ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অভূতপূর্ব গতি ও মাত্রা যোগ করেছিলো আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিচার সংক্রান্ত গন উদ্মাদনা ও জন বিক্ষোভ।
রশিদ আলি দিবস ও তার গুরুত্ব |
(১.) আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের পরিচয় :-
আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করা হয়েছিলো ব্রিটিশ ভারতের পরাজিত ভারতীয় সৈনিকদের নিয়ে। ব্রিটিশ ভারতের সৈনিকরা সংগঠিত হয়ে ব্রিটিশ ভারতকেই আক্রমণ করেছিলো।ব্রিটিশ সরকার এটিকে "শৃঙ্খলাভঙ্গ ও দেশদ্রোহী" হিসাবে দেখে এবং লালকেল্লায় তার বিচার করে। লালকেল্লা ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রভুত্বের প্রতীক। ১৮৫৮ খ্রিঃ এই লালকেল্লাতেই শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বহাদূর শাহের বিচার হয়েছিলো। ১৯৪৫ খ্রিঃ আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদেরও বিচার এখানে করা হয়।
আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিরুদ্ধে মোট ১০ টি বিচার চলেছিলো। এর মধ্যে প্রথম বিচারটি ছিলো সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই বিচারটি হয়েছিলো দিল্লির লালকেল্লায়। আজাদ হিন্দ ফৌজের ৩ জন প্রধান সেনাপতি বা আধিকারিকের বিচার এখানে হয়েছিলো। এই ৩ জন ছিলেন তিন ভিন্ন ধর্মের মানুষ। একজন ছিলেন হিন্দু, অন্য দুজন ছিলেন শিখ ও মুসলিম ধর্মাবলম্বী। এই তিন আধিকারিক ছিলেন যথাক্রমে - পি কে সায়গল, জি এস ধীলন এবং শাহনওয়াজ খান। ১৯৪৫ খ্রিঃ ৫ ই নভেম্বর দিল্লির লালকেল্লায় এদের প্রকাশ্যে বিচার শুরু হয়।
প্রায় দু মাস ধরে এই বিচারটি চলে। এই বিচারের প্রতিবাদে ভারতের সর্বত্র এক বিরাট গন অভ্যুত্থান ঘটে। শেষপর্যন্ত দেশের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে প্রধান সেনাপতি অচিনলেক ৩ রা জানুয়ারি, ১৯৪৬ খ্রিঃ INA এর তিন সেনাপ্রধানের দন্ডাদেশ মুকুব করে দেন।
(২.) রশিদ আলির বিচার :-
আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম ৩ সেনাপ্রধানের দন্ডাদেশ মুকুব করার পর ব্রিটিশ সরকার ফেব্রুয়ারি মাসে পুনরায় আজাদ হিন্দ ফৌজের আরেক ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদ আলির বিচার শুরু করলে দেশে পুনরায় অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
১৯৪৬ খ্রিঃ ৪ ই ফেব্রুয়ারি আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন আব্দুর রসিদ আলিকে ক্যাঙ্গারু আদালতে ৭ বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়।
(৩.) গন বিক্ষোভ ও আন্দোলন :-
রশিদ আলির বিচার ও শাস্তিদানের ঘটনার সূত্র ধরে কলকাতায় ১১ থেকে ১৩ ই ফেব্রুয়ারি রশিদ আলির সমর্থনে গন বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়।
ক্যাপ্টেন রশিদ আলি বিচারের সময় আত্মপক্ষ সমর্থনে কংগ্রেসের চাইতে মুসলিম লিগের ডিফেন্স কমিটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই রসিদ আলির দন্ডাদেশে মুসলিম লিগ সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট হয়।
(ক.) ছাত্র ধর্মঘটের ডাক :-
রশিদ আলির মুক্তির দাবিতে ১৯৪৬ খ্রিঃ ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয় মুসলিম লিগের ছাত্র সংগঠন "ছাত্র লীগ"। এই ধর্মঘটকে সমর্থন করে "বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেস", ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাত্র সংগঠন "ছাত্র ব্লক", কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন "ছাত্র ফেডারেশন", আর এস পির ছাত্র সংগঠন "বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন", ইসলামিয়া কলেজের ছাত্ররা সহ সবকটি ছাত্র সংগঠন।
(খ.) প্রতিবাদ সভার আহ্বান :-
রশিদ আলির মুক্তির দাবিতে ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতা জেলা মুসলিম লিগের সম্পাদক মোয়াজ্জম হোসেন ও সিটি ছাত্র ফেডারেশনের সম্পাদক গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের আহ্বানে কলকাতায় এক বিশাল জনসভার আহ্বান করা হয়।
কলকাতার বর্তমান সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে এই জনসভায় কলকাতার সমস্ত কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসার ছাত্ররা যোগ দেয়। এই সভায় বক্তব্য রাখেন - গান্ধীবাদী নেতা সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত, মুসলিম লিগ নেতা সুরাবর্দি, কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ লাহিড়ি। এছাড়া ভাষন দেন অন্নদাশংকর ভট্টাচার্য, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখ ছাত্র নেতারা।
(গ.) সমবেত মিছিল ও ছাত্র - পুলিশ সংঘর্ষ :-
সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের সভা শেষ করে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ - মিছিল ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে এগিয়ে গেলে পুলিশ তাতে বাধা দিলে ছাত্র - পুলিশ খন্ডযুদ্ধ বেঁধে যায়। আন্দোলনকারীরা রাগে বাস, লড়ি ও ট্রাম জ্বালিয়ে দেয়। ডেপুটি পুলিশ কমিশনার সামসুদ্দোরের নেতৃত্বে সশস্ত্র গোর্খা সেনাদল এই সময় বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে এবং লাঠি চার্জ করে। এতে প্রায় ৪৮ জন ছাত্র নিহত হয় ও ৩০০ বেশি ছাত্র আহত হয়।
(ঘ.) রশিদ আলি দিবস পালন :-
ইংরেজ পুলিশের বর্বরোচিত আক্রমণের ঘটনায় বাংলার সর্বত্র তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। প্রায় সর্বস্তরের মানুষ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন। এরই প্রতিবাদ স্বরূপ ১৯৪৬ খ্রিঃ ১২ ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায় "রশিদ আলি দিবস" পালনের ডাক দেওয়া হয়। ১২ ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রশিদ আলি দিবস পালন করা হয়।
(ঙ.) সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন :-
(১.) ১৯৪৬ খ্রিঃ ১২ ই ফেব্রুয়ারি, রশিদ আলি দিবসের দিন কলকাতা সহ হাওড়া, হুগলি, চব্বিশ পরগনার ১০ লক্ষ শ্রমিক জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে ধর্মঘট করে।
(২.) ১২ ই ফেব্রুয়ারি, পুলিশ ও সেনাকে উপেক্ষা করে কলকাতায় লক্ষাধিক মানুষের বিজয় মিছিল বের হয়। এই মিছিলের প্রধান প্রানশক্তি ছিলো ছাত্ররা।
(৩.) ১২,১৩ ও ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, সারা বাংলায় ধর্মঘট পালিত হয়। এই সময় সাধারন মানুষ পুলিশের ব্যারিকেট ভেঙ্গে ফেললে পুলিশ - জনতা খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়।
পরিস্থিতির মোকাবিলায় কলকাতার রাজপথে সেনা নামাতে হয়। আন্দোলনের চাপে কলকাতার অসামরিক প্রশাসন একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। পুলিশ জনতা সংঘর্ষে প্রায় ২০০ জন মানুষ নিহত হয় ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়।
অধ্যাপক গৌতম চট্টোপাধ্যায় এই গন আন্দোলনকে "প্রায় বিপ্লব" (Almost Revolution) বলে অভিহিত করেন। অমৃতবাজার পত্রিকা একে "প্রকৃত গন অভ্যুত্থান" বলে অভিহিত করেন।
(৪.) রশিদ আলি দিবসের গুরুত্ব :-
(১.) রশিদ আলির বিচারকে কেন্দ্র করে কলকাতা সহ বাংলায় যে জাতি, ধর্ম, বর্ন দল নির্বিশেষে যে বিরাট গন জাগরন ও বিক্ষোভ দেখা যায়, তা ব্রিটিশ সরকারের মনে বিরাট ত্রাসের সঞ্চার করে।
(২.) এই আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু - মুসলিম ঐক্য জোরদার হয়ে উঠেছিলো।
(৩.) রশিদ আলি দিবস সমস্ত সাম্প্রদায়িক বৈরিতাকে দূর করে হিন্দু - মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়কে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো এবং দুই সম্প্রদায়কে কাছাকাছি এনেছিলো তা এক নতুন চেতনা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিলো।
(৪.) রশিদ আলির বিচারকে কেন্দ্র করে একদিকে কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি, অন্যদিকে শ্রমিক - কৃষক - ছাত্র ও সাধারণ মানুষ সমবেত হয়ে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগঠিত করে তা স্থানীয় বা প্রাদেশিকতার পরিধি অতিক্রম করে জাতীয় চরিত্রের রূপ ধারণ করে।
(৫.) আন্দোলনের চাপে সরকার শেষপর্যন্ত নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। সীমান্তের গর্ভনর কানিংহাম প্রধান সেনাপতিকে সমস্ত বিচার বাতিল করার পরামর্শ দেন। প্রধান সেনাপতি অকিনলেক ভারতীয় বাহিনীর আনুগত্যের ওপর বিরুপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় ভীত ছিলেন। তাই তিনি নীতি পরিবর্তনের জন্য ইংল্যান্ডের সরকারের অনুমতি চেয়ে পাঠান। শেষপর্যন্ত স্থির হয় বর্বরোচিত ব্যবহারের অভিযোগ ছাড়া অন্য কোন বিষয়ের বিচার হবে না। অবশেষে সকল বন্দীদেরই মুক্তি দেওয়া হয়।
(৬.) রশিদ আলি দিবস সাংস্কৃতিক দিককেও প্রভাবিত করে। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কলকাতার এই গন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে লেখেন -
"বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকে, আমি যাই তারই দিন পঞ্জিকা লিখে।" এছাড়া, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "চিহ্ন" উপন্যাস রশিদ আলি দিবস সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।