ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অভূতপূর্ব গতি ও মাত্রা যোগ করেছিলো - (১.) আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্মপূর্ন সংগ্রাম, (২.) ভারতের পূর্ব সীমান্তে তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং (৩.) দিল্লির লাল কেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিচার।
পরাধীন ভারতের ইতিহাসে আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে সম্পর্কিত উল্লেখিত ৩ টি বিষয়ই দেশের জনমনে এক বিরাট গন উদ্মাদনা ও গন অভ্যুত্থানের জন্ম দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে বহুগুন ত্বরান্বিত করেছিলো।
আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার ও ভারতে গন অভ্যুত্থান |
১
(১.) আজাদ হিন্দ ফৌজের গঠন ও সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
আজাদ হিন্দ ফৌজের গঠন ও সংগ্রামের মূল রূপকার ছিলেন চারজন - (১.) ক্যাপ্টেন মোহন সিং, (২.) নিরঞ্জন গিল, (৩.) রাসবিহারী বসু এবং (৪.) সুভাষচন্দ্র বসু।
(ক.) মোহন সিং ও নিরঞ্জন গিলের উদ্যোগ : Indian National Army গঠন :-
১৯৪১ খ্রিঃ জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো। ১৯৪২ খ্রিঃ জাপানের হাতে সিঙ্গাপুরের পতন ঘটে। এই সময় মালয়ের জঙ্গলে ১৪ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মোহন সিং সহ প্রচুর ব্রিটিশ বাহিনীর ভারতীয় সৈন্য জাপানের হাতে বন্দী হয়। ঠিক এই সময়েই জাপানের হাতে বন্দী ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠনের প্রথম পরিকল্পনা করেন ক্যাপ্টেন মোহন সিং।
পরিকল্পনা মাফিক মোহন সিং জাপানের হাতে বন্দী ব্রিটিশ ভারতের ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে "Indian National Army" গঠনের জন্য জাপানি অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেন এবং জাপান সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় সাহায্য চান। মোহন সিংয়ের বাহিনী জাপানের ভারত আক্রমণের এবং ভারতে জাপানি সাম্রাজ্যবাদ প্রসারের কাজকে সহজ করবে এটা ভেবে জাপান সরকার কালবিলম্ব না করে মোহন সিংকে "Indian National Army" গঠনের যাবতীয় সাহায্যদানে সম্মত হয়।
এর ফলে মোহন সিং এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপর একজন পুরাতন উচ্চপদস্থ সেনাপতি নিরঞ্জন গিলের সহায়তায় ১৯৪২ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসে ১৬,৩০০ সেনা নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের "প্রথম ডিভিশন" গঠিত হয়।
(খ.) জাপান সরকারের সঙ্গে মোহন সিংয়ের বিরোধ ও গ্রেপ্তার হওয়া :-
আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হবার অল্প সময়কালের মধ্যেই জাপান সরকারের সঙ্গে মোহন সিংয়ের বিরোধ উপস্থিত হয়। জাপানিরা চেয়েছিলো মাত্র ২০০০ সৈন্যের একটি ভারতীয় ফৌজ গঠন করতে। কিন্তু মোহন সিংয়ের পরিকল্পনা ছিলো দু লক্ষ সেনার একটি শক্তিশালী ফৌজ গঠন করা। বাহিনী গঠনের "আয়তন ও উদ্দেশ্য" নিয়ে প্রথম দিকটায় জাপ সরকারের সঙ্গে মোহন সিংয়ের বিরোধ উপস্থিত হয়।
জাপান চেয়েছিলো আজাদ হিন্দ বাহিনী জাপানের স্বপক্ষে বিভিন্ন রনাঙ্গনে যুদ্ধ করুক। কিন্তু মোহন সিং কখনই এটা চান নি। এর ফলে মোহন সিংয়ের সঙ্গে জাপানি সেনা অফিসারদের বিরাট মতপার্থক্য ও বিরোধ দেখা দেয়। এমতাবস্থায় জাপান সরকার মোহন সিংকে গ্রেপ্তার করে নির্বাসনে পাঠায়।
(গ.) রাসবিহারী বোসের ভূমিকা : ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগ গঠন :-
মোহন সিং গ্রেপ্তার হবার পর ১৯৪৩ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে আজাদ হিন্দ বাহিনীর দায়িত্ব অর্পিত হয় রাসবিহারী বোসের ওপর। রাসবিহারী বৈবাহিক সূত্রে জাপানেরই নাগরিক ছিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই জাপানের বিরুদ্ধে বা জাপানের মতামতকে উপেক্ষা করে কোন কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।
তাছাড়া বয়সের ভারেও তিনি জর্জরিত ছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজকে নেতৃত্ব দিয়ে ভারত সীমান্তে নিয়ে গিয়ে যুদ্ধ করানোর মতো শারীরিক সক্ষমতা তার ছিলো না। এমতাবস্থায় আজাদ হিন্দ বাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজন পড়লো। ভারতের বাইরে থাকা ব্যক্তিবর্গের মধ্যে এক্ষেত্রে একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।
বলা বাহুল্য, ইতিমধ্যে ব্যাংককে এক সম্মেলনে ১৯৪২ খ্রিঃ ১৫ ই জুন রাসবিহারী বসুর সভাপতিত্বে "ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগ" বা "ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ" গঠিত হয়েছিলো। ঐ সম্মেলনে রাসবিহারী বসু সুভাষচন্দ্র বসুকে আমন্ত্রন জানান।
(ঘ.) সুভাষচন্দ্র বসুর আগমন ও আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব গ্রহন :-
সুভাষচন্দ্র তখন রাসবিহারী বসুর ডাকে জার্মানি থেকে জাপানে আসেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজো সুভাষচন্দ্রকে আশ্বস্ত করেন, ভারতে জাপানের সাম্রাজ্য বিস্তারের কোন পরিকল্পনা নেই। ঐ সময় আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বের দায়িত্ব সুভাষচন্দ্র বসুর ওপর অর্পন করা হয়।
সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪৩ খ্রিঃ ২১ শে অক্টোবর জাপান থেকে সিঙ্গাপুরে ফিরে যান এবং সেখানে স্বাধীন ভারতের জন্য এক অস্থায়ী সরকার গঠন করেন। এই সরকার ইংল্যান্ড ও আমেরিকার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক ভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে। রেঙ্গুন ও সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজের কেন্দ্রীয় দপ্তর স্থাপিত হয়।
অল্প কালের মধ্যেই জাপানি সহায়তায় আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতের পূর্ব সীমান্তে আক্রমণ হানে। কিন্তু অল্প কিছু সময়ের পর জাপানি অসহযোগীতা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিপর্যয় ও আত্মসমর্পণ আজাদ হিন্দ বাহিনীর ব্যর্থতা ডেকে আনে।
জাপানিরা যখন ভারত - ব্রহ্ম রনাঙ্গনে ইম্ফল আক্রমণ করলো তখন তারা ক্যাপ্টেন শাহনওয়াজের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের একটি মাত্র ব্যাটেলিয়ানকে ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়। জাপানি সেনারা প্রায়ই আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের প্রতি বিজেতা সুলভ আচরন করতো।
মোটকথা, সেনাবাহিনীতে জাপানি সেনাদের অমানবিক ব্যবহার ও অসহযোগীতা, ইম্ফল যুদ্ধের ব্যর্থতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিপর্যয় ও পিছু হটে যাওয়া ইত্যাদি নানাবিধ কারনে আজাদ হিন্দ ফৌজের "আজাদ হিন্দুস্থানের" স্বপ্ন অচিরেই ধুলিসাৎ হয়ে যায়।
ইংরেজ সরকার এইসময় ভারতের ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আজাদ হিন্দ ফৌজের যুদ্ধকে "দেশদ্রোহী" হিসাবে দেখে এবং পরাজিত বাহিনীর বিচারের ব্যবস্থা করে দিল্লির লালকেল্লায়।
২
(২.) আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের ব্যবস্থা :-
ব্রহ্মদেশের পোপা পার্বত্য অঞ্চলে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। আত্মসমর্পণের পর প্রায় ২০,০০০ আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিককে বন্দী করে ভারতে নিয়ে আসা হয়।
(ক.) অপরাধ অনুযায়ী সেনাদের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্তিকরন :-
এই সময় আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকদের "White", "Grey" ও "Black" - এই ৩ টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। White ও Grey ক্যাটাগরির অনেককে ছেড়ে দেওয়া হয়। আবার কিছুজনকে সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। White ও Grey ক্যাটাগরির অনেকেই জাপানি ও INA এর প্রচারে বিভ্রান্ত হয়েছিলো বলে ঘোষনা দিয়েছিলো। তাই তাদের White ও Grey ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছিলো।
White ও Grey ক্যাটাগরির বাইরে বেশ কয়েকজন সেনানায়ক ছিলেন যারা INA ও নেতাজীর আদর্শ ও লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। এরা তাদের কৃতকর্মকে বা ভারত আক্রমণের কাজকে কখনই ভুল কাজ বলে মনে করতেন না। ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করে সেনাবাহিনীর কিছু অংশের "সরকার ও দেশ বিরুদ্ধ" এই আচরণকে যদি সমর্থন করা হয়, তাহলে তা হবে শৃঙ্খলাভঙ্গ। এটি ভবিষ্যতে ব্রিটিশ সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে।
সুতরাং ঐ সমস্ত সৈনিকদের সরকার "Black" বা "কালো" তালিকা ভুক্ত করে এবং প্রকাশ্যে তাদের বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে চায়। ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করে "সেনার দেশদ্রোহীতাকে" সহ্য করলে ভারতীয় বাহিনীর আনুগত্যের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থেকে যাবে। পরবর্তীকালে সেনাদের একটা অংশ উপযুক্ত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে।
অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের এই আশঙ্কায় শেষপর্যন্ত সত্যি প্রমানিত হয়েছিলো। সৈনিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে তারা সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটাই বুমেরাং হয়ে ভারতীয় সেনাকে বিশৃঙ্খল করে বিদ্রোহী করে তুলেছিলো। এই বিদ্রোহ'ই শেষপর্যন্ত ১৯৪৬ খ্রিঃ নৌসেনা বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছিলো।
(খ.) বিচারের পরিচয় :-
আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করা হয়েছিলো ব্রিটিশ ভারতের পরাজিত ভারতীয় সৈনিকদের নিয়ে। ব্রিটিশ ভারতের সৈনিকরা সংগঠিত হয়ে ব্রিটিশ ভারতকেই আক্রমণ করেছিলো।ব্রিটিশ সরকার এটিকে "শৃঙ্খলাভঙ্গ ও দেশদ্রোহী" হিসাবে দেখে এবং লালকেল্লায় তার বিচার করে। লালকেল্লা ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রভুত্বের প্রতীক। ১৮৫৮ খ্রিঃ এই লালকেল্লাতেই শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বহাদূর শাহের বিচার হয়েছিলো। ১৯৪৫ খ্রিঃ আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদেরও বিচার এখানে করা হয়।
আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিরুদ্ধে মোট ১০ টি বিচার চলেছিলো। এর মধ্যে প্রথম বিচারটি ছিলো সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই বিচারটি হয়েছিলো দিল্লির লালকেল্লায়। আজাদ হিন্দ ফৌজের ৩ জন প্রধান সেনাপতি বা আধিকারিকের বিচার এখানে হয়েছিলো। এই ৩ জন ছিলেন তিন ভিন্ন ধর্মের মানুষ। একজন ছিলেন হিন্দু, অন্য দুজন ছিলেন শিখ ও মুসলিম ধর্মাবলম্বী। এই তিন আধিকারিক ছিলেন যথাক্রমে - পি কে সায়গল, জি এস ধীলন এবং শাহনওয়াজ খান। ১৯৪৫ খ্রিঃ ৫ ই নভেম্বর দিল্লির লালকেল্লায় এদের প্রকাশ্যে বিচার শুরু হয়।
প্রায় দু মাস ধরে এই বিচারটি চলে। এই বিচারের প্রতিবাদে ভারতে এক বিরাট গন অভ্যুত্থান ঘটে।
৩
(৩.) আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের বিরুদ্ধে গন বিক্ষোভ:-
ব্রিটিশ সরকার প্রকাশ্যে INA এর বিচারের ব্যবস্থা করে আশা করেছিলো INA এর ভারত বিরুদ্ধ কাজকর্ম ও বিদেশী সহযোগিতায় দেশকে আক্রমণ ইত্যাদি বিষয় গুলো জনসমক্ষে প্রকাশ হয়ে গেলে দেশের জনমত INA এর বিপক্ষে চলে যাবে।
কিন্তু যখন বিচার শুরু হলো তখন কার্যক্ষেত্রে ঘটলো এর উল্টোটা। দেশে এক বিরাট গন অভ্যুত্থান ঘটতে আরম্ভ করলো।
(ক.) শক্তিশালী জনমত গঠন :-
আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের খুঁটিনাটি সংবাদ ধীরে ধীরে সংবাদপত্রের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। দেশের সমস্ত সংবাদপত্রই আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতি নরম মনোভাব নেয় এবং লিখে, আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীরা "দেশদ্রোহী" নয়, তারা "দেশপ্রেমিক"। ক্রমে আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার বন্ধ করার জন্য দেশে জনমত শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করলো।
এই সময় "আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীরা দেশদ্রোহী নয়, দেশপ্রেমিক" - এই শিরোনামে সর্বত্র ইস্তেহার বিলি করা হয়। প্রকাশিত হয় আজাদ হিন্দ ফৌজের কীর্তি কাহিনীর অসংখ্য প্রচার পুস্তিকা। এর মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় ছিলো "বিশ্বাসঘাতক নয়, দেশপ্রেমিক" পুস্তিকাটি। দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার লেখা হয় -"জয় হিন্দ", "ভারত ছাড়ো","দিল্লি চলো", "আজাদ হিন্দ সেনানীদের মুক্তি চাই", "লাল কেল্লা ভেঙ্গে ফেলো"।
দিল্লির প্রায় সর্বত্রই হিংসাত্মক পোস্টার পড়ে। এরকম একটি পোস্টারে শ্লোগান দেওয়া হয় -" প্রতিজন শাস্তিপ্রাপ্ত আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিশোধে ২০ জন ইংরেজ কুকুরকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে"। বারানসীতে প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষনা করা হয় যদি আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের মুক্তি না দেওয়া হয় তাহলে ইংরেজ শিশুদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়া হবে।
(খ.) জনসভায় বিক্ষোভ প্রদর্শন :-
আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার বন্ধ করা ও নিঃশর্ত মুক্তির সমর্থনে দেশের সর্বত্র প্রচারাভিযান ও বিক্ষোভ সভার আয়োজন করা হয়। একমাত্র সেন্ট্রাল প্রদেশ ও বেরারেই INA এর মুক্তির দাবিতে ১৬০ টি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেকটি জনসভায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ উপস্থিত থাকে।
ত্রান কমিটির আহ্বানে কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে ৫ - ৭ লক্ষ জনতার এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় বক্তৃতা দেন - জওহরলাল নেহেরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, এবং শরৎ বসু। ক্রমে দিল্লি, কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, আসাম, বালুচিস্তান প্রভৃতি স্থানে আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে। প্রত্যন্ত গ্রাম গুলিতেও আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিচারের বিরুদ্ধে জনসভার ঢেউ আছড়ে পড়েছিলো। আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের মুক্তির দাবিতে প্রবল জনবিক্ষোভে এই সময় সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিলো।
(গ.) আজাদ হিন্দ দিবস পালন ও ধর্মঘট :-
আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের বিরুদ্ধে -
(১.) ৫ থেকে ১১ ই নভেম্বর, সারা দেশে "আজাদ হিন্দ ফৌজ সপ্তাহ" পালিত হয়।
(২.) ১২ ই নভেম্বর, "আজাদ হিন্দ দিবস" পালন করা হয়।
(৩.) গঠন করা হয় "আজাদ হিন্দ প্রতিরক্ষা তহবিল"।
সারা দেশের জনগন আজাদ হিন্দ তহবিলে অর্থ সাহায্য করেন। তারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আন্দোলনে সামিল হয়ে প্রতিবাদ সভায় অংশ নেন। দোকানপাট বন্ধ রাখেন। তাছাড়া আজাদ হিন্দ ফৌজের অনৈতিক বিচারের প্রতিবাদে তারা দেশে দেওয়ালির উৎযাপনও বন্ধ রাখেন।
(ঘ.) দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সমাবেশ :-
ইতিমধ্যে দেশে নির্বাচনী প্রচার শুরু হলে প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলই INA এর বিচারের প্রতিবাদের বিষয়টিকে সমর্থন করেন। INA এর স্বপক্ষে দেশের বিশাল জনসমর্থনকে উপেক্ষা করে কখনই নির্বাচনে জয়লাভ করা সম্ভব ছিলো না। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই কংগ্রেসের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
সুভাষচন্দ্র বসুকে একদা জাতীয় কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হলেও, আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম ও সুভাষ চন্দ্রের মৃত্যু সংবাদকে কংগ্রেস "শহীদ দেশপ্রেমিক" আখ্যা দিয়ে এর স্বপক্ষের প্রবল দেশীয় জনমতকে শক্তিশালী কংগ্রেস সংগঠনের আদর্শ হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে।
১৯৪৫ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসে AICC র সভায় INA এর বিচারে অভিযুক্তদের সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। INA কে বিচারে সহযোগিতা করার জন্য তেজ বাহাদূর সপ্রু, ভুলাভাই দেশাই, জওহরলাল নেহেরু, কৈলাস নাথ কাটুজকে নিয়ে কংগ্রেস একটি কৌঁসুলি বোর্ড গঠন করে।
জওহরলাল নেহেরু জীবনে এই একবারই ব্যারিস্টারের কোর্ট পরে লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর ৩ জন সেনানায়কের পক্ষে সওয়াল করে সমগ্র দেশের জনগনকে দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত করেন।
ভুলাভাই দেশাই সেনানায়কদের সমর্থন করে বলেন, ধৃত আসামীরা মুক্তি যুদ্ধের মহান সৈনিক। তারা সাধারণ অপরাধী নন। তিনি এও বলেন, "আদালতের সামনে আজ বিচারের বিষয় দেশোদ্রোহীরা নয়, বিচারের বিষয় হলো - একটি পরাধীন জাতির মুক্তি অর্জনের জন্য যুদ্ধ করার অধিকার আছে কিনা তা বিচার করা।"
দেশে নির্বাচনী প্রচার শুরু হলে নেহেরু ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতারা একাধিক বিশাল জনসমাবেশে ভাষন দিতে শুরু করেন। ঐ সমাবেশে আলোচনার মুখ্য বিষয় গুলির মধ্যে অন্যতম ছিলো INA এর বিচার বন্ধ করা।
তবে শুধু কংগ্রেস নয়, ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দল যেমন - কংগ্রেস সোশালিস্ট পার্টি, আকালি দল, ইউনিয়নিস্ট পার্টি, জাস্টিস পার্টি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, হিন্দু মহাসভা এমনকি মুসলিম লিগও চেয়েছিলো বিচার বন্ধ হোক। কমিউনিস্ট পার্টির অনেক সদস্য ব্যক্তিগত ভাবে উৎসাহের সঙ্গে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলো। যদিও তাদের দল এ ব্যাপারে সাড়া দিতে দ্বিধা করে।
(ঙ.) হিংসাত্মক আন্দোলনের প্রসার :-
আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের বিরুদ্ধে গন অভ্যুত্থান অতি অল্প সময়ের মধ্যেই হিংসার রূপ ধারন করে। ১৯৪৫ খ্রিঃ ৭ ই নভেম্বর মাদুরায় এক জনবহুল সভায় পুলিশ গুলি চালালে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এই ঘটনা সংঘটিত হবার পরে ২১ - ২৪ নভেম্বরের মধ্যে সুভাষ চন্দ্র বসুর নিজের শহর কলকাতা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অংশে হিংসাশ্রয়ী বিক্ষোভ প্রদর্শন ও আন্দোলন শুরু হয়ে যায়।
(চ.) কলকাতায় বিক্ষোভ ও ছাত্র আন্দোলন :-
আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভের ঢেউ সবচেয়ে বেশি তীব্র আকার ধারন করেছিলো বাংলাতে। এখানকার জন বিক্ষোভকে জঙ্গি আকারে পরিনত করেছিলো ছাত্রসমাজ।
কলকাতায় আন্দোলনের একেবারে প্রথম সারিতে ছিলো ছাত্ররা। ১৯৪৫ সালের ২১ শে নভেম্বর কলকাতায় এক গন অভ্যুত্থান ঘটে। ঐ দিন আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয়। এই ধর্মঘটকে দলমত নির্বিশেষে সমস্ত দলের ছাত্র সংগঠন ও ছাত্ররা সমর্থন করে।
কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, ফরওয়ার্ড ব্লক, ছাত্র ফেডারেশনের প্রভাবিত ছাত্রদের এক বিশাল শোভাযাত্রা ডালহৌসী স্কোয়ারের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ ধর্মতলা স্ট্রিটে মিছিল আটকে দিয়ে তা ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে। অবাধ্য ছাত্ররা ধর্মতলা স্ট্রিটের ওপর বসে পড়ে। পুলিশ জোর করে অবরোধ তোলার চেষ্টা করলে ও লাঠিচার্জ করতে ছাত্ররা পাল্টা ইট পাটকেল ছুঁড়ে তার জবাব দেয়।
ইতিমধ্যে শরৎচন্দ্র বসু ছাত্রদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলে ছাত্ররা সেই নির্দেশ অমান্য করে সন্ধ্যেবেলা পর্যন্ত বসে থাকে। পুলিশ সন্ধ্যাবেলা গুলি চালালে দুজন নিহত হন এবং ৫২ জন আহত হন। পুলিশের গুলি চালনার প্রতিবাদে কলকাতায় ছাত্র আন্দোলন আরোও জঙ্গি হয়ে ওঠে।
২২ শে নভেম্বর কলকাতা সহ বাংলার নানা স্থানে ছাত্ররা দলে দলে অবস্থান বিক্ষোভ ও ধর্মঘট শুরু করে। কমিউনিস্ট পার্টির ডাকে দলে দলে শ্রমিকরা তাতে যোগ দেয়। ধর্মঘটি ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেয় ট্যাক্সি চালকেরা ও ট্রাম শ্রমিকরা। তারা কলকাতায় আমেরিকান ও ব্রিটিশ সৈন্য শিবির গুলি আক্রমণ করে। পুলিশ বাধা দিলে পুলিশ - জনতা খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
এইসময় ধর্মঘটি ছাত্র ও আন্দোলনকারীরা এক নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রদর্শন করে। তারা একসঙ্গে কংগ্রেস, মুসলিম লিগ ও কমিউনিস্ট পার্টির পতাকা উড়িয়ে দেয়। প্রায় ৩ দিন ধরে বিক্ষোভ ও ধর্মঘট চলার পর কলকাতা আপাতত শান্ত হয়। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য পুলিশের দমন নীতিতে ৩৩ জন মানুষ নিহত হয় এবং ২০০ জন আহত হয়। বেসরকারি মতে আহত ও নিহতের পরিসংখ্যান ছিলো কয়েক হাজার।
কলকাতার দেখাদেখি জঙ্গি আন্দোলন ক্রমে বোম্বাই, করাচি, পাটনা, এলাহাবাদ, বারানসী, রাওয়ালপিন্ডি ও অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই প্রবল জন বিক্ষোভে সরকারের দৃঢ়তা একেবারে টলে যায়।
(ছ.) তিন সেনাপ্রধানকে মুক্তি :-
ইতিমধ্যে INA এর বিচারের সময় প্রতিবাদীদের তরফ থেকে যুক্তি দেখানো হয় - দেশবাসী যখন দেশের মুক্তির জন্য লড়াই করে তখন তাদেরকে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে বিচার করা যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অনুযায়ী তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
সবদিক বিবেচনা করে ও দেশের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে প্রধান সেনাপতি অচিনলেক ৩ রা জানুয়ারি, ১৯৪৬ খ্রিঃ INA এর ৩ সেনাপ্রধানের দন্ডাদেশ মুকুব করে দেন।
তিন আধিকারিক লালকেল্লা থেকে বেরিয়ে দিল্লি ও লাহোর জনসভায় বীরের সম্বর্ধনা পান। এটিকে দেশবাসী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নৈতিক জয় হিসাবে পালন করেন।
৪
(৪.) রশিদ আলির বিচার ও গন - প্রতিবাদ আন্দোলন :-
ফেব্রুয়ারি মাসে পুনরায় আজাদ হিন্দ ফৌজের আরেকটি বিচারকে কেন্দ্র করে দেশে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
১৯৪৬ খ্রিঃ ৪ ই ফেব্রুয়ারি অন্য একটি বিচারে আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন আব্দুর রসিদ আলিকে ক্যাঙ্গারু আদালতে ৭ বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। এই ঘটনার সূত্র ধরে কলকাতায় ১১ থেকে ১৩ ই ফেব্রুয়ারি গন বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়।
ক্যাপ্টেন রশিদ আলি বিচারের সময় আত্মপক্ষ সমর্থনে কংগ্রেসের চাইতে মুসলিম লিগের ডিফেন্স কমিটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। রসিদ আলির দন্ডাদেশে তাই মুসলিম লিগ সবচেয়ে বেশি ক্ষিপ্ত ও অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে।
(i.) ছাত্র ধর্মঘটের ডাক :-
রশিদ আলির মুক্তির দাবিতে ১৯৪৬ খ্রিঃ ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয় মুসলিম লিগের ছাত্র সংগঠন "ছাত্র লীগ"। এই ধর্মঘটকে সমর্থন করে "বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেস", ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাত্র সংগঠন "ছাত্র ব্লক", কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন "ছাত্র ফেডারেশন", আর এস পির ছাত্র সংগঠন "বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন", ইসলামিয়া কলেজের ছাত্ররা সহ সবকটি ছাত্র সংগঠন।
(ii.) প্রতিবাদ সভার আহ্বান :-
রশিদ আলির মুক্তির দাবিতে ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতা জেলা মুসলিম লিগের সম্পাদক মোয়াজ্জম হোসেন ও সিটি ছাত্র ফেডারেশনের সম্পাদক গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের আহ্বানে কলকাতায় এক বিশাল জনসভার আহ্বান করা হয়।
কলকাতার বর্তমান সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে এই জনসভায় কলকাতার সমস্ত কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসার ছাত্ররা যোগ দেয়। এই সভায় বক্তব্য রাখেন - গান্ধীবাদী নেতা সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত, মুসলিম লিগ নেতা সুরাবর্দি, কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ লাহিড়ি। এছাড়া ভাষন দেন অন্নদাশংকর ভট্টাচার্য, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখ ছাত্র নেতারা।
(iii.) সমবেত মিছিল ও ছাত্র - পুলিশ সংঘর্ষ :-
সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের সভা শেষ করে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ - মিছিল ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে এগিয়ে গেলে পুলিশ তাতে বাধা দিলে ছাত্র - পুলিশ খন্ডযুদ্ধ বেঁধে যায়। আন্দোলনকারীরা রাগে বাস, লড়ি ও ট্রাম জ্বালিয়ে দেয়। ডেপুটি পুলিশ কমিশনার সামসুদ্দোরের নেতৃত্বে সশস্ত্র গোর্খা সেনাদল এই সময় বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে এবং লাঠি চার্জ করে। এতে প্রায় ৪৮ জন ছাত্র নিহত হয় ও ৩০০ বেশি ছাত্র আহত হয়।
(iv.) রশিদ আলি দিবস পালন :-
ইংরেজ পুলিশের বর্বরোচিত আক্রমণের ঘটনায় বাংলার সর্বত্র তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। প্রায় সর্বস্তরের মানুষ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন। এরই প্রতিবাদ স্বরূপ ১৯৪৬ খ্রিঃ ১২ ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায় "রশিদ আলি দিবস" পালনের ডাক দেওয়া হয়। ১২ ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রশিদ আলি দিবস পালন করা হয়।
(v.) সর্বাত্মক ধর্মঘটের পালন :-
(১.) ১৯৪৬ খ্রিঃ ১২ ই ফেব্রুয়ারি, রশিদ আলি দিবসের দিন কলকাতা সহ হাওড়া, হুগলি, চব্বিশ পরগনার ১০ লক্ষ শ্রমিক জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে ধর্মঘট করে।
(২.) ১২ ই ফেব্রুয়ারি, পুলিশ ও সেনাকে উপেক্ষা করে কলকাতায় লক্ষাধিক মানুষের বিজয় মিছিল বের হয়। এই মিছিলের প্রধান প্রানশক্তি ছিলো ছাত্ররা।
(৩.) ১২,১৩ ও ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, সারা বাংলায় ধর্মঘট পালিত হয়। এই সময় সাধারন মানুষ পুলিশের ব্যারিকেট ভেঙ্গে ফেললে পুলিশ - জনতা খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়।
পরিস্থিতির মোকাবিলায় কলকাতার রাজপথে সেনা নামাতে হয়। আন্দোলনের চাপে কলকাতার অসামরিক প্রশাসন একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। পুলিশ জনতা সংঘর্ষে প্রায় ২০০ জন মানুষ নিহত হয় ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়।
তবে শেষপর্যন্ত আন্দোলনের চাপে সরকার শেষপর্যন্ত নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। সীমান্তের গর্ভনর কানিংহাম প্রধান সেনাপতিকে সমস্ত বিচার বাতিল করার পরামর্শ দেন। প্রধান সেনাপতি অকিনলেক ভারতীয় বাহিনীর আনুগত্যের ওপর বিরুপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় ভীত ছিলেন। তাই তিনি নীতি পরিবর্তনের জন্য ইংল্যান্ডের সরকারের অনুমতি চেয়ে পাঠান। শেষপর্যন্ত স্থির হয় বর্বরোচিত ব্যবহারের অভিযোগ ছাড়া অন্য কোন বিষয়ের বিচার হবে না। অবশেষে সকল বন্দীদেরই মুক্তি দেওয়া হয়।
৫
(৫.) গুরুত্ব :-
(ক.) আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারকে কেন্দ্র করে ভারতে যে বিরাট জনজাগরন ও গন বিক্ষোভের জন্ম হয় তা ব্রিটিশ সরকারের মনে বিরাট ত্রাসের সঞ্চার করে।
(খ.) জন বিক্ষোভের জন্য সরকার বাধ্য হয় আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারাধীন বন্দীদের মুক্তি দিতে।
(গ.) এই বিচারকে কেন্দ্র করে জাতি, ধর্ম, বর্ন ও দল নির্বিশেষে ভারতে যে বিরাট জাতীয়তাবাদী ঐক্য দেখা যায় তা নিঃসন্দেহে ছিলো এক অভূতপূর্ব ঘটনা। বস্তুতপক্ষে লিগ, কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির মতো পরস্পর বিরোধী দল গুলির মধ্যে এই প্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারকে কেন্দ্র করে মিলন দেখা যায়।
(ঘ.) সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও বৈরিতার পরিবেশকে দূরে সরিয়ে এই গন আন্দোলন ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে নজির সৃষ্টি করেছিলো, তা এক কথায় ছিলো অসামান্য।
(ঙ.) সর্বোপরি বলা যায়, আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম ও বিচারকে কেন্দ্র করে ভারতে যে বিরাট জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরন দেখা যায়, তার প্রেরনাতেই ১৯৪৬ খ্রিঃ ভারতে নৌ সেনা বিদ্রোহ ঘটে। এই সেনা অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরেই ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে।