ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা

ভারতে গান্ধীজির ডাকা সর্বশেষ গন আন্দোলনটির নাম ছিলো "ভারত ছাড়ো আন্দোলন" বা "Quit India Movement"। ১৯৪২ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার পর সারা দেশে প্রবল ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সেই পটভূমিতেই ১৯৪২ খ্রিঃ ১৪ ই জুলাই মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধায় জাতীয় কংগ্রেসের ওয়াকিং কমিটির বৈঠক বসে।

এই বৈঠকেই প্রথম ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই বৈঠকের একমাস পর ১৯৪২ খ্রিঃ ৮ ই আগস্ট, বোম্বাইয়ে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে "ভারত ছাড়ো" আন্দোলনের প্রস্তাব পাশ হয়। এই সময় গান্ধীজি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের শ্লোগান দেন - "DO or Die" অর্থাৎ "করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে"। হয় আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করবো, না হলে স্বাধীনতা অর্জনের মহৎ প্রচেষ্টায় মৃত্যুবরন করবো। "ইংরাজ তুম ভারত ছোড়ো..।"

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব যখন নেওয়া হয়, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিলো। ১৯৩৯ খ্রিঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিলোব্রিটেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতকে না জানিয়েই যুদ্ধে জড়িয়ে নিয়েছিলো। সেইজন্য ভারতীয়দের মধ্যে ক্ষোভ চরমে উঠেছিলো। যুদ্ধ নিয়ে ব্রিটেন এমনিতেই বিব্রত ছিলো। এমতাবস্থায় ব্রিটেন কোনমতেই চায়নি কংগ্রেস এই সময় কোন গন আন্দোলন সংগঠিত করে নতুন করে ঝামেলা পাকাক।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব তাই যেদিন গ্রহন করা হলো, সেদিনই অর্থাৎ ১৯৪২ সালের ৮ ই আগস্টের রাতে কংগ্রেসের সমস্ত প্রথম শ্রেণীর নেতাদের গ্রেপ্তার করে নেওয়া হয়। আন্দোলনকে সমূলে বিনাষ করার জন্য সরকার প্রাদেশিক গভর্নরদের কাছেও কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ পাঠায়

নেতাদের গ্রেপ্তারের সংবাদ সংবাদমাধ্যমে ও জনগনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ৯ ই আগস্ট, ১৯৪২ সালে সকাল থেকেই ভারতে শুরু হয়ে যায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন। জনগন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বিক্ষোভ, শোভাযাত্রা, মিটিং, মিছিল, সরকারী ভবন ও সম্পত্তি আক্রমণের মধ্য দিয়ে আন্দোলন শুরু করে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা 

(১.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও উল্লেখযোগ্য দিক :-

১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা -
  • (ক.) এই আন্দোলন ছিলো সম্পূর্ণ নেতৃত্বহীন
  • (খ.) শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনের পিছুনে কংগ্রেস নেতৃত্বের কোন নিয়ন্ত্রন ছিলো না
  • (গ.) জনগন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন
  • (ঘ.) আন্দোলন সব সময় অহিংস ছিলো না। বেশিরভাগ সময়ে এবং বেশিরভাগ স্থানেই আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠেছিলো।
  • (ঙ.) আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠলেও গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলনের মতো কোন হিংসার অজুহাতে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন নি
  • (চ.) আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে জনগন ও সাধারন কংগ্রেস কর্মীদের মধ্য থেকেই এই আন্দোলনের নেতৃত্ব উঠে এসেছিলো।

(২.)  ছাত্রসমাজের প্রতি গান্ধীজির ডাক :-

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সমাজের প্রায় সমস্ত শ্রেনী ও সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করেছিলো। এইসব শ্রেনী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে ছাত্রদের ভূমিকা ছিলো অনন্য

 পৃথিবীর যেকোন দেশেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকে ছাত্রসমাজ। মনে রাখতে হবে, জাতীয়তাবাদ সম্পূর্নই একটি ভাবগত ও আবেগের বিষয়। প্রচলিত সমাজে ছাত্রদের মন সমাজের অন্যান্য শ্রেনী ও সম্প্রদায় থেকে অনেক বেশি আবেগপ্রবন হয়ে থাকে। ফলে সমাজের অন্যান্য শ্রেনী অপেক্ষা তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও মননও অনেক প্রখর হয়ে থাকে। সম্ভবত এই কারনেই পৃথিবীর সকল জাতীয়তাবাদী যুদ্ধেই ছাত্রসমাজ অগ্রগামী ও প্রধান সেনানীর ভূমিকা পালন করে থাকে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম ছিলো না।

গান্ধীজি ছিলেন একজন দক্ষ মার্স লিডার। ভারতীয় জনগনের নাড়ির স্পন্দন তিনি খুব ভালো করেই বুঝতেন। ছাত্রসমাজের আবেগপূর্ন, নির্ভিক, লড়াকু মানসিকতার বিষয়টিও তাঁর অজানা ছিলো না। সম্ভবত এই কারনেই তিনি ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্র সমাজের প্রতি এক স্বতন্ত্র আহ্বানের আবেদন রাখেন

বোম্বাই অধিবেশনে গান্ধীজি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন - "তোমরা যদি স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত সংগ্রামে অবিচল থাকতে পারবে বিশ্বাস করো, তাহলে স্কুল কলেজ বর্জন করে আপাতত তোমাদের লেখাপড়া বন্ধ রেখে এই চূড়ান্ত সংগ্রামে অংশগ্রহণে প্রস্তুত হও।"

গান্ধীজির এই আহ্বানে দলে দলে ছাত্র সমাজ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল হয়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাদের যোগদানের সংখ্যা আগেকার সমস্ত পরিসংখ্যানকে ছাপিয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। প্রকৃতপক্ষে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে তার চূড়ান্ত সংগ্রামশীলতার জায়গায় পৌঁছে দেয় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্রসমাজ।

(৩.) ছাত্রদের অংশগ্রহণের ধরন ও প্রকৃতি :-

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের ধরন ও প্রকৃতির মধ্যে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। 
যেমন -

(১.) এই সময় ছাত্রদের অংশগ্রহণের মূল ও প্রধান নেতৃত্ব কমিউনিস্ট ছাত্র সংগঠন, ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং গান্ধীজির অনুগামীদের হাতেই ছিলো।

(২.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কংগ্রেস ও তার সশস্ত্র শাখা সংগঠন, কমিউনিস্ট পার্টি ও তার প্রভাবিত ছাত্র সংগঠন গুলি এবং কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত ছাত্র ফেডারেশন বেআইনি ঘোষিত হলেও, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ঐ সমস্ত বেআইনি সংগঠন গুলি অন্তরালে বা গোপনে ছাত্রদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

(৩.) জাতীয় কংগ্রেসের প্রধান নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হওয়ায় এই সময় নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠন, ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং মধ্যমস্তরের কংগ্রেস নেতারাই এই সময় ছাত্র আন্দোলন পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন।

(৪.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ব্যাপকতা আগেকার সমস্ত আন্দোলন থেকে অনেক বেশি ছিলো। কোন কোন ক্ষেত্রে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তারাই মূল নেতৃত্বের জায়গায় ছিলেন। যেমন ঊড়িষ্যায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সেখানকার সরকারি রেকর্ডে পুরোপুরি "ছাত্র বিদ্রোহ" বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো। ঊড়িষ্যা ছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশ, মাদ্রাজ, কেরালা, মহীশূরের ব্যাঙ্গালোর, কালিকট প্রভৃতি জায়গায় ছাত্রদের নেতৃত্বেই মূলত আন্দোলন চলেছিলো।

(৫.) বিভিন্ন বয়সের ছাত্ররা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও, অল্পবয়সী ছাত্রদের যোগদান ছিলো চোখে পড়ার মতো। ঐতিহাসিক সুমিত সরকার দেখিয়েছেন, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রথম পর্বে স্কুল কলেজের ছাত্রদের যোগদান ছিলো চোখে পড়ার মতো। তাঁর মতে, আগেকার আন্দোলন গুলি থেকেও ৪২ এর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের গড় বয়স ছিলো অনেক কম।

(৬.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ছাত্র আন্দোলনের আরেকটি লক্ষ্যনীয় দিক ছিলো ছাত্রীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। বহু ছাত্রী এই সময় ছাত্র আন্দোলনে সামিল হয়।

(৭.) ব্রিটিশ ভারত ছাড়াও স্বাধীন দেশীয় রাজ্য গুলির ছাত্ররাও এই সময় ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল হয়েছিলো।

(৮.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় এবং সমস্ত ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ থাকায় ছাত্র আন্দোলন শেষপর্যন্ত গন আন্দোলনে মিশে যায়। অনেক সময় আবার কোন কোন জায়গায় ছাত্র আন্দোলন থেকেই গন আন্দোলনের জন্ম হয়।

(৯.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ছাত্র আন্দোলনের প্রধান ধরন গুলি ছিলো -
  • (ক.) স্কুল কলেজ বর্জন ও ধর্মঘট,
  • (খ.) শোভাযাত্রা করে প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত করা
  • (গ.) সরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা,
  • (ঘ.) বিক্ষোভ সভার আয়োজন করে আন্দোলনের প্রচার ও জনমত সংগঠিত করা,
  • (ঙ.) গ্রামাঞ্চলে আন্দোলনের স্বপক্ষে কৃষকদের সংগঠিত করা,
  • (চ.) আন্দোলন পরিচালনার জন্য গোপন কেন্দ্র গুলির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করা
  • (ছ.) রেল লাইন উপড়ে ফেলা, টেলিগ্রাফ ধ্বংস করা, সরকারি ভবন ও থানায় অগ্নিসংযোগের মতো নাশকতামূলক কাজ গুলি পরিচালনা করা।

(৪.) ছাত্রদের ভূমিকা সম্পর্কে সমকালীন নেতৃত্ব ও ঐতিহাসিকদের মত :-

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদানের কথা তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্ব, সরকারি তথ্যপ্রমান ও রেকর্ডস এবং আধুনিক ঐতিহাসিকদের সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলনের বিশ্লেষন করতে গিয়ে নেহেরু বলেছেন, "সমগ্র ভারতের যুবসমাজ বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সহিংস ও অহিংস আন্দোলন, দুই দিকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।"

 বিপানচন্দ্র ছাত্রদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন, "ছাত্ররা কাজ করতো বার্তাবহ হিসাবে"। কারন ছাত্ররাই মূলত গ্রামে গঞ্জে ঘুরে আন্দোলনের স্বপক্ষে সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করেছিলো।

ঐতিহাসিক সুমিত সরকার ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সহিংস আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে ছাত্রদের ভূমিকা সবথেকে বেশি ছিলো বলে মনে করেছেন। মোটকথা, তৎকালীন জাতীয় নেতৃত্ব ও ঐতিহাসিকবৃন্দ সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন, ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সংগঠিত ও পরিচালিত করতে ছাত্র সমাজ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।

(৫.) ছাত্রদের ভূমিকার বহুবিধ দিক :-

ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিলো ভারতের নেতৃত্বহীন বিশাল জনতার এক স্বতঃস্ফূর্ত গন আন্দোলন। এই বিশাল জনতারই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বা পার্ট ছিলো ছাত্র সমাজ। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সর্বশক্তি নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো এবং এক অতি গৌরবোজ্জল ভূমিকা পালন করেছিলো।

(৬.) ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও কেন্দ্র :-

ভারত ছাড়ো আন্দোলন যেখানেই সংগঠিত হয়েছিলো, সেখানেই ছাত্রসমাজ অংশগ্রহণ করেছিলো। তবে যে সমস্ত স্থানে তাদের অংশগ্রহণ বিশেষ ও ব্যাপক ছিলো তার মধ্যে অন্যতম ছিলো - 
(i.) বোম্বাই,
(ii.) দিল্লি
(iii.) উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদ, বারানসী, কানপুর, লক্ষ্মৌ, আজমগড়, বলিয়া, গোরখপুর, 
(iv.) বিহারের পাটনা, গয়া, ভাগলপুর, সারন পুর্নিয়া, মুঙ্গের, সাহাবাদ, মুজাফফরপুর, চম্পারন,
(v.) ঊড়িষ্যা
(vi.) বাংলার কলকাতা, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া,
(vii.)  দক্ষিণ ভারতের গোদাবরী ও গন্টুর জেলা,
 ত্রিচিনোপল্লী, মাদুরাই, কালিকট, কেরালা, ব্যাঙ্গালোর।
(viii.) সিন্ধু প্রদেশ

(i.) বোম্বাইয়ে ছাত্র আন্দোলন :-

১৯৪২ খ্রিঃ ৮ ই আগস্ট জাতীয় কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনের পর কংগ্রেসের প্রথম সারির সব নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার করার প্রতিবাদে ৯ ই আগস্ট বোম্বাইয়ের গোয়ালিয়া ময়দানে এবং পরে শিবাজী পার্কে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় অরুনা আসফ আলির সভাপতিত্বে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশের মূল নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিলেন ছাত্রসমাজ। 

বোম্বাইয়ে ছাত্র ধর্মঘট ও শোভাযাত্রার প্রথম দিনেই পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাত্র নেতা উমাভাই কাদিয়া

(ii.) দিল্লিতে ছাত্র আন্দোলন :- 

দিল্লিতে বিশাল জনতা, যার বেশিরভাগই ছিলো ছাত্র, তারা শোভাযাত্রা করে বড়োলাটের বাড়ির সামনে উপস্থিত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। ইংরেজ সৈন্যরা শোভাযাত্রীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে ক্রুদ্ধ ছাত্র - জনতা দিল্লির সরকারী অফিস, পোষ্ট অফিস ও রেল লাইন অবরোধ ও আক্রমণ করে তছনছ করে দেয়। দিল্লির ছাত্ররা স্কুল কলেজ বয়কট করে আন্দোলনে সামিল হয়। 

(iii.) বাংলায় ছাত্র আন্দোলন :- 

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিলো বাংলা। বাংলার প্রায় সর্বত্রই আন্দোলনে ছাত্রসমাজ অংশগ্রহণ করেছিলো।

(ক.) কলকাতায় ছাত্র আন্দোলন :- 

কলকাতার প্রতিটি স্কুল কলেজে ধর্মঘট শুরু হয়। ছাত্রদের সভা ও শোভাযাত্রায় কলকাতা সহ সারা বাংলা উত্তাল হয়ে ওঠে। কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। ১৯৪২ খ্রিঃ ১৩ ই আগস্ট কলকাতায় পুলিশ ছাত্রদের শোভাযাত্রার ওপর বর্বর আক্রমন চালায়। এর একদিন পর ১৫ ই আগস্ট ঢাকার ছাত্র ধর্মঘটীদের শোভাযাত্রার ওপর পুলিশ গুলি চালালে ৫ জন ছাত্র নিহত হন। এর প্রতিবাদে পরেরদিন অর্থাৎ ১৬ ই আগস্ট সারা বাংলায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। 

সরকারি দমন নীতির প্রতিবাদে ১৮ ই আগস্ট থেকে ৩০ শে আগস্ট বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র গুলি সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ রাখে। ৩১ শে আগস্ট প্রকাশিত সংবাদপত্র গুলির তথ্য থেকে জানা যায় বাংলাদেশের সমস্ত জেলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে ও সরকারি তীব্র দমন নীতির প্রতিবাদে ছাত্ররা একটানা ধর্মঘট চালিয়ে গেছে এবং সেই ধর্মঘট এখনও চলছে। 

কলকাতার ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্ররা অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছিলো। কলকাতার ছাত্ররা ক্লাস বয়কট করেমিটিং, মিছিল, পথসভা ও পথ অবরোধের মাধ্যমে আন্দোলনের সূচনা করেন। তারা ট্রাম, রেললাইন, পোস্ট অফিস ও থানাতে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। 

(খ.) কলকাতার বাইরে ছাত্র আন্দোলন :- 

কলকাতার ছাত্র বিক্ষোভ ধীরে ধীরে বাংলার অন্যান্য জেলাগুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছিলো। কলকাতার বাইরে ছাত্র বিক্ষোভ সবচেয়ে বেশি তীব্র হয়ে উঠেছিলো মেদিনীপুরে। 

পুরুলিয়া 

তবে মেদিনীপুরের অনেক আগেই পুরুলিয়া জেলায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিলো। পুরুলিয়া জেলার মূল সদর শহর পুরুলিয়া বাজারে ছাত্ররা মিছিল ও সভা সমাবেশ কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলো। এখানে ছাত্ররা জনতার সঙ্গে অংশ নিয়ে সরকারি দপ্তরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার চেষ্টা করেন। সুযোগ পেলেই এরকম প্রচেষ্টা তারা বারংবার করতেন। 

বাঁকুড়া 

পুরুলিয়ার পার্শ্ববর্তী জেলা বাঁকুড়া আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেও, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নিস্প্রভ ছিলো। এখানে ভারত ছাড়ো আন্দোলন একমাত্র ছাত্রদের উদ্যোগেই সংগঠিত হতে পেরেছিলো

 ১৯৪২ খ্রিঃ ১৪ ই সেপ্টেম্বর, বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ান কলেজ, বর্তমান খ্রিষ্টান কলেজে ও ছাত্রাবাসে ছাত্ররা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। ১৪ ই সেপ্টেম্বর অমরকানন বিদ্যালয়ের ছাত্ররা, ২৭ শে সেপ্টেম্বর তিলুড়ি স্কুলের ছাত্ররা এবং ২৯ শে সেপ্টেম্বর বিষ্ণুপুর স্কুলের ছাত্ররা ধর্মঘট করে। তারা ডাকঘর পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ওন্দা ও রামসাগরের মধ্যে রেল লাইন উপড়ে ফেলার চেষ্টা চালায়। 

মোটকথা, বাঁকুড়া জেলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন যেটুকু ছড়িয়ে পড়তে বা সংগঠিত হতে পেরেছিলো, তা একান্তভাবে ছাত্রদের জন্যই হতে পেরেছিলো। এখান থেকেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের অসামান্য গুরুত্বের দিকটি বুঝে নেওয়া যেতে পারে। বাঁকুড়ার মতো ভারতবর্ষের এমন অনেক স্থান ছিলো যেখানে একমাত্র ছাত্রদের অংশগ্রহণের ফলেই ভারত ছাড়ো আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে পেরেছিলো। 

মেদিনীপুর 

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ছাত্র আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছিলো মেদিনীপুর জেলায়। মেদিনীপুরের ছাত্ররা স্কুল কলেজ বর্জন করে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। মেদিনীপুরের সুতা আটা, মহিষাদলে পুলিশের গুলিতে নিহত ছাত্রদের অনেকেরই বয়স ছিলো অল্প। ১৯৪২ খ্রিঃ ১৭ ই ডিসেম্বর তমলুকে স্বাধীন জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করেন। ছাত্র যুব নেতা সুশীল ধারার নেতৃত্বে জাতীয় সরকারের "বিদ্যুৎ বাহিনী" নামে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠেছিলো। এই বাহিনীতে ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলো।

(iv.) বিহারে ছাত্র আন্দোলন :- 

১৯৪২ খ্রিঃ ১১ ই আগস্ট, বিহারের পাটনা শহরে ছাত্ররা সচিবালয়ের উদ্দেশ্যে এক বিশাল মিছিল সংগঠিত করে এবং বিধানসভা ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের চেষ্টা করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষ হয় এবং এই সময় সামরিক বাহিনীর গুলিতে ৭ জন ছাত্র নিহত হয় ও বহু মানুষ আহত হয়। এই ঘটনার পর অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। 

ছাত্র আন্দোলন এর ফলে গন আন্দোলনের রূপ নেয়। ছাত্ররা উন্মত্ত জনতার সঙ্গে সরকারি ভবন, ডাকঘর ও রেলস্টেশনে অগ্নিসংযোগ করে। এর ফলে পুরো পাটনা শহর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। 

ধীরে ধীরে পাটনা শহর থেকে ছাত্র আন্দোলন দাবানলের আগুনের মতো বিহারের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। 

(v.) উত্তরপ্রদেশে ছাত্র আন্দোলন :- 

উত্তরপ্রদেশে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে তীব্র করে তুলেছিলো ছাত্র আন্দোলন। বারানসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা ট্রেন ছিনতাই করে তাতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। তারা আজাদ (মুক্ত) ট্রেনে চড়ে উত্তরপ্রদেশের গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে জেলার কৃষকদের আন্দোলনের স্বপক্ষে কৃষকদের সংগঠিত করে। 

এইসময় হাজার হাজার ছাত্র রেলস্টেশন আক্রমণ করে ও লুঠপাট চালায়। তাদের শ্লোগান ছিলো - "থানা জ্বালাও, রেল স্টেশন জ্বালিয়ে দাও - ইংরেজরা ভয় পাচ্ছে। 

১০ ই আগস্ট ছাত্ররা বিলথারা রোডে সামরিক বাহিনীর রসদ সরবরাহকারী ট্রেনে লুঠপাট চালায়। চারদিন বাদে তারা স্থানীয় থানা ও বানসদি শহরে তহশিল ভবন গুলি দখল করে নেয়। অল্প কালে মধ্যেই ছাত্র আন্দোলন গন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯ শে আগস্ট বিশাল জনতা বালিয়া শহরে অবরোধ করে এবং জেলাশাসক বাধ্য হয়ে কাগজপত্র পুড়িয়ে দেয় এবং রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেয়। এই ভাবে সরকারি দমন নীতি সত্ত্বেও বালিয়া শহরে ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে।

উত্তরপ্রদেশের ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে ছাত্রীরাও উল্লেখযোগ্য ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলো। এলাহাবাদে এক শোভাযাত্রায় পুলিশ গুলি চালালে যে  ৮ জন নিহত হয়, তার মধ্যে ২ জনই ছিলো ছাত্র। এই শোভাযাত্রায় ছাত্রীদের উপস্থিতিও ছিলো লক্ষ্যনীয়।

 লক্ষ্মৌতে ছাত্ররা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারের অফিস পুড়িয়ে দেয়, তখন সেখানেও ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছাত্রদের অপেক্ষা কোন অংশেই কম ছিলো না। লক্ষ্মৌতে পুলিশের লাঠি চালনায় আহত হন ছাত্রনেতা হরিশ তেওয়ারী, রবি সিনহা, রাম আম্রে প্রমুখ। এককথায় উত্তরপ্রদেশে তীব্র ছাত্র আন্দোলন সেখানকার ইংরেজ শাসনকে সাময়িক ভাবে অচল করে দিয়েছিলো।

(vi.) ঊড়িষ্যা ও আসামে ছাত্র আন্দোলন :-

ঊড়িষ্যায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্ররাই মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। তাই সরকারি প্রতিবেদনে এই রাজ্যের গন আন্দোলনকে পুরোপুরি "ছাত্র বিদ্রোহ" বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো। বাংলার মতো ঊড়িষ্যাতেও ছাত্ররা রেল, থানা ও সরকারি ভবন ধ্বংস করে এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। তারা স্কুল কলেজ বর্জন করে আন্দোলন সংগঠনে সর্বাত্মক ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আসামের ভারত ছাড়ো আন্দোলনেও ছাত্র সমাজ উল্লেখযোগ্য ভাবে অংশগ্রহণ করে। আসামে ছাত্র বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন নাদাই বা পাটগিরি, চারু গোস্বামী প্রমুখ

(vii.) গুজরাটে ছাত্র আন্দোলন :-

গুজরাটে স্কুল পড়ুয়া বালক বালিকাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিলো "বানর সেনা"। এই বানর সেনা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। গুজরাটের আমেদাবাদে ছাত্ররা স্কুল কলেজ বর্জন করে হরতাল পালন করে। তারা থানায় অগ্নিসংযোগ করলে পুলিশের সাথে ছাত্রদের ব্যাপক সংঘর্ষ বাঁধে।

(viii.) মহারাষ্ট্রে ছাত্র আন্দোলন :-

মহারাষ্ট্রের পুনা, সারা, বরোদা, কর্নাটক প্রভৃতি অঞ্চলে ছাত্ররা স্কুল কলেজ বর্জন করে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলো। মহারাষ্ট্রের আহমদনগরে জঙ্গী আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলো কৃষক সন্তান স্কুল ছাত্ররা। তাদের নেতা ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্র ধর্ম পোখারকার। তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ অকথ্য অত্যাচার করে। মহারাষ্ট্রে ছাত্রদের ব্যাপক ভাবে গ্রেপ্তার করেও সরকার ছাত্র আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পারে নি।

মহারাষ্ট্রের সাতারায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছিলো। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের একেবারে গোড়াতেই এখানে হাজার হাজার কৃষক, ছাত্র, যুব, জনতা একত্রিত হয়ে করদ, তালগাঁও, ইসলামপুর প্রভৃতি এলাকায় সরকারি দপ্তরে আক্রমণ চালিয়ে ধ্বংস করেছিলো। তারা সেখানে রেল লাইন উপড়ে ফেলে, টেলিগ্রাফ ধ্বংস করে, পোস্ট অফিস আক্রমণ করে যাবতীয় যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। ১৯৪৩ খ্রিঃ মাঝামাঝি সময়ে সাতারায় স্বাধীন "পত্রী সরকার" গঠিত হয়েছিলো। মহারাষ্ট্রের এইসব কর্মকান্ডের সঙ্গে ছাত্র সমাজ অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত থেকেছিলো।

(ix.) সিন্ধু প্রদেশে ছাত্র আন্দোলন :- 

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ছাত্র আন্দোলন উঃ পঃ সীমান্তে সিন্ধু প্রদেশেও বিস্তার লাভ করেছিলো। সিন্ধু প্রদেশে রেল লাইন উপড়ে ফেলতে গিয়ে ১৭ বছরের ছাত্র কিশোর দেশপ্রেমিক হেমু কালানির ফাঁসি হয়। ১৯৪৩ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে হেমুর সহকর্মীরা "করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে" ধ্বনি মুখে নিয়ে ৪২ এর আগস্ট বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। 

সিন্ধু প্রদেশে ছাত্র আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন - শোভা জ্ঞানচান্দানি, গোবিন্দ মালহি, নারায়ন ও ওয়াধ্বানি। ব্রিটিশ পুলিশ এদের প্রত্যেককেই গ্রেপ্তার করে জেলবন্দি করে। 

(x.) দক্ষিন ভারতে ছাত্র আন্দোলন :-

দক্ষিণ ভারতে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের তীব্রতা কম হলেও, আন্দোলন সংগঠনে সেখানেও ছাত্রদের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। 

(১.) দক্ষিণ ভারতে গোদাবরী তীরে পুলিশ ৫ জন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে। এর ফলে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে দক্ষিণ ভারত।

(২.) পশ্চিম গোদাবরী ও গন্টুর জেলা (অন্ধ্রপ্রদেশ), ত্রিচিনোপল্লী, মাদুরাই, কালিকট, কেরালা ও মহীশূরের ব্যাঙ্গালোরে ছাত্রদের নেতৃত্বেই মূলত আন্দোলন চলে। মহীশূরে জেলের মধ্যে ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষনে প্রান হারান ছাত্রকর্মী শঙ্করাপ্পা

(৩.) অন্ধ্রপ্রদেশে রেললাইন উপড়ে ফেলতে গিয়ে দুজন ছাত্র রেলে কাটা পড়ে মারা যায়। অন্য দুজন অন্ধ হয়ে যায়

(৪.) মাদ্রাজে সপ্তাহের পর সপ্তাহ পুলিশের দমন নীতি অগ্রাহ্য করে ছাত্রদের ধর্মঘট চলেছিলো। সেখানে ছাত্রদের প্রধান নেতা ছিলেন - কে আর গনেশ মোহন রেড্ডী। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিলো উল্লেখযোগ্য।

বিশেষকরে মাদ্রাজে রত্নাময়ী দেবীর ভূমিকার কথা এখানে বলতেই হয়। ছাত্রদের আন্দোলনে সামিল করানোর ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান জানান। কলেজের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন - 

"মাতৃভূমি তোমাদের ডাকছে। তার প্রতিটি পাঁঞ্জর ভেঙ্গে গেছে, তার শরীর থেকে রক্ত বয়ে চলেছে অবিরত ক্ষমাহীন ভাবে। এসব তোমরা চুপ করে বসে দেখবে? বই ছুঁড়ে ফেলে দাও এবং বেরিয়ে এসো। বাপুজির ডাক -" করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে" এর বেশি আর কী বলার আছে?"

(xi.) দেশীয় রাজ্য ও অন্যত্র ছাত্র বিক্ষোভ :-

ভারত ছাড়ো আন্দোলন দেশীয় রাজ্য গুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছিলো। এই সময় ব্রিটিশ ভারতের অন্যান্য স্থানের মতো দেশীয় রাজ্য গুলিতেও ছাত্র আন্দোলনের বিস্তার ঘটে। মহীশূর, ত্রিবাঙ্কুর, কোচিন, কাশ্মীর, ইন্দ্র, জয়পুর, যোধপুর, বিকানীর, কোটা, প্রভৃতি দেশীয় রাজ্য গুলিতে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের স্বপক্ষে এবং দেশীয় রাজাদের অগনতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতিব্রিটিশ তোষনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলন গড়ে তোলে।

(১.) দেশীয় রাজ্য ত্রিবাঙ্কুর ও কোচিনে ছাত্ররা টানা ২ মাস ধরে স্কুল কলেজে ধর্মঘট চালিয়েছিলো।

(২.) চিত্তুরে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে বহু ছাত্র আহত হয়। অনেক ছাত্রকে জেলে বন্দী করে নির্মম ভাবে চাবুক মারা হয়েছিলো।  সেখানে দুজন ছাত্রকর্মীর ফাঁসি হয়।

(৩.) ছাত্রদের গোপনে বিপ্লবী সংগ্রামে প্রশিক্ষণ দেবার জন্য মধ্যপ্রদেশের আস্ত ও চিমুরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিলো। মগনলাল বোগাধিরের নেতৃত্বে সেখানে ছাত্রদের বৈপ্লবিক সংগ্রামে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।

(৭.) তীব্র দমন নীতি, আন্দোলনে ভাঁটা এবং ছাত্রসমাজের প্রতিক্রিয়া :-

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনকারীদের ওপর তীব্র দমন নীতি প্রয়োগ করে। ১৯৪২ খ্রিঃ শেষদিকে প্রায় ৬০,০০০ আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৮,০০০ মানুষকে ভারত রক্ষা আইনে বিনা বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারের নামে প্রহসন সৃষ্টি করে শাস্তি দেওয়া হয় প্রায় ২৬,০০০ অধিক মানুষকে। এর ফলে ৪২ এর শেষদিক থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে একটি ভাঁটা দেখা যায়। এই সময় গোপন কেন্দ্র গুলি থেকে ইতস্তত ভাবে আন্দোলন ও নানা নাশকতামূলক কাজ চলেছিলো।

কয়েক হাজার কংগ্রেস কর্মীকে বিনা বিচারে জেলবন্দি রাখার প্রতিবাদে গান্ধীজি ১৯৪৩ খ্রিঃ ১০ ই ফেব্রুয়ারি থেকে টানা ২১ দিনের জন্য অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। গান্ধীজির অনশন ঝিমিয়ে পড়া আন্দোলনে এক নতুন জোয়ার নিয়ে আসে। এইসময় সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ছাত্র যুবকরাও গান্ধীজির মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৪৪ খ্রিঃ ৬ ই মে শারীরিক অবনতির কারনে গান্ধীজিকে মুক্তি দেওয়া হয়।

১৯৪৩ খ্রিঃ ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বাংলায় ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। এই দুর্ভিক্ষ ও সরকারের তীব্র দমন নীতি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গতিকে অনেকটাই স্তিমিত করে দেয়।

বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় ছাত্র সমাজ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলার ছাত্র ফেডারেশন গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা খুলে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের খাদ্যের ব্যবস্থা করে।

(৮.) ছাত্রদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব :-

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ একটি শ্রেনীর যোগদান মাত্র ছিলো না। এর একাধিক ঐতিহাসিক তাৎপর্যগুরুত্বের দিকও ছিলো। 

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের ফলে -
(১.) ভারত ছাড়ো আন্দোলন অভূতপূর্ব বলিষ্ঠতা ও ব্যাপকতা অর্জন করে।
(২.) এই সময়ের ছাত্র আন্দোলন গন আন্দোলনের ধারাকে অনেক বেশি মজবুত করে তোলে। অনেক স্থানে ছাত্র আন্দোলন থেকেই গন আন্দোলনের জন্ম হয়েছিলো।
(৩.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণের ফলে ছাত্র সমাজ রাজনৈতিক দিকে অনেক বেশি সচেতন হয়ে ওঠে।
(৪.) এই সময় দেশ ও জাতির সেবায় ছাত্র সংগঠন গুলি অনেক বেশি কার্যকরী ভূমিকা নেয়। এর ফলে ছাত্রদের মধ্যে সংঘবদ্ধ শ্রেনী চেতনার জন্ম হয়
(৫.) ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে প্রকৃত অর্থে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ও কৃষক সমাজের মধ্যে ছাত্রসমাজই ছড়িয়ে দেয়

(৯.) সীমাবদ্ধতা :-

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলনের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও লক্ষ্য করা যায়। যেমন -

(১.) এই সময় ছাত্র আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করলেও, তা শেষপর্যন্ত জাতীয় গন আন্দোলনের সঙ্গেই মিশে গিয়েছিলো।
(২.) সারা ভারতে ছাত্র সংগঠন গুলি নিষিদ্ধ হওয়ায় এবং স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় কোন অখন্ড গন - ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয় নি। ছাত্র আন্দোলন স্থান, কাল, সংগঠন ও নেতৃত্বের ভিন্নতায় ইতস্তত ও বিক্ষিপ্তভাবে সংগঠিত হয়েছিলো।
(৩.) সর্বোপরি ছাত্র আন্দোলনের ধারা, গতি ও বৈশিষ্ট্যও সব প্রদেশে একই রকম ছিলো না।


গ্রন্থঋন :-

(১.) ভারত ছাড়ো আন্দোলন - সম্পাদনা ইয়াসিন খান ও সুশান্ত দে। 
(২.) ভারতীয় উপমহাদেশের ছাত্র আন্দোলন - হীরেন দাশগুপ্ত। 
(৩.) বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (১৮৩০ - ১৯৭১) - ড. মোহাম্মদ হাননান। 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post