গান্ধীজির ডাকে ১৯৩০ খ্রিঃ ভারতে শুরু হয়েছিলো আইন অমান্য আন্দোলন। ভারতে ব্রিটিশ সরকারের তৈরি নানা স্বৈরাচারী আইন গুলিকে অমান্য করে এদেশে ব্রিটিশ প্রশাসনকে অচল ও অকার্যকর করার উদ্দেশ্যেই এই গন আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়।
এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিলো ৩ টি -
(১.) ভারতের বৃহত্তর জনসমাজকে আইন অমান্যের সঙ্গে যুক্ত করা,
(২.) সার্বিক আইন অমান্যের মধ্য দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অবৈধ উপস্থিতিকে অস্বীকার করা, এবং
(৩.) প্রবল জনমত সংগঠিত করে ব্রিটিশ সরকারকে স্বরাজ দানে বাধ্য করা।
ভারতে দুটি পর্বে আইন অমান্য আন্দোলন চলেছিলো। ১৯৩০ - ৩১ খ্রিঃ পর্যন্ত চলেছিলো আন্দোলনের প্রথম পর্ব। ১৯৩১ খ্রিঃ গান্ধি লন্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিলে আন্দোলন কিছুটা স্থগিত রাখা হয়। পরে ১৯৩২ খ্রিঃ থেকে ১৯৩৪ খ্রিঃ পর্যন্ত চলে আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব। দুটি পর্বেই নারীরা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা |
(অ.) নারী সমাজের প্রতি গান্ধীর আবেদন :-
নারীদের প্রতি গান্ধীজির সুগভীর বিশ্বাস, ভরসা ও আস্থা ছিলো। তিনি মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন, তার অহিংসা নীতি, সত্যাগ্রহ আদর্শ এবং স্বদেশী কর্মসূচি গুলি পালন করার ধৈর্য পুরুষ অপেক্ষা নারীদের মধ্যেই বেশি রয়েছে। এইজন্য গান্ধীজি তার সমস্ত গন আন্দোলনেই নারীদের সামিল করতে চেয়েছিলেন। আইন অমান্য আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম ছিলো না।
১৯৩০ খ্রিঃ ১০ ই এপ্রিল, গান্ধীজি তার "ইয়ং ইন্ডিয়া" পত্রিকাতে নারী সমাজকে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেবার আহ্বান জানালে তা মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাজ করে। গান্ধীর আহ্বানে জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে দলে দলে নারীরা যোগ দিতে এগিয়ে আসে।
(আ.) নারীদের অংশগ্রহণের ধরন ও প্রকৃতি :-
আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের ধরন ও প্রকৃতির মধ্যে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় -
(ক.) আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের প্রকৃতি ছিলো ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত। এর আগে আর কোন গন আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের এমন ব্যপকতা লক্ষ্য করা যায় নি।
(খ.) শুধু শিক্ষিতা মহিলারা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন নি। বহু অশিক্ষিতা মহিলারাও এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অশিক্ষিত নারীদের যোগদানের এই ব্যপকতাও পূর্ববর্তী আন্দোলন গুলিতে লক্ষ্য করা যায় নি।
(গ.) আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের সংখ্যা আগের দুই গন আন্দোলন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন থেকে পরিমানে অনেক বেশি ছিলো। আদিবাসী, মুসলিম, দলিত - সমাজের সর্বস্তরের নারীরাই আইন অমান্যে সামিল হয়েছিলেন।
(ঘ.) আগের দুই গন আন্দোলন স্বদেশী আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণকে নির্দিষ্ট পালনীয় কর্মসূচির গোন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ রাখার প্রবনতা লক্ষ্য করা গেলেও, আইন অমান্য আন্দোলনে এই সীমারেখা নারীরা মানেন নি। চিরাচরিত ঢঙে গান্ধী তার পূর্ববর্তী গন আন্দোলন গুলির মতো আইন অমান্য আন্দোলনেও নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কর্মসূচি ও ভূমিকা স্থির করে দিয়েছিলেন। কিন্তু নারীরা সেই সীমারেখা থেকে বেরিয়ে এসে সক্রিয় ভাবে আন্দোলনে অংশ নেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, আবার কোথাও পুরুষের সাথে একত্রে আন্দোলনের অংশীদার হন। এককথায়, পূর্ববর্তী গন আন্দোলন গুলি থেকে আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের ধরন ছিলো অনেক বেশি বৈপ্লবিক।
(ঙ.) অধ্যাপক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, আইন অমান্যে নারীদের অংশগ্রহণের প্রকৃতির দিক থেকে বোম্বাই প্রেসিডেন্সির আন্দোলন ছিলো সবচাইতে সংগঠিত। বাংলা প্রেসিডেন্সির আন্দোলন ছিলো সবচাইতে উগ্র এবং মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিলো কিছুটা সীমিত।
(ই.) আন্দোলনে নারীদের ভূমিকার বহুবিধ দিক :-
আইন অমান্য আন্দোলনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্যেই ছিলো এই আন্দোলনে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। একেবারে প্রথম থেকেই আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচির সঙ্গেই নারীরা জড়িত ছিলেন। আন্দোলনে তাদের ভূমিকা এবং অংশগ্রহণের প্রধান দিক গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) ডান্ডি অভিযানে অংশগ্রহণ :-
গান্ধীজি লবন আইন ভঙ্গের মধ্য দিয়ে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৮৮২ খ্রিঃ ইংরেজদের তৈরি "Salt Act" এর জন্য ভারতীয়রা লবন তৈরি করতে পারতো না। এই আইন অনুযায়ী ভারতীয়রা লবন তৈরি করলে সরকার তার ওপর প্রচুর পরিমান কর বা Tax চাপাতো। ১৮৮২ খ্রিঃ এই কুখ্যাত লবন আইন ভঙ্গের মধ্য দিয়েই গান্ধীজি আইন অমান্য আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন।
লবন আইন ভাঙ্গবার জন্য গান্ধীজি ১৯৩০ খ্রিঃ ১২ ই মার্চ ৭৮ জন অনুগামীকে নিয়ে গুজরাটের সবরমতী আশ্রম থেকে ডান্ডী গ্রামে পদযাত্রা করেন। ৬ ই এপ্রিল তিনি ডান্ডীতে পৌঁছান এবং নিজ হাতে সমুদ্রের জল থেকে লবন প্রস্তুত করে তা গ্রহণ করেন। এইভাবে গান্ধী ব্রিটিশ সরকারের Salt Act কে অমান্য করে আইন অমান্য আন্দোলনের সূত্রপাত করেন।
গান্ধীজি প্রথমদিকে ডান্ডি অভিযানের কর্মসূচিতে নারীদের অংশগ্রহণের অনুমতি দেন নি। এপ্রসঙ্গে গান্ধীর আপত্তির কারন ছিলো দুটি -
এক, তার মনে হয়েছিলো, নারীরা ডান্ডি অভিযানের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারবে না। কেননা শারীরিক দিক থেকে তারা পুরুষদের মতো সক্ষম নয়।
দুই, নারীদের ডান্ডি অভিযানে সামিল করলে ব্রিটিশ সরকার এই বিষয়টি নিয়ে অপপ্রচার চালাবে যে, ব্রিটিশ পুলিশের ভয়ে ভারতীয়রা আইন অমান্যে অংশ না নিয়ে তাদের বাড়ির মেয়েদের আন্দোলনে অংশ নিতে পাঠিয়ে দিয়েছে।
যাইহোক, গান্ধী না চাইলেও, ভারতীয় নারীরা কিন্তু প্রথম থেকেই ডান্ডি অভিযানে অংশ নিতে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। এই উৎসাহের প্রমান সমগ্র ডান্ডি অভিযান কালেই লক্ষ্য করা যায়। ডান্ডি অভিযানের মাঝে ছোট ছোট বিরতি পথে যেখানেই গান্ধী বিশ্রাম নিতেন এবং সভা করতেন, সেখানেই অসংখ্য মহিলা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ দেন। প্রথম থেকেই নারীরা ডান্ডি অভিযানে অংশ নিতে চেয়ে দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
কিন্তু গান্ধী কোনরকম ঝুঁকি নিতে চান নি। ডান্ডি অভিযানকালে নারীদের অদম্য আকাঙ্খা ও আগ্রহের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে গান্ধি পরে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং অল্প কিছু মহিলাকে ডান্ডি অভিযানে অংশগ্রহণের অনুমতি দেন।
১৯৩০ খ্রিঃ ৬ ই এপ্রিল ডান্ডিতে লবন আইন ভঙ্গ করার সময় ৭ জনের যে দলটি প্রথম লবন আইন ভঙ্গ করে, তার মধ্যে দুজন ছিলেন নারী। এরা ছিলেন যথাক্রমে - কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় এবং অবন্তিকাবাই গোখলে।
(২.) লবন সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদান :-
ডান্ডিতে লবন আইন ভঙ্গ করার পরেই সরকারি লবন গোলা দখলের জন্য দিকে দিকে বিক্ষোভ ও সত্যাগ্রহ শুরু হয়ে যায়। বহু স্বেচ্ছাসেবী মহিলা সমুদ্রের জল থেকে লবন বানিয়ে লবন আইন ভঙ্গ করেন। অনেকে সরকারি লবন কারখানাও দখল করেন।
১৯৩০ খ্রিঃ ডান্ডিতে লবন সত্যাগ্রহের পরেই সরোজিনী নাইডু প্রায় আড়াই হাজার সত্যাগ্রহীকে সঙ্গে নিয়ে ধরসানার সরকারি লবনগোলা দখল করেন। অন্যদিকে কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় ১৫,০০০ সত্যাগ্রহীকে নিয়ে ওয়াদালা লবন কারখানায় বিক্ষোভ দেখান।
বলা বাহুল্য, যেখানে প্রাকৃতিক ভাবে লবন আইন ভঙ্গের কোন সুযোগ ছিলো না, সেখানে সরকারের অন্য আইন ও নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে আইন অমান্য চলতে থাকে। আইন ভঙ্গের এই কর্মসূচিতে পুরুষদের সঙ্গে দলে দলে নারীরাও যোগদান করে।
(৩.) আন্দোলনে বিভিন্ন "নারী সংগঠনের" ভূমিকা :-
আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(ক.) আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে ১৯২৫ খ্রিঃ "ন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেন" এবং ১৯২৭ খ্রিঃ "নিখিল ভারত মহিলা কনফারেন্স"প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এদের শাখা সংগঠন ছিলো। এই দুই সংগঠনের প্রায় ১০,০০০ সদস্য আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেয়।
(খ.) গান্ধিবাদী সরোজিনী নাইডু "রাষ্ট্রীয় স্ত্রী সংঘ" গঠন করে নারীদের সংঘবদ্ধ করেন এবং আইন অমান্য আন্দোলনকে জোরদার করে তোলেন।
(গ.) গান্ধীজির ডান্ডি অভিযানের পর আইন অমান্য পরিচালনার জন্য ১৯৩০ খ্রিঃ ১৩ মার্চ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় "নারী সত্যাগ্রহ সমিতি"। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন ঊর্মিলাদেবী, মোহিনী দেবী, আশালতা দাস ও কিছু অবাঙালি নারী এই সংগঠনের মাধ্যমে বাংলায় আইন অমান্য আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেন এবং জেলায় জেলায় পিকেটিং, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন।
(ঘ.) কলকাতায় "ছাত্রী সংঘ" নামে মেয়েদের একটি প্রতিষ্ঠান আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নেয় এবং পিকেটিং কর্মসূচি পালন করে।
(৪.) বিভিন্ন প্রদেশে নারীদের ভূমিকা :-
আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে প্রাদেশিক স্তরে আন্দোলনকে তীব্র করে তুলতে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। যেমন -
(ক.) বোম্বাই :-
বোম্বাইয়ে আইন অমান্য আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে নারীরা তাতে অংশ নেয়। বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে গুজরাটী মহিলাদের পাশাপাশি পার্শি ও খ্রিষ্টান মহিলারাও আন্দোলনে অংশ নেয়। ওখানে আন্দোলনকে ঘনীভূত করে তোলার জন্য সরোজিনী নাইডু এবং অবন্তিকা গোখলে পূর্বে প্রতিষ্ঠিত "রাষ্ট্রীয় স্ত্রী সংঘ" (১৯১৯ খ্রিঃ) কে কাজে লাগান।
বোম্বাই প্রেসিডেন্সির মধ্যে গুজরাটে আইন অমান্য আন্দোলন সবথেকে বেশি তীব্র হয়ে উঠেছিলো। আমরা আগেই আলোচনা করেছি, আইন অমান্য আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি "ডান্ডি অভিযান"গুজরাটেই হয়েছিলো। এই ঘটনা গুজরাট সহ গোটা বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতেই তুমুল উদ্মাদনা সৃষ্টি করে।
ডান্ডি অভিযানের পর গান্ধীজি সুরাট জেলার ধরসানায় সরকারী লবনগোলা দখলের জন্য সত্যাগ্রহের ডাক দিলে ব্রিটিশ সরকার গান্ধীজিকে গ্রেপ্তার করে। গান্ধীজি গ্রেপ্তার হওয়ায় ধরসানা সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব দেন সরোজিনী নাইডু। তার নেতৃত্বে প্রায় আড়াই হাজার সত্যাগ্রহী ধরসানা সত্যাগ্রহ চালায়। ব্রিটিশ সরকার ধরসানা সত্যাগ্রহ ভঙ্গ করার জন্য নিষ্ঠুর দমন নীতি প্রয়োগ করে।
(খ.) বাংলা :-
বোম্বাই প্রেসিডেন্সির পর বাংলাতেই আইন অমান্য আন্দোলনে সবথেকে বেশি সাড়া পাওয়া গিয়েছিলো। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, মেদিনীপুর, হুগলি, বর্ধমান এবং বাঁকুড়াতে আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু পূর্ব বাংলায় এই আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের মতো তেমন তীব্র আকার ধারণ করে নি।
বাংলাতে কংগ্রেসের সংগঠন দুর্বল ছিলো। এখানে মূলত নারী ও ছাত্রদের উদ্যোগেই আইন অমান্য আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করেছিলো। বাংলাতে "মহিলা রাষ্ট্রীয় সংঘ", "ছাত্রী সংঘ", "নারী সত্যাগ্রহ সমিতির" হাত ধরে হাজার হাজার নারী আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নেন। এদের নেতৃত্ব দেন - ঊর্মিলাদেবী, মোহিনী দেবী, জ্যোর্তিময়ী গঙ্গোপাধ্যায়, আশালতা দাস প্রমুখ।
এছাড়া, বাঁকুড়ায় শান্তশীলা পালিত, হাওড়ায় পারুল মুখোপাধ্যায়, দিনাজপুরে প্রভা চট্টোপাধ্যায়, নোয়াখালীতে সুশীলা মিত্র, ঢাকায় আশালতা সেন প্রমুখ নারী সক্রিয় ভূমিকা নেন।
(গ.) মাদ্রাজ :-
মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে আইন অমান্য আন্দোলন বোম্বাই ও বাংলা প্রেসিডেন্সির মতো তীব্র ছিলো না। এখানে শ্রীনিবাস আয়েঙ্গায়ারের কন্যা শ্রীমতি অম্বুজামল আইন অমান্য আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন এবং স্বদেশীর প্রচার করেন। রকমনি লক্ষ্মীপতি নামে জনৈক নারী লবন আইন ভঙ্গ করতে গিয়ে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।
(ঘ.) উত্তর ভারত :-
উত্তর ভারতে আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের প্রধান কেন্দ্র ছিলো - এলাহাবাদ, লক্ষ্মৌ, দিল্লি এবং লাহোর।
(১.) দিল্লিতে আইন অমান্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন সত্যবতী দেবী। দিল্লির অনেক সম্ভ্রান্ত মহিলা তার ডাকে আইন অমান্যে যোগ দিয়ে মদের দোকানে ও বিলিতি কাপড়ের দোকানে পিকেটিং করে। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতেই ১৬০০ মহিলা আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরন করেন। দিল্লির আন্দোলন দমনে ব্রিটিশ সরকার অত্যন্ত পৈশাচিক দমন নীতির আশ্রয় নেয়।
(২.) এলাহাবাদে জওহরলাল নেহেরুর মা স্বরূপরানী নেহেরু ও স্ত্রী কমলা নেহেরু আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্ব দেন।
(৩.) লাহোরে জওহরলাল নেহেরুর পিতা মতিলাল নেহেরুর ভাইঝি লডো রানি জুৎসি আন্দোলনে অংশ নেন এবং নেতৃত্ব দেন।
(ঙ.) মধ্য ও দক্ষিণ ভারত :-
মহারাষ্ট্র, কর্নাটকের ও মধ্যপ্রদেশে আইন অমান্য আন্দোলন অরন্য সত্যাগ্রহের রূপ নিয়েছিলো। বহু গ্রাম্য মহিলা এই অরন্য সত্যাগ্রহে শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া, মদের দোকান ও বিদেশী পন্যের দোকানে পিকেটিং কর্মসূচিতেও তারা অংশ নেন।
(চ.) আসাম ও উত্তর - পূর্ব ভারত :-
আসামে কংগ্রেস নেতাদের অদক্ষতা ও উদাসীনতার ফলে আইন অমান্য আন্দোলন তীব্র হয় নি। সেখানে মূলত নারী ও ছাত্র যুবদের উৎসাহে আইন অমান্য আন্দোলন সংগঠিত হয়। আসামে চন্দ্রপ্রভা শৈকিয়জী নামে জনৈক মহিলা "কাছারি" গ্রামে উপজাতি সম্প্রদায়কে একত্রিত করে অরন্য আইন ভঙ্গ করেন এবং আইন অমান্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
নাগাল্যান্ডে রানী গইদিলিউ (Rani Gaidinliu) মাত্র ১৩ বছর বয়সে গান্ধীজির ডাকে সাড়া দিয়ে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৯৩২ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার রানীকে গ্রেপ্তার করে আজীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে। রানী তার যৌবনের উজ্জ্বল দিন গুলি আসামের অন্ধকার কারাবাসেই কাটিয়ে দেন।
(ছ.) প্রান্তিক নারীদের অংশগ্রহণ :-
আইন অমান্য আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষিত হিন্দু নারীদের পাশাপাশি আদিবাসী, দলিত ও মুসলিম নারীরাও অংশ নিয়েছিলেন। দলিত নারীদের মধ্যে চম্পুতাই, গোপিকা বাই, ধূলিবেন সোলাংকি ও সোনাল সোলাংকি আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরন করেন।
আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা মুসলিম নারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - ২৪ পরগনার হাড়োয়া থানার হোসেন আরা বেগম, সিলেটের জোবেদা খাতুন, ময়মনসিংহের রাজিয়া খাতুন ও হালিমা খাতুন, বিক্রমপুরের ফুলবাহার বিবি।
(ঈ.) গুরুত্ব :-
আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক গুলি কারনে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো -
(১.) এই আন্দোলনে সমাজের সর্বস্তরের নারীরাই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলো। জাতীয় আন্দোলনে তাদের এই যোগদান ব্রিটিশ সরকারকে চিন্তায় ফেলে দেয়।
(২.) নারীদের এই ব্যাপক অংশগ্রহণ একদিকে যেমন আইন অমান্য আন্দোলনকে বলিষ্ঠতা প্রদান করে, তেমনি অন্যদিকে কংগ্রেসকে সাংগঠনিক দিক থেকে যথেষ্ট শক্তিশালী করে তোলে।
(৩.) আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারীদের সম্মান ও মর্যাদাকে বহুগুন বৃদ্ধি করে।
(৪.) নারীরা রাজনৈতিক দিকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি নিজেদের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন হয়ে ওঠে। তারা নারী ভোটাধিকারের বিষয়ে সোচ্চার হয়।
(৫.) আইন অমান্য আন্দোলনের গ্রামোন্নয়নের কর্মসূচি, চরকা, খাদি ও তাঁতের প্রসার, মাদক বর্জন, নারী শিক্ষার প্রসার, কুটির ও হস্তশিল্পের প্রসার আদতে নারীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির পথ খুলে দেয় এবং নারী ক্ষমতায়নের পথ প্রশস্ত করে।