ বছরের গ্রাম্য বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা, যিনি গান্ধীজির আদর্শ নিষ্ঠা ভাবে পালনের জন্য "গান্ধী বুড়ি" উপাধি লাভ করেছিলেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় তমলুকের ২০ হাজার মানুষ এক বিরাট মিছিল করে তমলুক থানা ঘেরাও করে। এই মিছিলে একেবারে অগ্রভাগে জাতীয় পতাকা নিয়ে নেতৃত্ব দেন মাতঙ্গিনী হাজরা। পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে মাতঙ্গিনী মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও, দেশের জাতীয় পতকাকে ভূলুন্ঠিত হতে দেন নি।
অসিতিপর গ্রাম্য বৃদ্ধা বিধবার এই আত্মত্যাগ হাজার হাজার নারীকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।
মেদিনীপুরের পাশাপাশি বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে মহিলা কর্মীরা আন্দোলনকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌহিত্রী নন্দিত দেবী এবং শ্রীমতি রানী চন্দ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে কারারুদ্ধ হন।
কলকাতায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে বহু নারী কারারুদ্ধ হন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বীনা দাশ। দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেসের প্রধান সম্পাদক হিসাবে আন্দোলন সংগঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কলকাতা ছাড়া, বাঁকুড়ায় শান্তশীলা পালিত, বীরভূমের নন্দিতা কৃপালনী, ঢাকায় আশালতা সেন, কুমিল্লায় লাবন্যলতা চন্দ, বালুরঘাটে প্রভা চট্টোপাধ্যায়, দিনাজপুরে লাবন্যপ্রভা দাশগুপ্ত, নোয়াখালীতে সুশীলা মিত্র ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে পুরুলিয়া জেলার মহিলারাও উল্লেখযোগ্য ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৪২ খ্রিঃ ১০ ই আগস্ট পুরুলিয়াতে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শামিল হয়ে গ্রেপ্তার হন "পুরুলিয়ার মা" নামে খ্যাত লাবন্যপ্রভা ঘোষ এবং কমলা ঘোষ। পুরুলিয়াতে বিভিন্ন এলাকায় মহিলারা সরকারি দপ্তর গুলিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের চেষ্টা করেন। ওখানকার মদভাঁটি গুলি ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া, রাস্তা ও রেল অবরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
(খ.) আসাম :-
আসামে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেন কনকলতা বড়ুয়া। ১৯৪২ খ্রিঃ ২০ সেপ্টেম্বর, পাঁচ হাজার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গোহাপন থানা দখলের জন্য মিছিল করেন। দারোগা গুলি চালালে কনকলতার মৃত্যু হয়। বহু নারী আহত ও নিহত হন।
আন্দোলন পরিচালনার জন্য আসামে "Free India Fighting Force" গঠিত হলে বহু অসমীয়া নারী তাতে যোগ দেন। ১৯৪২ খ্রিঃ ৭ অক্টোবর, বাজাইল গ্রামের দশ হাজার মহিলা পাথরকুচি পুলিশ স্টেশন দখল নিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এছাড়া, ১৯৪৩ খ্রিঃ ২৬ জানুয়ারি, এক হাজার অসমিয়া নারী একটি সভা আহ্বান করে স্বাধীনতা দিবস পালন করলে ব্রিটিশ পুলিশ বেশ কয়েকজন নারীকে গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন - চন্দ্রপ্রভা সৈকিয়ানী।
(গ.) পাঞ্জাব :-
পাঞ্জাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্র ছাত্রীরা ব্যপক ভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে বিপ্লবী কার্যকলাপে যুক্ত থাকার সন্দেহে ব্রিটিশ পুলিশ লাহোর থেকে ১০৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে ২২ জন ছিলেন ছাত্রী। এইসব ছাত্রীদের অমৃতসর নিয়ে এসে অকথ্য অত্যাচার চালায়। তীব্র অত্যাচারেও তারা নিজেদের পরিচয় পুলিশকে জানায় নি। তারা বলে, তাদের একটাই পরিচয় তারা স্বাধীনতা সংগ্রামী।
তবে পাঞ্জাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সবচেয়ে স্মরণীয় নামটি ছিলো রাজকুমারী অমৃত কাউর। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় জন্য ব্রিটিশ পুলিশ তার ওপর ১৫ বার লাঠি চার্জ করে। শেষপর্যন্ত অবাধ্য এবং অদম্য এই বীরাঙ্গনাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেলবন্দী করে।
অমৃত কাউরের মতোই আরেকজন স্মরনীয়া ছিলেন অমর কাউর। অমর শুধু পাঞ্জাবেই নয়, উত্তর পশ্চিম সীমান্তেও ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে বহু মিটিং মিছিলের আয়োজন করেন। এইজন্য ১৯৪২ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটিশ পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলে জেলের ভিতরেই অমর কাউরে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
এ প্রসঙ্গে পাঞ্জাবের আরোও একজন নারীর নাম করতে হয়। ইনি হলেন পুষ্প গুজরাল। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় তিনি পাঞ্জাবের জেলা কংগ্রেসের সভাপতি মনোনীত হন এবং আন্দোলনকে সংগঠিত করতে গোপনে বিপ্লবী কার্যকলাপে যুক্ত হয়ে পড়েন। এইজন্য ব্রিটিশ পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
(ঘ.) বোম্বাই :-
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বোম্বাই প্রদেশ পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। ৮ ই আগস্ট কংগ্রেসের প্রধান নেতাদের গ্রেপ্তারের পর বোম্বাইয়ের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও বিক্ষোভ সভার মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সূচনা হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন ও নেতৃত্ব দেন মিসেস অরুনা আসফ আলি।
বোম্বাই প্রেসিডেন্সির মহিলারা Women's Day পালন করে এবং বিভিন্ন শোভাযাত্রার আয়োজন করে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। গুজরাটেও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ অংশ নেন। আমেদাবাদে মহিলারা তিনটি শোভাযাত্রা ও মিছিলের মধ্য দিয়ে আন্দোলনে অংশ নেন। বোম্বাই প্রদেশে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দলে দলে নারীরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। দুটি বালিকা জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অপরাধে গ্রেপ্তার হন। এইসব আন্দোলন ও মিছিলে নেতৃত্ব দেন অরুনা আসফ আলি, খুর্শিদবেন, সত্যবতী মেহতা প্রমুখ নারী।
পুলিশ আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য ব্যাপক লাঠিচার্জ করে এবং গুলি চালায়। ফলে বহু মহিলা আহত হন। শুধু বোম্বাই প্রদেশে আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে পুলিশ ১৫০ জন মহিলাকে গ্রেপ্তার করে।
(ঙ) উত্তর ও মধ্য প্রদেশ :-
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ পুলিশ উত্তর প্রদেশের বেনারসে কংগ্রেস পার্টি অফিস ভাঙচুর করলে একদল ছাত্রী এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এই সময় বহু মহিলা ও ছাত্রী গোপনে বিপ্লবীদের নানা ভাবে সাহায্য করেন। বারানসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ জন ছাত্রীকে বিপ্লবী কাজকর্মে সাহায্য করার অপরাধে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
উত্তর প্রদেশের মতো মধ্য প্রদেশের মহিলারাও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেন। এই প্রদেশের মহিলারা আদালতের ভারতীয় বিচারকদের হাতে রাখি পরিয়ে আন্দোলনে অংশ নিতে এবং চাকুরি ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন।
তবে মধ্য প্রদেশে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে বীরাঙ্গনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন অনসূয়াবাই কালে নামে জনৈক মহিলা। তিনি "ভগিনী মন্ডল" নামে একটি মহিলা সংগঠন তৈরি করেন এবং বহু সভা সমিতির মাধ্যমে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যপক প্রচার চালান।
(চ) দক্ষিণ ভারত :-
দক্ষিণ ভারতের প্রদেশ গুলিতেও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মহিলারা ব্যপক ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মহারাষ্ট্রের সাতারায় নিন্মবর্গ কুনবি সম্প্রদায়ের নারীরা আন্দোলনে সামিল হন।
কর্নাটকে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে ১৪ জনের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৩ জনই ছিলেন মহিলা। এখানে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে তীব্র করে তুলতে ছাত্রীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। তারা থানা ও জেলা কোর্টে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। সেখানকার কর্মীদের গান্ধী টুপি পরিয়ে দিয়ে সরকারি চাকুরি ত্যাগ করে আন্দোলনে সামিল হওয়ার অনুরোধ করেন।
এর ফলে আন্দোলনে যুক্ত অনেক ছাত্রী ও মহিলাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। অনেককে আবার মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা করে এবং জেলে নিয়ে গিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালায়।
(ছ) সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু প্রদেশ :-
উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে "খুদা ই খিদমদগার" এর কার্যকলাপে প্রভাবিত হয়ে বহু মহিলা আন্দোলনে অংশ নেন। সিন্ধু প্রদেশেও নানা সভা সমিতি ও মিছিলে মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ ভাবে অংশ নেন। এজন্য তাদের মাঝে মধ্যেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে গভীর রাত্রে নির্জন স্থানে ছেড়ে দিয়ে আসতো বলে গোপন নথিপত্র ও রেকর্ড থেকে জানতে পারা যায়।
(জ.) ছাত্রী সমাজ ও অন্যান্য ক্ষেত্রের নারীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা :-
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রীরাও গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করে। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ছাত্রদের পাশে ছাত্রীরা উল্লেখযোগ্য ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলো। এ প্রসঙ্গে সেখানে রত্নাময়ী দেবীর কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয়। কলেজের ছাত্রদের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি লেখেন - "মাতৃভূমি তোমাদের ডাকছে। তাঁর প্রতিটি পাঁজর ভেঙে গেছে, তাঁর শরীর থেকে রক্ত বয়ে চলেছে অবিরত ক্ষমাহীন ভাবে। এসব তোমরা চুপ করে বসে দেখবে, বই ছুঁড়ে ফেলে দাও এবং বেরিয়ে এসো। বাপুজির ডাক" করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে" - এর বেশি আর কী বলার আছে?"
উত্তর প্রদেশে এবং বাংলায় আন্দোলনের ক্ষেত্রে ছাত্রীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলো। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদের এক শোভাযাত্রায় পুলিশ গুলি চালালে ৮ জন নিহত হন। এই শোভাযাত্রায় নারীরা ব্যাপক ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। লক্ষ্মৌতে আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারের অফিস যখন ছাত্ররা পুড়িয়ে দেয়, তখন সেখানে ছাত্রদের পাশে নারী ছাত্রীরাও গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করেন।
গুজরাটে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কিশোর বালকরা যে বানর সেনাদল তৈরি করে, তাতে নারী বালিকারাও অংশগ্রহণ করেছিলো।
১৯৪১ খ্রিঃ মধ্যে "স্টুডেন্টস ফেডারেশন" ও "মহিলা ফেডারেশনের" সদস্য সংখ্যা ছিলো প্রায় ৫০ হাজার। এই বিপুল সংখ্যক নারীরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। বামেরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সমর্থন না করলেও, ১৯৪২ খ্রিঃ বাংলার কিছু বামপন্থী মহিলা নেত্রী "মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি" নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে তারা গ্রামীন মহিলাদের আন্দোলনের স্বপক্ষে সংগঠিত করেন।
১৯৪৪ খ্রিঃ ২ আগষ্ট একদল মহিলা হায়দ্রাবাদ শহরে সত্যাগ্রহ করেন। এই সময় তারা ছড়া কেটে বলেন - "গান্ধি কা চরকা চালানা পড়েগা, গোরোঁ কো লন্ডন যানা পড়েগা"।
(ঈ.) মূল্যায়ন :-
এইভাবে দেখা যায়, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণের যে গৌরবময় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তা তাদের পূর্ববর্তী সব দৃষ্টান্তের গৌরবকে ছাপিয়ে যায়।গান্ধীজি মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন তার সত্যাগ্রহের আদর্শ ও অহিংসার নীতি পালন করার অসীম ধৈর্য্য পুরুষ অপেক্ষা নারীদেরই বেশি আছে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগ গান্ধীর সেই বিশ্বাসকেই সত্য প্রমানিত করেছিলো।
একথা ঠিক, ঊষা মেহতা, অরুনা আসফ আলি, সুচেতা কৃপালনীর মতো মেয়েরা যদি ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে গোপনে সংগঠিত করার চেষ্টা না করতেন তাহলে হয়তো ভারত ছাড়ো আন্দোলন এতটা সংগঠিত ভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ওপর আছড়ে পড়তে পারতো না। তবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের ভূমিকার দিকটি শুধুমাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহন বা যোগদানের বিষয়টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। আমাদের আলোচনার বাইরে আরোও অসংখ্য নারী ছিলেন, যাদের ভূমিকার কথা সেভাবে সমকালীন নথি পত্রে লিপিবদ্ধ হয় নি। এইসব নারীদের একটা বড়ো অংশ অন্তপুরবাসীনী ছিলেন।
মনে রাখতে হবে, ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিলো ভারতের সর্ববৃহৎ গন আন্দোলন। সারা ভারতের যে পরিমান মানুষ এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন তা আগের কোন গন আন্দোলনে লক্ষ্য করা যায় নি।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই আন্দোলনকে স্তিমিত করতে ব্রিটিশ সরকার অকথ্য নির্যাতন ও নিষ্ঠুর দমন নীতি প্রয়োগ করে। আন্দোলনে অংশ নেওয়া পুরুষদের নাম পরিচয় ও ঠিকানা বলবার জন্য এই সময় বহু অন্তপুরবাসীনী নারীদের ওপর নানা নির্যাতন চালানো হয়। বহু নারী ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনার হাতে গনধর্ষিতা ও লাঞ্ছিত হন। কিন্তু এত অত্যাচার সত্ত্বেও তারা স্বামী, ভাই বা সন্তানের নাম পুলিশের কাছে জানান নি। আন্দোলন দমনের সময়েও সবথেকে বেশি মানসিক ও শারীরিক নিপীড়নের শিকার হতে হয় নারীদের।
সুতরাং ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ও অবদানের বিষয়ে আলোচনার সময় এইসব অনামী, অসহায়, কালের গহরে হারিয়ে যাওয়া নারী সমাজের আত্মত্যাগের বিষয়টিকেও দেশবাসী হিসাবে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।
গ্রন্থঋন :-
এই লেখায় ব্যবহৃত কিছু তথ্যের জন্য নিন্মলিখিত গ্রন্থকারদের কাছে আমি ঋনী -
১. ভারত ছাড়ো আন্দোলন, সম্পাদনা - ইয়াসিন খান ও সুশান্ত দে।
২. জাতীয় আন্দোলনে বঙ্গনারী - যোগেশচন্দ্র বাগল।
৩. স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী - কমলা দাশগুপ্ত।