১৯৩০ খ্রিঃ মহাত্মা গান্ধী আইন অমান্য আন্দোলন ও সত্যাগ্রহের ডাক দিলে আপামোর ভারতবাসী তাতে অংশগ্রহণ করেন। যে কোন গন আন্দোলনেই দেখা যায়, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষেরা তাতে কম বেশি অংশগ্রহণ করে থাকেন। আইন অমান্য গন আন্দোলনেও তাই দেখা গিয়েছিলো। এই সময় বিভিন্ন শ্রেনী ও স্তরের মানুষদের পাশাপাশি ছাত্রসমাজও ব্যপকভাবে অংশগ্রহণ করে।
ভারতে দুটি পর্বে আইন অমান্য আন্দোলন চলেছিলো।১৯৩০ খ্রিঃ থেকে ১৯৩১ খ্রিঃ ৫ ই মার্চ পর্যন্ত ছিলো আইন অমান্য আন্দোলনের প্রথম পর্ব। মাঝখানে কিছুমাস বিরতির পর ১৯৩২ - ১৯৩৪ খ্রিঃ পর্যন্ত চলেছিলো আইন অমান্য আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব। দুটি পর্বেই ভারতের ছাত্র সমাজ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগদান করেছিলো।
(ক.) ছাত্রদের অংশগ্রহণের ধরন ও প্রকৃতি :-
আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের ধরন ও প্রকৃতির মূল দিক গুলি ছিলো এইরকম -
(১.) অসহযোগ আন্দোলনের তুলনায় আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিলো অনেক কম।
(২.) এই পর্বে ছাত্র আন্দোলন মূলত বাংলা, পাঞ্জাব, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, আসাম ও উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।
(৩.) বিহারে আইন অমান্য আন্দোলনকে সংগঠিত করার ব্যপারে ছাত্রদের কাছে তেমন উল্লেখযোগ্য সাড়া পাওয়া যায় নি।
(৪.) অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পরবর্তীকালীন সময়ে ছাত্রদের মধ্যে বেশ কিছু ছাত্র সংগঠন গড়ে উঠেছিলো। যেমন ১৯২৬ খ্রিঃ ভগৎ এর নেতৃত্বে পাঞ্জাবের "নওজোয়ান ভারতসভা", ১৯২৮ খ্রিঃ কংগ্রেসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত "হিন্দুস্থানী সেবাদল" এবং ঐ বছরেই (১৯২৮) কলকাতায় "অল বেঙ্গল স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন" (ABSA) প্রতিষ্ঠিত হয়। এইসব সংগঠনের ছত্রছায়ায় থাকা ছাত্ররা আইন অমান্য আন্দোলনকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
(৫.) আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের জন্য নির্দিষ্ট কোন পালনীয় কর্মসূচির কথা কংগ্রেস সংগঠন বা উচ্চস্তরের নেতৃত্ব থেকে বলা হয় নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কট করার কথাও বলা হয় নি। আইন অমান্য আন্দোলন শুরুর আগেই ১৯২৯ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে গান্ধিজী জানিয়ে দিয়েছিলেন, আইন অমান্য আন্দোলনের সময় ছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কট সমর্থন যোগ্য নয়। গান্ধীর এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কটের মধ্য দিয়েই ছাত্রসমাজ আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
(৬.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের মতোই আইন অমান্য আন্দোলনেও ছাত্র আন্দোলনের চরিত্র ছিলো অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও আপোষহীন।
(খ.) আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা :-
আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে ছাত্ররা দলে দলে তাতে অংশগ্রহণ করে। এক্ষেত্রে আন্দোলনে তাদের মূল ভূমিকার দিক ছিলো ৪ টি। তারা -
(১.) স্কুল, কলেজ ত্যাগ করে,
(২.) ব্রিটিশ পন্য বর্জন করে,
(৩.) সভা সমাবেশের আয়োজন করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ও আইন অমান্য আন্দোলনের স্বপক্ষে জনমত গঠন করে, এবং
(৪.) লবন আইন ভঙ্গ করে ও ট্যাক্স বা খাজনা প্রদান বন্ধের প্রচার করে আইন অমান্য আন্দোলনকে কৃষক সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়।
আইন অমান্য আন্দোলনে স্থানীয় বা আঞ্চলিক ক্ষেত্রে ছাত্রদের ভূমিকার মূল দিকটি আমরা খুব সংক্ষেপে নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি।
(১.) বাংলায় ছাত্র আন্দোলন : -
(অ.) কলকাতার ছাত্রসমাজের ভূমিকা -
আইন অমান্য আন্দোলনের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিলো বাংলা। এখানে আইন অমান্য আন্দোলনে কলকাতার ছাত্রসমাজ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।
(i.) বিলাতি পন্য বর্জনের প্রচার :-
আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে কলকাতার হাজার হাজার ছাত্র স্কুল কলেজ ত্যাগ করে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সামিল হয়। তারা বিলাতি পন্য বর্জনের জন্য জোরদার প্রচার চালায়। তাদের এই প্রচারাভিযান ইংরেজ ব্যবসায়ীদের অনেককেই আতঙ্কিত করে তুলেছিলো। তৎকালীন ভারত সচিব ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তার অর্ধ - মাসিক রিপোর্টে ছাত্রদের এই প্রচার আন্দোলনকে এজন্য "মারাত্মক" বলে উল্লেখ করেছিলেন।
(ii) কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ছাত্র সমাবেশ :-
আইন অমান্য আন্দোলন শুরুর দু বছর আগে ১৯২৮ খ্রিঃ বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো "All Bengal Students Association" বা ABSA নামে একটি ছাত্র সংগঠন। পরে মতপার্থক্যের কারনে এই সংগঠনটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মূল সংগঠনটি ABSA নামেই পরিচিত ছিলো। অন্য গোষ্ঠীটি সুভাষচন্দ্র বসুকে সমর্থন করে তাদের নামকরন করেছিলো - "বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন"।
আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে ABSA এর ছাত্র সদস্যরা সমস্ত বিভাজন ভুলে একত্রিত হন এবং একসঙ্গে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩০ খ্রিঃ ৬ ই এপ্রিল, গান্ধীজি যে দিন ডান্ডিতে লবন আইন ভঙ্গের মধ্য দিয়ে আইন অমান্য আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন, ঐ দিনই যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের সভাপতিত্বে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে একটি ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এই সম্মেলনে ABSA ও "বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন" একসঙ্গে অংশগ্রহণ করে। এই সম্মেলনে প্রায় ৭০০ ছাত্র প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে।
(iii) বিভিন্ন স্থানে ছাত্রদের প্রতিবাদ সমাবেশ :-
আইন অমান্য আন্দোলনের স্বপক্ষে ছাত্ররা (ক.) ১৯৩০ খ্রিঃ ১১ এপ্রিল কলকাতার কলেজ স্কোয়ার, (খ.) ১৪ ই জুলাই প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে, (গ.) ১৮ ই জুলাই বেথুন কলেজের গেটে, এবং (ঘ.) ১৯ শে জুলাই স্কটিশ চার্চ কলেজে অবরোধ সত্যাগ্রহ সংগঠিত করে।
(১.) কলেজ স্কোয়ারে ছাত্র সমাবেশ ও আক্রমণ :-
আইন অমান্য আন্দোলনের স্বপক্ষে কলকাতার ছাত্রসমাজ ১৯৩০ খ্রিঃ ১১ এপ্রিল কলেজ স্কোয়ারে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে। কিন্তু ঐ শান্তিপূর্ণ জনসমাবেশকে বন্ধ করার জন্য মিঃ গর্ডনের নেতৃত্বে কলকাতা পুলিশের এক বিরাট দল ছাত্রদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এর ফলে বহু ছাত্র আহত হয়।
(২.) কলকাতার অন্যান্য কলেজে ছাত্র বিক্ষোভের সংক্রমন ও প্রসার :-
কলেজ স্কোয়ারে ছাত্রদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে অচিরেই ছাত্র বিক্ষোভ ও আন্দোলন কলকাতার নামকরা কলেজ গুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।
(১.) ১৯৩০ খ্রিঃ ১৪ ই জুলাই প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে ছাত্ররা পিকেটিং ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করলে পুলিশ বহু সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করে এবং ছাত্রদের ওপর লাঠি চালায়।
(২.) ১৯৩০ খ্রিঃ ১৮ ই জুলাই, বেথুন কলেজের গেটে ছাত্রীরা সত্যাগ্রহ শুরু করলে, পুলিশ সেখান থেকে তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে বিপজ্জনক জায়গায় ছেড়ে দিয়ে আসে। অনেক সময়ই ব্রিটিশ পুলিশ নারী সত্যাগ্রহীদের ধরে নিয়ে গিয়ে জনমানবশূন্য, যোগাযোগহীন স্থানে ছেড়ে দিয়ে আসতো ও শাস্তি দিতো।
(৩.) ১৯৩০ খ্রিঃ ১৯ শে জুলাই, স্কটিশ চার্চ কলেজে অবরোধ ও সত্যাগ্রহ করার অপরাধে বহু ছাত্রছাত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
(৪.) ১৯৩০ খ্রিঃ ৯ ই সেপ্টেম্বর, হাওড়া ময়দানে আইন অমান্য আন্দোলনের স্বপক্ষে এক বিশাল জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়। ঐ সমাবেশে কলকাতার বিভিন্ন কলেজের বহু ছাত্র অংশগ্রহণ করে। পুলিশ এই জন সমাবেশের ওপর আক্রমণ চালালে সাধারণ মানুষ সহ বহু ছাত্র আহত ও গ্রেপ্তার হন।
(৫.) বাংলার ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের জেরে এই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়।
(আ.) কলকাতার বাইরে ছাত্র আন্দোলন :-
আইন অমান্য আন্দোলন কলকাতার বাইরে মফঃস্বল ও গ্রামগঞ্জের ছাত্রদের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলো। বহু ছাত্রকর্মী আইন অমান্য আন্দোলনকে কৃষক সমাজের মধ্যেও ছড়িয়ে দেবার জন্য এইসময় গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলো। তারা সরকারকে ট্যাক্স না দেবার প্রচার করে। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে দলে দলে কৃষকরা সরকারকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়।
অনেক জায়গায় আবার ব্রিটিশ অরন্য আইনকে ভঙ্গ করেও আইন অমান্য আন্দোলন হয়েছিলো। এই আইন ভঙ্গের ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজ অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছিলো।
পূর্ব বাংলার চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল, ফরিদপুরে আইন অমান্য আন্দোলনকে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সেখানকার ছাত্রসমাজ বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলো। পশ্চিমবঙ্গে আইন অমান্য আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিলো মেদিনীপুর।
মেদিনীপুরের তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় আইন আমান্য আন্দোলনের গতিবেগ ছিলো খুবই ব্যাপক ও তীব্র। এই দুই মহকুমায় সরকারি চাপ, নিষেধাজ্ঞা ও দমন পীড়ন উপেক্ষা করে সমস্ত হাইস্কুলের ছাত্ররা একটানা ৬/৭ মাস স্কুল বর্জন করেছিলো। তারা স্কুল কলেজ বর্জন করে প্রত্যন্ত গ্রামে কৃষকদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলো এবং তাদের খাজনা বন্ধে উৎসাহিত করে আইন অমান্য আন্দোলনকে একেবারে গ্রামরুটে পৌঁছে দিয়েছিলো।
বাংলার প্রায় সব জেলাতে এই ভাবেই ছাত্ররা আইন অমান্য আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিয়েছিলো। কৃষকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।
(২.) ভারতের অন্যান্য স্থানে ছাত্রসমাজের আন্দোলন :-
বাংলা ছাড়াও গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, আসাম, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের ছাত্ররা আইন অমান্য আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলো।
(১.) মধ্যপ্রদেশের বেশিরভাগ স্থানে ছাত্ররা স্কুল কলেজ বয়কট করে।
(২.) আসামে ছাত্র আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে শিক্ষা বিভাগের অধিকর্তা ক্যানিংহাম এক সার্কুলার জারি করে ছাত্রদের রাজনৈতিক কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে প্রায় ৩,০০০ ছাত্র স্কুল কলেজ ত্যাগ করে।
(৩.) পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশে ছাত্রসমাজ মিছিল, মিটিং ও পিকেটিং এ অংশগ্রহণ করে।
(৪.) বিহারের চম্পারন ও মুঙ্গের জেলায় ছাত্ররা বিলিতি কাপড় ও মদের দোকানের সামনে পিকেটিং করে।
(৫.) উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের ছাত্ররা খান আব্দুল গফফর খানের "খোদা - ই - খিদমতগার" দলে যুক্ত থেকে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নেন।
(৬.) পাঞ্জাবের লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঞ্জাবের গভর্নরের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা হলে পাঞ্জাবের ছাত্রদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। এর ফলে যেখানে ছাত্র আন্দোলন আরোও তীব্র হয়ে ওঠে।
(৩.) গান্ধী আরউইন চুক্তি ও ছাত্র সমাজের হতাশা :-
আইন অমান্য আন্দোলন যখন সারা ভারতকে বাঁধন ছাড়া করে আন্দোলনকে দুর্বার করে তুলেছিলো, ঠিক সেই সময়েই ১৯৩১ খ্রিঃ মহাত্মা গান্ধী ও বড়োলাট লর্ড আরউইনের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় "গান্ধী আরউইন চুক্তি"। এই চুক্তির মাধ্যমে আন্দোলনে সাময়িক যুদ্ধ বিরতি ঘোষনা করা হয়।
এই চুক্তি বা যুদ্ধ বিরতিকে ছাত্র সমাজ মেনে নিতে পারে নি। যুদ্ধ বিরতির ঘোষনায় তারা মনে করলো, স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিপথগামী করা হচ্ছে। এই সময় ভগৎ সিং ও তার সহকর্মীদের ফাঁসি (১৯৩১ খ্রিঃ, ২৩ শে মার্চ) ছাত্র সমাজকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিলো।
সকলেই আশা করেছিলেন, গান্ধী ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি রোধের চেষ্টা করবেন। কিন্তু গান্ধী তেমন চেষ্টা না করে নীরব ভূমিকা পালন করলে ছাত্র সমাজের একটা অংশ চরম হতাশা ও ক্ষোভে কংগ্রেস ত্যাগ করে বিপ্লবী আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করেন। এর ফলে ১৯৩১ খ্রিঃ পর বাংলা সহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বিপ্লবী আন্দোলন ও ইংরেজ হত্যাকাণ্ডের মতো নাশকতামূলক কর্মকান্ড অনেক বেড়ে যায়। বলা বাহুল্য, এই নাশকতামূলক বিপ্লবী কর্মকান্ড এই সময়কালে ছাত্র সমাজের উদ্যোগেই চলেছিলো।
(৪.) দ্বিতীয় পর্যায়ের আইন অমান্য আন্দোলন ও ছাত্র সমাজের ভূমিকা :-
১৯৩১ খ্রিঃ দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়ে গেলে দ্বিতীয় পর্যায়ে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। পুনরায় ছাত্রসমাজ নতুন উদ্যোম ও আশা আকাঙ্খায় উদ্দীপ্ত হয়ে আন্দোলনে সামিল হয়। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ের ছাত্র আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার চরম দমন নীতির আশ্রয় নেয়। ABSA ও Bengal Presidency Student Association কে বেআইনি ঘোষনা করে। জেলায় জেলায় দমন পীড়ন চালিয়ে ছাত্রদের গ্রেপ্তার করা হতে থাকে।
(৫.) ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে দমনমূলক নীতি :-
জওহরলাল নেহেরুর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, এই সময় ছাত্র আন্দোলন দমন করতে সরকার একাধিক কঠোর দমনমূলক নীতি নেয়।
(ক.) এই সময় ১২ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে সকল ছাত্রকে তাদের নিজ নিজ পরিচয়পত্র বহন করতে হতো।
(খ.) সরকার বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে এই সময় হাজার হাজার ছেলে মেয়েকে স্কুল কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
(গ.) ছাত্রদের চিহ্নিত করতে তাদের ওপর পোশাক বিধি লাগু করা হয়। অর্থাৎ ছাত্ররা স্কুল কলেজে কি রংয়ের পোশাক পড়বে তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
(ঘ.) ছাত্রদের ওপর সান্ধ্য আইন জারি করে তাদের সূর্যাস্তের মধ্যে বাড়ি ফেরা বাধ্যতামূলক করা হয়।
(ঙ.) সন্দেহভাজন ছাত্রদের নিয়মিত পুলিশের কাছে হাজিরা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এমনকি তাদের সাইকেলে চড়ার ওপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
বহু ছাত্র যুবকে আইন অমান্য আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে আন্দামানে, রাজপুতানার মরুভূমি অঞ্চলে, ভুটান বাংলা সীমান্তে বক্সার অঞ্চলে এবং খড়্গপুরের হিজলীর মতো বন্দী শিবিরে অন্তরীন করে রাখা হয়। ছাত্র সমাজের ওপর এই ব্যাপক দমন পীড়ন থেকেই বুঝে নেওয়া যায়, আইন অমান্য আন্দোলনে তাদের ভূমিকা কতখানি সক্রিয় ছিলো।
কিন্তু তীব্র দমন নীতির কারনে শেষপর্যন্ত গান্ধীজি ১৯৩৪ খ্রিঃ আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে ছাত্র সমাজে গভীর হতাশা দেখা যায়। তীব্র দমন নীতি সত্ত্বেও ছাত্র সমাজ আপোষহীন ভাবে আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
(৬.) ছাত্রদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব :-
(i.) আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ তাদের রাজনৈতিক দিক থেকে অনেক বেশি সচেতন করে তোলে।
(ii.) আইন অমান্য আন্দোলনের প্রবল উদ্মাদনা ও জাতীয়তাবাদী আদর্শ ছাত্রদের মধ্যে দলাদলির অবসান ঘটিয়ে তাদের আরোও ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছিলো।
(iii.) এই আন্দোলনে গান্ধীজি ও কংগ্রেসের আপোষমুখী নীতি ছাত্র সমাজের একটা বড়ো অংশকে ক্ষুব্ধ করেছিলো। এর ফলে অনেক ছাত্র বিপ্লবী আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করেছিলো।
(iv.) আইন অমান্য আন্দোলনকে গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং আন্দোলনের স্বপক্ষে জনমত গঠনের ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজই সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলো। তাদের এই উদ্যোগ ও ভূমিকার ফলেই আইন অমান্য আন্দোলন প্রকৃত গন আন্দোলনে রূপলাভ করে।
(৭.) সীমাবদ্ধতা :-
আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও চোখে পড়ে। যেমন -
(১.) অসহযোগ আন্দোলনের চাইতে আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিলো অনেক কম।
(২.) জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা এইসময় সেভাবে ছাত্র আন্দোলনকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন নি।
(৩.) ছাত্র আন্দোলনের জন্য নির্দিষ্ট কোন কর্মসূচিও ঘোষিত হয় নি।
(৪.) ভারতের সব অঞ্চলের ছাত্ররা সমান ভাবে আন্দোলনে সামিলও হয় নি।