পশ্চিমবঙ্গ মধ্য শিক্ষা পর্ষদ প্রবর্তিত মাধ্যমিক ইতিহাসের সমগ্র পাঠ্যক্রমের মধ্যে বেশ কয়েকটি আইনের উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারতে ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন সময়ে এই আইন গুলি প্রবর্তন করেছিলেন।
মাধ্যমিক ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় গুলিতে এই আইন গুলির পরিচয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া আছে। ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার কথা ভেবে এই আইন গুলিকে একত্রে ধারাবাহিক ভাবে সংক্ষিপ্ত পরিচয় সহ তুলে ধরা হলো।
আইন ও বিল সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য |
(ক.) গুরুত্বপূর্ণ আইন :-
(১.) ১৮১৩ খ্রিঃ চার্টার আইন :-
- ১৮১৩ খ্রিঃ চার্টার বা সনদ আইন অনুযায়ী -
- (i.) ভারতে কোম্পানির একচেটিয়া বানিজ্যের অধিকার লোপ করা হয়।
- (ii.) ভারতে শিক্ষা খাতে কোম্পানি সরকারকে বার্ষিক এক লক্ষ টাকা খরচ করার কথা বলা হয়।
(২.) ১৭ নং রেগুলেশন অ্যাক্ট ( Regulation Act - XVII)/ "সতীদাহ প্রথা বিরোধী আইন-১৮২৯" :-
- (i.) লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৭ নং রেগুলেশন অ্যাক্ট দ্বারা ভারতে সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন।
- (ii.) রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে সতীদাহ আন্দোলনের ফলে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিঃ ৪ ই ডিসেম্বর এই আইন দ্বারা ভারতে সতীদাহ প্রথাকে দন্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষনা করেন।
(৩.) Regulation v and vii of 1830/ পঞ্চম ও সপ্তম আইন - ১৯৩০ :-
- (i.) ১৮৩০ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার পঞ্চম ও সপ্তম আইন প্রণয়ন করে।
- (ii.) এই আইন গুলিতে ঘোষনা করা হয় অগ্রিম অর্থ বা "দাদন" নিয়ে কোন নীলচাষী নীলচাষ না করলে নীলকর সাহেবরা কৃষকদের কয়েদ করতে ও তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।
(৪.) ১৮৩৩ খ্রিঃ সনদ আইন / চার্টার অ্যাক্ট :-
- (i.) ১৮৩৩ খ্রিঃ চার্টার আইন দ্বারা ভারতে ও চিনে কোম্পানির একচেটিয়া বানিজ্যের অধিকার চূড়ান্ত ভাবে লুপ্ত করা হয়।
- (ii.) এই আইন দ্বারা কোম্পানির কর্মচারী ও ইউরোপীয় পুঁজিপতিরা ভারতে জমি ক্রয় বিক্রয়ের অধিকার লাভ করে।
- (iii.) এই আইনের ফলে ভারতে ইউরোপীয় বনিকগন ব্যাপক ভাবে নীল চাষের সুযোগ লাভ করেন।
(৫.) ১৫ নং রেগুলেশন আইন (Regulation Act - XV)/"বিধবা পুর্নবিবাহ আইন - ১৮৫৬":-
- (i.) ১৮৫৬ খ্রিঃ ২৬ শে জানুয়ারি গর্ভনর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি ১৫ নং রেগুলেশন আইন পাশ করেন।
- (ii.) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা পুনর্বিবাহ আন্দোলনের ফলে এই আইন দ্বারা বিধবা বিবাহকে আইনসিদ্ধ বিষয় বলে ঘোষনা করা হয়।
(৬.) "ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন - ১৮৫৭":-
- (i.) ১৮৫৭ খ্রিঃ "ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন" প্রণয়ন করা হয়।
- (ii.) এই আইনের দ্বারা কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী অঞ্চলে তিনটি পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
(৭.) ১৮৫৮ খ্রিঃ ভারত শাসন আইন :-
- (i.) ১৮৫৭ খ্রিঃ সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতের জন্য ১৮৫৮ খ্রিঃ "ভারত শাসন আইন" প্রবর্তন করে।
- (ii.) এই আইন অনুযায়ী ভারতে কোম্পানি সরকারের অবসান ঘটিয়ে ভারত শাসনের দায়িত্ব ইংল্যান্ডের মহারানী ভিক্টোরিয়ার হাতে অর্পন করা হয়।
(৮.) Indian Forest Act - 1865 /ভারতীয় অরন্য আইন - ১৮৬৫ :-
- (i.) ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় বনভূমি ও অরন্য সম্পদের ওপর নিজেদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার জন্য ১৮৬৫ খ্রিঃ "ভারতীয় অরন্য আইন" পাশ করে।
- (ii.) স্যার জন লরেন্সের (sir John Lawrence 1864 - 68) আমলে ভারতীয় অরন্য আইন পাশ হয়েছিলো।
(৯.) অষ্টম আইন - ১৮৬৮:-
- ১৮৬৮ খ্রিঃ অষ্টম আইন দ্বারা বাংলাতে "নীলচুক্তি আইন" রদ করে বাধ্যতামূলক "দাদন" নিয়ে নীল চাষকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়।
(১০.) তিন আইন - ১৮৭২ :-
- (i.) ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের ফলে ১৮৭২ খ্রিঃ "তিন আইন" পাশ হয়।
- (ii.) এই আইন দ্বারা ব্রাহ্মসমাজে অসবর্ন বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং বহু বিবাহ ও বাল্য বিবাহকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়।
- (iii.) এই আইনে বিবাহের জন্য পাত্র পাত্রীর সর্বনিন্ম বয়স স্থির হয় যথাক্রমে - ১৮ বছর ও ১৪ বছর।
(১১.) নাট্যাভিনয়ন নিয়ন্ত্রণ আইন - ১৭৭৬ :-
- (i.) লর্ড নর্থব্রুক ১৮৭৬ খ্রিঃ "নাট্যাভিনয়ন নিয়ন্ত্রন আইন" পাশ করেন।
- (ii.) নাটকের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের প্রসার রোধ করার উদ্দেশ্যে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছিলো।
- (iii.) এই আইনে বলা হয় নাটক মঞ্চস্থ করার আগে নাটকের পান্ডুলিপি স্থানীয় থানায় জমা দিয়ে অনুমোদন নিতে হবে। ব্রিটিশ বিরোধী কোন নাটক মঞ্চস্থ করা যাবে না।
(১২.) দ্বিতীয় অরন্য আইন - ১৮৭৭ :-
- (i.) ভারতীয় অরন্য আইনকে আরোও কঠোর ভাবে বলবৎ করার জন্য এবং ১৮৬৫ খ্রিঃ অরন্য আইনের ক্রুটি দূর করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৮ খ্রিঃ "দ্বিতীয় অরন্য আইন" প্রণয়ন করে।
- (ii.) এই আইনে ভারতীয় অরন্য অঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা - সংরক্ষিত অরন্য (Reserved Forest), সুরক্ষিত অরন্য ( protected Forest), এবং গ্রামীন অরন্য ( village Forest)।
(১৩.) ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট / মাতৃভাষা সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রন আইন - ১৮৭৮ :-
- (i.) লর্ড লিটন ১৮৭৮ খ্রিঃ ১৪ ই মার্চ মাতৃভাষা সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রন আইন প্রণয়ন করেন।
- (ii.) সংবাদপত্রের মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধিতা দূর করা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কন্ঠরোধের উদ্দেশ্যে এই আইন প্রণয়ন করা হয়।
- (iii.) এই আইনে বলা হয়, দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্র গুলিতে ব্রিটিশ বিরোধী কোন সংবাদ বা লেখা প্রকাশিত হয়ে সংবাদপত্রকে বাজেয়াপ্ত করা হবে।
- (iv.) লর্ড রিপনের আমলে এই আইনটি ১৮৮১ খ্রিঃ প্রত্যাহার করা হয়।
(১৪.) অস্ত্র আইন - ১৮৭৮ :-
- (i.) লর্ড লিটন ভারতীয়দের নিরস্ত্র করার উদ্দেশ্যে ১৮৭৮ খ্রিঃ অস্ত্র আইন প্রণয়ন করেন।
- (ii.) এই আইন অনুযায়ী সরকারের অনুমতি ব্যতীত অস্ত্র সংরক্ষণ ও অস্ত্র বহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
(১৫.) প্রজাস্বত্ব আইন - ১৮৮৫ :-
- (i.) জমির ওপর প্রজা অর্থাৎ কৃষকদের স্বত্ত্ব বা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ সরকার যেসব আইন প্রণয়ন করেছিলো, সেগুলিকেই এককথায় "প্রজাস্বত্ব আইন" বলা হয়।
- (ii.) ১৮৫৯ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার প্রথম প্রজাস্বত্ব আইন প্রবর্তন করে। পরে এই আইনটিকে সংশোধন করে ১৮৮৫ খ্রিঃ বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন করে।
(১৬.) ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন :-
- (i.) ১৯০৮ খ্রিঃ ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন করা হয়।
- (ii.) এই আইনে মুন্ডা উপজাতিদের খুঁৎকাঠি প্রথা বা যৌথ মালিকানা ভিত্তিক ভূমি ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি জানানো হয়।
(১৭.) ভারতীয় স্বাধীনতা আইন - ১৯৪৭ :-
- (i.) ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৮ ই জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাস হয়।
- (ii.) এই আইন অনুযায়ী ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে।
(খ.) গুরুত্বপূর্ণ বিল :-
(১.) ইলবার্ট বিল :-
- (i.) ১৮৮৩ খ্রিঃ লর্ড রিপন ১৮৮৩ খ্রিঃ ইলবার্ট বিল প্রনয়ন করেন।
- (ii.) এই বিলে ভারতীয় বিচারকদের ভারতে অবস্থানরত ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচারের অধিকার প্রদান করা হয়েছিলো।
- (iii.) শ্বেতাঙ্গ বা ইংরেজদের তীব্র বিরোধিতায় এই বিলটি আইনে পরিণত হতে পারে নি।
(২.) চম্পারন কৃষি বিল :-
- (i.) গান্ধীজির চম্পারন সত্যাগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৭ খ্রিঃ চম্পারন কৃষি বিল প্রনয়ন করা হয়।
- (ii.) এই বিল দ্বারা বিহারে তিন কাঠিয়া প্রথা ও বাধ্যতামূলক নীল চাষের অবসান ঘটানো হয়।
(৩.) শিল্প বিরোধ বিল ও জন নিরাপত্তা বিল /ট্রেড Disputes Bill and Public sifty Bill :-
- (i.) লর্ড আরউইন জরুরী ক্ষমতার প্রয়োগ করে ১৯২৯ খ্রিঃ শিল্প বিরোধ বিল ও জন নিরাপত্তা বিল প্রনয়ন করে তা আইন সভায় পাশ করেন।
- (ii.) এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল - (ক.) ভারতীয় কলকারখানায় শ্রমিক ধর্মঘট বন্ধ করা (খ.) শ্রমিক আন্দোলন বন্ধ করা এবং (গ.) কমিউনিস্ট আন্দোলনকে স্তব্ধ করা।
(গ.) জেনে রাখা ভালো :-
ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইনের ক্রম তালিকা :-
- ১৭৭৩ খ্রিঃ রেগুলেটিং অ্যাক্ট
- ১৭৮৪ খ্রিঃ পিটের ভারত শাসন আইন
- ১৭৯৩ খ্রিঃ চার্টার বা সনদ আইন (প্রথম)
- ১৮১৩ খ্রিঃ চার্টার বা সনদ আইন (দ্বিতীয়)
- ১৮২৯ খ্রিঃ ১৭ নং রেগুলেশন আইন / সতীদাহ প্রথা নিবারন আইন
- ১৮৩০ খ্রিঃ পঞ্চম ও সপ্তম আইন
- ১৮৩৩ খ্রিঃ চার্টার বা সনদ আইন (তৃতীয়)
- ১৮৫৩ খ্রিঃ চার্টার বা সনদ আইন (চতুর্থ ও শেষ)
- ১৮৫৭ খ্রিঃ ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন
- ১৮৫৮ খ্রিঃ ভারত শাসন আইন
- ১৮৬১ খ্রিঃ ভারতীয় পরিষদ আইন /The Indian councils act of 1861
- ১৮৫৬ খ্রিঃ ১৫ নং রেগুলেশন আইন / বিধবা পুনর্বিবাহ আইন
- ১৮৬৫ খ্রিঃ ভারতীয় অরন্য আইন
- ১৮৬৮ খ্রিঃ অষ্টম আইন
- ১৮৭২ খ্রিঃ তিন আইন
- ১৮৭৬ খ্রিঃ নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন
- ১৮৭৭ খ্রিঃ দ্বিতীয় অরন্য আইন
- ১৮৭৮ খ্রিঃ অস্ত্র আইন ও ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট
- ১৮৮৫ খ্রিঃ বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন
- ১৮৯২ খ্রিঃ ভারতীয় পরিষদ আইন
- ১৯০৮ খ্রিঃ ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন
- ১৯০৯ খ্রিঃ মর্লে মিন্টো সংস্কার আইন
- ১৯১৯ খ্রিঃ মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন ও রাওলাট আইন
- ১৯৩৫ খ্রিঃ ভারত শাসন আইন
- ১৯৪৭ খ্রিঃ ভারতীয় স্বাধীনতা আইন।