দুর্গা পুজার ইতিবৃত্ত

সনাতন ধর্মের শাক্ত সম্প্রদায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপাস্য দেবী ছিলেন দুর্গা। "স্কন্দপুরানের কাশীখন্ড" থেকে জানা যায়, অতিদুর্গম দুর্গদৈত্যকে যুদ্ধে যে দেবী বধ করেন, তিনিই পরবর্তীতে "দুর্গা" নামে আখ্যায়িত হন। আবার "দেবীপুরানে" দুর্গাকে পুর বা দুর্গে বিরাজমান "দুর্গেশ্বরী" বলে বর্ননা করা হয়েছে। অন্যদিকে "ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে" বলা হয়েছে, যে দেবী দুর্গতি ও শঙ্কা বা বিপদ হরন করেন, তিনিই দুর্গা। 


দুর্গাপুজার ইতিবৃত্ত
দুর্গাপুজার ইতিবৃত্ত

প্রাচীন কাল থেকেই বাংলাদেশে বাড়ি থেকে কেউ বের হলে বা দূরবর্তী কোনো স্থানে যাত্রা করলে বয়োঃজেষ্ঠ মহিলারা "দুগ্গা দুগ্গা" বলে যে আর্শিবাদ করতেন, তার পিছনে দুর্গতি হরনের কামনা ছিলো। দুর্গতিনাশিনী দেবীর কাছে এই প্রার্থনা করা হতো। প্রাচীনকালে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বা দূরবর্তী কোন অঞ্চলে যাতায়াতের পথ বিশেষ মসৃন ছিলো না। রাস্তাঘাটে প্রায়ই দস্যু বা ডাকাতের উপদ্রব ছিলো। তাছাড়া, যানবাহনও ছিলো অতি অল্প এবং তার গতি ছিলো শ্লথ। ফলে নির্বিঘ্নে কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য বাংলার রমনীরা যাত্রা কালে "দুগ্গা দুগ্গা" নামোচ্চারন ও প্রার্থনা করতেন। 

 পরবর্তীকালে এই প্রার্থনা গ্রাম বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারে পরিনত হয়েছিলো। গৃহের প্রবেশ দ্বারের ওপরে গিরিমাটি দিয়ে "শ্রী শ্রী দুর্গা মাতার আগমন" দুর্গতিনাশের কামনাতেই গৃহিণীরা লিখে রাখতেন। আজোও দুর্গা পুজোর দিনে এই লেখা বাংলার ঘরে ঘরে লেখা হয়। দুর্গাকে গ্রামবাংলার ঘরে "মেয়ে হিসাবে" অভ্যর্থনা ও বরন করে নেওয়ার আকাঙ্খাও এই লেখার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়। 

বাংলা তথা ভারতে দুর্গাপুজোর ইতিহাস বহু প্রাচীন। সেই ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনার আগে সনাতন ধর্মের রূপ বৈশিষ্ট্য ও তার ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রত্যেকের ধারনা থাকা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যেই সনাতন ধর্মের পাঁচ উপাস্য সম্প্রদায়ের কথা আমরা বলবো। কারন হিন্দু ধর্মের ইতিবৃত্তকে না জানলে আমরা কখনই দুর্গাপুজোর ইতিবৃত্তকে উপলব্ধি করতে পারবো না এবং তার সারমর্মকে বুঝতেও পারবো না। 

 (১.) সনাতন ধর্মের পাঁচ উপাস্য :-

শৈব, শাক্ত, সৌর, বৈষ্ণব ও গানপত্য - সনাতন ধর্মের এই পাঁচটি শাখাই একসময় সম্মিলিত হয়ে "হিন্দু ধর্মের" রুপ পরিগ্রহ করেছিলো। অতীত কাল থেকে সনাতন ধর্মের এই ৫টি শাখার মধ্যে যে সদ্ভাব ছিলো, তেমনটি কিন্তু নয়। বরং একটি শাখা অপর শাখাকে তার চরম প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করতো। এদের মধ্যে প্রায়ই সংঘাত ও লড়াই লেগে থাকতো। 

মধ্য যুগের সূচনালগ্নে ভারতে মুসলিম আক্রমণে সনাতন ধর্মের ৫টি শাখাই ক্ষতিগ্রস্থ ও বিপন্ন হয়। এই বিপন্নতার হাত থেকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সনাতন ধর্মের শাখা গুলি পারস্পরিক বিবাদ দূর করে ঐক্যবদ্ধ হবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। পরবর্তীকালে সনাতন ধর্মের ৫ টি শাখা সম্মিলিত হয়েই বর্তমান "হিন্দু ধর্মের" রুপ পরিগ্রহ করে। 

শৈব, শাক্ত, সৌর, বৈষ্ণব ও গানপত্য হিন্দু ধর্মের এই ৫ টি শাখাই হলো লৌকিক ও ঐতিহাসিক। পৃথিবীর অন্যান্য সকল ধর্মের মতো হিন্দু ধর্ম কোন একজন ধর্মপ্রচারক বা ধর্ম তাত্ত্বিকের গর্ভ থেকে নির্গত হয় নি। এই ধর্ম দীর্ঘ ঐতিহাসিক বিবর্তন ও লৌকিকতার মধ্য দিয়ে তার রুপ লাভ করেছিলো। হিন্দু ধর্ম কোন একজন ধর্ম তাত্ত্বিকের কথন, প্রবচন,প্রচার, বানী বা গর্ভ থেকে নির্গত না হওয়ায় অর্থাৎ আজন্ম হওয়ার কারনে আজও এর মৃত্যু হয় নি। দীর্ঘ ঐতিহাসিক ঝড় ঝাপটার পরেও হিন্দু ধর্ম টিকে আছে এবং বেঁচে আছে। বারে বারে, যুগ থেকে যুগান্তরে রুপ পরিবর্তন করে ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মের স্রোত প্রবাহিত হয়ে চলেছে। 

হিন্দু ধর্মের এই বৈশিষ্ট্য ও রুপান্তর একমাত্র "ঐতিহাসিক ও লৌকিক ধর্ম" বলেই সম্ভব হয়েছে। ব্যাক্তি বিশেষ কর্তৃক প্রচারিত ধর্মে প্রাতিষ্ঠানিকতা ও ধর্মীয় অনুশাসন পালনের যে কঠোরতা ও নাগপাশ থাকে, হিন্দু ধর্ম তা থেকে অনেকটাই মুক্ত, স্বাধীন ও উদার। ফলে সহজেই এর রূপান্তর, বিবর্তন ও অভিযোজন সম্ভবপর হয়েছে। সুপ্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার কাল থেকে যে এখনো হিন্দু ধর্ম টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে, এটিই ছিলো এর মূল কারন। 

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, পঞ্চম উপাসকদের মধ্যে শৈব সম্প্রদায়রা ভগবান শিবকেই জগতের সর্বোত্তম আরাধ্য দেব হিসাবে মনে করে থাকেন। শাক্তরা মনে করেন, সমস্ত জাগতিক সৃষ্টি ও স্থিতির মূলে রয়েছে নারীশক্তি অর্থাৎ দেবীশক্তি। শাক্তরা তাই দেবী শক্তিকেই তাদের প্রধান ও সর্বোত্তম উপাস্য দেবী হিসাবে মনে করে থাকেন। সৌর সম্প্রদায়রা সূর্যের উপাসনা করেন। তাদের মতে জাগতিক সমস্ত সৃষ্টি তত্ত্বই সূর্য থেকেই উৎগত হয়। বৈষ্ণবরা বিষ্ণুকে তাদের প্রধান ও সর্বশ্রেষ্ঠ আরাধ্য দেব বলে মনে করেন। অন্যদিকে গানপত্যরা ভগবান গনপতি বা গনেশকে প্রথম পূজ্য ও সর্বশ্রেষ্ঠ দেব বলে মনে করেন। 

ভারতবর্ষে আজোও মহারাষ্ট্রে গনপতির আরাধনা বেশ ধূমধাম করে পালন করা হয়। অন্যদিকে বাংলা ও আসামে শাক্ত উপাসনা অর্থাৎ দুর্গা ও কালী পুজোর প্রচলন দেখা যায়। বিহারীদের মধ্যে ছট অর্থাৎ সূর্য উপাসনার প্রচলন আজও আছে। বৈষ্ণবদের বিষ্ণু অথবা কৃষ্ণ উপাসনা বাংলা, বৃন্দাবন, ঊড়িষ্যা সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেই দেখা যায়। একই ভাবে শৈব উপাসনার কেন্দ্র ও অঞ্চল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেই দেখা যায়। 

প্রকৃতপক্ষে ভারতে সনাতন ধর্মের ৫ টি শাখার মধ্যে শৈবশাক্ত সম্প্রদায় দুটিই ছিলো সবচেয়ে প্রাচীনতর। হরপ্পা সভ্যতার কাল থেকেই এদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।

সনাতন ধর্মের ৫টি শাখা অতীতে যে যেরকম প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলো, সে সেইরকম ভৌগলিক কর্তৃত্ব বা উপস্থিতি অর্জন করেছিলো। হিন্দু ধর্ম যখনই সংকটের সম্মুখীন হয়েছিলো, তখনই সনাতন ধর্মের কোন একটি শাখা শক্তিশালী হয়ে হিন্দু ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলো। 

খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী ও তার পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্ম যখন হিন্দু ধর্ম এবং সারা ভারতকে আচ্ছন্ন করেছিলো, তখন বৈষ্ণব ধর্ম হিন্দু ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করে প্রতিস্থাপন করে। এই সময় ভগবান বুদ্ধকে বিষ্ণুর এক অবতার হিসাবে তুলে ধরে তাকে হিন্দু ধর্মের অন্তর্ভূক্ত করে নেওয়া হয়। মধ্য যুগে একই ভাবে ইসলামের করাল গ্রাস থেকে বাঙালী হিন্দুকে রক্ষা করেন শ্রীচৈতন্যদেব ও তার প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্ম। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনকালে খ্রিষ্টান ধর্মের আগ্রাসন থেকে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, যার নেতৃত্বে সনাতন ধর্মের শাক্ত শাখাটি হিন্দু ধর্মকে শুধু উদার করে তোলে না, সারা বিশ্বে হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বকেও প্রতিষ্ঠিত করে। শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ খ্রিঃ আমেরিকার শিকাগো বিশ্বধর্ম সম্মেলনে গিয়ে হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বকে বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেন।

(২.) প্রকৃতি পুজা থেকে শক্তি ও দুর্গা পুজা :-

শাক্ত সম্প্রদায়রা ভারতের যেসব অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তার করেন, সেইসব অঞ্চলেই পরবর্তীকালে শক্তি পুজার প্রচলন ঘটেছিলো। হিন্দু ধর্মের দেবভাবনাকে দুটি দিক বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলো। এর একটি ছিলো পুরুষ এবং অপরটি ছিলো প্রকৃতি বা শক্তির সাধনা। 

বলা বাহুল্য, জগতে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের পিছনে এই দুই শক্তিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। এই ভূমিকা যেমন ব্যক্তি জীবনের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি সমাজ জীবনরাষ্ট্র জীবনের ক্ষেত্রেও সমান সত্য। পুরুষ যখন প্রকৃতিকে উপেক্ষা বা অবহেলা করে, অথবা প্রকৃতি বিরুদ্ধ কোন কাজ করে, তখনই সামাজিক স্থিতি ও ভারসাম্য নষ্ট হয়। পুরুষ ও প্রকৃতির ভারসাম্য এবং সঠিক সম্বন্ধেই সামাজিক ও জাগতিক স্থিতি রক্ষিত হয়।

আমাদের ভাবতে অবাক লাগে আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতীয়রাই "পুরুষ ও প্রকৃতির" এই উন্নত দর্শন ও চিন্তাভাবনার জন্ম দেন। এই দর্শন ও চিন্তা ভাবনাই আমাদের ধর্ম ভাবনার মূলে পরিলক্ষিত হয়। আমরা এখনোও শক্তি পুজা ও ধর্মীয় উৎসব উৎযাপনের মধ্য দিয়ে এই সনাতন দর্শন ভাবনাকেই বহন করে চলেছি।

ভারতে শক্তি পুজার ধারনা অনার্যদের কাছ থেকেই এসেছিলো বলে বেশিরভাগ গবেষক মনে করেন। আর্যদের ভারতে আগমনের অনেক আগে থেকেই এদেশে শক্তিরূপা মাতৃ উপানার প্রচলন ছিলো। সিন্ধু সভ্যতার ধর্ম ভাবনার একটি বড়ো জায়গা জুড়ে ছিলো প্রকৃতি পুজা। প্রকৃতির এক অর্থ যেমন শক্তি, তেমনি প্রকৃতির আরেক অর্থ হলো সৃষ্টিপ্রতিপালনশক্তি, সৃষ্টি এবং প্রতিপালনের ধারনা থেকেই পরবর্তীকালে মাতৃত্বের concept বা ধারনা আসে। 

সিন্ধু সভ্যতার প্রত্যেকটি শহর কোন না কোন নদীর তীরে গড়ে উঠেছিলো। শুধু সিন্ধু সভ্যতাই নয়,পৃথিবীর সমস্ত শহর ও সভ্যতারই জন্ম হয়েছিলো কোন না কোন নদীর তীরে। নদী তীরবর্তী অঞ্চল এমনিতেই অত্যন্ত উর্বর ছিলো। কৃষি কাজের জন্য অপরিহার্য ছিলো উর্বর মৃত্তিকা এবং জল। এ দুই-ই পাওয়া যায় নদী থেকে। নদীকে তাই অতি প্রাচীনকাল থেকেই "উর্বরতার প্রতীক" হিসেবে মনে করা হতো। 

উর্বরতার অর্থ হলো যা উৎপন্ন করে বা সৃষ্টি করে। উর্বরতার ধারনা থেকেই পর্ববর্তীকালে মাতৃত্বের concept বা ধারনা আসে। নদীর সাথে মাতৃত্বের concept এর যোগ এই কারনেই প্রাচীনকাল থেকে পরিলক্ষিত হয়। এই concept এর জন্যই নদীকে আজও মা বলে ডাকা হয়। এছাড়া, সিন্ধু সভ্যতার মাতৃতান্ত্রিক ধর্ম ভাবনার পিছুনেও এই বিশ্বাস ও ধারনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো বলে মনে হয়। 

পৃথিবীতে সভ্যতার জন্ম যেমন কৃষি থেকে হয়েছিলো, তেমনি মাতৃ উপাসনার জন্মও হয়েছিলো কৃষি থেকে। কৃষিকাজের সূচনা মেয়েদের দ্বারাই হয়েছিলো বলে ঐতিহাসিকগন মনে করে থাকেন। পুরুষের রমন বা মৈথুনের বারংবার ঘর্ষনে সন্তান উৎপাদনের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে মৃত্তিকা খনন করে কৃষি উৎপাদনের ধারনা নারীদের মনেই প্রথম এসেছিলো। এই কারনে "লিঙ্গ" শব্দটি থেকে পরবর্তীকালে মৃত্তিকা খননের জন্য "লাঙ্গল" নামক কৃষিযন্ত্রটির উৎপত্তি ঘটেছিলো। 

দুর্গামূর্তি নির্মানে বারবনিতা বা পতিতালয়ের মৃত্তিকা কেনকোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, সেই ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে তুলে ধরার জন্যই এই ঘটনাটির উল্লেখ করলাম। আগেই বলেছি, সনাতন ধর্মের সকল দেবতাদেরই নির্মান হয়েছে লৌকিক ও ঐতিহাসিক ধারনাকে অবলম্বন করে। দুর্গাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। ভারতে সমগ্র প্রাচীনকাল জুড়ে মাতৃত্ব ও দেবীশক্তি নির্মানের যে ঐতিহাসিক ধারা রচিত হয়ে আসছিলো, তাই পরিপূর্ণ রূপ লাভ করেছিলো দুর্গার মধ্য দিয়ে।

প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায় আমরা প্রচুর দেবীমূর্তির নিদর্শন পাই। এর পাশাপাশি ঐ সভ্যতায় এমন একটি নগ্ন নারী মূর্তি পাওয়া যায়, যার মাথা নীচের দিকে এবং জঙ্ঘার ফাঁক থেকে কিছু লতা ও বৃক্ষ নির্গত হয়েছে। ইনিই ছিলেন "মার্কেন্ডেয় পুরান" বর্নীত শস্যের দেবী "শাকম্ভরী", যাকে আদি দুর্গাও বলা হয়ে থাকে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, প্রকৃতি পুজা, মাতৃ উপাসনা এবং দুর্গাপুজা এই তিনটিই অঙ্গাঙ্গীভাবে সংযুক্ত।

দুর্গাপুজার বৈশিষ্ট্য এবং উপাচারের দিকটি খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়, দুর্গাপুজা প্রকৃতি আরাধনারই একটি রূপান্তরিত রূপ। "রঘুনন্দন স্মৃতিতে" দুর্গাপুজার ছয়টি কল্পের বিধানের কথা বলা আছে। এর মধ্যে বাংলা, বিহার ও আসামে ষষ্ঠ্যাদি কল্প অনুসারে দুর্গা পুজা হয়ে থাকে। ষষ্ঠ্যাদি কল্প অনুসারে ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যাকালে বিল্ববৃক্ষের শাখায় দেবীর বোধন করা হয়। এরপরে দেবীকে জানানো হয় আমন্ত্রন ও অধিবাস। ঐ দিনের দেবীর পুজো সম্পন্ন হয় ঘটে। এই ঘট প্রকৃতির রূপেরই প্রতীকি রূপ

এরপর সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী দিনের পুজো সম্পন্ন হয় দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমায়। দুর্গাপুজোতে গনেশের বউ সর্বসাধারনের কাছে "কলাবউ" নামে সুপরিচিত। কলাবউ আসলে "নবপত্রিকা"। কলাগাছ, কালো কচুগাছ, হলুদগাছ, জয়ন্তীগাছের শাখা, বেল গাছ, অশোক ডাল, ডালিম, মানকচু ও ধানের শিষ - এই নয়টি গাছকে শ্বেত অপরাজিতা লতা ও হলুদ রঙের সুতো দিয়ে বেঁধে নবপত্রিকার পুজো করা হয়।

ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে শস্য উৎপাদনের আশায় ধরিত্রীদেবীর পুজোর যে বৈশিষ্ট্য প্রচলিত ছিলো, তারই স্মৃতি বহন করে এটি। নবপত্রিকার পুজো প্রকৃতপক্ষে ছিলো প্রকৃতিরই প্রতীকি উপাসনা। এর প্রতিটি উদ্ভদ ছিলো দেবীর অর্থাৎ প্রকৃতিরই এক একটি প্রতীক। এইভাবে দেখা যায়, প্রকৃতি উপাসনার সম্মিলিত ধারা গুলি দুর্গাপুজার মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।

প্রাক্ কৃষিপর্বে দুর্গা ছিলেন জনজাতির ঘেরাটোপে। এই সময় অরন্যচারী বনদুর্গার পুজা করা হতো "শেওড়াগাছকে"। মেয়েরা পালন করতো বনদুর্গার ব্রত। অধুনা বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে আজোও পৌষসংক্রান্তিতে বা বৈশাখ মাসে বনদুর্গার পুজার প্রচলন দেখা যায়। বঙ্গদেশে একসময় কুষ্ঠরোগ থেকে নিষ্কৃতি পাবার কামনায় সধবারা "রা'ল দুর্গার ব্রত" পালন করতেন। এছাড়া "শুভদুর্গা" নামে আর এক দুর্গার পুজার কথাও গ্রামবাংলার লোকায়ত সংস্কৃতিতে দেখা যায়। "শুভদুর্গা" সামান্য উপাচারেই তুষ্ট হন।

বলা বাহুল্য বনদুর্গা থেকে শুভদুর্গা সকলেই ছিলেন মূর্তিহীন। পুরানে দেবী দুর্গাকে শস্যদেবী বলে আখ্যায়িত করে তার নামকরন করা হয়েছিলো "শাকম্ভরী"। সিন্ধু সভ্যতাতে শাকম্ভরী দেবীর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে, যা ইতিপূর্বেই আমরা উল্লেখ করেছি। দুর্গাপুজায় নবপত্রিকার পুজো দেবীর আরন্যক জীবনের সাক্ষ্য তুলে ধরে। দেবীর সপরিবারের উপস্থিতি ও আগমন অনার্য যৌথ পরিবাবের স্মৃতিকে তুলে ধরে। এছাড়া, সপরিবারে আগত দেবী দুর্গার যে বাহনদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যথা - পেঁচা, সাপ, ময়ূর, ইঁদুর, হাঁস, বাঘ বা সিংহ এগুলি অনার্য উপজাতির Totem কেই সূচিত করে। সুপ্রাচীন শিকার ও কৃষি ব্যবস্থার এক অভূতপূর্ব সমন্বয়ের প্রতীরূপ দুর্গার মৃন্ময়ী রূপের মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হয়। এমনকি দুর্গাপুজোর কুমারী পুজা উর্বরতা তন্ত্রেরই প্রতীক স্বরূপ। 

এইভাবেই লৌকিক, পৌরানিক ও প্রকৃতির রূপকে সম্মিলিত করে আধুনিক দুর্গা মূর্তির নির্মান ঘটে। 

(৩.) দুর্গা পুজার অতীত অনুসন্ধান :-

দুর্গা পুজা কতদিনের পুরানো তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্কের শেষ নেই। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, শক্তি পুজার ধারনা বৌদ্ধ ধর্ম থেকেই হিন্দু ধর্মে এসেছিলো। অধ্যাপক ম্যাক্সমুলারের মতে, দুর্গা বৈদিক দেবতা নন। শিব এবং দুর্গা দুজনেই অনার্য দেবতা ছিলেন। আর্য - অনার্য সংঘাতের পরবর্তীকালে যখন দুই জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ের যুগ শুরু হয়, তখনই অনার্য দেবদেবীগন আর্য সংস্কৃতিকে প্রবেশ করেন এবং তাদের আর্যীকরন ঘটে।

বলা বাহুল্য, হিন্দু দর্শনের পুরুষ ও প্রকৃতির যে তত্ত্বের কথা ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি, তা প্রকৃতপক্ষে হরপ্পা সভ্যতারই সৃষ্টি। প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতায় ঐতিহাসিকরা অসংখ্য মাতৃকা মূর্তির পাশাপাশি এক যোগী পুরুষের সীলমোহরও পেয়েছেন। এই সিলমোহরে স্থিত পুরুষটি ছিলেন আদি পুরুষ, যাকে অনেক ঐতিহাসিক "পশুপতি শিব" বা আদি শিব বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইনিই হলেন দুর্গার স্বামী আদি বা মূল পুরুষ। 

হরপ্পায় লিঙ্গপুজারও বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। লিঙ্গ পুজার এই ঐতিহ্য পরবর্তীকালে অনার্য থেকে আর্য সংস্কৃতিতে প্রবাহিত হয়, এবং লিঙ্গ উপাসনার এই ঐতিহ্য আজোও আমরা বহন করে চলেছি। লিঙ্গ পুজাকে পশ্চিমী সমালোচক বা বিধর্মীরা "অশ্লীলতা" নামে বিরূপ সমালোচনা করলেও, মাথায় রাখতে হবে, লিঙ্গ পুজা পুরুষ ও প্রকৃতির সৃষ্টি তত্ত্বেরই ঐশ্বরিক প্রতিরূপ, যা আদিম, অনাদীঅনন্ত

অনার্য হরপ্পা সভ্যতার পরে ভারতে শুরু হয়েছিলো আর্য সভ্যতা। বৈদিক আর্যরা ভারতে প্রবেশ করবার পর যে ধর্মদেবতাদের নির্মান করেন, তাতে পুরুষ দেবতাদেরই প্রধান্য ছিলো। ঋকবেদে এই জন্য আমরা কোন শক্তি দেবীর উপস্থিতি লক্ষ্য করি না। ঋকবৈদিক যুগের প্রথম দিকে আর্যদের লড়াই করতে হয়েছিলো অনার্যদের সঙ্গে। যুদ্ধের প্রয়োজনেই এই সময় পুত্র সন্তানের চাহিদা ছিলো প্রবল। পুত্র সন্তান কামনার্থে এই সময় নারীদের অবাধ মেলামেশা ও স্বাধীনতার সুযোগ মিলেছিলো। তবে নারী স্বাধীনতা থাকলেও এই সময় সমাজের চরিত্র ছিলো পুরুষতান্ত্রিক

ঋকবৈদিক সমাজ পুরুষতান্ত্রিক হওয়ায়, এই সময়ে নির্মিত বৈদিক ধর্ম ব্যবস্থাতেও ছিলো পুরুষ উপাসনা। আর্য - অনার্য সংঘাতের পরবর্তীকালে শক্তিদেবীর ধারনা অনার্য সভ্যতা থেকে আর্য সমাজে স্থানান্তরিত হয়। এই স্থানান্তরের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় অনার্য রমনীরা। যুদ্ধে পরাভূত অনার্য রমনীদের পরবর্তীকালে আর্য পুরুষরা বিবাহ করেন। অনার্য রমননীরা অনার্য  ধর্ম ও সংস্কৃতিকে পরবর্তীকালে আর্য সমাজে ছড়িয়ে দেন।

এখানে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করাও প্রয়োজন। শুরুর দিকে বৈদিক সমাজে নারীদেরও "উপনয়ন" বা "পৈতা" হতো। কিন্তু শেষের দিকে তা বন্ধ হয়ে যায়। আর্য সমাজে যখন অনার্য নারীরা পত্নী বা পুত্রবধূ হিসাবে প্রবেশ করেন, তখন তাদের প্রতি বিশেষ অবজ্ঞা ও উচ্ছিষ্টসূচক মনোভাব পোষন করা হয়। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে অনার্য নারীদের প্রতি অবজ্ঞাসূচক মনোভাবের সম্প্রসারণ ঘটে। ক্রমে তা অনার্য নারী থেকে আর্য নারী সমাজে সংক্রমিত হয়। এরফলে নারী সমাজ তাদের পূর্ব অধিকার ও মর্যাদা গুলি হারান। নারীদের পৈতাচ্যুতি এই অধিকার হরনেরই একটি দৃষ্টান্তমাত্র ছিলো।

ঋকবেদে দুর্গার যেমন বিশেষ উল্লেখ নেই, তেমনি শিবেরও উল্লেখ নেই। শিব এবং শক্তি বা কালী অথবা দুর্গা দুজনেই ছিলেন অনার্য দেবতা। ঋকবেদে "রুদ্র" নামক এক দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়, যিনি নাকি ভয়ঙ্কর রাগী দেবতা। ঋকবেদে অনার্য দেবতা শিবকে রুদ্রের সঙ্গে একাত্ম করে শিবের আর্যীকরন ঘটানো হয়।

অনার্য দেবতা শিব এমনিতেই খুব শান্ত ও ভোলাভালা। তার বেশভূষাও অনার্যদের মতোই। অনার্যদের মতোই তিনি সহজ, সরল, কালো - বাঘছাল পরিহিত। দক্ষরাজার যজ্ঞে অনার্য দেবতা শিবকে তাই অবজ্ঞাভরে আমন্ত্রনই জানানো হয় নি। স্বামীর এই অপমান শিবপত্নী সতী মেনে নিতে পারেন নি। পরে বিনা আমন্ত্রনে তিনি দক্ষযজ্ঞে প্রবেশ করেন এবং স্বামী নিন্দা শুনতে না পেরে যজ্ঞে আত্মহুতি দেন।

শিব - সতীর এই বিবাহ থেকে এটা বোঝা যায়, সেসময়ে আর্য পুরুষরা যেমন অনার্য রমনীদের বিবাহ করতেন। তেমনি অনেক সময় অনার্য পুরুষও আর্য রমনীদের বিবাহ করতো। যদিও দুইটি বিবাহের ক্ষেত্রেই নারী পুরুষ উভয়কেই জাতী বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছিলো। 

দক্ষযজ্ঞে সতীর আত্মহুতিতে বাঘছাল পরিহিত, শশ্মানবাসিনী শিব প্রচন্ড ক্রূদ্ধ হন এবং তার রুদ্র রূপের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই সময় বলা হয় শিব এবং রুদ্র একই দেবতার অভিন্ন রূপ। এইভাবে অনার্য দেবতা শিবকে বৈদিক দেবতা রুদ্রের সঙ্গে একাত্ম করে তার আর্যীকরন ঘটানো হয় বৈদিক ধর্মে এবং শশ্মান থেকে তাকে স্থান দেওয়া হয় হিমালয়ে। তার পত্নী হন কালিকা। ইনিও শিবের মতোই উলঙ্গ, এবং বাস করেন শশ্মানে

পরবর্তীকালে সমাজ পরিশিলিত ও ভদ্রস্থ হলে দেবীরও রূপান্তর ঘটে। চন্ডরূপা কালি অন্তরালে থেকে কখনো তিনি প্রতিভাত হন দুর্গা রূপে, আবার কখনো পার্বতী রূপে। জগৎপালক ও জগৎপালিকা হিসাবে এরা দেবকুলমনুষ্যকুলে খ্যাত হন। বলা হয়, জগৎ সংসার তাদের থেকেই সৃষ্টি। তারাই বিশ্ব সংসারে সমস্ত নিয়তির আধার। তারাই আদি পুরুষ এবং আদি প্রকৃতি

তাদের সংযোগ এবং মিলনেই বিশ্বপ্রকৃতির সকল রহস্যের জন্ম। এই রহস্যের অনুসন্ধানেই যোগ সাধনা। আত্মাকে জানা, নিজেকে অনুসন্ধান করা এবং শেষপর্যন্ত পরমব্রহ্মকে উপলব্ধি করা। সেই পরমসত্তাকে অনুসন্ধান করা, সকলের মধ্যেই যার উপস্থিতি রয়েছে। সনাতন ধর্মের লিঙ্গ ও যোনী পুজার মূলে এই দর্শনই কাজ করেছে। 

বলা বাহুল্য, অনার্য দেবতা শিব ও কালিকে আর্যসমাজে স্থান দেওয়া হলেও, অনার্যদের প্রতি আর্যদের যে রুঢ় ব্যবহার আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা এদের প্রতিও নেওয়া হয়। সমুদ্র মন্থনের ফলে যখন গরল উদিত হলো, তখন তা কোন আর্য দেবতা পান করলেন না। সেটি পান করানোর জন্য অনার্য ভোলাভালা দেবতা শিবের ডাক পড়লো। শিব হলাহল বিষ পান করে "নীলকন্ঠ" হলেন ঠিকই, কিন্তু বিষের তীব্রতায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। তখন শিবকে পুত্রবৎ বক্ষদুদ্ধ পান করে পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন তার পত্নী মহাকালী। 

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, হলাহল বিষের তেজ লাঘব করার জন্যই যা কিছু বিষাক্ত তা দিয়েই শিবের পুজো করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হল - ধুতরা, আকন্দ, কলকা, গাঁজা, ভাঙ্গ ইত্যাদি। বিষে বিষে বিষক্ষয় ঘটানোর জন্য এবং বিষ হরনের জন্যই শিবকে এই সমস্ত বিষাক্ত দ্রব্য গুলি উৎসর্গ করা হয় বা ঐ গুলি দিয়ে তার পুজা করা হয়। দুধ বিষকে অনেকটাই নির্জিব করে দেয় এবং ব্যক্তিকে সুস্থ করে বাঁচিয়ে তোলে। হলাহল বিষের করাল গ্রাস থেকে শিবকে পরিত্রান দেওয়ার জন্যই শিবের মাথায় দুধ ঢালা হয়। 

মনে রাখতে হবে, শিব হলেন মহাকাল বা সময়। কালের গর্ভে সবকিছুই অন্তর্হিত হয়। কিন্তু কালের করাল গ্রাসকেও যিনি আটকে দিতে পারেন, তিনি হলেন মহাকালীতাই জগতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ দেবী। শশ্মানবাসী মহাকাল এবং মহাকালী দুজনেই ছিলেন জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের প্রতিমূর্তি।

দুর্গা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন নামে পুজিত হয়ে থাকেন। কাশ্মীরে তিনি "অম্বা" নামে, দাক্ষিনাত্যে "অম্বিকা" নামে, গুজরাটে "হিঙ্গুলা" ও "রুদ্রানী" নামে, কান্যকুব্জে "কল্যানী" নামে, মিথিলায় "উমা" নামে, এবং কুমারিকা প্রদেশে "কন্যাকুমারিকা" নামে পুজিতা হয়ে থাকেন। পূর্ব ভারতে যখন দুর্গাপুজা অনুষ্ঠিত হয়, তখন দক্ষিণ ভারতের অধিবাসীরা পালন করেন "নবরাত্রি" উৎসব। এই নবরাত্রি উৎসবে সরস্বতী, লক্ষী ও দুর্গাকে একসঙ্গে উপাসনা করা হয়। এই তিনজন দেবী যথাক্রমে জ্ঞান, সমৃদ্ধি এবং দুর্গতিনাশীনীর প্রতীক। প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত নয় রাত জুড়ে এই পুজা চলে বলে এর নাম "নবরাত্রি"

পূর্ব ভারতে যখন দুর্গা পুজা, দক্ষিণ ভারতে যখন নবরাত্রি চলে, ঠিক তখনই উত্তর ভারতে অনুষ্ঠিত হয় দশেরা উৎসব। বিজয়া দশমীর দিন রামচন্দ্র রাবন বধ করে বিজয় লাভ করেন। এরই প্রতীক হিসাবে ঐ দিন বিশাল দশমুন্ডের রাবন নির্মান করে তার নিধন করে দশরা উৎসব পালন করা হয়। দুর্গাপুজা, নবরাত্রী ও দশেরা এই তিনটি উৎসবই শরৎকালে অনুষ্ঠিত হয়। এই তিনটি উৎসব নিয়েই ভারতবর্ষে পালিত হয় "শারদোৎসব"

হরপ্পা সভ্যতার পরে ভারতে বৈদিক যুগের সূত্রপাত ঘটে। এই সময় বেদের বহু শাখা প্রশাখা এবং বেদাশ্রয়ী বিভিন্ন গ্রন্থে দুর্গা নামের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। দুর্গা এখানে কখনো বিশ্বদুর্গা, সিন্ধুদুর্গা, অগ্নিদুর্গা আবার কখনো শিবাসুখদাশুল্ক যজুর্বেদের বাজসনীয় সংহিতাতে সর্বপ্রথম রুদ্রের ভগিনী হিসাবে "অম্বিকা" দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। "উমার" প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় "কেনোপনিষদে" । তবে কৃষ্ণ যজুর্বেদের নারায়ন উপনিষদেই আমরা প্রথম "দুর্গা" নামটি পাই। সেখানকার একটি শ্লোকে বলা হয়েছে - 

"তামগ্নিবর্না তপসা জলন্তীং, বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্ঠাম। দুর্গাদেবীং শরনমহং প্রপদ্যে সুতারসি তরসে নমঃ।। 

এর অর্থ - সূর্য সমউজ্জ্বলবর্না, কর্মফলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টা, শোভনরূপে রক্ষাকারী দেবী দুর্গাকে প্রনাম। 

ঋকবেদের রাত্রীসূক্তেও "দুর্গার" উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈদিক দেবতার ব্যাখ্যাগ্রন্থ "বৃহদ্দেবতা" তে বলা হয়েছে, অদিতি, বাক্, সরস্বতী এবং দুর্গা অভিন্ন। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে, বৈদিক রুদ্র যজ্ঞের পরিবর্তিত রূপই হলো দুর্গাপুজা। বৈদিক যুগে শরৎকালেই নতুন বছরের গননা আরম্ভ হতো। অনুমান করা হয়, এই নতুন বছরের শুরুতেই "রুদ্র যজ্ঞ" সম্পন্ন করা হতো। 

অমূল্যচরন বিদ্যাভূষনের মতে, "অম্বিকা" বলতে শরৎ ঋতুকে বোঝায়। তিনি "তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মন" থেকে প্রমান উদ্ধার করে দেখায়েছেন, শরৎ ঋতুর পুজা করার অর্থই দেবী অম্বিকার অর্থাৎ দুর্গার পুজা করা। যদিও মনে রাখতে হবে হিন্দু ধর্মে দেব পুজার প্রচলন শুরু হয় পুরানের যুগে। 

ঐতিহাসিক বিশ্লেষন থেকে বোঝা যায়, খ্রীঃ পূর্ব ১৫০০ থেকে ১০০০ মধ্যে ঋকবেদের রচনা হয়। এবং খ্রিঃ পূর্ব নবম ও ষষ্ঠ বা পঞ্চম শতাব্দীতে বাকি বৈদিক সাহিত্য গুলি রচিত হয়। বেদে দেবী দুর্গার উল্লেখ থেকে এটি অনুমিত হয় দুর্গা খুবই প্রাচীন দেবী। 

বৈদিক যুগের পর শুরু হয় মহাকাব্যের যুগ। আনুমানিক খ্রিঃ পূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিঃ চতুর্থ বা পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে রামায়ন ও মহাভারত মহাকাব্য দুটি রচনা করা হয় বা সংকলিত হয়। মূল বাল্মিকি রামায়নে দেবী দুর্গার কোন উল্লেখ নেই। যদিও মধ্যযুগে লিখিত কৃত্তিবাসী রামায়নে রাবন বধের পূর্বে রামচন্দ্রের দুর্গাপুজার কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ১০৮ টি পদ্ম দিয়ে রামচন্দ্র এই সময় দেবীর অকাল বোধন করেছিলেন। 

শরৎকালে রামচন্দ্রের সমুদ্রপার করে শ্রীলঙ্কা গমন কতটা সময়ভেদে যুক্তিগ্রাহ্য ছিলো, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ওঠে।কেননা বর্ষার পরেই শরৎ এর আগমন ঘটে। এই সময় সমুদ্রের জলরাশি যথেষ্টই স্ফিত থাকে। তাই সেতু বাঁধার কাজটি শরৎকাল অপেক্ষা চৈত্রমাসেই অধিক যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। 

যাইহোক, মূল রামায়নে দেবী দুর্গার কোন উল্লেখ না থাকলেও, মহাভারতের বেশ কিছু জায়গায় পান্ডবদের দ্বারা দুর্গার স্তব করা হয়েছে। বিরাট পর্বে সফল অজ্ঞাতবাসের জন্য পান্ডবরা দেবী দুর্গার স্তব করেন। ভীষ্মপর্বের ২৩ তম অধ্যায়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সফলতার জন্য স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দুর্গাবন্দনার নির্দেশ দেন। 

খ্রীঃ পূর্ব ষষ্ঠ শতকে বৈদিক হিন্দু ধর্মাচারের প্রতিবাদ হিসাবে বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব ঘটে। পরবর্তীকালে এই ধর্মের পৃষ্ঠপোষক মৌর্য রাজাদের ব্যাপক প্রচারে হিন্দু ধর্ম অনেকটাই চাপা পড়ে যায়। শুঙ্গ বংশের আমলে এই ধর্ম পুনরায় পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এর অল্প কিছুকাল পরে কুষান আমলে পুনরায় দেবী দুর্গার পুজা চাক্ষুস করা যায়। খ্রীষ্ট্রীয় প্রথম শতকে কুষান সম্রাট হুবিষ্কের একটি মুদ্রায় সিংহবাহিনীর মূর্তি প্রত্যক্ষ করা যায়। এই মুদ্রাটি মথুরা মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া, হুবিষ্কের আর একটি মুদ্রায় উমা মূর্তির প্রতিচ্ছবিও পাওয়া যায়।

গবেষক বিমলচন্দ্র দত্তের মতে, কুষান যুগের "ননা" মূর্তিই পরবর্তীকালে "মহিষমর্দিনী দুর্গা" রূপে মূর্ত হন। কুষান সাতবাহন যুগের পর ভারতে গুপ্তরাজাদের রাজত্ব শুরু হয়। এই সময়কালকে অনেকে পুরানযুগও বলে থাকেন। কেননা বেশিরভাগ পুরান গুপ্তযুগেই রচিত হয়। 

পুরানের যুগেই হিন্দুদেবতাদের মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মান, পুজার আচার পদ্ধতি, নিয়মবিধি ইত্যাদি গুলি রচনা করা হয়। এই সময়ে রচিত স্কন্দপুরান, দেবীপুরান, বৃহন্নারদীয়পুরান, দেবী ভাগবৎ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরানে দেবী দুর্গার কথা জানতে পারা যায়। বর্তমানে দুর্গাপুজার যে রীতি ও আচারপদ্ধতি দেখা যায়, তা "মার্কেন্ডেয় পুরান" ও "বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরানের" এক সংমিশ্রিত রূপ। 

"মার্কেন্ডেয়পুরানের দেবীমাহাত্মে" উল্লেখিত আছে, ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর পুরুষের অবধ্য হওয়ায় ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের আশ্বাসবানী দেন, সকল দেবতাদের তেজ থেকে উৎপন্ন শক্তি সম্মিলিত হয়ে এক দেবীর আর্বিভাব ঘটবে, যিনি "মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা" নামে পরিচিত হবেন। "মার্কেন্ডেয়পুরানের" দেবীর উদ্ভব সংক্রান্ত এই ব্যাখ্যাটিই সবথেকে বেশি প্রচলিত। 

তবে দেবীর উদ্ভব সম্পর্কে আরেকটি ব্যাখ্যা আছে "পদ্মপুরানে"। এখানে বলা হয় ব্রহ্মার অনুরোধে রাত্রীদেবী হিমালয়পত্নী মেনকার গর্ভে প্রবেশ করে উমার গায়ের রং কৃষ্ণ বর্নে পরিনত করে দেন। এই বৈদিক রাত্রীদেবীই পরে পার্বতী বা দুর্গা নামে আখ্যায়িত হন। কাহিনী যাই হোক, কৃষ্ণবর্না অনার্য দেবীই যে পরবর্তীকালে রূপান্তরিত হয়ে দুর্গা রূপে খ্যাত হন তা এই কাহিনী থেকেও অনুমিত হয়। 

পুরান বা গুপ্তযুগের বেশ কিছু দুর্গা মূর্তির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। গুপ্তযুগে নির্মিত ও ভিটার পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে পাথরের তৈরি ছোট আকৃতির দ্বিভূজ মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া, উদয়গিরি গুহায় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলের একটি দ্বাদশভূজা মহিষাসুরমর্দিনী অলঙ্করনমূর্তিও পাওয়া গেছে। এসবই দুর্গা পুজার প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য দেয়। 

আদিমধ্য যুগ (৬৫০ খ্রিঃ থেকে ১২০৬ খ্রিঃ) ও মধ্য যুগেও (১২০৬ - ১৭৫৭) ভারতে দুর্গাপুজার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। একাদশ শতকের অন্যতম লেখক ভবদেব ভট্ট তার "দশকর্ম দীপিকা" ও "কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি" গ্রন্থে দেবী দুর্গার পুজা পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। দ্বাদশ - ত্রয়োদশ শতকের জীমূতবাহনের "দুর্গোৎসব নির্নয়" গ্রন্থেও দুর্গা পুজার বিস্তারিত বর্ননা পাওয়া যায়। এসময়ের অন্যতম কবি বিদ্যাপতিও তাঁর "দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী" গ্রন্থে দুর্গা পুজার কথা লিখেছেন। 

এছাড়া, "চৈতন্যভাগবতের" লেখক বৃন্দাবন দাস (১৫৩৮ - ১৫৫০ খ্রিঃ মধ্যে লিখিত) "চৈতন্যভাগবতেও দুর্গোৎসবের উল্লেখ করেছেন। সমগ্র মুঘলকাল জুড়ে দুর্গা পুজার আয়োজনের প্রমান পাওয়া যায়। এইসব ঐতিহাসিক প্রমান থেকে একথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, খুব প্রাচীনকাল থেকেই দেবী দুর্গা এই উপমহাদেশে ধারাবাহিক ভাবে পুজিত হয়ে আসছেন। 

(৪.) বাংলায় দুর্গাপুজার ইতিবৃত্ত :- 

বাংলায় ঠিক কখন থেকে দুর্গাপুজার প্রচলন শুরু হয়, তা নিয়ে একাধিক গবেষক বিস্তৃত ভাবে আলোচনা করেছেন। দুর্গাপুজা এবং বাঙালি আজ কোথাও যেন সমার্থক হয়ে গেছে। বাংলাদেশে দুর্গাপুজার প্রাচীনত্বও বেশ ঈর্ষনীয়। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বহু প্রাচীন দুর্গামূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। 

নবম শতকে নির্মিত একটি লোধাসনা দুর্গামূর্তি পাওয়া গেছে মালদহ জেলাতে। ফরিদপুরের মাদারিপুরে, দারিন্দা বসুলপুরেও দশভূজা দুর্গা মূর্তি পাওয়া গেছে। এছাড়া, পশ্চিমবঙ্গের দীনাজপুর, বীরভূম, বর্ধমান প্রভৃতি জেলাতেও প্রচুর প্রাচীন দুর্গামূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। মানভূমে খ্রীঃ দ্বাদশ শতকের একটি দুর্গা মূর্তি পাওয়া গেছে। এই মূর্তিটি ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এ প্রসঙ্গে বাঁকুড়া জেলার হাজার বছরের পুরাতন বিষ্ণুপুর মল্ল রাজপরিবারের দুর্গাপুজারও উল্লেখ করতে হয়। বাংলার প্রাচীন পটচিত্র আজ বিলুপ্ত। কিন্তু এই পটচিত্রেই দেবীকে এঁকে এখানে পুজো করা হয়। 

এ প্রসঙ্গে অবিভক্ত বাংলার ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দুর্গাপুজোরও উল্লেখ করতে হয়। পাল সেন যুগে গৌড়েশ্বর বল্লাল সেন নিজহাতে ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী ঢাকেশ্বরী হলেন দশভূজা দুর্গা। ঢাকেশ্বরীর নামেই পরবর্তীকালে ঢাকা শহরটির নামকরন হয়েছিলো। 

বাংলার দুর্গাপুজা সম্বন্ধীয় এইসকল তথ্য থেকেই বোঝা যায়, বাংলায় দুর্গাপুজার ঐতিহ্য খুবই প্রাচীন। তবে কে প্রথম বঙ্গে দুর্গাপুজা প্রচলন করেন, আজও সেই বিতর্কের অবসান ঘটে নি। "মার্কেন্ডেয় পুরান" অনুযায়ী জানা যায়, বঙ্গে দুর্গাপুজার প্রচলন হয়েছিলো রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যের দ্বারা। কথিত আছে, সুরথ নাকি এক লক্ষ বলি দিয়ে দুর্গাপুজা করেন। যে স্থানে তিনি এই লক্ষ বলি দেন তা "বলিপুর" গ্রাম নামে খ্যাত হয়। এই বলিপুর গ্রামই এখন বোলপুর নামে খ্যাত। 

ঐতিহাসিকদের অনুমান মার্কেন্ডেয় পুরান সম্ভবত খ্রীঃ দ্বিতীয় শতকে রচিত হয়েছিলো। রাজা সুরথের পুজার বয়সও সম্ভবত ঐ কাছাকাছি সময়কালেরই হবে। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, রাজা সুরথের পুজো কিন্তু কখনই শারদিয়ার দুর্গাপুজো ছিলো না। বা অকাল বোধনের দুর্গাপুজো ছিলো না। তা ছিলো বাসন্তীপুজা। সাধারনত চৈত্র মাসে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়। 

মর্তলোকের ছ মাসে দেবতাদের একদিন এবং পরবর্তী মাসে দেবতাদের এক রাত্রি হয়। মাঘ মাস থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত ছয় মাসকে "উত্তরায়ন" বলা হয়। এই ছয় মাস হলো দেবতাদের একদিন। অন্যদিকে শ্রাবন মাস থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত ছয় মাসকে বলা হয় "দক্ষিণায়ন"। এই ছয়মাস দেবতাদের একরাত। এইসময় দেবতারা নিদ্রামগ্ন থাকেন। আশ্বিন মাস যেহেতু দক্ষিনায়নের মধ্যে পড়ে তাই শরৎকালে দেবীকে বোধনের দ্বারা জাগ্রত করতে হয়। বাসন্তীপুজো উত্তরায়নের মধ্যে পড়ায় দেবীকে বোধনের প্রয়োজন পড়ে না। 

বাসন্তীপুজা আসল দুর্গাপুজা হলেও, প্রথমে ব্রহ্মার এবং পরে রামচন্দ্রের শরৎকালে দেবীর অকাল বোধনের পুজাটিই সারা বিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করে। যাইহোক, এবার মূল প্রসঙ্গক্রমে ফেরা যাক। আগেই বলেছি, বঙ্গে দুর্গাপুজার প্রচলন নিয়ে নানামুনির নানা মত। তবে ঐতিহাসিক দিক থেকে বঙ্গে দুর্গাপুজার সুস্পষ্ট প্রমান পাওয়া যায় পাল রাজা মহিপাল ও নয়পালের সময়কালে। রাঢ়বঙ্গের গোপভূমের স্বাধীন সার্বভৌম রাজা ছিলেন ঈশ্বরঘোষ বা ইছাই ঘোষ। তিনি তার রাজধানী ঢেক্করীর শ্যামারূপা গড়ে বঙ্গে সর্বপ্রথম দুর্গাপুজা করেন। 

তবে মনে রাখতে হবে, ইচ্ছাই ঘোষের পুজা কিন্তু মৃন্ময়ী মূর্তির দুর্গাপুজা নয়। যতটুকু ইতিহাস জানা যায়, বঙ্গে মৃন্ময়ী দুর্গাপুজার প্রচলন করেন অবিভক্ত বাংলার রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মন বংশীয় রাজা কংসনারায়ন। ইনি আকবরের সময়কার বঙ্গের দেওয়ান ও সুবাদার ছিলেন। এই পুজোতে তখনকার দিনে তার খরচা হয়েছিলো প্রায় ৯ লক্ষ টাকা। তার দেখাদেখি বঙ্গে তখন অন্যান্য সমৃদ্ধশালী জমিদারবারভূঁইয়ারাও দুর্গাপুজো শুরু করেন। এর ফলে বঙ্গে মৃন্ময়ী দুর্গাপুজা একটি অভিজাত পারিবারিক অথচ সার্বজনীন পুজাতে রূপলাভ করে। 

কালের নিয়মে ভারতে ইংরেজদের আগমন ঘটে। তারা এদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিলাভ করে বাংলায় নতুন নতুন জমিদারদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই সময় হিন্দু জমিদাররা তাদের জমিদারির জৌলুষ ও সমৃদ্ধির বহর দেখানোর জন্য দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। বড়োলোকের সেই দুর্গাপুজায় মেতে উঠতো পুরো গ্রাম। এজন্য অবশ্য পুরো গ্রাম থেকেই বিশেষ কর আদায় করা হতো। সকল প্রজার পক্ষেই সেই কর দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিলো। মুসলিম হলেও সেখানে ছাড় মিলতো না। 

পলাশীর যুদ্ধের পর লর্ড ক্লাইভের বিজয় উপলক্ষে ১৭৫৭ খ্রিঃ রাজা নবকৃষ্ণ দেব বিরাট ধুমধাম করে দুর্গাপুজার আয়োজন করেন। এই পুজাতে নাচের আসর ও সুরাপানে তিনি যে বিপুল অর্থ খরচ করেছিলেন, তা পরবর্তীকালে লোকশ্রুতিতে পরিনত হয়েছিলো। পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ আড়ম্বরপ্রিয় দুর্গাপুজার আয়োজন করে স্মরনীয় হয়ে আছেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। ইনি ১৭৮১ খ্রিঃ নদীয়ায় দুর্গোৎসবের প্রচলন করেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র সর্বপ্রথম দুর্গাপুজাতে বাইজিনাচের প্রচলন করেন। পরে তার দেখাদেখি অন্যান্যরাও তা চালু করেন। 

তবে ঐতিহাসিকগত ভাবে রাঢ় বঙ্গে দুর্গোৎসবের প্রথম প্রবর্তক ছিলেন বাঁকুড়া জেলার ভুলাই গ্রামের জগদ্রাম রায়। ইনি খুব সম্ভবত অষ্টাদশ শতকের লোক ছিলেন। জগদ্রাম "জগদ্রামী রামায়ন" রচনা করে পরবর্তীতে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তাঁর বাড়ি ছিলো শিখরভূমের পঞ্চকোট রাজ্যে। বর্তমানে এটি বাঁকুড়া জেলার মেজিয়া থানার ভুলাই গ্রামে অবস্থিত ছিলো। 

কালীপ্রসন্ন সিংহের লেখা "হুতোম প্যাঁচার নকশা" গ্রন্থ থেকে জানা যায়, উনিশ শতকের প্রথম দিকে দুর্গাপুজা ছিলো রাজারাজড়াদের উৎসব। আজকের দিনে দুর্গাপুজাকে কেন্দ্র করে শহর কলকাতা যেমন মেতে ওঠে, অতীতেও তা ছিলো। সেযুগে জাঁকজমকপূর্ন পুজোর আয়োজন করে একে একে কুমোরটুলির গোবিন্দরাম মিত্র, হাটখোলার দত্তবাড়ি, শোভাবাজার রাজবাড়ি, ছাতুবাবু ও লাটুবাবুর পুজা, খেলাতবাবুর বাড়ির পুজা, জানবাজারে পীতরাম মাড়বাড়ির পুজা, পোস্তার রাজবাড়ি, শ্রীমনিবাড়ির পুজো ইতিহাসের পাতায় নাম তুলেছিলো। 

পুরানো কলকাতায় তখন দুর্গাপুজাকে কেন্দ্র করে অর্থব্যায়ের প্রতিযোগীতা চলতো। কে কত লক্ষ টাকা দুগ্গা পুজায় খচ্চা করলো, তা নিয়ে রীতিমত লোকেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চলতো। দুর্গাপুজার সাথে থাকতো বাঈজি নাচ, সুরাপান, যাত্রাগান, কবিগানের লড়াই, বুলবুলির লড়াই, খেমটা নাচ, খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি। কালক্রমে দুর্গা পুজা বিত্তবানদের বেড়াজাল ছিন্ন করে সর্বসাধারনের মধ্যে নেমে আসে। 

হুতোমের সাক্ষ্য মতে, উনিশ শতক থেকে দুর্গাপুজার চরিত্রে বিশেষ বদল আসতে শুরু করেছিলো। এই সময় "পুঁটে তিলিকেও প্রিতিমা আনতে দেখা যায়।" উনিশ শতকের শেষদিকে কলকাতায় বারোয়ারি দুর্গাপুজার প্রচলন ঘটে। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্ত পাড়ার বারোজন ইয়ার বা বন্ধু মিলে সর্বপ্রথম "বারো - ইয়ারি" পুজোর প্রচলন শুরু করেন। কালক্রমে "বারোয়ারি পুজা" সর্বজনীন সম্প্রদায় পুজায় রূপলাভ করেছিলো। 

(৫.) উপসংহার :- 

সনাতন ধর্মে "পুজা" শব্দের অর্থ যেমন দেবতাকে বন্দনা করা, তেমনি দেবীকে তুষ্ট করে কাঙ্খিত কল্যানের প্রার্থনা করাও। দেবতাকে তুষ্ট ও বন্দিত করার জন্য পরবর্তীকালে নানা আচার অনুষ্ঠান ও উপাচারের জন্ম হয়। স্থান কাল ভেদে তার মধ্যে নানা বৈচিত্র্যও লক্ষ্য করা যায়। আগেই বলেছি, ভারতের লৌকিক ধর্ম বিশ্বাস ও আচারের সমন্বয়েই হিন্দু ধর্ম পরিপূর্নতা লাভ করেছিলো। দুর্গা পুজাও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। 

সনাতন ধর্মে "ধর্মকে" কেন্দ্র করে সংস্কৃতি আবর্তিত হয়। তাই সনাতন ধর্মে সব পুজাই শেষ পর্যন্ত সম্মিলন ও উৎসবের রূপ লাভ করে। ভগবান বুদ্ধ দুঃখকে নিবারনের কথা বলেছিলেন। সনাতন ধর্মেও পরম আনন্দলাভের কথা বলা হয়েছে। একমাত্র পরমব্রহ্মের প্রাপ্তি লাভের মধ্য দিয়েই ব্যক্তি চরম সুখানুভূতি ও আনন্দলাভ করতে পারেন। এই আনন্দই মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ ও পরম প্রাপ্তি। সেই চরম কাঙ্ক্ষিত আনন্দের অন্বেষনে সুদূর বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সনাতন ধর্মের সব পুজাই  শেষপর্যন্ত "আনন্দ মহোৎসবে" পর্যবসিত হয়। 

দুর্গোৎসবেও তাই ঘটে। "চরম আনন্দ" - উদ্যম, উৎসাহ, অফুরন্ত জীবনীশক্তি ও সৃষ্টিশীলতারই প্রতীক। সুপ্রাচীন কাল থেকেই তাই হিন্দু ধর্মকে কেন্দ্র করে শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্যচর্চা প্রভৃতি মানুষের সুকুমার বৃত্তি গুলি বিকশিত হয়ে চলেছে। আজকের দুর্গাপুজাতে তারই প্রতিস্ফুরন দেখা যায়। শিল্প ও সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে ঐশ্বরিক সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করার নামই হলো সনাতন ধর্ম। সনাতন ধর্মের এই রূপ প্রকাশ ছত্রে ছত্রে দেখা যায় আজকের দুর্গা পুজায়। 

প্রচলিত লৌকিক বিশ্বাস অনুসারে দুর্গা স্বর্গ থেকে মর্তে আসেন বিশেষ কোন একটি যানে। তিনি ফিরেও যান বিশেষ কোন একটি যানে। জ্যোতিষ মতে দেবীর এই বিশেষ যানে আগমন ও গমন এক একটি ফল নির্দেশ করে। দেবীর নৌকায় আগমন ও গমনের ফল হয় শস্যবৃদ্ধি বা জলবৃদ্ধি। দোলায় আগমন ও গমনের ফল হয় মড়ক। গজে আগমন ও গমনের ফল হয় শস্যপূর্না বসুন্ধরা। ঘোটকে অর্থাৎ ঘোড়াতে আগমন ও গমনের ফল হয় ছত্রভঙ্গ। 

হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী, সপ্তমী রবি বা সোমবার হলে দেবীর বাহন হয় গজ বা হাতি, মঙ্গল বা শনি বার হলে দেবীর বাহন হয় ঘোটক বা ঘোড়া, বুধবার হলে দেবীর বাহন হয় নৌকা এবং বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার হলে দেবীর বাহন হয় পালকী বা দোলা। 

একই ভাবে দশমী রবি বা সোমবার হলে দেবী বিদায় নেবেন গজে। অন্যদিকে তা শনি বা মঙ্গলবার হলে ঘোড়ায়, বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার হলে দোলায়, বুধবার হলে দেবী নৌকা করে কৈলাসে ফিরবেন। বাঙালি সংস্কৃতিতে দেবী দুর্গার আগমনকে কন্যার পিতৃলোকে বা বাপেরবাড়ি আগমনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কন্যাকে যেভাবে আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে বিদায় জানানো হয়, এক্ষেত্রেও সেই একই নিয়মে দেবীকে বিদায় জানানো হয়। 

দেবীর বিদায়লগ্নে সবধা নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় সিঁদুর খেলে। দুর্গাপুজার এই সিঁদুর খেলার মধ্যেও আদিম অনার্য উপজাতীয় সংস্কৃতির প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীনকালে প্রত্যেকটি উপজাতীর তীরের ফলার আকার ছিল ভিন্ন আয়তনের। যখন কোন এক উপজাতি অপর কোন উপজাতিকে যুদ্ধে পরাভূত করতো, তখন ঐ পরাজিত উপজাতির সমস্ত সম্পত্তি তারা দখল করে নিতো। সেসময় পরাজিত উপজাতীর নারীরাও সম্পত্তি হিসাবে পরিগনিত হতেন। ঐসব নারীদের দখলের প্রতীক হিসাবে তাদের মাথায় তীরের ফলা এঁকে দেওয়া হতো। তীরের ফলার ঘর্ষনের রক্তপাতের সেই চিহ্নই পরবর্তীকালে লাল সিঁদুরের প্রতীকে পরিনত হয় বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করে থাকেন। 

সবশেষে আসি, দুর্গাপুজার তাৎপর্যের আলোচনায়। রামচন্দ্র রাবন বধের কামনায় দুর্গা পুজা করেন। দুর্গাপুজার অষ্টমীনবমী তিথির সন্ধিক্ষনে যে পুজা অনুষ্ঠিত হয় তাকে বলে "সন্ধিপুজা" । অষ্টমীর শেষ চব্বিশ মিনিট ও নবমীর প্রথম চব্বিশ মিনিট নিয়ে মোট আটচল্লিশ মিনিটের মধ্যে সন্ধিপুজা করতে হয়। এই সন্ধিপুজার সন্ধিক্ষনেই রামচন্দ্র রাবনের দশমুন্ড ছিন্ন করেন। 

দেবীপুরানে দুর্গাপুজাকে অশ্বমেধ যজ্ঞের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়েছে, ভক্তিসহকারে দুর্গাপুজা করলে "অশ্বমেধ যজ্ঞের" সমান ফলপ্রাপ্তি হয়। তাই শাস্ত্রে দুর্গাপুজাকে "মহাপুজাও" বলা হয়েছে। আজকের আধুনিক প্রগতিশীল সমাজে অবশ্য শাস্ত্রের এইসব ধর্মীয় প্রলভন মানুষকে সন্তুষ্ট করে না। প্রশ্ন জাগে, তাহলে দুর্গা পুজার স্বার্থকতা কোথায়? খুব সহজ সরল ভাবে বলতে গেলে, এ পুজার সারমর্ম হল সকল নারীকে ভগবতী বুদ্ধিতে দেখা। 

নারী মাতৃরূপা। তিনি সর্বভূতে বিরাজমান। পৃথিবীর সকল সৃষ্টিই মাতৃগর্ভজাত। তিনি এই জগতে শক্তিরূপে বিরাজমান। এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে তিনি প্রকৃতিরূপে বিরাজমান। সেই পরমা প্রকৃতিকে বন্দনা, স্তুতি করার নামই হলো দুর্গা পুজা। যে মৃত্তিকাকে অবলম্বন করে এই পরমা প্রকৃতি বিরাজমান, সেই মৃত্তিকা দ্বারা নির্মিত মৃন্ময়ীর মূর্তি দুর্গার প্রতীকমাত্র। সেই মুর্তি অখন্ড ও অনাদী নয়। তাই বিসর্জনে তা প্রকৃতিতেই পুনঃরায় লীন হয়ে যায়। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post