লর্ড কার্জন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দমন করার জন্য বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা করেন। ১৯০৫ খ্রিঃ ১৯ শে জুলাই সরকারি ভাবে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা ঘোষনা করা হয় এবং প্রশাসনিক ভাবে ঐ পরিকল্পনাকে কার্যকর করা হয় ১৯০৫ খ্রিঃ ১৬ অক্টোবর ।
বাংলার শিক্ষিত ও সচেতন মানুষেরা কার্জনের বাংলা ভাগের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেন নি। এর বিরুদ্ধে তারা স্বদেশী আন্দোলনের ডাক দেন। নারী, পুরুষ, জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে আপামোর বাঙালি স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তবে তাদের মধ্যে ছাত্রদের অংশগ্রহন ও ভূমিকা ছিলো সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয়।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা |
(ক.) কেন ছাত্রদের ভূমিকা এত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো?
যে কোন আন্দোলনে কোন জাতি, সম্প্রদায় বা শ্রেনী তাদের নিজস্ব শ্রেনী স্বার্থের তাগিদেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে থাকে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অনেক শ্রেনীই নিজেদের শ্রেনী স্বার্থ রক্ষার তাগিদে আন্দোলনকে সমর্থন বা অসমর্থন করে ছিলেন। কেউবা আবার আন্দোলনে নিজ শ্রেনী স্বার্থের কোন সংযোগ খুঁজে না পেয়ে আন্দোলন থেকে দূরে থাকেন এবং নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
কিন্তু এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলো ছাত্রসমাজ। সংকীর্ণ শ্রেনী স্বার্থ রক্ষার তাগিদে কখনোই ছাত্রসমাজ পৃথিবীর কোন আন্দোলন বা বিদ্রোহে সামিল হয় না। একমাত্র দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ ও বৃহত্তর আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার তাগিদেই যুগে যুগে ছাত্রসমাজ গন আন্দোলনে সামিল হয়ে এসেছে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এই ধারা ও প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে দেখা যায় -
(১.) সমাজের অন্যান্য শ্রেনি গুলির চাইতে ছাত্ররাই সবথেকে বেশি সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করে।
(২.) তারাই বাংলার সর্বত্র স্বদেশীর আদর্শ প্রচার করে।
(৩.) বিভিন্ন সভা সমিতিতে স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যই ছিলো ছাত্র।
(৪.) স্বদেশী আন্দোলনের বয়কট কর্মসূচিকে ছাত্ররাই সর্বাত্মক ও তীব্র করে তুলেছিলো।
(৫.) স্বদেশী আন্দোলনে ছাত্রসমাজের এই ব্যাপক অংশগ্রহণে আতঙ্কিত ইংরেজ সরকার ছাত্রদের দমন করার জন্য একের পর এক সার্কুলার জারি করে তাদের স্কুল কলেজ থেকে বহিষ্কার করে।
শুধু তাই নয়, স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের অনেককে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরা হয়। দেশপ্রেমী ছাত্রদের সভা সমাবেশে পুলিশি নির্যাতন চালানো হয়। তা সত্ত্বেও, ছাত্র সমাজ দ্বিগুন উৎসাহে স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে ছাত্ররাই স্বদেশী আন্দোলনকে বিপ্লবের পর্যায়ে টেনে নিয়ে যান।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই ছাত্রদের এই ব্যাপক অংশগ্রহণ, সরকারি স্কুল কলেজ থেকে তাদের বিতাড়ন, ইত্যাদি বিষয় গুলি জাতীয় নেতাদের মনকেও উদ্বেগে ভরিয়ে তোলে। তারা ঔপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার জন্য "জাতীয় শিক্ষা নীতি" ঘোষনা করেন। একের পর এক দেশীয় বা জাতীয় স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্রদের বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিতে চেষ্টা করলেন। তেমনই জাতীয় শিক্ষা নীতির মধ্য দিয়ে তারা জাতির স্বাধীন সত্তাকেও প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। স্বদেশী আন্দোলনে "জাতীয় শিক্ষা নীতি"র কর্মসূচি ও তার বাস্তবায়নের উদ্যোগটির মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, এই আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা কতটা ব্যাপক, সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।
(খ.)ছাত্রদের অংশগ্রহণের ধরন ও প্রকৃতি :-
স্বদেশী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের ধরন ও প্রকৃতির মধ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দিক লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
(১.) স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের মধ্যে স্কুল কলেজের ছাত্রদের সংখ্যাই ছিলো সর্বাধিক।
(২.) কোন সংগঠন ছাড়াই এই সময় ছাত্ররা সংঘবদ্ধ হয়েছিলো।
(৩.) এই সময়ে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের ভার ছিলো জাতীয় নেতাদের হাতে। মূলত জাতীয়তাবাদী নেতাদের ডাকে সাড়া দিয়েই এই সময় ছাত্ররা দলে দলে স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
(৪.) এই সময়কার ছাত্র আন্দোলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিলো ছাত্র আন্দোলনের ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র। হিন্দু মুসলিম ছাত্ররা একসঙ্গে স্বদেশী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলো।
(৫.) ইংরেজ বিরোধিতা এই সময়কার ছাত্র আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলো।
(৬.) "শ্রেনী" সচেতনতার বাইরে সম্পূর্ন জাতীয়তাবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই এই সময় ছাত্ররা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সামিল হয়।
(৭.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের যোগদান ছিলো মূলত বাংলাকেন্দ্রীক। বাংলার বাইরে ছাত্ররা তেমন ভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেয় নি।
(৮.) এই সময়ে ছাত্র আন্দোলনের রাশ ছিলো জাতীয় নেতাদের হাতে।
(গ.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকার বহুবিধ দিক :-
স্বদেশী আন্দোলনে বাংলার ছাত্রসমাজ যে ব্যাপকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে অংশগ্রহণ করে, তা ইতিপূর্বে আর কোন আন্দোলনে লক্ষ্য করা যায় নি। বস্তুতপক্ষে এর আগে বাংলার ছাত্রসমাজ কোনদিন জাতীয় আন্দোলনে এইভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে নি।
(১.) নেতৃত্ব :-
এই সময় ছাত্র আন্দোলনে যে সমস্ত জাতীয়তাবাদী নেতা নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঢাকার আনন্দচন্দ্র রায়, বরিশালের অশ্বিনীকুমার দত্ত, ফরিদপুরের অম্বিকাচরন মজুমদার, রংপুরের উমেশচন্দ্র গুপ্ত, রাজশাহীর কিশোরমোহন চৌধুরী, ময়মনসিংহের অনাথবন্ধু গুহ প্রমুখ।
তবে এই সময় ছাত্র যুবকদের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় ৩ ছাত্রনেতা ছিলেন - বিপিনচন্দ্র পাল, মৌলভী লিয়াকৎ হোসেন এবং ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল।
(২.) রাখিবন্ধন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ :-
ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেনে নিতে পারেন নি। কবির নির্দেশে বঙ্গভঙ্গ কার্যকরের দিনটিকে জাতীয় শোক ও প্রতিবাদের দিন হিসাবে পালন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক বিশাল জনসভায় বঙ্গভঙ্গ না মানার একটি প্রতিবাদপত্র পাঠ করেন।
বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে এবং ব্রিটিশ সরকারের ভেদ নীতি কে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৬ ই অক্টোবর অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের কার্যকরের দিনটিতে রাখিবন্ধনের ডাক দেন। ছাত্র সমাজ ১৬ ই অক্টোবর, রাখী পূর্নিমার দিনে রাস্তায় নেমে সকলের হাতে ঐক্যের প্রতীক "হলদে সুতোর রাখী" বেঁধে দেয় এবং ব্রিটিশ সরকারের ভেদ নীতিকে ব্যর্থ করে দেয়।
(৩.) বয়কট কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ :-
১৯০৫ খ্রিঃ ১৭ ই জুলাই কলকাতার রিপন কলেজের (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) এক সভায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ব্রিটিশ দ্রব্য বর্জন ও প্রতিষ্ঠান বয়কটের ডাক দেন। এই সভায় কলকাতার ছাত্রসমাজ ব্যাপক ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং বয়কটের শপথ নেয়।
১৯০৫ খ্রিঃ ৩১ জুলাই কলকাতার সব কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে "কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি" গঠন করা হয়। ১৯০৫ খ্রিঃ ৭ ই আগস্ট কলকাতার টাউন হলে এক ঐতিহাসিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় বয়কটের প্রস্তাব আনুষ্ঠানিক ভাবে পাশ হয়। এই সময় প্রায় ৫ হাজার ছাত্র কলেজ স্কোয়ারে সমবেত হয় এবং মিছিল করে টাউন হলের সভায় অংশগ্রহণ করে।
টাউন হলের সভায় স্বদেশী আন্দোলনের কর্মসূচি হিসাবে বয়কট এবং স্বদেশীর প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ছাত্রদের প্রচেষ্টায় "বয়কট" আন্দোলন এক প্রত্যক্ষ সংগ্রামের রূপ নেয়। এই সময় ছাত্ররা -
(ক.) বিদেশী কাগজ ও কলমে না লিখবার শপথ গ্রহণ করে।
(খ.) বিদেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জন করে।
(গ.) বিদেশী লবন, চিনি, কাপড়, মদ ও বিদেশী পন্যাগারের সামনে পিকেটিং করে।
(ঘ.) বিদেশী দ্রব্য সংগ্রহ করে প্রকাশ্যে তাতে অগ্নিসংযোগ করে।
কলকাতার ইডেন হোস্টেলের ছাত্ররা হোস্টেল প্রাঙ্গনে লর্ড কার্জনের কুশপুত্তলিকা দাহ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং বয়কটের শপথ নেয়। এই সময় বিশাল ছাত্র সভায় শ্রী হরিন্দ্রনাথ দত্ত বক্তৃতা করে ইংরেজদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কটের ডাক দেন।
সেই ডাকে সাড়া দিয়ে কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন জেলার ছাত্ররা স্কুল কলেজ বয়কট করতে এগিয়ে আসে। তারা বিভিন্ন পরীক্ষায় বসতে অসম্মতি জানায়। ধীরে ধীরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কটের আন্দোলন বাংলার বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে সর্বাত্মক রূপ নেয়। ১৯০৫ খ্রিঃ ২৫ শে অক্টোবর, "সন্ধ্যা" পত্রিকা থেকে জানা যায় প্রায় ১ হাজার ছাত্র সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কটে সামিল হয়েছিলো।
(৪.) স্বদেশী ভাবধারা প্রচার ও জনমত গঠন :-
ছাত্ররা শুধু স্কুল কলেজ বর্জন করেই ক্ষান্ত ছিলেন না। স্বদেশীর ভাবধারা প্রচারে এবং বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে জনমত সংগঠনের কাজেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
"সঞ্জীবনী", "বেঙ্গল" ইত্যাদি পত্রিকা থেকে জানা যায়, ছাত্রনেতা বিপিন চন্দ্র পাল, অশ্বিনীকুমার দত্ত, লিয়াকত হোসেন, আব্দুল রসুল প্রমুখের নেতৃত্বে ছাত্রসমাজ কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় "মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়, মাথায় তুলে নেরে ভাই", "বিধির বিধান কাটবে তুমি এমন শক্তিমান"," বাঙালির প্রান, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন এক হোউক হে ভগবান..." ইত্যাদি গান গেয়ে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ও স্বদেশীর স্বপক্ষে জনমত সংগঠিত করেন।
বাংলার বিশিষ্ট জননেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ছাত্রসমাজ ছিলো স্বদেশী আন্দোলনের" "স্বনিয়োজিত প্রচারক"। তার মতে, ছাত্রদের উদ্যোগেই স্বদেশী আন্দোলন বহুলাংশে সফলতা অর্জন করে। স্বদেশী আন্দোলনের শুরুতে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে" স্টুডেন্টস অ্যান্ড ইয়ং মেনস্ ইউনিয়ন" গঠিত হয়। এই ইউনিয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ (পরে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন)। স্বদেশী আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে ও সভা সমিতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এই ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
স্বদেশী দ্রব্যের প্রচারে এই সময় ছাত্ররাই সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ভূমিকা নেয়। বাংলার বিভিন্ন স্থানে ৭৫ টি বিক্রয় কেন্দ্র বা দোকানের মাধ্যমে ছাত্ররা বিদেশী পন্য সামগ্রী বিক্রয় করতো। এই সময় মাত্র ১১ মাসের মধ্যে কয়েক লক্ষ টাকার স্বদেশী কাপড় বিক্রি হয়।
(৫.)ছাত্রদের বিরুদ্ধে দমনমূলক সার্কুলার :-
স্বদেশী আন্দোলনকে ছাত্ররা যে ব্যপকতা প্রদান করে তা অচিরেই ব্রিটিশ সরকারকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। এইজন্য সরকার ছাত্রদের আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখবার জন্য একের পর এক দমন মূলক সার্কুলার জারি করে। যেমন -
(i.) কার্লাইল সার্কুলার :- ১৯০৫ খ্রিঃ ১০ ই অক্টোবর, বাংলা সরকারের শিক্ষা সচিব আর ডাবলিউ কার্লাইল "কার্লাইল সার্কুলার" জারি করে ঘোষনা করে, যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র রাজনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকবে তাদের সরকারি অনুমোদন বাতিল করে দেওয়া হবে। ছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কারও করা হবে। তাদের বৃত্তি এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুদানও বাতিল করে দেওয়া হবে।
(ii)পেডলার সার্কুলার :- কার্লাইল সার্কুলারের সূত্র ধরে ছাত্র আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য শিক্ষা অধিকর্তা পেডলার ১৯০৫ খ্রিঃ ২১ শে অক্টোবর এক সার্কুলার জারি করে কলকাতার কলেজ গুলির অধ্যক্ষদের পিকেটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রদের বহিষ্কারের অর্ডার দেন। এটি "পেডলার সার্কুলার" নামে পরিচিত ছিলো।
(iii) লায়ন সার্কুলার :- ঐ একই বছর অর্থাৎ ১৬ ই অক্টোবর ১৯০৫ খ্রিঃ আরেকটি অর্ডার জরি করা হয়। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গে স্বদেশী আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করলে সেখানে ছাত্র ও শিক্ষকদের দমন করার জন্য পি সি লায়ন ছাত্র ও শিক্ষকদের আচরন বিধি সংক্রান্ত এক নির্দেশিকা জারি করেন। এটি "লায়ন সার্কুলার" নামে পরিচিত ছিলো।
এই নির্দেশিকাকে ব্যবহার করে রংপুর, মাদারিপুর ও বরিশালে ছাত্রদের বিরুদ্ধে কঠোর দমনমূলক নীতি নেওয়া হয়।
(৬.) পাল্টা প্রতিবাদ ও অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি গঠন:-
কার্লাইল সার্কুলার ও তার আনুষঙ্গিক দমনমূলক সার্কুলার গুলি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী পর্বে ছাত্রদের আন্দোলন দমন করতে তো পারলোই না। উল্টে তাদের যোগদানকে আরোও বাড়িয়ে দেয়। কার্লাইল সার্কুলার সহ অন্যান্য সার্কুলার গুলিতে ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্রদের শিক্ষার ব্যবস্থা করবার জন্য এইসময় প্রতিষ্ঠিত হয় "অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি"।
(i.) প্রতিষ্ঠা :- বাংলা সরকারের কুখ্যাত কার্লাইল সার্কুলার বা ফতোয়া রাজের বিরুদ্ধে কলকাতার ছাত্র সমাজ গর্জে ওঠে। এইসময় সিটি কলেজের বি এ ক্লাসের ছাত্রনেতা শচীন্দ্রনাথ প্রসাদ বসুর নেতৃত্বে কার্লাইল সার্কুলারের বিপক্ষে গঠিত হয় "অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি"।
১৯০৫ খ্রিঃ ৪ নভেম্বর কলকাতা কলেজ স্কোয়ারে প্রায় ৩ হাজারের বেশি ছাত্রের সমাবেশে "অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি" গঠিত হয়। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, "অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি" ছিলো এদেশের প্রথম প্রকৃত "গন - ছাত্র সংগঠন"।
(ii.) সভাপতি, সম্পাদক ও কার্যালয় :- অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটির সভাপতি হন কৃষ্ণকুমার মিত্র। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট ব্রাহ্ম নেতা ও কলকাতা সিটি কলেজের অধ্যাপক। শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু এই প্রতিষ্ঠানটির সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। কৃষ্ণকুমার মিত্রের বাড়িতেই অ্যান্টি সার্কুলার সমিতির প্রধান কার্যালয় ছিলো।
(iii.) উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি :- "অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটির" প্রধান উদ্দেশ্য গুলি ছিলো -
(১.) কার্লাইল সার্কুলারে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত ছাত্রদের বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
(২.) বক্তৃতা, সঙ্গীত ও শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করা।
(৩.) বিদেশী পন্যাগারের (দোকান) সামনে পিকেটিং করা।
(৪.) শহরে ও গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বদেশী বস্ত্র ও পন্য বিক্রি করা।
এই সমিতির একটি বিভাগ গোপনে শরীরচর্চা ও লাঠিখেলার অনুশীলন চালাতো। এটি "ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন" নামে পরিচিত ছিলো। এই সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে অরবিন্দ ঘোষ ও সুকুমার মিত্র।
(iv.) স্বদেশী আন্দোলনে ভূমিকা :- অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি সারা বাংলার জন্যই কাজ করে। অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি স্বদেশী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণকে আরোও ব্যাপক ভাবে সূচিত ও সংগঠিত করে। এই সমিতির অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের জন্য তা ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
এই সময় উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে রংপুরে স্বদেশী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। সেখানে আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক বিরাট পরিমান ছাত্রকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। অ্যান্টি সার্কুলার নেতৃবৃন্দ রংপুরে যান এবং সেখানে বহিষ্কৃত ছাত্রদের বিকল্প শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করার জন্য রংপুরে প্রথম "জাতীয় বিদ্যালয়" গড়ে তোলেন।
এই সময় নোয়াখালির স্কুল কলেজ থেকে বহিষ্কৃত ছাত্ররা কলকাতায় সমবেত হলে সেখানেও আরেকটি জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে পূর্ববঙ্গের মধ্যে স্বদেশী আন্দোলন সবথেকে বেশি ব্যপকতা লাভ করেছিলো বরিশালে। সেখানে অশ্বিনী কুমার দত্ত ছাত্রদের সংগঠিত করে "স্বদেশ বান্ধব সমিতি" প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে তিনি ছাত্রদের নিয়ে গঠনমূলক স্বদেশীর প্রচার করেন।
(৭.) জাতীয় শিক্ষা নীতি গ্রহণ :-
"বিদেশী শিক্ষা এবং প্রতিষ্ঠান" দুই-ই ভারতের জাতীয়তাবাদের অন্তরায় ছিলো। এইজন্য এই সময় বাংলার বুদ্ধিজীবীরা বিদেশী শিক্ষা নীতির বিপরীতে" "জাতীয় শিক্ষা নীতি" নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন। এরই ফলশ্রুতিতে -
(i.) ১৯০৫ খ্রিঃ রঙপুরে সর্বপ্রথম জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।
(ii.) কার্লাইল সার্কুলারের প্রতিবাদে ও তার প্রত্যুত্তরে বিপিন চন্দ্র পাল এক সভায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব রাখেন।
(iii.) ১৯০৬ খ্রিঃ এক বিশাল জনসভায় সুবোধ চন্দ্র (বসু) মল্লিক জাতীয় শিক্ষার প্রসারে এক লক্ষ টাকা দান করেন।
(iv.) ১৯০৬ খ্রিঃ ১১ মার্চ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ৯২ জন সদস্য নিয়ে "জাতীয় শিক্ষা পরিষদ" গঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও হীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হন।
(v.) এই সময় ব্রিটিশ শিক্ষা নীতিকে তীব্র সমালোচনা করা হয়। এই শিক্ষা কেরানি তৈরি করে ভারতীয়দের গোলাম করে রাখতে চায়। এই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে "গোলদিঘির গোলামখানা" বলে আক্রমন করা হয়।
(vi.) জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে অরবিন্দ ঘোষকে অধ্যক্ষ করে "বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ" প্রতিষ্ঠিত হয়।
(vii.) ক্রমে ১৯০৮ খ্রিঃ মধ্যে সারা বাংলায় ৫০০ টি মাধ্যমিক ও ৩০০ টির বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ক্রমে জাতীয় শিক্ষার আদর্শ ভারতের অন্যান্য স্থানেও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বোম্বাই, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানে জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
(৮.) তীব্র অত্যাচার ও ছাত্র - পুলিশ সংঘর্ষ :-
১৯০৫ - ১৯০৮ পর্যন্ত সারা বাংলায় ছাত্রদের ওপর নির্মম অত্যাচার ও নিপীড়ন চলতে থাকে। ১৯০৬ খ্রিঃ ১৪ ও ১৫ ই এপ্রিল বরিশালে ব্যারিস্টার আব্দুল রসুলের সভাপতিত্বে এক রাজনৈতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে পুলিশ উস্কানি দিলে এক বিরাট ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সারা বাংলায় এই সময় প্রায় ১০,০০০ অধিক ছাত্র বিভিন্ন ভাবে শাস্তির সম্মুখীন হয়। এতদসত্ত্বেও তারা আন্দোলন থেকে পিছু হটে নি।
(৯.) জাতীয় পতাকা নির্মান :-
স্বদেশী আন্দোলনে ছাত্রসমাজ অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের নজির স্থাপন করেন১৯০৬ - ০৭ খ্রিঃ বয়কট আন্দোলনের সময় বাংলার ছাত্ররা নিজেরাই একটি জাতীয় পতাকা তৈরি করে তা এক সমাবেশে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেন। ছাত্ররাই এই পতাকাটির পরিকল্পনা করেছিলো।
এই পতাকাটির ৩ টি রং ছিলো - লাল, সবুজ ও হলুদ। এতে আঁকা ছিলো ৮ টি আধ ফোটা পদ্মফুল - যা তৎকালীন ভারতের ৮ টি প্রদেশের প্রতীক ছিলো। হিন্দু মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হিসাবে পতাকার গায়ে আঁকা হয়েছিলো সূর্য ও একফালি চাঁদ।
(১০.) গুরুত্ব :-
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের একাধিক গুরুত্বের দিক ছিলো। যথা -
(i.) স্বদেশী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ স্বদেশী আন্দোলনকে সফল ও তীব্র করে তুলতে সাহায্য করেছিলো।
(ii.) এর ফলে ছাত্রদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীকালে ছাত্র যুবদের একাংশ কংগ্রেসি আন্দোলনের দ্বিচারিতা ও বয়কটের প্রশ্নে মতপার্থক্যে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে বিপ্লবী আন্দোলনে ঝুঁকে পড়ে।
(iii) এরই পরিনামে স্বদেশী আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের জন্ম হয়। এই সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্র সমাজ ব্যপক ভাবে অংশগ্রহণ করে।
(iv.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বাংলার ছাত্রসমাজ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত এবং আদর্শ স্থাপন করেন তা ছিলো অনন্য। যারা ছাত্র, তাদের ত্যাগ করার মতো তেমন কিছুই হয়তো ছিলো না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ছিলো তাদের কাছে সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। তারা সেটাই ত্যাগ করে চরম আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলো।
(১১.) ছাত্রদের অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতা :-
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিলো। যেমন -
(i.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের যোগদান বাংলা দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।
(ii.) বাংলার বাইরে ছাত্ররা তেমন ভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেয় নি।
(iii.) এই সময় ছাত্রদের সংগঠিত করতে কোন ছাত্র সংগঠনও গড়ে ওঠে নি।
(iv.) নেতৃত্বের রাশ ছিলো সম্পূর্ণ ভাবে জাতীয় নেতাদের হাতে।