ইংরেজি "Proto History" শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হলো "প্রায় ইতিহাস"। প্রত্নতাত্ত্বিক পরিভাষায় প্রাক্ ইতিহাস ও ইতিহাসের মধ্যবর্তী সময়কালকে বলে প্রায় ইতিহাস। প্রায় ইতিহাসকে "আধা ইতিহাস" বা "আদি ইতিহাসও" বলা হয়ে থাকে।
প্রায় ঐতিহাসিক যুগ |
(১.) সংজ্ঞা ও ধারনা :-
১৮৩০ এর দশকে ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ পল তুর্নাল লিখিত উপাদান প্রাপ্তির ভিত্তিতে মানব সভ্যতার ইতিহাসকে "প্রাক্ ইতিহাস" এবং "ইতিহাস" এই দুটি পর্বে ভাগ করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই বিভাজন নিয়ে নানা গবেষণা ও মতামত উঠে আসে। এই গবেষণায় এমন কিছু সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়, যে সভ্যতা গুলিতে লিখিত উপাদান পাওয়া গিয়েছিলো, কিন্তু পাঠোদ্ধার করা যায় নি। এমতাবস্থায় ঐ সমস্ত সভ্যতা গুলিকে প্রাক্ ইতিহাস না ইতিহাস কোন পর্যায়ে ফেলা হবে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি ও সমস্যা দেখা যায়।
১৯৫১ খ্রিঃ ঐতিহাসিক ক্রিস্টোফার হকার প্রথম বিশ্ব প্রাগৈতিহাসিক সম্মেলনে এই সমস্যার কথা তুলে ধরে প্রথম প্রায় ইতিহাস শব্দটির প্রয়োগ করেন। এরপর থেকেই এই শব্দটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
প্রায় ইতিহাসের সংজ্ঞা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতে দুটি মত লক্ষ্য করা যায়।
(১.) একদল ঐতিহাসিকদের মতে -
যে সময়ে লিখিত উপাদান পাওয়া গেছে কিন্তু তা পাঠোদ্ধার করা যায় নি, সেই সময়কালের ইতিহাসকেই সাধারনত" প্রায় ইতিহাস" বলা হয়।
(২.) আরেকদল ঐতিহাসিকদের মতে -
ধাতুর ব্যবহারের সূচনাকাল থেকে অর্থাৎ তামা ও ব্রোঞ্জের ব্যবহারের সময়কাল থেকে লৌহযুগ পর্যন্ত সময়কালকেই সাধারনত "প্রায় ঐতিহাসিক যুগ" বলা যায়।
(২.) প্রায় ইতিহাস যুগের উদাহরন :-
ভারতের ক্ষেত্রে প্রায় ঐতিহাসিক যুগের সভ্যতার উদাহরন হল হরপ্পা সভ্যতা। হরপ্পা সভ্যতায় অনেক গুলি সিলমোহর পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু আজও সেগুলির পাঠোদ্ধার করা যায় নি। যদি কোনদিন ঐ সমস্ত সিলমোহর গুলি পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়, তখন এই সভ্যতা আর প্রায় ঐতিহাসিক পর্বের অন্তর্গত থাকবে না। তা ঐতিহাসিক পর্বের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
ভারতের হরপ্পা সভ্যতা ছাড়াও ঐতিহাসিকরা আর যেসকল সভ্যতাকে প্রায় ইতিহাস পর্যায়ের বলে চিহ্নিত করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো - কোর্ট, হুন, কোফাল, ম্যাগিয়ার, পার্থিব, স্লাভ, থ্রেসীয় ইত্যাদি সভ্যতা। হরপ্পা সভ্যতার মতো এইসব সভ্যতাতেও লিখিত উপাদান পাওয়া গিয়েছিলো, কিন্তু আজও সেগুলির পাঠোদ্ধার করা যায় নি।
(৩.) প্রায় ইতিহাস যুগের সময়কাল :-
প্রায় ইতিহাস যুগের সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। মোটামুটি ভাবে বলা যায়, খ্রিঃ পূর্ব পাঁচ হাজার বছর থেকে একহাজার দুইশত খ্রিঃ পূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কাল প্রায় ইতিহাস পর্বের অন্তর্গত।
ভারতের ক্ষেত্রে তাম্র - ব্রোঞ্জ যুগের সূচনাকাল থেকে লৌহ যুগের সূচনাকাল পর্যন্ত সময়কালের ইতিহাস "প্রায় - ঐতিহাসিক" পর্যায়ের অন্তর্গত।
(৪.) প্রায় ইতিহাস রচনার উপাদান :-
প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতোই প্রায় ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার প্রধান উপাদান হলো বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। মাথায় রাখতে হবে, প্রায় ঐতিহাসিক যুগে লিখিত উপাদান পাওয়া গেলেও, সেগুলির পাঠোদ্ধার করা যায় নি। এমতাবস্থায়, লিখিত উপাদান থেকে প্রায় ঐতিহাসিক যুগের সম্পর্কে কোন তথ্যই পাওয়া যায় না।
উদাহরন হিসাবে বলা যায়, হরপ্পা সভ্যতায় অনেক গুলি সিলমোহর পাওয়া গেলেও, সেগুলির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ভিত্তিতেই হরপ্পা সভ্যতার ইতিহাস লেখা হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতোই বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ, মাটির পাত্র, অলংকার ও খেলনা, মুদ্রা, জীবাস্ম প্রায় ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার প্রধান উপাদান বলে বিবেচিত হয়।
(৫.) প্রায় ইতিহাস যুগের বৈশিষ্ট্য :-
প্রায় ইতিহাস যুগের মূল বৈশিষ্ট্য গুলি হলো -
(১.) "প্রায় - ইতিহাস যুগ" প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক যুগের মধ্যবর্তী সময়কাল বা অবস্থা।
(২.) এই সময়কালে লিখিত উপাদান পাওয়া গিয়েছিলো।
(৩.) কিন্তু লিখিত বিষয়ের হরফ না জানার কারনে আজও প্রায় ঐতিহাসিক যুগের লিপিগুলির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয় নি।
(৪.) প্রায় ঐতিহাসিক যুগ হলো প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ঐতিহাসিক যুগে উত্তরনের বিবর্তন কাল।
(৫.) প্রায় ঐতিহাসিক যুগের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ধাতুর ব্যবহার। অর্থাৎ প্রায় ঐতিহাসিক যুগের মানুষ প্রস্তর বা পাথরের ব্যবহারের পাশাপাশি ধাতুর ব্যবহারও করতো। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, সাধারনত ব্রোঞ্জ যুগের শেষে বা লৌহ যুগের সভ্যতা গুলিতেই লিপির প্রথম উদ্ভাবন ঘটেছিলো।
(৬.) প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ সাধারনত যাযাবর ছিলো। তাদের জীবনযাত্রার মানও উন্নত ছিলো না। কিন্তু প্রায় ঐতিহাসিক যুগের মানুষ জীবন যাত্রার মানের দিক থেকে অনেক উন্নত ছিলো। এমনকি তারা উন্নত সভ্যতারও জন্ম দিয়েছিলো। উদাহরন হিসাবে হরপ্পা সভ্যতার কথা বলা যায়।
(৬.) প্রায় ইতিহাস যুগের গুরুত্ব :-
প্রাচীন যুগের ইতিহাস চর্চায় প্রায় ইতিহাস পর্বের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা -
(১.) প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে কিভাবে বিবর্তনের ফলে মানুষ উন্নত সভ্যতার স্তরে পৌঁছাতে পেরেছিলো, সেই ইতিহাস "প্রায় ইতিহাস" পর্বথেকে জানতে পারা যায়।
(২.) লিখন বিদ্যা সামাজিক স্বাক্ষরতা ও অগ্রগতির স্মারক। প্রায় ইতিহাস পর্বের সঠিক বিশ্লেষনের মাধ্যমে ঐতিহাসিকরা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানব সভ্যতার ধারাবাহিক অগ্রগতির দিক গুলিকে দেখাতে পারেন।
(৭.) প্রায় ইতিহাস সম্পর্কে বিতর্ক ও সমালোচনা :-
প্রায় ইতিহাস পর্বের নামকরন ও বিভাজন নিয়ে সাম্প্রতিক কালে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা মতপার্থক্য ও সমালোচনা দেখা যায়।
লিপি জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রায় ইতিহাস পর্বের বিভাজনকে অনেক ঐতিহাসিকই বিশেষত, ভারতীয় ঐতিহাসিকরা মেনে নিতে চান নি। তাদের মত হলো, শুধুমাত্র লিপি জ্ঞানের সরলতার ভিত্তিতে প্রায় ইতিহাস যুগকে চিহ্নিত করা যায় না। যেমন - ভারতে আর্যরা কোন লিপি জ্ঞান ছাড়ই বিপুল ও বিস্তৃত বৈদিক সাহিত্য রচনা করেছিলো। তারা লিখতে জানতো না অথচ তাদের সভ্যতাকে কখনই "প্রায় ইতিহাস" যুগের সভ্যতা বলা যায় না।
তাই ভারতে লিপি জ্ঞানের ভিত্তিতে "Proto - History" যুগকে Identity করা খুবই কঠিন। এই শ্রেণীর ঐতিহাসিকরা তাই প্রায় ইতিহাস যুগ বিভাজনের ক্ষেত্রে লিপির বদলে ধাতুর ব্যবহারকে বেছে নিয়েছেন। এদের মতে, ভারতে ধাতুর বিশেষত, তামা বা ব্রোঞ্চ ধাতু ব্যবহারের সময়কাল থেকে লৌহযুগ পর্যন্ত সময়কালকেই "প্রায় ইতিহাস যুগ" বলা যথার্থ হবে।
তবে ধাতুর ব্যবহার নিয়েও বিতর্ক আছে। কারন ভারতে সব জায়গায় একই সময়ে বা একই নিয়মে ধাতুর ব্যবহার হয় নি। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, উত্তর ভারতে পাথরের যুগের পর তামা এবং লোহার ব্যবহার যথাক্রমে শুরু হলেও, দক্ষিণ ভারতে পাথরের যুগের পরেই লৌহ যুগের সূচনা হয়। অর্থাৎ সেখানে তাম্র যুগের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় নি। তাই ধাতুর ব্যবহারের ভিত্তিতেও ভারতে "প্রায় ইতিহাস" যুগকে চিহ্নিত করা যথেষ্ট জটিল এবং বিতর্কিত।
প্রায় ইতিহাস যুগ চিহ্নিত করনের এই জটিলতা ও সমস্যার কারনে অনেক ঐতিহাসিক বলেছেন, লিখন পদ্ধতি আবিষ্কারের আগের যুগটিকে "প্রাক্ ইতিহাস যুগ" না বলে "প্রাক্ লিখন যুগ" বললে অনেক উপযুক্ত ও যুক্তিযুক্ত হতো। কারন সভ্যতার অগ্রগতি মানুষের চিন্তা ভাবনার অগ্রগতির হাত ধরে আসে। আর লিখন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে মানুষ তার চিন্তা ভাবনাকে সুসংবদ্ধ করে, বা নথিবদ্ধ করে। চিন্তাশক্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তিই মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে পৃথক ও উন্নত করেছিলো। এই দুই শক্তির হাত ধরেই মানুষ সভ্য ও উন্নত হয়ে উঠেছিলো। গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সভ্যতা আর কিছুই নয়, মানুষের উন্নত চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির স্মারক।
তাই লিপির উদ্ভাবন ও ব্যাবহারের দিক থেকে "প্রাক্ ইতিহাস" বা "প্রায় ইতিহাস" যুগ বিভাজনের বদলে ইতিহাসের প্রাচীন যুগকে যদি "প্রাক্ লিখন যুগ" এবং "লিখন যুগ" এই দুই ভাগে বিভাজন করা হতো, তাহলে তা অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহনযোগ্য হতো।