"প্রাক্ ইতিহাস" ও "প্রায় ইতিহাসের" পরবর্তী যুগ বা সময়কালকেই বলা হয় "ঐতিহাসিক যুগ" বা "Historic Age"।
ঐতিহাসিক যুগ |
ঐতিহাসিক যুগের সংজ্ঞা ও ধারনা :-
যে সময়ে লিখিত উপাদান পাওয়া গেছে এবং তার পাঠোদ্ধারও করা গেছে, সেই সময়কালকেই সাধারনত বলা হয় "ঐতিহাসিক যুগ" বা "Historic Age"।
সময়কাল ও উদাহরন :-
পৃথিবীর সব জায়গায় একই সময়ে লিপির উদ্ভাবন ঘটে নি এবং একই সময়ে লিপি গুলির পাঠোদ্ধারও সম্ভব হয় নি। তাই বিশ্বের সব জায়গায় ঐতিহাসিক যুগের সূচনাকাল এক নয়।
যেমন মিশর ও মেসোপটেমিয়াতে ৩,২০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়েছিলো। আবার ভারতে ৬০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে ঐতিহাসিক যুগের সূত্রপাত ঘটে।
৩,০০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দের কাছাকাছি কোন এক সময়ে মিশর এবং মেসোপটেমিয়াতে লিপির প্রচলন শুরু হয়েছিলো বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। মিশরের হায়ারোগ্লিফিক লিপি এবং মেসোপটেমিয়ার কিউনিফর্ম লিপির পাঠোদ্ধার ঐতিহাসিকরা করতে সক্ষম হয়েছেন। সবদিক বিবেচনা করে ঐতিহাসিকরা সিদ্ধান্তে এসেছেন, ৩,২০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দ থেকেই ঐ সমস্ত দেশ গুলিতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়েছিলো।
ভারতে প্রথম অশোকের ব্রাহ্মি লিপির পাঠোদ্ধার করা হয়। জেমস প্রিন্সেপ ১৮৩৭ খ্রিঃ সর্বপ্রথম অশোকের ব্রাহ্মি লিপির পাঠোদ্ধার করেন। ভারতে পাঠোদ্ধার করা সর্বপ্রাচীন লিপির নিদর্শন ছিলো অশোকের "গিরি অনুশাসন" এবং "স্তম্ভ অনুশাসন"। আনুমানিক ২৬০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে এই লিপি দুটি উৎকীর্ন করা হয়। এই কারনে নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, ভারতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়েছিলো খ্রিঃ পূঃ তৃতীয় শতকে।
তবে ভারতে লেখার ঐতিহ্য, বর্নমালার সংস্কার, বিবর্তন এসব আরোও অন্তত দুই তিনশ বছর আগে থেকে শুরু হয়েছিলো। এই কারনে অধিকাংশ ঐতিহাসিক বলেছেন, নিশ্চিত ভাবে ভারতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়েছিলো খ্রিঃ পূর্ব তৃতীয় শতকে, কিন্তু শিথিল ভাবে ভারতে খ্রিঃ পূর্ব ষষ্ঠ শতকে অথবা ৬০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দ থেকেই ঐতিহাসিক যুগের সূচনা ঘটে।
ঐতিহাসিক যুগের উপাদান :-
ঐতিহাসিক যুগের উপাদান বিস্তৃত ও বহুবিধ। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ছাড়াও লিখিত উপাদান, বিশেষত লিপি, মুদ্রা, বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়। এছাড়া বিভিন্ন মিথ, জনশ্রুতি,পৌরাণিক কাহিনী ও কিংবদন্তীকেও ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
ঐতিহাসিক যুগের বৈশিষ্ট্য :-
ইতিহাসের "ঐতিহাসিক যুগ" পর্বের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
(১.) এই সময়ে লিখিত উপাদান পাওয়া গেছে।
(২.) লিখিত উপাদান গুলির পাঠোদ্ধারও করা গেছে।
(৩.) খুব স্বাভাবিক ভাবেই লিখিত উপাদান "ঐতিহাসিক যুগ" পর্বের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়।
(৪.) লিখিত বিভিন্ন উপাদান যেমন লিপি, মুদ্রা, বিভিন্ন গ্রন্থাদি ছাড়াও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানও ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়।
(৫.) ঐতিহাসিক যুগ থেকেই মূলত ধারাবাহিক ভাবে সন তারিখ অনুযায়ী ইতিহাসকে জানতে পারা যায়।
(৬.) লিপির উৎকর্ষতা, কৃষি প্রযুক্তির উদ্ভাবন, নগর কেন্দ্রীক সভ্যতার বিকাশ, রাজতন্ত্র বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিপূর্ণ ও সুস্পষ্ট বিকাশ ঐতিহাসিক যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এগুলি একমাত্র ঐতিহাসিক যুগেই লক্ষ্য করা যায়।যেমন ভারতে খ্রিঃ পূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। আবার এই সময়কালেই ষোড়শ মহাজনপদের মধ্য দিয়ে ভারতের রাষ্ট্র ব্যবস্থারও সূত্রপাত ঘটে।
(৭.) লোহার ব্যবহার ঐতিহাসিক যুগের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
"ঐতিহাসিক যুগ" বিভাজন সম্পর্কে বিতর্ক :-
লিখিত উপাদানের প্রাপ্তি ও তার পাঠোদ্ধারের ভিত্তিতে যুগ বিভাজনকে অনেক ভারতীয় ঐতিহাসিকই মেনে নিতে পারেন নি। তাদের মতে লিপিজ্ঞান ও পঠন পাঠনের সক্ষমতার ভিত্তিতে যুগ বিভাজন করলে প্রাক্ ইতিহাস যুগের মানুষদের কৃতিত্বের দিক গুলিকে এক অর্থে অস্বীকার করা হয়।
মাথায় রাখতে হবে, মানুষ যখন একটি অক্ষরও লিখতে পারতো না তখন তারা অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গুলির উদ্ভাবন করেছিলো। আগুনের
আবিষ্কার,চাকার আবিষ্কার এবং কৃষিপ্রযুক্তির আবিষ্কার মানুষের আর্থ - সামাজিক জীবনযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়েছিলো এবং মানুষকে সভ্যতার দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। এই দিক থেকে বিচার করলে পৃথিবীতে মানুষের সমগ্র অস্তিত্বকাল ও কর্মকান্ডই ঐতিহাসিক যুগের মধ্যে পড়ে। আলাদা করে তাই "ঐতিহাসিক যুগ" বিভাজন অর্থহীন ও অবান্তর।
আধুনিক কালের ঐতিহাসিকদের মতে, লিপি জ্ঞানের ভিত্তিতে যুগ বিভাজন না করে মানুষের ইতিহাসকে প্রস্তর যুগ এবং ধাতু যুগ এই দুটি ভাগে ভাগ করলে অধিক যুক্তিসঙ্গত হবে। মানব সভ্যতার প্রস্তরকাল প্রাক্ লিখন পর্বের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। আর ধাতু যুগ ছিলো লিখন পর্বের অন্তর্গত। পৃথিবীর অধিকাংশ লিপি গুলির জন্ম হয়েছিলো ধাতু যুগে। এমনকি বিশ্বের সব প্রাচীনতম সভ্যতা গুলিও ধাতু যুগের। এই যুক্তিতে মানব সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসকে প্রাগৈতিহাসিক, প্রায় ঐতিহাসিক এবং ঐতিহাসিক - এইভাবে ভাগ না করে প্রস্তর যুগ, ধাতু যুগ - এই দুই ভাগে বিভক্ত করলে যুগ বিভাজন অধিক যুক্তিসঙ্গত ও সঠিক হবে।
প্রাগৈতিহাসিক, প্রায় ঐতিহাসিক ও ঐতিহাসিক যুগের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা :-
প্রাক্ ইতিহাস | প্রায় ইতিহাস | ইতিহাস |
---|---|---|
এই সময়কালে লিখিত উপাদান পাওয়া যায় নি। | এই সময়কালে লিখিত উপাদান পাওয়া গেছে কিন্তু তার পাঠোদ্ধার করা যায় নি। | এই সময়কালে লিখিত উপাদান পাওয়া গেছে এবং তার পাঠোদ্ধারও করা গেছে। |
এটি প্রাক্ লিখন যুগের অন্তর্গত। | এটি লিখন যুগের অন্তর্গত। | এটি লিখন যুগের অন্তর্গত। |
প্রাক্ ইতিহাস হলো মানব সভ্যতার সূচনা লগ্নের ইতিহাস। | প্রায় ইতিহাস হলো প্রাক্ ইতিহাস ও ইতিহাসের মধ্যবর্তী সময়কালের ইতিহাস। | ইতিহাস হলো প্রায় ঐতিহাসিক যুগের পরবর্তী কালের ইতিবৃত্ত। |
এটি প্রস্তর যুগের অন্তর্গত। | এটি ধাতু বিশেষত তামা ও ব্রোঞ্জ যুগের অন্তর্গত। | এটি লৌহ যুগের অন্তর্গত। |
ইতিহাস রচনার একমাত্র উপাদান হলো প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। | ইতিহাস রচনার প্রধান উপাদান হলো প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। | লিখিত এবং প্রত্নতাত্ত্বিক দুটি উপাদানই ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। |
তথ্যের অপ্রতুলতার জন্য ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করা কষ্টকর। | তথ্যের অপ্রতুলতার জন্য ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করা যায় না। | ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করা যায়। |
সাল, তারিখ ও সময়ের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি দেখা যায়। | সাল, তারিখ ও সময়কালের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি দেখা যায়। | প্রায় নির্ভুল ভাবে সাল, তারিখ ও সময়কাল জানতে পারা যায়। |
প্রাক্ ইতিহাস অনেকটাই আবেগবর্জিত ও নিরপেক্ষ হয়ে থাকে। | প্রায় ইতিহাস অনেকটাই আবেগবর্জিত ও নিরপেক্ষ হয়ে থাকে। | ইতিহাস সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও আবেগবর্জিত হয় না। |