অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে "অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি" নামক প্রতিষ্ঠানটি।


অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি
অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি 

(১.) প্রেক্ষাপট :- 

১৯০৫ খ্রিঃ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে বাংলার ছাত্রসমাজ তাতে দলে দলে অংশগ্রহণ করে। ছাত্ররাই মূলত বাংলাদেশে বয়কট আন্দোলনকে তীব্র করে তোলে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণকে বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের তরফে একাধিক শিক্ষা সার্কুলার জারি করা হয়। যেমন - 

(১.) ১৯০৫ খ্রিঃ ১০ ই অক্টোবর, বাংলা সরকারের শিক্ষা সচিব আর ডাবলিউ কার্লাইল "কার্লাইল সার্কুলার" জারি করেন। এতে বলা হয়, যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র রাজনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকবে তাদের সরকারি অনুমোদন বাতিল করে দেওয়া হবে। আন্দোলনরত ছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কারও করা হবে। এছাড়া, তাদের বৃত্তি এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুদানও বাতিল করে দেওয়া হবে। 

(২.) কার্লাইল সার্কুলারের সূত্র ধরে ছাত্র আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য শিক্ষা অধিকর্তা পেডলার ১৯০৫ খ্রিঃ ২১ শে অক্টোবর এক সার্কুলার জারি করে কলকাতার কলেজ গুলির অধ্যক্ষদের পিকেটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রদের বহিষ্কারের অর্ডার দেন। এটি "পেডলার সার্কুলার" নামে পরিচিত ছিলো। 

(৩.) ঐ একই বছর অর্থাৎ ১৬ ই অক্টোবর ১৯০৫ খ্রিঃ আরেকটি অর্ডার জরি করা হয়। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গে স্বদেশী আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করলে সেখানে ছাত্র ও শিক্ষকদের দমন করার জন্য পি সি লায়ন ছাত্র ও শিক্ষকদের আচরন বিধি সংক্রান্ত এক নির্দেশিকা জারি করেন। এটি "লায়ন সার্কুলার" নামে পরিচিত ছিলো।

এই নির্দেশিকাকে ব্যবহার করে রংপুর, মাদারিপুর ও বরিশালে ছাত্রদের বিরুদ্ধে কঠোর দমনমূলক নীতি নেওয়া হয়। 

 বলা বাহুল্য, কার্লাইল সার্কুলার ও তার আনুষঙ্গিক দমনমূলক সার্কুলার গুলিতে বাংলার এক বিরাট সংখ্যক ছাত্রকে সরকারি স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই সব বিতাড়িত ও ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্রদের শিক্ষার ব্যবস্থা করবার জন্য এইসময় প্রতিষ্ঠিত হয় "অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি"।


(২.) প্রতিষ্ঠা :- 

বাংলা সরকারের কুখ্যাত কার্লাইল সার্কুলার বা ফতোয়া রাজের বিরুদ্ধে কলকাতার ছাত্র সমাজ গর্জে ওঠে। এইসময় সিটি কলেজের বি এ ক্লাসের ছাত্রনেতা শচীন্দ্রনাথ প্রসাদ বসুর নেতৃত্বে কার্লাইল সার্কুলারের বিপক্ষে গঠিত হয় "অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি"

১৯০৫ খ্রিঃ ৪ নভেম্বর কলকাতা কলেজ স্কোয়ারে প্রায় ৩ হাজারের বেশি ছাত্রের সমাবেশে "অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি" গঠিত হয়। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, "অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি" ছিলো এদেশের প্রথম প্রকৃত "গন - ছাত্র সংগঠন"। 

(৩.) সভাপতি, সম্পাদক ও কার্যালয় :- 

অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটির সভাপতি হন কৃষ্ণকুমার মিত্র। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট ব্রাহ্ম নেতা ও কলকাতা সিটি কলেজের অধ্যাপক। শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু এই প্রতিষ্ঠানটির সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। কৃষ্ণকুমার মিত্রের বাড়িতেই  অ্যান্টি সার্কুলার সমিতির প্রধান কার্যালয় ছিলো। 

(৪.) উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি :- 

"অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটির" প্রধান উদ্দেশ্য গুলি ছিলো - 
(১.) কার্লাইল সার্কুলারে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত ছাত্রদের বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা করা। 
(২.) বক্তৃতা, সঙ্গীত ও শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করা। 
(৩.) বিদেশী পন্যাগারের (দোকান) সামনে পিকেটিং করা। 
(৪.) শহরে ও গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বদেশী বস্ত্র ও পন্য বিক্রি করা। 

এই সমিতির একটি বিভাগ গোপনে শরীরচর্চা ও লাঠিখেলার অনুশীলন চালাতো। এটি "ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন" নামে পরিচিত ছিলো। এই সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে অরবিন্দ ঘোষ ও সুকুমার মিত্র। 

(৫.) স্বদেশী আন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলনে ভূমিকা :- 

অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি সারা বাংলার জন্যই কাজ করে। অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি স্বদেশী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণকে আরোও ব্যাপক ভাবে সূচিত ও সংগঠিত করে। এই সমিতির অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের জন্য তা ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। 

এই সময় উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে রংপুরে স্বদেশী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। সেখানে আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক বিরাট পরিমান ছাত্রকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। অ্যান্টি সার্কুলার নেতৃবৃন্দ রংপুরে যান এবং সেখানে বহিষ্কৃত ছাত্রদের বিকল্প শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করার জন্য রংপুরে প্রথম "জাতীয় বিদ্যালয়" গড়ে তোলেন

 এই সময় নোয়াখালির স্কুল কলেজ থেকে বহিষ্কৃত ছাত্ররা কলকাতায় সমবেত হলে সেখানেও আরেকটি জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে পূর্ববঙ্গের মধ্যে স্বদেশী আন্দোলন সবথেকে বেশি ব্যপকতা লাভ করেছিলো বরিশালে। সেখানে অশ্বিনী কুমার দত্ত ছাত্রদের সংগঠিত করে "স্বদেশ বান্ধব সমিতি" প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে তিনি ছাত্রদের নিয়ে গঠনমূলক স্বদেশীর প্রচার করেন।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post